সুশান্ত কুমার রায়

 ছোটগল্প আক্কেল আলীর আড়াই প্যাঁচ
আক্কেল আলী যে তাঁর কথায় আড়াই প্যাঁচ দিয়ে রেখেছেন এটা কাল্টু কামার বুঝতে পারেনি কোনদিন। বুঝবেনই বা কেমন করে ? মোটর সাইকেল মেকারেরা নাট বল্টুতে রেঞ্জ দিয়ে শরীরে ঘাম ঝরিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জোরে প্যাঁচ দিয়ে টাইট দেয়। কিন্তু কেউ যদি কারো অজান্তে কথায় নাট বল্টুর মতো প্যাঁচ দেয় তাহলে সেই প্যাঁচ খোলা অনেক সময় মুশকিল হয়ে দাড়ায়। কাজেই নাট-বল্টুতে প্যাঁচ এক কথা আর কথাতে প্যাঁচ আর এক কথা। আদালতে যথাযথ প্রমাণ ও কথার মার-প্যাঁচের কারণে অনেক সময় অপরাধী অপরাধ করেও পার পেয়ে যায় আবার কখনো নিরপরাধী এই কথার মার প্যাঁচের কারণে বিচার থেকে জামিন বা খালাস পান না। আক্কেল আলী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় শুধু কথার প্যাঁচের কারণে ধরা খেয়েছেন বার বার। জীবনে তাঁকে যে কতবার খেসারত দিতে হয়েছে। নিরুপায় হয়ে তাঁকে ষোলো আনাই গুনতে হয়েছে শুধু কথার প্যাঁচের কারণে। তখন থেকে তাঁর চৈতন্য বোধদয় হয়েছে কথার মার প্যাঁচ খুব খারাপ জিনিস। টাকা পয়সা তো গুনতে হয় তার উপর কোনো মান সম্মান থাকে না। কাল্টু কামার তাঁর জল-জ্যান্ত প্রমাণ। আক্কেল আলী একবার হাতিয়ার বানাতে গিয়ে আগাম টাকা দিয়ে ধরা খেয়েছে কাল্টু কামারের কাছে। এরকম বিভিন্ন কাজে কেউ বার ধরা খেলে মাথা কি ঠিক থাকে ? তবে কাল্টু কামার খুব চালাক চতুর- ধূর্ত লোক হওয়ায় ধরাটা খেয়েছে আক্কেল আলী। কাল্টু কামার বাপ-দাদার আমলের অনেক পুরোনো ভাতী টেনে কামারীগিরি করে আসছেন প্রায় বিশ বছর ধরে। ভাতি টানা, হাতুর পেটানো তাঁর নিত্যদিনের কাজ। নিজে ছাই-কালিতে থেকে লোহাকে আগুনে পুড়িয়ে, সেই লোহাকে পিটিয়ে লম্বা করেন। তারপর বিভিন্ন রকম শেপ দিয়ে দা, কুড়াল, বটি, কাটার, খুন্নি, কাছি প্রভৃতি বানিয়ে সেগুলো হাটে বিক্রি করে টানাপোড়েনের সংসার চালান। তাঁর বাবাও এই একই পেশা করে সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন। কাল্টু কামার কারো কাছ থেকে কোনো রকম কূটকৌশলে কাজের অর্ডার নিয়ে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়াটাই তাঁর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। অর্ডার নেয়ার পর শুরু হয় তাঁর নানা টালবাহানা। প্রথম অর্ডার নেয়ার সময় মিষ্টি কথা ও পাকা লোহার জিনিস দেয়ার কথা বলে কিছু অগ্রিম টাকা নিয়ে নেন। তারপর শুরু হয় হয়রানি। হয়রানি করে নাজেহাল করে ফেলেন মানুষকে । আজ দেবো, কাল দেবো, পরশু দেবো, পাকা লোহা পায়নি