মনোনীতা চক্রবর্তী | মেসম্যারিক-ব্ল্যাক



তখন অমনোযোগী স্পর্ধা। তখন দুর্মর স্পর্শ। অনুবাদের গুলদস্তা। একটা জবরদস্ত ফিটনেস ক্যাম্প; সাবস্ক্রাইব এবং বেল-আইকনের হুড়োহুড়ি। সবটাই আনিমেটেড গ্লেসিয়ার। আনকাউন্টেবল ব্যালান্স-শিট। উন্মুক্ত এক-একটা লভ-বার্ড। ডিপ্রেসড। ওভারথিঙ্কড। এক্সট্রাভার্ট। উল্টো করে ধরে রাখা রাত্রি এবং চাঁদ। মাইন্ডগেম এক সুরম্য রাপিড-ফায়ার রাউন্ড। মাইন্ডগেম একটা হতাশ বিছানার নিঃসঙ্গ চাদর। মাইন্ডগেম একটা

"এসো প্রিয় আরও কাছে.."-র মতো আনারকলি-কাট বাসনা। স্টিয়ারিং এবং হাতের মায়া- এ-কথা নিয়ে এখানে কোনো গল্প নেই। কোনো করিডোর নেই; গোপন তিল ও শাসন নেই। প্রিয় কী করে কাছে আসবে, কত ডিগ্রি কোণে গ্রহের দশা বা অন্তর্দশা থাকলে সে আসতে মানে প্রিয় আসতে বাধ্য, এ- সব বলা আছে। এক পঞ্চাশোর্ধ পরিচিত ভদ্রলোক হঠাৎ-ই একদিন দেখলাম কী অদ্ভুতভাবে চিরঅপরিচিত হয়ে উঠলেন! দু-চোখ তখন কাজল খুলে 'আশ্চর্য'-এর আইরিং পরেছিল। বলবো, নিশ্চয়ই বলতেই হবে ওই ভদ্রলোকের এমন আচরণ বদলের আসল রহস্য ঠিক কোথায়। দিব্যি অত্যন্ত আন্তরিক মানুষটি এমন বদলে গেল কেন, সেটাই মস্ত 'কেন'। ফিরবো খুব শিগগিরই এ-বিষয়ে। তার আগে বলি, মনের মানুষকে কাছে ফিরে পেতে এবং আবশ্যিক সুফল পেতে ঠিক কী-কি তুমি করবে। মার্জনা আগেই চেয়ে নিচ্ছি যে কাউকে আঘাত বা অসম্মান করা আমার কোনোভাবেই উদ্দেশ্য নয়। তবে কেনই-বা এসব বিচ্যুত পথরেখার মতো এমন লিখছি;আসলে, আরও একটু ভ্রমরের কাছে শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে পোড়ার সজল-কাহিনি এবং সম্পূর্ণ সমাধান যদি পেতে কিংবা কী-করে ব্যক্তিত্ব বাড়াবেন-যেমন কীভাবে হাঁটবেন, কথা বলবেন, কতটা বলবেন অথবা যখন কোনো স্পিচ আপনি দেবেন, তখন শুরুর সময়ে আপনার আই-কন্টাক্ট কতটা ডায়ে-বাঁয়ে থেকে ধীরে-ধীরে অডিয়েন্স-এর দিকে যাবে এবং সম্পূর্ণ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু আপনি হবেন-ই হবেন; পেয়ে যাবেন তার আস্ত ফ্রি অনলাইন-ক্লাস। 

গুপ্তশত্রু? গুপ্তরোগ? লাভলি দিদির সমাজসেবা? পানু'দির অভাব ও কিঞ্চিৎ ভারসাম্যহীন জীবন নিয়ে 'পাওভাজি' খেতে চান? তবে, আর দেরি কেন? একটা স্মার্টফোন, হ্যাঁ, একটা স্মার্টফোনই সব পারে; অনেকটা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির মতো যেন; সব রোগ এখানে নিরাময় হয়-কারসিনোমা থেকে আর্নিকা বা কষ্টিকাম থার্টি; সে-যাইহোক, একটাই জিনিস চাই আপনাদের কাছ থেকে, তা হল 'ধৈর্য্য'।

 বাড়ির চারপাশে আঁশটে গন্ধ? রান্নাঘরে ভাঙা বাসন? ছাদের ওপর ভারী লোহার স্তূপ? পুজোঘর থেকে ব্রহ্মবিন্দু; এবং সহবাস ও সন্তান আনার আয়োজন সব প্ল্যান মুতাবিক হচ্ছে তো? গ্রহণের দিন কিন্তু নৈব নৈব চ... সূর্যমাস, চান্দ্রমাস এসব তো বটেই আরও ব্যাটেবলের একচুল ছন্দভুল কিন্তু আপনাকে নিয়েই যাবে ভুলের অতলে। ভরিয়ে দেবে নেগেটিভ এনার্জিতে আপনার জীবন ও চারপাশ; যদি এর একটিও আপনার সঙ্গে হয়ে থাকে, তবে বন্ধুরা জাস্ট স্ক্রল, বেল-আইকন এবং সাবস্ক্রাইব... ত্রিবেণী তীর্থপথ-সবকিছুর আপডেট সঙ্গে-সঙ্গে পেতে তোমাদের একটা আঙুলই সব কামাল করে দিতে পারে!

"আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে.." পরকীয়া থেকে প্রমোশন; সারেগা-রেগামা-চিকেন রেজালা সব অন্তর্বাসের ভিতর। বিন্দুবাসিনী আগে জানতেই পারিনি এই পৃথিবী এত সুন্দর! সব তো মুঠোয়! মোটিভেশণাল স্পিকারদের রমরমা হাট! সস্ত্রীক প্রেম নিবেদন করো; স্ত্রী স্বামীর প্রেমিকার জন্য জিভ জুড়িয়ে যাওয়া রসনা বাসনার বোন-চায়নার ডিশে সার্ভ করুক; স্ত্রীর প্রেমিকের জন্য স্বামীর প্রিয় মাছ বা মাংসের পূর্ণাঙ্গ বাজার; কেউ প্রেম করতে আসছে সস্ত্রীক এবং স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে; কেউ বিয়ে করতে গিয়ে চলমান-প্রাক্তন প্রেমিকার অনুমতি নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন...আবার, সময়মতো লাটাই গোটানোর মস্ত-মস্ত ধামাকাও! চতুর্পাশে সুসজ্জিত চতুরদোলা। হে প্রিয় সুধীজন, "এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায়..." অথবা অদল-বদল বা পাল্টিঘরের এই মায়াময় জীবনের জন্যই তো কত 'অবিনাশ' স্বেচ্ছাপতঙ্গ হতে বাজী রাখে মহার্ঘ জীবনের। এবারে ফিরে যেতেই হবে ওই সেই শুরুর ভদ্রলোকের কাছে। আসলে, উনি ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন করতে সুসজ্জিত ইউটিউবারের পরামর্শ মতো। ঘরে 'ইওগা'-প্রশিক্ষক, যিনি ডাক্তাদের ছাপিয়ে অসামান্য সব টার্মিনোলজি ব্যবহারে অভ্যস্ত; যেমন ধরা যাক- 'ইনরেগুলারিটি"; এমন সব কত-কী!তাঁর তত্বাবধানে ঘরে চলছে (ফিটনেস থেরাপি) এই আর মনোবিদ বা মনোসমীক্ষককে তুড়ি মেরে হাতুড়ে চলছে ইউটিউবারের পরামর্শ মতো পঞ্চাশ পেরিয়ে 'ব্যক্তিত্ব গঠন'-এর প্র্যাকটিস। এছাড়াও বশীকরণ থেকে বেহেস্ত কী নেই এখানে!

আসলে, খুব ভয়ঙ্কর একটা সময়কে সময় পেলেই আপন করে নিচ্ছি স্বেচ্ছায়, অজান্তেই। টিআরপি বাড়াতে জীবনের স্পর্শকাতর অধ্যায় সমূহ প্যাথস-টোনে কী তীব্র বুক ঝাঁকিয়ে-ঝাঁঝিয়ে বেজে উঠছে; সঙ্গে সঞ্চালকের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন! আসলে, সময়কে সময় দিতে আমরা ভুলে গিয়েছি। বরং এতে কত-কী! কারণ, এতে চমক আছে। স্বপ্ন আছে। ঠিক তিনমাসের মধ্যে "আপনার প্রিয়জন আপনার কাছে ফিরে আসবেই.." এতেও গ্যারান্টি! এমন সব 'বিশ্বস্ত-মিথ্যা' আছে...হ্যাঁ, আজ একটি ছোট্ট শিশুও লাফাতে-লাফাতে খুব সিরিয়াসলি সেলফি-ক্যাম অন করে ভিডিও করে একজন জননেত্রী হয়ে...

কিছু না-বলেও সে বা তার মতো অনেক শিশুই এখন হতে চায় ইউটিউবার...আসলে, ওরা 'মানুষ' এর সংজ্ঞাটাই জানে না;শব্দটি ধীরে-ধীরে টক্সিসিটিতে ভরে উঠছে; ওই শিশুরা কেন জানবে সে-কথা? আমরাই কি জানি?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন