শনির বচন | ঝুলে রইল এমএসপি’র দাবি

Sobdermichil .  Krishok andolon

চলমান কৃষক আন্দোলনের প্রথম পর্বের সমাপন আজ। দিল্লীর সীমান্তে টিকরি সিঙ্ঘু ও গাজীপুর থেকে কৃষকরা রওনা দেবেন বাড়ির পথে। ঠিক ৩৮১ দিন দিল্লীর সীমান্তে ধর্ণা দেওয়ার পর। পৃথিবীর গণআন্দোলনের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এবং দীর্ঘকালীন গণআন্দোলনের ইতিহাস রচনা করে। না, তাই বলে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার আন্দোলনের পরিসমাপ্তি হয়নি এখনো। সেই আন্দোলন চলতেই থাকবে। বিশেষ করে ভারতবর্ষের প্রতিটি কৃষিপণ্যকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আওতায় নিয়ে আসার আগে অব্দি। অন্তত চলমান কৃষক আন্দোলনের নেতানেত্রীদের কথায় সেই সংকল্পেরই ঘোষণা শোনা গিয়েছে। তাঁরা খুব স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, আন্দোলন তুলে নেওয়া হচ্ছে না। বা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটানোও হচ্ছে না। দিল্লীর সীমান্তে ধর্ণা তুলে নেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র। দিল্লীর সীমান্তে অবস্থান করে চলতে থাকা আন্দোলন আপাতত স্থগিত রাখা হচ্ছে কেবল। পরবর্তী সিদ্ধান্তের ঘোষণা করা হবে আগামী বছর। ১৫ই জানুয়ারী সংযুক্ত কিষান মোর্চার সাধারণ সভার পরবর্তী বৈঠকে। যে বৈঠক বসবে আবারও সেই দিল্লীতেই। সেইরকমই ঘোষণা করা হয়েছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার ৯ই ডিসেম্বরের সাংবাদিক সম্মেলন থেকে।

সংযুক্ত কিষান মোর্চার এই সিদ্ধান্তে আপাতত হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে ক্ষমতাসীন শাসকদল। এরপর পরবর্তী লক্ষ্য হিন্দু মুসোলমান ফর্মুলার রাজনীতি করে উত্তরপ্রদেশের আসন্ন নির্বাচন জিতে নেওয়ার। উল্টোদিকে আন্দোলনরত কৃষকরা সেই হিন্দু মুসোলমান ফর্মুলার রাজনীতির বিরুদ্ধে কতটা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়। আর ঠিক এইখানেই সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন, দিল্লীর সীমান্তে ধর্ণা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত হলো। সামনে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি বাঁচাতেই গুরু নানকের জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রীর টিভিতে এসে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা। যে তিন কৃষি আইন কোন পরিস্থিতিতেই বাতিল করতে রাজি ছিল না শাসকদলসহ কেন্দ্রীয় সরকার। এবং সরকারপন্থী সমস্ত মিডিয়া। এর থেকে বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথাই নয়, উত্তর ভারতের রাজনীতিতে বিজেপির রাজনৈতিক জমি কত দ্রুত এবং কতটা আলগা হয়ে পড়েছে। সেই পরিস্থিতির সঠিক উপলব্ধি করেই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তিন কৃষি আইন বাতিল করা ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ খোলা ছিল না। আন্দোলনরত কৃষকরা ‘মিশন ইউপি’ কার্যক্রমকে সারা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে ছড়িয়ে দিতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ‘নো ভোট টু বিজেপি’ স্লোগান তুলে। বিশেষ করে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশসহ উত্তরাখণ্ডের গ্রামে গ্রামে বিজেপির বিধায়ক সাংসদদের বয়কটের ডাক দেওয়ায়, বিজেপির বিধায়ক সাংসদসহ নেতানেত্রী ও কর্মকর্তারা গ্রামে ঢুকতে গেলেই বিদ্রোহী কৃষকদের প্রতিরোধের সামনে পড়ছিলেন। ফলে তাঁরা খুব স্পষ্টই বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন, তিন কৃষি আইন বাতিল না হলে কৃষক আন্দোলন বন্ধ হবে না। আর সেই আন্দোলন বন্ধ না হলে বিজেপির মতো শক্তিশালী রাজনৈতিক দলকেও গ্রামছাড়া হয়ে থাকতে হবে। আর গ্রামের ভোট হাতছাড়া হওয়া মানে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর ভোট হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। যার সরাসরি প্রভাব শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার ভোট দিয়েও প্রতিরোধ করা যাবে না। তার একটাই কারণ। ভারতবর্ষে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীই সংখ্যাগরিষ্ঠ। যাদেরকে চলমান কৃষক আন্দোলন বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে এবং কর্পোরেট স্বার্থের অর্থনীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে সফল হয়েছে। আর ঠিক এই ঐক্যবদ্ধ শক্তিকেই ভয় পেতে শুরু করে দিয়েছে সংঘ পরিবারসহ শাসকদল বিজেপি এবং তাদের কর্পোরেট গুরুকুল। ফলে আম ও বস্তা দুইই হারানোর আতঙ্কে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতির পক্ষে।

