✓ শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় | রানী রায়বাঘিনী

Michil  মিছিল

দিল্লী ও আগ্রাকে কেন্দ্র করে তখন ভারতের বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে তখন মুঘল শাসন। প্রবল পরাক্রমী রাজপুতরাও বাদশা আকবরের কূটনীতির জালে প্রতিরোধ ছেড়ে স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তিশালী স্তম্ভে পরিণত। আর এদিকে বাংলার বুকে চলছে মুঘল পাঠান আফগানদের মধ্যে লুঠপাঠ ধর্ষণের প্রতিযোগিতা, আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধর্মান্তকরণ। সেই অগ্নিগর্ভ দুঃসময় ভুরশূট রাজ্যের এক নারী দুঃসাহস দেখালেন মুঘল ও পাঠান উভয়ের আধিপত্য তাচ্ছিল্য করার। ভারতীয় বিশেষত হিন্দুরা ইতিহাস রচনায় পারদর্শী ছিল না বহুদিন পর্যন্ত। তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত চরিত্রেরই সঠিক জন্মকাল নথিকৃত নেই। আর ইনি তো ছিলেন এক নারী – যতই অসামান্যা হন। আকবর বাদশার শাসনকালই ছিল তাঁর শাসনকাল, এটুকুই জানা গেছে। বাঙালীর প্রাচীন ও মধ্যযুগে ছিল ইতিহাস রচনায় অনীহা, আর আধুনিক যুগে দেখা দিয়েছে ইতিহাস বিকৃতির প্রবণতা। তাই এই অবিশ্বাস্য চরিত্রটির ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে স্থান হয়নি।

মধ্যধুগীয় বাংলার​ ভূরিশ্রেষ্ঠ বা​ ভুরশুট রাজ্যে। অধুনা পশ্চিমবঙ্গ​ রাজ্যের​ হাওড়া​ ও​ হুগলি জেলা নিয়ে গড়ে ওঠা ছোট রাজ্য। অবিশ্বাস্য বীরাঙ্গনা এই নারী বীরত্বে ও শারীরিক কুশলতায় পুরুষদের সমকক্ষ ছিলেন বললে ভুল হয়, তাঁর সমকক্ষ পুরুষ সে যুগেও ছিল কিনা ভার। রাজা রুদ্রনারাণের অধীনে এক গ্রাম্য জমিদারের এই কন্যা বাবার প্রশ্রয়ে ছোটবেলা থেকেই অসিখেলা,​ ঘোড়ায় চড়া,​ তীরন্দাজিতে পারদর্শিনী হয়ে ওঠেন।​ সঙ্গে লাভ করেছিলেন​ সমাজশাস্ত্র,​ রাজনীতি,​ দর্শন,​ ধৰ্মশাস্ত্র,​ কূটনীতিতে শিক্ষা। অর্থাৎ সুযোগ্য প্রশাসক হওয়ার জন্য যা যা গুণ আবশ্যক, তার সবকটাই যথেষ্ট মাত্রায় ছিল রমনীর। পিতা দীননাথ চৌধুরী ব্রাহ্মণ হলেও অস্ত্রচালনায় দক্ষ ছিলেন বলে দুর্গরক্ষকের কাজও করতেন।

ভুরশুটের রাজা রুদ্র নারায়ণে একঝাঁক বন্য মহিষকে একা ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে রাজা রুদ্রনারায়ণ ভবশঙ্করীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন পিতা দীননাথ চৌধুরীর কাছে। কিন্তু ভবশঙ্করী​ নিজের​ বিয়ের জন্য পানিপ্রার্থীর কাছে তাঁকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে হারানোর শর্ত রাখেন তিনি। বিকল্পে তিনটি পশুকে এক কোপে বলি দান করতে পারার ক্ষমতা। তবে এই শর্ত পালনের প্রয়োজন হয় কিনা স্পষ্ট নয়। রুদ্রনারায়ণের সঙ্গে বিবাহসূত্রে ভবশঙ্করী রাজরানী হন।