এখোনো, এরকম নানা টাল-বাহানা। তবে যে একবার কাল্টু কামারের খপ্পরে পড়েছে, দ্বিতীয়বার আর কোনো দিন কাল্টু কামারের কথা মুখে তোলেন না। অনেক সময় হয়রানি হয়ে জিনিস না পেয়ে অর্ডারের টাকাও আর চাইতে আসেন না অনেকে। তবে জিনিস তৈরি করে দেবেন না, একথা বলেন না কখনো। কিন্তু অনেক হয়রানি করে জিনিস দেন। আক্কেল আলীও নাছোড় বান্দা। বিভিন্ন জায়গায় ঠকতে ঠকতে কথার মার প্যাঁচ শিখে ফেলেছেন। এখন যে কোন কাজে কথার মার প্যাঁচকে খুবই প্রাধান্য দেন। কে কী বলতে চায় ? কথায় কোনো ফাঁক রাখলো কি না ? এসব সাত পাঁচ ভেবেই তবেই কাজ করেন। আক্কেল আলী যখনই কাল্টু কামারের দোকানের পাশ দিয়ে বাজারে ঢুকেন তখন তাঁর হাতিয়ার বানানোর আগের টাকাটার কথা মনে পড়ে যায়। কতবার টাকার কথা বলেছেন কিন্তু টাকাটা ফিরে দেননি কখনো। তবে অনেক দিন পর একদিন নতুন জিনিস বানিয়ে দেয়ার কথা বলেছেন কাল্টু কামার আক্কেল আলীকে। নতুন কোন জিনিস বানানোর থাকলে তিনি তা বানিয়ে দেবেন। আক্কেল আলী মনে মনে ফন্দি আটলেন, এবার ষোল আনাই বুঝিয়ে নেবো, কাল্টু। এবার কথার এমন আড়াই প্যাঁচ দেবো তোর চৌদ্দ গোষ্ঠী ঠিক হয়ে যাবে। আর মনে মনে ভাবলেন কথার এক প্যাঁচ আমি আগে নিজে দেবো।

তারপর মানুষ দিয়ে আর এক প্যাঁচ দেবো। সব শেষে আমি আবার আধা প্যাঁচ দেবো। হাটশেষে দোকানে যখন কেউ নেই তখন একটি খিলি পান কিনে কাল্টু কামারকে দিয়ে বললেন, কাল্টু দা- আগের কথা বাদ দেও। অল্প কয়টা টাকা পাই, না দেন নাই। এই লোহাটা নেও, ইয়্যার থাকি মোক পাতলা করিয়া পাঁচ হাজারটা লোহার পয়সা বানে দ্যাও মোক। প্রত্যেকটা টাকায় একটা করি ছিদ্র করি দ্যাওয়া নাইগবে কিন্তু। আক্কেল আলী টাকা দিয়ে কি কইরবে, এই কথা জিজ্ঞাসা না করতেই আক্কেল আলী একশত টাকার দুইটি নতুন চকচকে নোট বের করে কাল্টু কামারকে দিয়ে বললেন, কাল্টুদা পয়সাগুলো খুব তড়িঘড়ি করে বানানোর দরকার নেই। তোমরা একনা সময় নিয়ে আস্তে আস্তে ভালো করি তৈয়ারি করি দেন। চকচকে নোট পেয়ে, টাকা দিয়ে টাকা দিয়ে কী হবে, এতগুলো টাকা কী করবেন এসব কথার আর কিছুই আক্কেল আলীকে কাল্টু কামার জিজ্ঞাসা করলো না। আর মনে মনে কাল্টু কামার ভাবলেন, এইবারও ধরা খেয়েছিস আক্কেল আলী। পাঁচ হাজার টাকার একটা টাকাও হাতে পাবি না। ন্যাড়া একবারই বেল তলায় যায়। আর তুই আসলি দ্বিতীয়বার বেল কুড়াতে । আর এদিকে আক্কেল আলী কথায় ও কাজে এক প্যাঁচ দিয়ে মনে মনে ভাবলেন, এবার বুজবি কাল্টু, কত ধানে কত চাল। আক্কেল আলীর আড়াই প্যাঁচ তোর সারাজীবন মনে রাখতে হবে।

যমজমাট যাত্রাপুর হাট। সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে। দূর-দূরান্তর থেকে হাটুরে আসে। তারাও অনেকে কাল্টু কামারের কাছে মাঝে সাজে জিনিস বানাতে নিয়ে আসে। তবে স্থানীয় লোকজন কম যায় তাঁর কাছে। একটাই কারণ হয়রানি। জিনিস তৈরি করে দেন, তবে হয়রানি করে। পরবর্তী হাটের দিন যখন তাঁর দোকানে কিছূ খরিদদার জিনিসপত্র বানাতে এসে ভিড় করে, তখন তাঁদের উপস্থিতিতে কাল্টু কামারকে লক্ষ্য করে আক্কেল আলী উচু স্বরে একটু দূর থেকে বললেন, কাল্টুদা, মোর টাকাটার কি খবর ? পাঁচ হাজার কিন্তু ! আইজ দিব্যার পাবার না পাইম। দোকানোত খুব ভিড়। পরে দেইম, আর একদিন। আক্কেল আলী হাটুদেরকে অর্থাৎ তাঁর কাস্টমারকে দিয়ে প্যাঁচ দিয়ে সেদিন হাট করে বাড়ি চলে যায়। পরের হাটে আবার হাট যখন জমজমাট হয়, লোকজন তাঁর দোকানে জিনিস তৈরি করে নেয়ার সময় ভিড় করে, তখন একটু ফাঁকে থেকে আবারো পূর্বের দিনের ন্যায় জিঙ্গেস করেন। কাল্টুদা আমার টাকাটা কি আইজ দিবেন ? কিন্তু আক্কেল আলী কখনো লোহার পয়সা তৈরির কথা বলেন না। আবারও বলেন- টাকাটা আমার খুব দরকার, অর্ধেক দিব্যার পাবার নন। আইজকে মোক আড়াই হাজার দ্যাও। দোকানে উপস্থিত সবাই ধারণা করলো যে, আক্কেল আলীর সাথে কাল্টু কামারের সম্ভবত পাঁচ হাজার টাকা দেনা-পাওনা আছে। যার অর্ধেক আড়াই হাজার আইজ আক্কেল আলী চাইলো। এ অবস্থায় পূর্বের দিনের মতো সবাই হাট থেকে চলে যায়। আক্কেল আলী মনে মনে ভাবলেন, আমার তো দুই প্যাঁচ হয়ে গেছে। আমি নিজে এক প্যাঁচ প্রথমে দিয়েছি। হাটের সবাইকে নিয়ে আর এক প্যাঁচ দিয়েছি। সামনের হাটে অর্ধেক প্যাঁচে ফেলে দেবো কাল্টুদাকে। সামনের শুক্রবার হাটেই সেটা করে ফেলবো। শুক্রবার হাটে অনেকে হাট করতে এসেছে, যাঁর মধ্যে পূর্বে যাঁরা কামার কাল্টু ও আক্কেল আলীর মধ্যে লেন-দেনের কথোপকথন শুনেছে। আক্কেল আলী কাল্টুর দোকানে উপস্থিত তাঁদেরকে দেখে দোকানে সবার সামনে গিয়ে বললেন, কাল্টুদা আইজকে আমি অর্ধেক আড়াই হাজার টাকা নেবো না। আমাকে পুরো পাঁচ হাজার টাকাই দ্যাওয়া নাইগবে। আমাকে অনেক দিন থেকে ঘুরাইতেছেন। আইজকে আমাকে টাকা দেন তো। আর না হলে আমার পাঁচ হাজার টাকার লোহাই আমাকে ফেরৎ দিয়ে দেন। একথা বললে কাল্টু কামার আক্কেল আলীর উদ্দেশ্যে বলেন- কি বলতেছেন আপনি ? আপনি আমার কাছে কিসের টাকা পান। আর একথা বলতেই আক্কেল আলী বললেন, কেনো লোহা বিক্রির পাঁচ হাজার টাকা। তখন উপন্থিত স্বাক্ষী জয়নালকে পেয়ে জোরে গলা ফাটিয়ে বলছেন- ক্যাঁ জয়নাল ভাই, কি নিমকহারাম দ্যাখ।

