✓ তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় | দাদা​ আমি বাঁচতে চাই

মিছিল michil

কিছু কিছু মুহূর্তে এই কথাগুলোই যেন একমাত্র আকুতি হয়ে ওঠে। বেঁচে থাকার আকুতি। আমি কিছুতেই মরবনা, আমি বাঁচবই, যেভাবেই হোক বাঁচতে চাই। বেঁচে থাকার প্রবল আর্তিটাকে এ ছাড়া আর কোন বাক্যবন্ধ দিয়েই বা বোঝানো যায়? তাই এ লেখার শিরোনামে প্রিয় পরিচালক শ্রদ্ধেয় ঋত্বিক ঘটকের অমর সৃষ্টি ‘মেঘে ঢাকা তারা’ চলচ্চিত্রের সেই যে বিখ্যাত সংলাপ – ‘…দাদা আমি বাঁচব’, তাকে একটু অন্যরকম করে ব্যবহার করেছি। তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তাঁর কাছে। তবে এটা তো বলার অপেক্ষা রাখেনা যে এক্ষেত্রে ‘দাদা’ কোনো নিকট বা দূর সম্পর্কের কেউ নয়। কোন বিশেষ ব্যক্তি নয়। শিরোনামের ‘দাদা’ একটা শক্তি। স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী কেউ বা কোনো সত্তা, যার ক্ষমতা আছে যে বাঁচতে চায় তাকে অন্তত এ যাত্রা বাঁচতে দেওয়ার। বাঁচিয়ে রাখার।

এক একটা বিশেষ সময়ে যে বেঁচে থাকতে বড় বাসনা হয়। যখন অবধারিত কোনো যন্ত্রণা অপেক্ষা করে থাকে যা মৃত্যুর মতো কিম্বা তার চেয়েও ভয়ংকর, অথবা মৃত্যু যখন অবধারিত মনে হয়, কিম্বা মৃত্যুর দরজা থেকে ভাগ্যক্রমে কোনোভাবে ফিরে আসতে পারা যায়, সেই সেই সময়গুলোতে জীবন বড় প্রিয় হয়ে ওঠে। তখন মনে হয় যেকোনো মূল্যে বেঁচে থাকি। শুধু বেঁচে থাকতে পারাটাই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে যায়। তার জন্য কোনো ঝুঁকিই আর ঝুঁকি মনে হয়না।

তাই বুঝি এরকম পরিস্থিতিতে মানুষ অকুতোভয় হয়ে ওঠে। প্রাণকে বাজি রেখেও প্রাণ বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা করে। নাহলে সেই দৃশ্যটার জন্ম হবে কেন?
আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দরের সেই স্তম্ভিত করে দেওয়া দৃশ্যটা! সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে সারা দুনিয়া দেখেছে সে ছবি। কে না শিউরে উঠবে সে ছবি দেখে? এমন নিশ্চয় নয় যে যে মানুষগুলি ওভাবে বিমানে ওঠার চেষ্টা করছিল তারা কেউই জানতনা যে বিমান মানে অফিস টাইমে কোনো লোকাল ট্রেন বা বাস নয়। মফস্বলের বাস বা ট্রেকারের মতো বিমানে ওভাবে ছাদে বাম্পারে বসে বা দাঁড়িয়ে বা ঝুলে যাওয়া যায়না। তবু তা দেখে হয়তো মনে মনে অনেকেই ভেবেছেন, এ মা! এরা মিনিমাম নিয়মটুকুও জানেনা? প্লেনে এভাবে ওঠা যায় নাকি?

কিন্তু অস্তিত্বটাই যখন চরম সংকটে, তখন নিয়ম নীতির কথা আর জানলেই বা মানা যায় কি করে? তখন একটাই আকুলতা সর্বশক্তি দিয়ে ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে, ‘দাদা আমি বাঁচব’। আমি বাঁচতে চাই। নাই বা থাকল পাসপোর্ট ভিসা টিকিট। নাই বা পাওয়া গেল সঠিক দরজা দিয়ে বিমানের ভিতরে উঠে বসার সিট। অনেকগুলো চাকা তো আছে। দু দুটো লম্বা ডানা আছে, ছাদ আছে। যেখানটায় পার শক্ত করে আঁকড়ে ধরো। আগে তো এই মুহূর্তটা বেঁচে নিই।

বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা কতটা তীব্র হলে এরকম হয়! ভিতরে কতটা কাঁপুনি থাকলে, কতটা আতংক থাকলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য এই দৌড় দৌড়াতে বাধ্য হয় মানুষ, একটা মৃত্যুর গ্রাস থেকে বাঁচতে আর একটা মৃত্যুর হাতে সঁপে দেয় নিজেকে, তা জানার জন্য মিডিয়াতে দেখা ওই দৃশ্যটাই যথেষ্ট। শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা রক্ষীর গুলিতে কিম্বা উড়ন্ত বিমানের চাকা থেকে পড়ে মরে যাওয়া মানুষও যেন সেই অমোঘ সংলাপটিই বলতে বলতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে – ‘দাদা আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম’। একটা সিনেমার দৃশ্যকে ছাপিয়ে জগতের ওরকম হাজারও দৃশ্যকে বোঝানোর জন্যই যেন তৈরি হয়েছিল এই কালজয়ী সংলাপ!

ঠিকই তো। দৃশ্য তো একটা নয়। শুধু আফগানিস্তানেও নয়। হুবহু এক না হলেও মাঝেমাঝেই এরকম কত দৃশ্যের জন্ম হয়। চরম সংকটের মুহূর্তে যদি কোনোভাবে বেঁচে থাকা যায় তার আপ্রাণ চেষ্টা করে মানুষ। ক’টা আর নজরে আসে? মাত্র ক’বছর আগের সেই ছবিটার কথা কেউ ভুলবে কি করে! একটি ছোট্ট শিশু মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সমুদ্রের তীরে ভিজে বালিতে। জামা প্যান্ট পরা ভেজা শরীর তার। মনে হচ্ছে অভিমানে শুয়ে আছে সে। কিন্তু সে আসলে মৃত। বাঁচার তাগিদে তার বাবা মায়ের সঙ্গে সে আসছিল নিজের বিধ্বস্ত দেশ ছেড়ে অন্য কোনো উন্নত সভ্য দেশে। এরকম অতিরিক্ত মানুষের ভারে তাদের নৌকায় জীবন ছিল আক্ষরিক অর্থেই টলোমলো। তার ফলেই সমুদ্রে নৌকাডুবি এবং মৃত্যু। এমনটা যে হতেই পারে তার বাবা মা জানতনা তা নয়। কিন্তু ঐ যে! সেই অমোঘ আর্তি - আমি বাঁচতে চাই।

চেনা দৃশ্যগুলোর বাইরে আটপৌরে জীবনে এরকম কতই ঘটতে থাকে। সব তো খবরে আসেনা! কিন্তু সবার একই আর্তি। কেউ আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরা অভাব অনটন বা বেকারত্বের জ্বালা থেকে বাঁচতে চায়। কেউ কারও অতর্কিত আক্রমণ বা অত্যাচার থেকে বাঁচতে চায়। কেউ রোগ যন্ত্রণা থেকে, কেউ বা গভীর কোনো মানসিক দুঃখ বা বিষাদ থেকে মুক্তি খোঁজে। আসলে সবাই সেই অসহনীয় অবস্থাটা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। তার জন্য যেকোনো একটা পথ খোঁজে। সব সময় সে পথ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যায়না। কিন্তু সবগুলোই মানুষকে স্থিতাবস্থা থেকে বের করে এনে ফেলে দেয় সময়ের এক অন্য স্রোতে।​

জীবনকে বাজি রেখেই জীবনের জন্য এই পাড়ি দিতে হয় মানুষকে বারবার। কখনও সাগর ডিঙিয়ে। কখনও বিমানের ছাদে বা ডানায় বা চাকার ভিতর লুকিয়ে। কখনও উথাল পাথাল বন্যায় পারলে একটা গাছের ডাল ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করে। কখনও বা আগুনে দাউ দাউ জ্বলতে থাকা বহুতলের জানলা থেকে নিচে লাফ দিয়ে। আবার কখনও বা দৈনন্দিন জীবনের কোনো কঠিন পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে আরও কঠিন কোনো পদক্ষেপ নিয়ে। জীবন সত্যিই বড় ম্যাজিক জানে। মাঝে মাঝে মৃত্যুকে দিয়ে তার দাবি মিটিয়ে নিতে চায়। ভুলে যায় যে বেঁচে থাকার প্রাণপণ আকুতিটার জন্যই তার যত গরিমা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