চলমান কৃষক আন্দোলনের ঝটকা ধীরে হলেও অত্যন্ত সজোরেই লেগেছে শাসকদল, সরকার ও কর্পোরেট স্বার্থে। তিন কৃষি আইন বাতিল করাই তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। এই আইন এই সময়ে বাতিল না করলে কৃষকদের ‘মিশন ইউপি’ কার্যক্রম আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে এমন অকাট্য ভাবেই প্রভাব ফেলতো যে উত্তরপ্রদেশসহ বাকি রাজ্যগুলিই শুধু হাতছাড়া হতো না, দিল্লীর মসনদও টালমাটাল হয়ে যেত। ছাপ্পান্ন ইঞ্চীর ছাতির পক্ষে তাই এতবড়ো ঝুঁকি নেওয়া আর সম্ভব হয়নি। 
অর্থাৎ কৃষকদের দেওয়া ঝটকা শাসকদল বিজেপি ও তার সরকার এবং তাদের কর্পোরেট গুরুকুলকে কতটা বেসামাল করে দিয়েছে, এই ঘটনাই তার অকাট্য প্রমাণ। আর ঠিক সেই কারণেই প্রশ্ন উঠছে এমএসপি’র দাবি না মেটা সত্বেও দিল্লীর সীমান্তে চলমান কৃষক আন্দোলন স্থগিত করে দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত হলো, তাই নিয়েই। চলমান আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতেই। সেকথা সর্বাংশেই সত্য। কিন্তু একথাও তো সত্য। সেই দাবির সাথেই অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল এমএসপি’র উপরে আইন করার দাবি। স্বামীনাথান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ফসলের ন্যূনতম সহায়ক ম্যূল্য নির্ধারণের দাবি। কিন্তু সেই দাবিগুলিকে বিশ বাঁও জলে ডুবিয়ে রেখে মাঝপথে আন্দোলন স্থগিত করা এবং দিল্লীর সীমান্ত থেকে ধর্ণা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কৃষক আন্দোলনের পক্ষে আসলেই মস্তবড়ো ভরাডুবি হয়ে গেল না কি? হ্যাঁ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দ আবারো ১৫ই জানুয়ারী পরবর্তী সভায় বসবে। আন্দোলনের প্রাপ্তি ও পরবর্তী আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনায়। এমএসপি’র বিষয়ে সরকারের দেওয়া লিখিত আশ্বাস কতদূর বাস্তবায়িত হওয়ার পথে, সেই বিষয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতে। এগুলি অবশ্যই হবে। কিন্তু চলমান আন্দোলন সরকারকে যেভাবে কোনঠাসা করতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সেই অবস্থান কতটা বজায় থাকবে দিল্লীর সীমান্ত থেকে এই ধর্ণা তুলে নেওয়ায়, সেউ বিষয়ে একটা গভীর প্রশ্নচিহ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। আরও একটি বড়ো বিষয় এমএসপি’র দাবির পথে কাঁটা হয়ে বিঁধে রইল। সরকারী আশ্বাসে স্পষ্টই বলা হয়েছে, এমএসপি’র বিষয়ে যে সরকারী কমিটি গড়া হবে। তাতে অন্যান্য কৃষক সংগঠনের সাথে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চাকেও স্থান দেওয়া হবে। চমৎকার। এই অন্যান্য কৃষক সংগঠন কোনগুলি? দেশ জুড়ে পাঁচ শতাধিক কৃষক সংগঠন মিলে গড়ে তুলেছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। যারা ৩৮১ দিন ব্যাপী লাগাতার দিল্লীর সীমান্তে ধর্ণায় বসে তিন কৃষি আইন বাতিল করতে বাধ্য করলো সরকারকে। যে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার অন্যতম বড়ো দাবি এমএসপি’র উপরে সরকারী আইন প্রণয়নের। সেই দাবি নিয়ে আলোচনায় এই পাঁচ শতাধিক কৃষক সংগঠনের বাইরে থাকা কৃষক সংগঠনকে ডাকা হবে কোন যুক্তিতে? মূল দাবিটিকেই দুর্বল করে দিতে নিশ্চয়ই। ফলে এই বিষয়টি সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা কোন যুক্তিতে স্বীকার করে নিল, সেটিও এক বড়ো প্রশ্ন। দাবি ছিল এমএসপি’র উপরে সরকারী আইন প্রণয়ন করতে হবে। দাবি ছিল স্বামীনাথান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। দাবি ছিল প্রতিটি কৃষিপণ্যকেই এমএসপি আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এবং প্রতিটি কৃষি পণ্যেই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। যার থেকে কম মূল্যে কৃষিপণ্য ক্রয় আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে আদালতে গ্রাহ্য হবে। দবি ছিল সারা ভারতেই সেই এমএসপি আইন চালু করতে হবে সমান ভাবে। যাতে ভারতবর্ষের প্রতিটি কৃষক লাভবান হয়। আর এই সব দাবিগুলিই সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার তোলা দাবি। যে পাঁচ শতাধিক কৃষক সংগঠন মিলে এই মোর্চা গঠন করেছে। এখন প্রস্তাবিত সরকারী কমিটিতে এই দাবি না তোলা কৃষক সংগঠনও স্থান পেলে, সেটি মস্তবড়ো প্রবঞ্চনা হবে এমএসপি’র দাবিতে আন্দোলনরত প্রতিটি কৃষকের সাথেই। ফলে সরকারের দেওয়া লিখিত আশ্বাস মতো যে কমিটি গঠন করা হবে, তাতে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চাই সংখ্যালঘু হয়ে গেলে গোটা এমএসপির দাবিই কিন্তু দুর্বল হয়ে যাবে। সেই সম্ভাবনার ভাবনা সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দের মাথাতেও নিশ্চয় রয়েছে। কিন্তু তারপরেও তাঁদের আন্দোলন স্থগিতের সিদ্ধান্তেও প্রশ্নচিহ্ন রয়েই যাচ্ছে।

উত্তরপ্রদেশ উত্তরাখণ্ড পাঞ্জাবের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে কৃষক আন্দোলনকে দিল্লীর সীমান্তে জারি রেখেও প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে পারলে এই নির্বাচনের আগেই হয়তো সরকারকে এমএসপির উপরে কৃষক আন্দোলনের দাবি মতো আইন প্রণয়ন করতে হতো। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা হঠাৎ কেন সেই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে দিয়ে শাসকদল বিজেপি ও সরকারকে আসন্ন বিপর্যয় থেকে আত্মরক্ষার একটা পরিসর করে দিল, তার উত্তর এখনো পরিস্কার নয়। সবটাই অনুমান নির্ভর। অনুমানের কথা বাদ দিলেও এই সিদ্ধান্তের ফলাফলই বলবে, সিদ্ধান্ত সঠিক না ভুল হলো। কিন্তু একথা ঠিক। কৃষকদের দাবি মতো দেশব্যাপী এমএসপি’র আইন যদি শেষমেশ তৈরী না হয়। বা বাধা প্রাপ্ত হয়। তবে কিন্তু হঠাৎ আন্দোলন স্থগিত রেখে এই ধর্ণা তুলে নিয়ে দিল্লীর সীমান্ত ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তের মাশুল দিতে হবে ভারতবর্ষের প্রতিটি কৃষককেই। আবারও শুরু করতে হবে একেবারে শূন্য থেকেই।


১০ই ডিসেম্বর’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