আন্দোলজীবী পরজীবী। কথাটা যিনি বলেছিলেন। তিনিই অবশেষে দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছেন। না, এটাকে তাঁর হার বলে ভুল করার প্রয়োজন নেই। লড়াইটা সরাসরি কৃষকদের সাথে দেশের নির্বাচিত সরকারের। যে সরকারকে কৃষকরাও নির্বাচিত করেছিলেন। আর তাদেরকেই তাদেরই নির্বাচিত সরকার পথে বসিয়ে দিয়েছিল কৃষক বিরোধী তিন কৃষি আইন প্রণয়ন করে। কৃষকদের লড়াইটাও তাই সরাসরি নির্বাচিত সরকারের সাথে। আর সেই লড়াইয়ের অন্যতম স্লোগান ছিল ‘ভোট পে চোট’। উত্তরপ্রদেশ উত্তরাখণ্ড পাঞ্জাবসহ পাঁচ রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে কৃষকরা তাদের এই স্লোগানকে সত্য করে তুলতে, কার্যকর করে তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অনেকদিন আগে থেকেই। পশ্চিমবঙ্গে একুশের বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকেই বলতে গেলে কৃষকরা এই স্লোগান তুলে দিয়েছিল। ফলে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে কৃষকরা ‘নো ভোট টু বিজেপি’ এই বার্তা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যার প্রাথমিক ফল মিলেছে হাতে হাতে। গত মাসের প্রায় সব কয়টি উপনির্বাচনেই বিজেপি মুখ থুবড়ে পড়েছে। অনেক প্রার্থীরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। আর এটাকেই কেন্দ্র সরকার অশনিসংকেত রূপে দেখছে। এবং এটা খুব পরিস্কার। এই অশনিসংকেতকে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তার পরবর্তী পরিকল্পনা ও কার্যক্রম ঠিক করে নিয়েছে। সেই পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের প্রথম পদক্ষেপ গুরু নানকের জন্মতিথিতে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা।
এখন দেশ প্রধানের এই ঘোষণায় কয়কটি বিষয়ের উপরে আলোকপাতের প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত, দেশবাসীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করা। অনেকেই বলতে শুরু করেছেন। এই প্রথম কোন দেশ প্রধান তাঁর ভুলের জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইলেন। ফলে জনমানসে নিজের ভাবমূর্তি অটুট রাখতেই যে এই ক্ষমা ভিক্ষা, সে বিষয়ে কোন বিতর্ক থাকার কথা নয়। নিত্য প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। পেট্রল ডিজেল রান্নার গ্যাসের আকাশ ছোঁয়া মূল্য। একের পর এক সরকারী সংস্থা ও সম্পত্তি জলের দরে কয়েকজন গুজরাটি শিল্পপতির মালিকানায় বেচে দেওয়া। এবং সারা দেশেই কর্মসংস্থানের পরিসর দিনকে দিনকে কমে আসার কারণে এমনিতেই দেশবাসীর একটা বড়ো অংশের কাছেই যিনি খলনায়ক রূপে প্রতিভাত হচ্ছিলেন। তাঁর পক্ষে এই ক্ষমাভিক্ষা করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ খোলাও ছিল না হয়তো।
এখন সরকার বিশ্বস্ত সমস্ত গণমাধ্যমগুলিই তারস্বরে দেশ প্রধানের দেশবাসীর কাছে এই ক্ষমাভিক্ষার ঘটনাকেই নিরন্তর তুলে ধরে ছাপ্পান্ন ইঞ্চী ছাতির মহানুভবতার প্রচারে সক্রিয় হয়ে উঠবে। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে যে প্রচার নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার অন্যতম বড়ো আয়ুধ হয়ে দাঁড়াবে।
দেশ প্রধানের তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণায় আরও কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ আলোকপাতের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি পরিস্কার বলেছেন, কিছু কৃষকভাইকে প্রদীপের শিখার মত সত্য এই তিন কৃষি আইন তিনি বোঝাতে পারেননি বলেই এই তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। অর্থাৎ তাঁর কথার একটাই অর্থ। মাত্র কিছু একগুঁয়ে এবং নিশ্চিতভাবেই আকাট মুর্খ কৃষকে তিন কৃষি আইনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই এই আইন প্রত্যাহার করতে হচ্ছে। এবং তাঁর ভাষণে তিনি খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন। তাঁর সরকার কৃষকের বিশেষ করে ক্ষুদ্র কৃষকের কল্যাণের জন্য এবং দেশের কৃষি জগতের হিতার্থে এবং দেশহিতের জন্যেই এই তিন কৃষি আইন প্রণয়ন করেছিল। অর্থাৎ কৃষি আইন এবং সেই আইনের প্রণয়ন ঠিক ছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কিছু সংখ্যক কৃষককে তিন কৃষি আইনের উপকারীতা বোঝাতে না পারার জন্যেই এমন উপকারী এবং দরকারী কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিতে হচ্ছে। ফলে এটা জলের মত পরিস্কার। এই ক্ষমা ভিক্ষা এবং তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার কোনটিই কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। তিনি একবারের জন্যেও স্বীকার করেন নি। সরকারের তৈরী এই কৃষি আইন ভুল ছিল। কৃষি এবং কৃষক বিরোধী ছিল। কৃষকদের এই দীর্ঘ আন্দোলনের মূল দাবি কিন্তু কৃষক বিরোধী তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের। সরকার প্রধান আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও। আইন যে কৃষক বিরোধী ছিল। সেকথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে গেলেন।
এর থেকে এটা অত্যন্ত পরিস্কার। এই সরকার তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে এক ইঞ্চীও সরে আসেনি। বরং সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পুরণে এক কদম পিছিয়ে এসে দশ কদম এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে মাত্র। দেশ প্রধানের ভাষণের দ্বিতীয় ভাগে স্পষ্ট বলা হয়েছে। দেশের কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য এবারে সব পক্ষকে নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হবে। অর্থাৎ তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিলেও নতুন করে আবারও আইন প্রণয়নের পথ খোলার প্রয়াস জারি থাকবে। এবং অনুমান করাই যায়। ভবিষতে নতুন কৃষি আইন প্রণয়নে এবারের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েই এমন ভাবে পরিকল্পনা করা হবে, যাতে লাঠিও না ভাঙে আর সাপও মারা যায়। অর্থাৎ সরকারের উদ্দেশ্য কিন্তু পরিস্কার। তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিয়ে জনমানসে সরকারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার ও পাঁচ রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের বৈতরণী পার। এবং ২০২৪’শের লোকসভা নির্বাচনে পুনরায় ক্ষমতা দখল। মধ্যবর্তী সময়ে এমন ভাবেই নির্দিষ্ট পথরেখা প্রস্তুত করা। যাতে পরবর্তীতে কৃষকদেরকে সরাসরি না চটিয়ে ঘুরপথে একই ব্যবস্থার পত্তন করা যাতে এই কৃষি আইনের মূল প্রবক্তারদের ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ও লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয়। এবারের ঘটনা থেকে সরকার যে শিক্ষাটি গ্রহণ করলো সেটি হলো এই। কৃষকদেরকে সরাসরি চটিয়ে শিল্পমহলের স্বার্থ রক্ষা ও স্বার্থ পূরণে নতুন আইন প্রণয়ন সম্ভব নয়। ফলে তাদেরকে এগোতে গেলে এমন একটা পথ তৈরী করতে হবে যাতে কৃষকদেরকে সরাসরি চটাতে না হয়। এই একটি শিক্ষা এই সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে প্রভুত সয়াহক হবে।
বর্তমান কৃষক আন্দোলনকে বানচাল করা ও ধামাচাপা দেওয়ার হাজার চেষ্টা করেও সরকার ও সরকারী দলের ব্যর্থ হওয়াই এই আন্দোলনের প্রধান জয়। কৃষক আন্দোলনের প্রধান চারটি দাবির আরও তিনটি দাবি পুরণ হয়নি এখনো। কিন্তু প্রথম দাবিটি সরকার মেনে নেওয়ায় কয়েকটি বিষয় পরিস্কার। এক ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক পরিসরকে সম্পূর্ণ গ্রাস করা সম্ভব হয়নি এখনো। চলমান কৃষি আন্দোলন সেই প্রয়াসে বড়ো ধরণের একটা ঝটকা দিয়েছে। হ্যাঁ সরকার কৃষি আইনের কৃষক বিরোধী উদ্দেশ্য স্বীকার না করলেও। কৃষক আন্দোলনের দেওয়া এই ঝটকাকে সম্পূর্ণ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এই ঝটকার দুইটি দিক বর্তমান। একটি সরাসরি রাজনৈতিক। আন্দোলনরত কৃষকদের কথায় ‘ভোট পে চোট’। যার ফলে সরকার এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শিবিরের কাছে নির্দিষ্ট খবর রয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে সম্পূর্ণ ভরাডুবি হওয়ার। এখন ভারতীয় রাজনৈতিক ঘরানায় উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে ভরাডুবির অর্থ সারাদেশেই রাজনৈতিক বিশ্বস্ততা হারানো। কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শিবির এই ঝুঁকিটা আর বহন করতে পারলো না। তাঁদের কাছে পরিস্কার খবর রয়েছে, তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার না করলে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনেই বিজেপির ভরাডুবি অনিবার্য্য। এই খবর না থাকলে দেশপ্রধানকে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে হতো না সরাসরি লাইভ টেলিকাস্ট করে। এটা ড্যামেজ কন্ট্রোলের প্রয়াস মাত্র। এবং দুই, যেটি মূলত অনুমান ভিত্তিক। সরাসরি কোন তথ্য এখনো উঁকিঝুঁকি দেয়নি। সেটি হলো, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা বড়ো অংশই শিখ। এবং কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান। এক বছর ধরে চলা এই আন্দোলন। এবং তাতে সাত থেকে সাড়ে সাতশো কৃষকের শহীদ হওয়া, সেনাবাহিনীর একটা অংশে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বরং তার সম্ভাবনাই সমধিক। এবং সেনাবাহিনীর একটা বড়ো অংশই এই কৃষিজীবী পরিবার থেকে আসা বলেই কেন্দ্র সরকার কৃষক আন্দোলন দমন করতে কাশ্মীরের মতোন সেনা নামিয়ে দিতে পারেনি এখনো। এবং ভবিষ্যতেও পারার কথা নয়। দিলে বা দেওয়ার প্রয়াস শুরু করলেও যে সেনা বিদ্রোহ দেখা দেবে না। তেমন কথাও বলা যায় না নিশ্চিত করে। ফলে একদিকে কৃষক আন্দোলন দমনে সেনা নামানো অসম্ভব। অন্য দিকে আরও বেশি দিন এই আন্দোলন চলতে থাকলে সেনাবাহিনীতেই অসন্তোষ দানা বাঁধার সম্ভাবনার কথাও মাথায় রাখতে হয়েছে ক্ষমতাসীন সরকার ও শাসক দলকে। ফলে আসন্ন বিধনসভা নির্বাচনগুলিতে সাম্ভব্য ভরাডুবির আশংকা এবং সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ দানা বাঁধার সম্ভাবনা। এই দুই সম্ভাবনার অশনিসংকেতেই আপাতত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার। এক কদম পিছিয়ে দশ কদম এগিয়ে যাওয়ার সময় নেওয়া মাত্র। সরকার এখনো তিন কৃষি আইন যে আসলেই কৃষক বিরোধী আইন। প্রবল প্রতাপে সেই সত্য অস্বীকার করে যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, চলমান কৃষক আন্দোলন ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে কতটা রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়াতে পারে। নাকি, সরকারের এই এক কদম পেছনোতেই এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে যায়। সরকার কিন্তু নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে না। ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ রূপে বেসরকারী শিল্পমহলের মালিকানাধীন করে দিতে সরকার কিন্তু এখনো বদ্ধপরিকর। নতুন রূপে নতুন ছলে নতুন আইন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আপাতত রাজনৈতিক ক্ষমতা ও গদী রক্ষা এবং সাম্ভব্য সেনা অসন্তোষে জল ঢালা ছাড়া সরকারের আর কোন বিকল্প পথ খোলা ছিল না। কৃষক আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য এইখানেই।
২০শে নভেম্বর’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত
এর থেকে এটা অত্যন্ত পরিস্কার। এই সরকার তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে এক ইঞ্চীও সরে আসেনি। বরং সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পুরণে এক কদম পিছিয়ে এসে দশ কদম এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে মাত্র। দেশ প্রধানের ভাষণের দ্বিতীয় ভাগে স্পষ্ট বলা হয়েছে। দেশের কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য এবারে সব পক্ষকে নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হবে। অর্থাৎ তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিলেও নতুন করে আবারও আইন প্রণয়নের পথ খোলার প্রয়াস জারি থাকবে। এবং অনুমান করাই যায়। ভবিষতে নতুন কৃষি আইন প্রণয়নে এবারের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েই এমন ভাবে পরিকল্পনা করা হবে, যাতে লাঠিও না ভাঙে আর সাপও মারা যায়। অর্থাৎ সরকারের উদ্দেশ্য কিন্তু পরিস্কার। তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিয়ে জনমানসে সরকারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার ও পাঁচ রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের বৈতরণী পার। এবং ২০২৪’শের লোকসভা নির্বাচনে পুনরায় ক্ষমতা দখল। মধ্যবর্তী সময়ে এমন ভাবেই নির্দিষ্ট পথরেখা প্রস্তুত করা। যাতে পরবর্তীতে কৃষকদেরকে সরাসরি না চটিয়ে ঘুরপথে একই ব্যবস্থার পত্তন করা যাতে এই কৃষি আইনের মূল প্রবক্তারদের ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ও লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয়। এবারের ঘটনা থেকে সরকার যে শিক্ষাটি গ্রহণ করলো সেটি হলো এই। কৃষকদেরকে সরাসরি চটিয়ে শিল্পমহলের স্বার্থ রক্ষা ও স্বার্থ পূরণে নতুন আইন প্রণয়ন সম্ভব নয়। ফলে তাদেরকে এগোতে গেলে এমন একটা পথ তৈরী করতে হবে যাতে কৃষকদেরকে সরাসরি চটাতে না হয়। এই একটি শিক্ষা এই সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে প্রভুত সয়াহক হবে।
বর্তমান কৃষক আন্দোলনকে বানচাল করা ও ধামাচাপা দেওয়ার হাজার চেষ্টা করেও সরকার ও সরকারী দলের ব্যর্থ হওয়াই এই আন্দোলনের প্রধান জয়। কৃষক আন্দোলনের প্রধান চারটি দাবির আরও তিনটি দাবি পুরণ হয়নি এখনো। কিন্তু প্রথম দাবিটি সরকার মেনে নেওয়ায় কয়েকটি বিষয় পরিস্কার। এক ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক পরিসরকে সম্পূর্ণ গ্রাস করা সম্ভব হয়নি এখনো। চলমান কৃষি আন্দোলন সেই প্রয়াসে বড়ো ধরণের একটা ঝটকা দিয়েছে। হ্যাঁ সরকার কৃষি আইনের কৃষক বিরোধী উদ্দেশ্য স্বীকার না করলেও। কৃষক আন্দোলনের দেওয়া এই ঝটকাকে সম্পূর্ণ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এই