বিয়ের পর রুদ্রনারায়ণ স্ত্রীকে দমিয়ে অন্তপুরিকা করে রাখেননি। বরং দুজনে মিলেই রাজ্য শাসন ও শত্রু দমন করতেন।​ ভূরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সুরক্ষা ব্যাবস্থাকে মজবুত করতে তমলুক,​ আমতা,​ উলুবেড়িয়া ইত্যাদি নানা জায়গায় গড়ে তোলা হয় দুর্গ।​ সেই সঙ্গে রাজ্যের সামরিক প্রশিক্ষণের বিষয়টিও দেখভাল করতেন। তাঁর নজরদারির মধ্যেই অনেকগুলি সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালিত হতো।​ রানী ভবশঙ্করীই প্রথম ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীতে মহিলাদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন।​ সেই সঙ্গে তিনি নিয়ম করেন যে ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের প্রতিটি পরিবারের একজনকে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নিতে হবে,​ যাতে আপদকালীন পরিস্থিতিতে সেনার দরকার পড়লে যুদ্ধ যোগ দিতে পারে। রানী ভবশঙ্করীর প্রশাসনিক দক্ষতায় ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য​ হাওড়া ও হুগলী ছাড়িয়ে পূর্ব বর্ধমান,​ পূর্ব মেদিনীপুর এবং পশ্চিন মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অংশে বিস্তার লাভ করে।​ সেই সঙ্গে তিনি নৌবাহিনীর দিকেও নজর দেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের নিজস্ব নৌবাহিনী গঠন করেন,​ যা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল।​ বাংলার ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের খ্যাতি ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।​ পাণ্ডুয়ার কাছে গড় ভবানীপুর ছিল তার রাজধানী রাজধানী।

সেইসময় গৌড়ের শাসক ছিলেন পাঠান বংশীয় সুলেমান কারী।​ সুলতানের বাহিনী ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অতর্কিত হামলা করার লুঠ-পাট চালাত। তাই এদের শায়েস্তা করতে রানী ভবশঙ্করীর পরামর্শে উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেবের​ সঙ্গে জোট করেন রাজা রুদ্রনারায়ন।​ ​ ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবেণীর যুদ্ধে ভুরিশ্রেষ্ঠ ও মুকুন্দদেবের মিলিত সেনাবাহিনী গৌড়ের সুলতান সুলেমান কারীকে পরাজিত করে।​ এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুকুন্দদেবের সেনাপতি​ রাজীবলোচন রায়,​ যিনি কালাপাহাড়​ নামে বিখ্যাত।

সুলেমানের মৃত্যুর পরে গৌড়ের শাসক হন তাঁর পুত্র​ দাউদ খান। তখন চলছে মুঘল পাঠান দ্বৈরথ। দাউদ খান মুঘলদের পরাজিত করার জন্যে রাজা রুদ্রনারায়নের সাহায্য চান। রুদ্রনারায়ন রাজি না হওয়ায় দাউদ খান তাঁর​ সেনাপতি কলটু খানকে​ ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য আক্রমণের নির্দেশ দেন। বীরাঙ্গনা স্ত্রীকে পাশে নিয়ে রুদ্রনারায়নের সেনাবাহিনী কলটু খানের সেনাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে এবং হত্যা করেন। এইযুদ্ধে বিশাল সংখ্যক পাঠান সেনার মৃত্যু হয়। এরফলে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুসলিম শাসনভুক্ত হওয়া থেকে তখনকার মতো বেঁচে যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী নন্দিনীর চরিত্র পাঠান সেনাপতি কতলু খাঁই সম্ভবত সূত্রান্তরে কলটু খান হিসাবে বর্ণিত।​

এর পরেই রানী ভবশঙ্করী এক পুত্র সন্তান​ প্রতাপনারায়নের​ জন্ম হয়।​ পুত্র প্রতাপনারায়নের বয়স যখন ৫ বছর, রাজা রুদ্রনারাণায়ণের অকাল মৃত্যুর হয়। সুযোগ্য জীবনসঙ্গীর প্রতি প্রেম তো ছিলই। তার সঙ্গে মাথায় প্রোথিত সংস্কার বা লোকাচার তাড়িত হয়ে রানীও সহমৃতা হতে চেয়েছিলেন। রাজ পুরোহিত তাঁকে নিবৃত্ত করে নিজের শিশু সন্তান ও রাজ্যের দায়িত্ব নিতে অনুপ্রাণিত করেন। ঠিক হয়​ ছাউনাপুরের অন্তর্গত বাঁশুরি গ্রামের ভবানী মন্দিরে রানী ভবশঙ্করীর রাজ্যাভিষেক হবে। কিন্তু সেখানেও দানা বাঁধে কিছু রাককর্মচারীর বিশ্বাসঘাতকতায় ভবশঙ্করীর জীবনহানির ষড়যন্ত্র। রানী নিজেই অস্ত্র হাতে পাঠান সেনাদের পরাজিত করে সেই অপচেষ্টা বানচাল করে দেন। তারপর থেকে মুঘল ও পাঠান দুই পক্ষই বিশেষত পাঠানরা পড়ল আরও কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বীর পাল্লায়। ভুরশুটের অধিবাসী পাঠান সর্দার ওসমান খাঁ মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং যুদ্ধে সাহায্যের জন্য মহারাণীর সাহায্য দাবি করে। ভবশঙ্করী রাজী না হওয়ায় সেও ভুরশুট রাজ্য আক্রমণের করার পরিকল্পনা করে।​ আসলে সেটা যত না রাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনা, তার চেয়ে বেশি রানীকে হত্যার ষড়যন্ত্র।

পাণ্ডুয়ার কাছে রাজধানী গড় ভবানীপুর থেকে ১৪ মাইল দূরে বাসডিঙা গড়ের কালীমন্দিরে যখন মা চণ্ডীর ভক্ত রানী ভবশঙ্করী পুজো দিতে যান, তখন নিজে ছিলেন প্রায় নিরস্ত্র পূজারিণীর বেশে, আর সঙ্গে মাত্র গুটি কয়েক ব্যক্তিগত দেহরক্ষী, যারা অধিকাংশই নারী। ওসমান নিজের দলবল নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায় রানীর ওপর। সামান্য যে ক’জন দেহরক্ষী ছিল,​ তাদেরকে নিয়েই পাঠানদের সঙ্গে প্রবল​ যুদ্ধ শুরু করেন তিনি। তাঁর অসম সাহস, তাৎক্ষণিক বুদ্ধি, রণকুশলতা ও অবশ্যই অসামান্য বীরত্বের কাছে​ পাঠান পুরুষ ওসমান খাঁ পরাজিত এবং নিহত হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে ওসমান চরিত্রটিকে অনেকটা হিন্দু বীরদের আদলে এঁকে গৌরবান্বিত করা হয়েছে, হয়তো মুসলিমদের মধ্যেও মানবতা থাকতে পারে সেই বার্তা দিতে। কিন্তু এই বীরপুরুষ অপ্রস্তুত প্রায় সৈন্যহীন রমণীকে নিজের ইসলামী ঐতিহ্য মেনেই হামলা করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।

তবে এই নিয়ে ঐতিহাসিত সূত্রান্তরে মতভেদ আছে। কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে ওসমান পরাজিত হয়ে বাংলাদেশের বুখাই নগর, ময়মসিংহ গড়ে। মোগলরা ঢাকা দখল করলে সে শ্রীহট্ট আসে এবং সুবিদনারায়ণ নামে ছোট হিন্দু​ সামন্তরাজাকে হত্যা করে ১৬ বছর রাজত্ব করেন। পরে মোগলদের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হয়। সবচেয়ে কার্যকরী বই মির্যা নাথানের ‘বাহারি স্থান-ই-গায়েবি’ অনুযায়ী ওসমান সেই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। সিলেটে কিছু কাজ হয়েছে। “বাংলার বারো ভূইয়ার ইতিহাস”, হাবিবুর রহমান খান লোহানির লেখা “বাংলার শেষ পাঠান সুলতান ওসমান খান”, কিছু ফারসি বই আছে (যা নাগালের বাইরে), স্যার যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখেরও গবেষণা ভিন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে। ইতিহাসে দুইজন ওসমান পাঠান​ তৈরি করা যেমন মুশকিল, ​ আবার তারে মেরে ফেলাও বিপজ্জনক। তবে ‘রায়বাঘিনী’ উপাধী যে সামান্য কাজ করে পাননি, সে ব্যাপারে অতিরঞ্জন ছাড়াই নিশ্চিত হওয়া যায়।

যাইহোক, সেই সময় ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারে মুঘলদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল পাঠান শক্তি বিশেষত পূর্ব ভারতে। এই সংবাদ মুঘল সম্রাট আকবররের কানে পৌঁছোতে তিনি যারপরনাই হৃষ্ট হন। তাছাড়া অস্বীকার করার উপায় নেই, তিনি কিছুটা হলেও গুণের কদর করতেও জানতেন। সঙ্গে ছিল রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, যা দিয়ে শত্রুকে সহজে বশ করা যায়। বাদশা আকবর রানী ভবশঙ্করীকে “রায়বাঘিনী” উপাধিতে ভূষিত করেন।​ তবে এসব দিয়েও রানী ভবশঙ্করীকে ভোলানো যায়নি। মুঘল সাম্রাজ্যের বশ্যতাও তিনি স্বীকার করেননি। ঐ বিপুল আয়তন, সৈন্যবল ও কূটনৈতিক বলে বলীয়ান আকবরও ভুরশুটের দিকে না তাকিয়ে তাকে “স্বাধীন” রাজ্য হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ প্রজাদের বহিঃশত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা থেকে ঐটুকু রাজ্যে (যদিও বলা হত ভূরিশ্রুত সাম্রাজ্য) অত দক্ষ স্থল ও নৌসেনা গড়ে তুলে পাঠান দস্যুতা ও আগ্রাসন থেকে রক্ষা আবার “রায়বাঘিনী” উপাধি আদায় করে মুঘল শক্তির কাছেও স্বাধীন শাসক হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়া ছিল রানী ভবশঙ্করীর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। দেবী চণ্ডীর ভক্ত হিসাবে একাধিক চণ্ডী মন্দীর নির্মাণ করান। তবে এমন সাক্ষাৎ অবিশ্বাস্য অসুরদলনী রূপের পরিচয় পেয়েও কিংবদন্তী প্রিয় বাঙালী কিন্তু তাঁকে দেচী চণ্ডী বা দুর্গার অবতার হিসাবে গড়ে তোলেনি। আর ইতিহাস তো মানুষই রচনা করে – কেউ হয় অতি গৌরবান্বিত, কেউ রয়ে যায় উপেক্ষিত।

​ ​ ​  আমাদের দুর্ভাগ্য সাল সন স্পষ্ট করে না জানায় তাঁকে কোনও নির্দিষ্ট ভাবে স্মরণ করার কোনও দিন নির্দিষ্ট হয়নি।


তথ্যসূত্র:

​ Ghosh,​ Paschimbanger Sanskriti, Volume II, pp. 224

​ Ghosh, Anil Chandra.​ বীরত্বে বাঙালী​ [Heroism of the Bengalis] (in Bengali) (9th ed.). Kolkata: Presidency Library. pp.​ 48–50.

​ Land and Local Kingship in Eighteenth-Century Bengal By John R. McLane

Kundu, Ashok Kumar (1 October 2009).​ "রাজবল্লভপুরের জলঘড়ি". Kolkata:​ Anandabazar Patrika. Archived from​ the original​ on 22 October 2009. Retrieved​ 7 August​ 2010.

​ Gangopadhyay, Ramaprasad (15 May 2012).​ "সংস্কারের অভাবে হারাচ্ছে ইতিহাস".​ Anandabazar Patika​ (in Bengali). Kolkata. Retrieved​ 17 October​ 2014.

হাবিবুর রহমান খান লোহানি, “বাংলার শেষ পাঠান সুলতান ওসমান খান”।












একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