গত হাটের দিন তুইও তো ছিলু, তোর সাথে অবিনাশদাও তো ছিলো। আমি যে টাকার কথা বলেছিলাম, তখন কাল্টুদা আড়াই হাজার দিতে চেয়েছিলো। আমি পাঁচ হাজার টাকাই বলেছিলাম। কাল্টুদা দিব্যার পারবে না বলে আমাকে আড়াই হাজার টাকা নিজ মুখে স্বীকার করলো। কিন্তু কাল্টুর লোহা দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা তৈরির কথা কেহই আর তখন শুনেেত চায় না। তখন হাটে দুজনের কথা কাটাকাটি ও তর্কাতর্কীর এক পর্যায়ে অনেক হাটুরে লোক সেখানে উপস্থিত হলো। তখন কাল্টু কামার যখন বলছিলো, আক্কেল আলী আমার কাছে কোনো টাকা পায় না। শালা, আমাকে লোহার টাকা বানাতে দিয়ে আমার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা চায়। মনে হয় বাপের টাকা, আমার এখানে এনে জমা করি রাইখছে। তখন উপস্থিত অনেকে কানাকানি ও বলাবলি করতে লাগলো, কেউ কোনো দিন লোহার টাকা কামারোক বানবার দেয়। যারা কাল্টু কামারকে জিনিস বানাতে দিয়ে হয়রানির স্বীকার হয়েছেন, তাঁদের অনেকে বলতে লাগলো, শালা ফালতু কামার-কাল্টু। মানুষ পাগলা তো, লোহা কামারোক দিয়ে টাকা বানবার দ্যায়। তাও আবার এক দুই টাকা নয়, পাঁচ হাজার টাকা। কোন দ্যাশে বাস করি রে বাবা ! আজব দ্যাশে আজব কথা। তখন আক্কেল আলী বলে উঠে- আচ্ছা তোমরা গুল্যায় কন তো, আমি কি লোহার টাকা বানবার দিছি। আর মনে মনে ভাবে, এইবার তোর কামারি শ্যাষ। হাট শেষে হাট প্রাঙ্গণে বিশাল বটগাছের তলায় এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বারের উপস্থিতিতে কাল্টু কামার ও আক্কেল আলীকে নিয়ে মিটিং-শালিস বসে। শালিসে কাল্টু কামারকে টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। কারণ বিষয়টি মেম্বার চেয়ারম্যানের বিচার বিশ্লেষণ ও দোকানে যাঁরা প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ছিলো তাঁদের কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কাল্টু মিথ্যাবাদী। আক্কেল আলীর কথার মার প্যাঁচে কাল্টু কামার কুপোকাত। অকাট্য প্রমাণ দিয়ে কাল্টু বোঝাতে পারছে না চয়্যারম্যানকে কিংবা মেম্বারদরেকে। কথার আড়াই প্যাঁচ বড়ই মারাত্বক জিনিস। প্রত্যক্ষ স্বাক্ষীর বর্ণনাতেও কাল্টু কথার মার প্যাঁচে হেরে গিয়েছে। মিটিং ও শালিসিতে কান্দাকাটি করে মেম্বার-চেয়ারম্যানকে বলে কয়ে বউয়ের গয়নাগাটি বিক্রি করে শেষ পর্যন্ত আক্কেল আলীকে চার হাজার টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করলো উপস্থিত সবার সামনে। কথার আড়াই প্যাঁচে পড়ে কাল্টু কামারের আক্কেল করে ছাড়লো আক্কেল আলী।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* মন্তব্য করতে পেজটি রিফ্রেশ করুন .