ঝটকার দুইটি দিক বর্তমান। একটি সরাসরি রাজনৈতিক। আন্দোলনরত কৃষকদের কথায় ‘ভোট পে চোট’। যার ফলে সরকার এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শিবিরের কাছে নির্দিষ্ট খবর রয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে সম্পূর্ণ ভরাডুবি হওয়ার। এখন ভারতীয় রাজনৈতিক ঘরানায় উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে ভরাডুবির অর্থ সারাদেশেই রাজনৈতিক বিশ্বস্ততা হারানো। কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শিবির এই ঝুঁকিটা আর বহন করতে পারলো না। তাঁদের কাছে পরিস্কার খবর রয়েছে, তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার না করলে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনেই বিজেপির ভরাডুবি অনিবার্য্য। এই খবর না থাকলে দেশপ্রধানকে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে হতো না সরাসরি লাইভ টেলিকাস্ট করে। এটা ড্যামেজ কন্ট্রোলের প্রয়াস মাত্র। এবং দুই, যেটি মূলত অনুমান ভিত্তিক। সরাসরি কোন তথ্য এখনো উঁকিঝুঁকি দেয়নি। সেটি হলো, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা বড়ো অংশই শিখ। এবং কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান। এক বছর ধরে চলা এই আন্দোলন। এবং তাতে সাত থেকে সাড়ে সাতশো কৃষকের শহীদ হওয়া, সেনাবাহিনীর একটা অংশে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বরং তার সম্ভাবনাই সমধিক। এবং সেনাবাহিনীর একটা বড়ো অংশই এই কৃষিজীবী পরিবার থেকে আসা বলেই কেন্দ্র সরকার কৃষক আন্দোলন দমন করতে কাশ্মীরের মতোন সেনা নামিয়ে দিতে পারেনি এখনো। এবং ভবিষ্যতেও পারার কথা নয়। দিলে বা দেওয়ার প্রয়াস শুরু করলেও যে সেনা বিদ্রোহ দেখা দেবে না। তেমন কথাও বলা যায় না নিশ্চিত করে। ফলে একদিকে কৃষক আন্দোলন দমনে সেনা নামানো অসম্ভব। অন্য দিকে আরও বেশি দিন এই আন্দোলন চলতে থাকলে সেনাবাহিনীতেই অসন্তোষ দানা বাঁধার সম্ভাবনার কথাও মাথায় রাখতে হয়েছে ক্ষমতাসীন সরকার ও শাসক দলকে। ফলে আসন্ন বিধনসভা নির্বাচনগুলিতে সাম্ভব্য ভরাডুবির আশংকা এবং সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ দানা বাঁধার সম্ভাবনা। এই দুই সম্ভাবনার অশনিসংকেতেই আপাতত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার। এক কদম পিছিয়ে দশ কদম এগিয়ে যাওয়ার সময় নেওয়া মাত্র। সরকার এখনো তিন কৃষি আইন যে আসলেই কৃষক বিরোধী আইন। প্রবল প্রতাপে সেই সত্য অস্বীকার করে যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, চলমান কৃষক আন্দোলন ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে কতটা রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়াতে পারে। নাকি, সরকারের এই এক কদম পেছনোতেই এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে যায়। সরকার কিন্তু নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে না। ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ রূপে বেসরকারী শিল্পমহলের মালিকানাধীন করে দিতে সরকার কিন্তু এখনো বদ্ধপরিকর। নতুন রূপে নতুন ছলে নতুন আইন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আপাতত রাজনৈতিক ক্ষমতা ও গদী রক্ষা এবং সাম্ভব্য সেনা অসন্তোষে জল ঢালা ছাড়া সরকারের আর কোন বিকল্প পথ খোলা ছিল না। কৃষক আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য এইখানেই।
২০শে নভেম্বর’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন