দেশের প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর কাছে ক্ষমাভিক্ষা করে নতুন তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তারপরেও তাঁর অনুরোধে কর্ণপাত না করে বেয়াড়া কৃষকরা এখনও দিল্লীর সীমান্ত অবরুদ্ধ করে খুঁটি গেড়ে বসে রয়েছে। স্বভাবতই একজন দেশপ্রেমী হিসেবে অধিকাংশ ভারতীয় নাগরিকের মতোই আমি আপনিও যথেষ্ঠ ক্ষুব্ধ এই নাছোড়বান্দা কৃষকদের উপরে। ক্ষুব্ধ হওয়ারই তো কথা। গত এক বছর ধরে আমরা জেনে এসেছি, দিল্লীর সীমানায় সরকার বিরোধী খালিস্তানী পাকিস্তানপন্থী মাওবাদী চীনপন্থী দেশদ্রোহীরাই রাজপথ অবরোধ করে বসে রয়েছে। দিনের পর দিন মাসের পর মাস। আর প্রকৃত কৃষকরা সরকার প্রণীত নতুন তিন কৃষি আইনকে স্বাগত জানিয়ে খেতে খামারে খাটছে বারোমাস। তবেই না আমাদের পাতে দুই বেলা অন্নসংস্থান হচ্ছে। কৃষক দরদী এহেন সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রকারীরাই না কৃষকের ছদ্মবেশে লাগাতার অবস্থান বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে দিল্লীর সীমানা জুড়ে। আমাদের তো সেদিন টিভির স্ক্রিন জুড়ে ফলাও করে দেখানোও হল, কিভাবে দেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করে কৃষকরা লালকেল্লায় তাদের পতাকা উড়িয়ে দিল। না, সেদিনও আমরা লালকেল্লায় কোন পতাকা কত উচ্চতায় ছিল। সেসব মাপতে যায়নি। সমস্ত দেশপ্রেমী ও সরকারভক্ত টিভি চ্যানেলগুলি থেকে যেমন যেমন সংবাদ প্রচারিত ও প্রদর্শিত হয়েছিল। গত ছাব্বিশে জানুয়ারী দিনভর আমরা সেই সকল প্রচারিত সংবাদই সত্য ও অভ্রান্ত বলে মেনে এসেছি। আমাদের দেশভক্তি ও নাগরিক কর্তব্যে। ফলে আমাদের মনে কোন সংশয় ছিল না। দিল্লীর সীমান্তে যারা কৃষক সেজে রাজপথ অবরোধ করে রেখেছে। তারা দেশের প্রকৃত কৃষকই নয়। অন্তত খেতে খামারে কৃষিকাজের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। এমনটাই বিশ্বাস করে এসেছি আমরা অন্তত ১৯শে নভেম্বর ২০২১ অব্দি। না, এখনো করি বইকি। শুধু মনের ভিতরে একটু কষ্ট হয়, যখন মনে পড়ে গুরুনানকের জন্মদিনে আমাদের সকলের প্রিয় দেশপ্রধান দিল্লীর সীমান্তে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের কৃষক বলেই মেনে নিলেন। আসলে এটা দেশ প্রধানের অধঃপতন না আপাতত বিক্ষোভকারীদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে মাথা নোয়ানো। সেটা আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। নাকি এক পা পিছিয়ে দশ কদম এগিয়ে যাওয়ার মাস্টারস্ট্রোক! আমরা অন্তত মনে মনে প্রার্থনা করছি শেষের অনুমানটিই যেন সঠিক হয়। ছাপ্পান্ন ইঞ্চী ছাতি বলে কথা! কিন্তু ছাতির মাপ যাই হোক না কেন। তাঁর অনুরোধ অস্বীকার করার স্পর্ধা হয় কি করে অবস্থানরত কৃষকদের। কৃষকই বলতে বাধ্য হচ্ছি আমরা এখন। কেননা দেশপ্রধান স্বয়ং যখন তাঁদের কৃষক বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। তখন আমরাই বা আর অস্বীকার করি কি করে? কিন্তু তাই বলে দেশপ্রধানের অনুরোধে কর্ণপাত করা তো দূরস্থান। তার সাথে নিত্য নতুন শর্ত জুড়ে দেওয়া? এমএসপি’র গ্যারান্টি দেওয়া আইন চালু করতে হবে? বিদ্যুৎ বিল রদ করতে হবে। এটা করতে হবে ওটা করতে হবে। কথায় বলে বসতে দিলে শুতে চায়। এই জন্যেই শাসককে কানে তুলো আর পিঠে কুলো বেঁধে থাকতে হয়। নয়ত শাসন কার্য চালানো দায়। এরপর তো কাশ্মীরে ফের ৩৭০ ধারা চালু করার দাবি উঠে যাবে। দাবি উঠে যাবে সিএএ আইনও রদ করার। দাবি উঠে যাবে এনারসি বাতিল করার। ডিটেনশন ক্যাম্প বন্ধ করে দেওয়ার। ব্যাংক ও বীমা বেসরকারী করণ রদ করার। একের পর এক দাবি উঠতেই থাকবে। তখন কি সরকার সব দাবির কাছেই এই ভাবে মাথা নত করবে নাকি? না, আমরা যারা দেশপ্রেমী ভারতীয়। বিশেষ করে হিন্দুস্তানী হিন্দুত্বের পক্ষে, আদানী আম্বানীর পক্ষে, আমেরিকাপন্থী ও নিও লিবারেল ইকনমির পক্ষে। তারা এসব মেনে নিতে পারি না।
ধরা যাক। তথাকথিত কৃষকদের সব কয়টি দাবিই সরকার প্রধান মেনে নিলেন। সরকার প্রধানের কথা বলা হচ্ছে কারণ, তিনিই তো সব। তিনিই নেতা। তিনিই প্রধান। তিনিই সরকার। তিনিই আইন। বাকি সব তাঁরই বকলমে চলছে। এবং চলবে।
এখন তিনিই যদি স্বয়ং তথাকথিত এইসব কৃষকদের সব দাবি মেনে নেন। তবে দেশজুড়ে তাঁর অন্ধভক্তদের কি দশা হবে? কেউ কি আর তাদের ভয় করবে? না হুকুম মানবে? দেশের মানুষ একবার যদি বুঝে যায় ছাপ্পান্ন ইঞ্চী ছাতির মাপকেও ঝুঁকিয়ে দেওয়া সম্ভব।
আসন্ন নির্বাচনের সাম্ভব্য ভরাডুবির ভয় দেখিয়ে কাঁপিয়ে দেওয়া যায়। তবে তো রাজ্যপাটের দফরফা হতে আর বেশি দেরি নেই। একটা কেন, দশটা পুলওয়ামা ঘটালেও নির্বাচনী ভরাডুবি ঠেকানো যাবে না আর। এদিকে এমনিতেই দেশের অধিকাংশ মানুষের চিত্তিরে পেট্রল ডিজেল রান্নার গ্যাস আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তারপর এইসব ঘটনায় মানুষকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে কি? রাস্তাজুড়ে অন্ধভক্তদের মিছিল নামিয়ে দিলেও, মানুষকে কি আর বোকা বানানো যাবে কোনভাবে? মানুষ কিন্তু একবার জেগে উঠলে কি করতে পারে। সেটা টের পেয়ে গিয়েছিলেন প্রবল প্রতাপশালী ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং। কথায় কথায় ব্যাংক ফেলের হাত থাকে আপামর দেশবাসীকে যিনি রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁকেও কিন্তু জনরোষের সামনে পড়তে হয়েছিল। আর আজকে দেশের মানুষ একবার যদি জেগে ওঠে। তাহলে কিন্তু নোট বাতিল, জিএসটি, সরকারী সম্পত্তির বেসরকারীকরণ, ব্যাংক বীমার বেসরকারী করণের প্রয়াস, সরকারী চাকরির পরিসর অবরুদ্ধ করে দিতে থাকা, হিন্দু-মুসলিম করে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার সৃষ্টি করা, বেকারি বৃদ্ধি, পরিযায়ী শ্রমিকদের হাজার হাজার কিলোমিটার পথ হাঁটানো, প্রত্যকের ব্যাংক একাউন্টে পনেরো লাখ করে টাকা দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতির নির্বাচনী ধোঁকাবাজি, বছরে দুই কোটি করে সরকারী চাকরি দেওয়ার টোপ, দেশের সম্পত্তি ও সরকারী সংস্থা জলের দরে আদানী আম্বানী টাটা বিড়লাদের হাতে তুলে দেওয়া, ব্যক্তিগত আমানতের উপরে ক্রমাগত ব্যাংকের সুদ কমিয়ে দেওয়া, একের পর এক ব্যাংক লুঠেরাদের দেশ ছেড়ে পালাতে সাহায্য করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ পরিসেবায় সরকারী ব্যায় সংকোচ, ইত্যাদি শত শত জনবিরোধী কর্মের জন্যে দেশের জনতা কিন্তু দেশপ্রধান ও তার দলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দুইবার ভাববে না। তাই এই জনতাকে ঘুম পারিয়ে রাখতে গেলে হিন্দু মুসলিমে ভাগ করে রাখতে গেলে ভাবতে হবে নতুন করে। শুধুই ছাপ্পান্ন ইঞ্চীর ছাতি দেখিয়ে আর জনতাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাবে বলে মনে হয় না আমাদের। এমনকি অন্ধভক্তদের ভিতরেও অন্ধভক্তি জাগ্রত রাখতে নতুন নতুন মেকানিজমের আমদানী করতে হবে। নয়তো উদ্ভাবন করতে হবে।
ফলে দেশের জনতা বনাম রাষ্ট্র বা ক্ষমতাসীন সরকারের মুখোমুখই সংঘর্ষ ঠেকাতে আমাদের প্রিয় দেশ প্রধান নতুন কোন অবতারে আবির্ভুত হন। সেটা দেখার অপেক্ষা নিয়েই আমাদের দিন গুনতে হচ্ছে। আপাতত দেশ প্রধান এক কদম পিছিয়ে আমাদের মতোন দেশপ্রেমীদের অবস্থানকে বিশেষ ভাবেই নড়বড়ে করে দিয়েছেন। সেকথা মুখে স্বীকার না করলেও, বাস্তবতা সেইরকমই। কৃষক আন্দোলনের বর্ষপূর্তিতে আনন্দে উত্তাল বিক্ষোভকারী কৃষকদের ঠেকিয়ে রাখতে সরকার ঠিক কোন পথে এগোয়। সেটাও নজরে রাখতে হচ্ছে। না হলে আমাদের মতো সরকারপন্থীদের বড়োই সমস্যা। এতদিন যাঁদের খালিস্তানী পাকিস্তানপন্থী মাওবাদী চীনপন্থী দেশদ্রোহী বলে জেনে ও প্রচার করে এসেছি। আজ যদি তাদেরকেই দেশ প্রধানের সুরে সুর মিলিয়ে দেশের অন্নদাতা বলে মেনে নিতে হয়। তবে তো গত এক বছরের সব আয়োজনই বৃথা যাওয়ার উপক্রম। দেশের অন্নদাতাদের সংগ্রাম যদি একবার দেশের আপামর জনতার ভিতরে সংক্রমিত হয়ে পড়ে। তাহলে কিন্তু এই সরকার এবং শাসকদলের বিপর্যয ঠেকানো কোন ভ্যাকসিনই সম্ভব হবে না। পুলওয়ামা বালাকোট কিংবা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, কিংবা ইভিএম, কোনটাই আর জনতার ভিতরে কাজ করবে না। ঘুমন্ত জনতা যদি জাগ্রত চেতনায় বদলিয়ে যায়, তবে কি হতে পারে তারই একটা ঝলক দেখা যাচ্ছে তিন কৃষি আইন বিরোধী এই কৃষক আন্দোলনে। ফলে যেভাবেই হোক এই আন্দোলনকে জনবিচ্ছিন্ন করে রাখতে না পারলে সমূহ বিপদ। আর আমি আপনি যে সেকথা বুঝতে পারছি। এটাই হয়তো আশার কথা। বাকিটা হয়তো জনতাই ঠিক করে নেবে।
২৭শে নভেম্বর’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত
ফলে দেশের জনতা বনাম রাষ্ট্র বা ক্ষমতাসীন সরকারের মুখোমুখই সংঘর্ষ ঠেকাতে আমাদের প্রিয় দেশ প্রধান নতুন কোন অবতারে আবির্ভুত হন। সেটা দেখার অপেক্ষা নিয়েই আমাদের দিন গুনতে হচ্ছে। আপাতত দেশ প্রধান এক কদম পিছিয়ে আমাদের মতোন দেশপ্রেমীদের অবস্থানকে বিশেষ ভাবেই নড়বড়ে করে দিয়েছেন। সেকথা মুখে স্বীকার না করলেও, বাস্তবতা সেইরকমই। কৃষক আন্দোলনের বর্ষপূর্তিতে আনন্দে উত্তাল বিক্ষোভকারী কৃষকদের ঠেকিয়ে রাখতে সরকার ঠিক কোন পথে এগোয়। সেটাও নজরে রাখতে হচ্ছে। না হলে আমাদের মতো সরকারপন্থীদের বড়োই সমস্যা। এতদিন যাঁদের খালিস্তানী পাকিস্তানপন্থী মাওবাদী চীনপন্থী দেশদ্রোহী বলে জেনে ও প্রচার করে এসেছি। আজ যদি তাদেরকেই দেশ প্রধানের সুরে সুর মিলিয়ে দেশের অন্নদাতা বলে মেনে নিতে হয়। তবে তো গত এক বছরের সব আয়োজনই বৃথা যাওয়ার উপক্রম। দেশের অন্নদাতাদের সংগ্রাম যদি একবার দেশের আপামর জনতার ভিতরে সংক্রমিত হয়ে পড়ে। তাহলে কিন্তু এই সরকার এবং শাসকদলের বিপর্যয ঠেকানো কোন ভ্যাকসিনই সম্ভব হবে না। পুলওয়ামা বালাকোট কিংবা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, কিংবা ইভিএম, কোনটাই আর জনতার ভিতরে কাজ করবে না। ঘুমন্ত জনতা যদি জাগ্রত চেতনায় বদলিয়ে যায়, তবে কি হতে পারে তারই একটা ঝলক দেখা যাচ্ছে তিন কৃষি আইন বিরোধী এই কৃষক আন্দোলনে। ফলে যেভাবেই হোক এই আন্দোলনকে জনবিচ্ছিন্ন করে রাখতে না পারলে সমূহ বিপদ। আর আমি আপনি যে সেকথা বুঝতে পারছি। এটাই হয়তো আশার কথা। বাকিটা হয়তো জনতাই ঠিক করে নেবে।
২৭শে নভেম্বর’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন