শনির বচন | ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে

শব্দের মিছিল

আসুন আমরা আঙ্গুল চুষি। সামনেই ভোট। সেই আঙ্গুলের ছোঁয়াতেই তো ইভিএমের বোতাম টিপে বাংলাকে তুলে দিতে হবে কেন্দ্রের হাতে। অন্তত তেমনই ডাক দিয়েছেন দলবদলের নির্ঘন্টে সদ্য দলত্যাগী রংবদল করা হেভিওয়েট নেতারা। মন্ত্রীত্ব ছেড়েছেন। বিধায়ক পদ ছেড়েছেন। দল ছেড়েছেন। ঝাঁকের কইয়ের মতো গিয়ে উঠেছেন পদ্মফুলের ঝুড়িতে। না, ঝাঁকের কইদের নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা নেই। কে কবে কোন দল ছেড়ে কোন দলে গিয়ে ভিড়বেন। কোন উদ্দেশে ভিড়বেন। কোন স্বার্থ পূরণের লোভে। সেটি একান্তই তার ব্যক্তিগত বিষয়। মৌলিক অধিকার। ব্যক্তি চরিত্রের স্বরূপ। এবং দিন যত গড়াচ্ছে ঝাঁকের কই ততই বহরে বাড়ছে। বাড়ুক, সেটি রাজ্য রাজনীতির বিষয়। আমাদের লক্ষ্য অন্য। আমরা একটি ডাক শুনেছি। রাজ্যের স্বার্থে গোটা রাজ্যকেই কেন্দ্রে সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিশেষ রাজনৈতিক দলের হাতে তুলে দিতে হবে। অর্থাৎ সমপর্ণ করতে হবে। কারণ তাহলেই কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতায় একই রাজনৈতিক দল অধিষ্ঠিত থাকবে। এবং রাজ্যে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে য়াবে। অর্থাৎ রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বৈষম্যের অবসান হবে। না, এটা যে প্রকারন্তরে রাজ্যের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগকেই স্বীকার করে নেওয়া হয়ে যায়, সে কথা সদ্য দলবদলের উন্মাদনায় কারুর খেয়াল নাও থাকতেই পারে। সেকথা থাক। কিংবা পূর্বতন দলে থাকতে বর্তমান দলের বিরুদ্ধে করে রাখা চোখা চোখা বিশ্লেষণগুলির কথাও তোলাই থাক। আমরা বরং আমাদের নজর একটু নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে দেখি। 

যে আঙ্গুল চোষার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। চুষতে চুষতে সত্যই সেই আঙ্রুল ভোটের আগে কতটা ধারালো হয়ে ওঠে সেসব বুঝতে পারা যাবে আগামী ভোটের ফলাফলে। কিন্তু এটা তো খুবই সত্য। এই আঙুল চোষার মিছিলে প্রতিদিনই নতুন নতুন পদযুগলের ভিড় বেড়ে চলেছে। হ্যাঁ আমরাই ভিড় করছি তো। আর নয় অন্যায়। সত্যিই এমন স্লোগানও ভোলার নয়। তাই আপাতত আমরা আঙুল চুষতেই ব্যস্ত। লক্ষ্য আমাদের একুশের পালাবদলের দিকে। আমরা বেশ উত্তেজিত। আমরা শুনেছি সোনার বাংলা গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। আমরা যা গড়তে পারিনি। সেই সোনার বাংলা যদি অন্য কেউ গড়ে দেয়, তবে তো কথাই নাই। এমন লোভনীয় প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করবো না, হয় কখনো? এমনকি যাঁরা কোনদিন বারান্দা থেকেও নামেননি। সাতে পাঁচে থাকেননি। তাঁরাও এখন সোনার বাংলা গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে থাকতে শুরু করে দিয়েছেন। হ্যাঁ ভিড় বাড়ছে বই কি। প্রতিদিনের ছবিতে যতই সেই ভিড় বাড়ার ছবি দেখি। ততই আঙুল চুষতে থাকি। সোনার বাংলা গড়ে দিল বলে। আর তো মাত্র কয়েকটা দিনের অপেক্ষা শুধু।

এই আঙুল চোষার অবশ্য খুব ছোট একটা শর্ত রয়েছে। চোখকান বুজে বিশেষ বিশেষ টিভি চ্যানেলের বিশেষ বিশেষ সংবাদ সঞ্চালকদের ফ্যান হতে হবে। এবং বিশেষ বিশেষ প্রবক্তাদের প্রবচন মুখস্থ করে নিতে হবে। হয়ে উঠতে হবে সোনার বাংলা গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি যারা দিচ্ছেন এবং ভোটের আগের দিন অব্দিও দেবেন, তাদের অন্ধভক্ত। মাত্র এইটুকু শর্ত পূরণেই আঙুল চোষার অধিকার অর্জন সম্ভব। সেই আঙুল চুষতে চুষতেই আমরা জেনে যাবো, কেন্দ্র সরকার কতটা মহানুভব। জেনে গিয়েছি, কৃষিতে বিপ্লব আনতে কৃষক দরদী আইন পাশ হয়ে গিয়েছে। আসমুদ্রহিমাচল ব্যাপী কৃষকদের হাতে এমন এক অভুতপূর্ব সরকারী উপহার স্বাধীন ভারতে এই প্রথম। আমরা বিশ্বাস করবো, তিনি যা করেন তার উপরে আর কোন কথা হয়ই না। হতে পারে না। হওয়া উচিৎ নয়। হলে সেটি রাজদ্রোহ। দেশদ্রোহীতার সামিল। 

এবং সেই একই বিশ্বাসে সাধের আঙুল চুষতে চুষতে আমরা দেখছি, দিল্লী ঘিরে আতঙ্কবাদী কৃষকদের দেশদ্রোহী আন্দোলন। আমরা দেখতে পাচ্ছি এই আন্দোলনের ফলে সাধারণ দিল্লীবাসীদের প্রতিদিনের জীবন কি সাংঘাতিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। সরকার একবার নয়। এগারো বার কৃষকদের নিজেদের ঘরে ডেকে নিয়ে এসে ভদ্রভাবে বোঝানোর কতই না চেষ্টা করেছে। কৃষি আইন কৃষকদের জীবনে কিভাবে আলাদীনের আশ্চর্য্য প্রদীপ হয়ে উঠবে। এবং মাত্র দুই বছরেই। আমরা দেখতে পেলাম খালিস্তানী কৃষকরা কিভাবে সেসব ভালো ভালো কথা অগ্রাহ্য করে লালকেল্লায় খালিস্তানী ঝাণ্ডা তুলে দিল। প্রত্যেকেই নিজের কানে শুনলাম। বিশেষ বিশেষ টিভি রিপোর্টারের সেই আর্তনাদ! লালকেল্লার উপর থেকে জাতীয় পতাকা নামিয়ে খালিস্তানী পতাকা লাগানো হচ্ছে। আর বিশ্বাস তো আমরা করবোই। আমাদের যে আঙুল চুষে চুষে আগামী বিধানসভা ভোটের আগেই আঙুল ধারালো করে তুলতে হবে। আর নয় অন্যায় স্লোগানকে সফল ভাবে রূপায়িত করতে। তাই কে না কে দীপ সিধুকে নিয়ে কৃষকরা কি বোঝাতে চাইছে। সেসব কথা বোঝার দায়িত্ব আমাদের নাই। কার ঘরে বসে দীপ সিধু পরবর্তী পরিকল্পনার নির্দেশ গ্রহণ করছে, কিংবা প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে তাঁকে পাশে নিয়ে দীপ সিধুর ছবি কেন গুরুত্বপূর্ণ, সেসব বিতর্কে আমরা নাই। আমরা থাকবো না। আমরা আঙুল চোষার বরাত পেয়ে গিয়েছি। লক্ষ্য আমাদের একুশের বিধানসভা নির্বাচন। 

হ্যাঁ দিল্লী পুলিশ কংক্রিটের ব্যারিকেড তুলছে। বেশ করছে। করবেই তো। যেভাবেই হোক দিল্লীকে এই আতঙ্কবাদী কৃষকদের হামলা থেকে রক্ষা করতে হবে না? আরও একটা ২৬শে জানুয়ারী কে চাইবে? দিল্লীকে রক্ষা করতে হবে। দিল্লীকে বাঁচাতে হবে। সরকারকে রক্ষা করতে হবে। মন্ত্রীদের বাঁচাতে হবে। তাই তো কংক্রিটের ব্যারিকেড। তাই তো কাঁটাতার। তাই তো পেরেক পোঁতা রাস্তায়। আসুক না এবার। দেখুক মজাটা। কিন্তু তাই বলে বিদেশী সেলিব্রেটিরা টুইট করবে কৃষক আন্দোলনের পক্ষে? ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত ভাবে নাক গলাবে? কোন অধিকারে? কার স্বার্থে? এতো ভারতের সার্বভৌমত্বের উপরেই আক্রমণ। আমাদের সরকারের উপরেই আক্রমণ। সরকারী আধিকারিকদের উপরেই আক্রমণ। সরকারের প্রধানের উপরেই আক্রমণ। তিনি তো প্রথম থেকেই বলে আসছেন, নতুন কৃষি আইন কৃষকের ভাগ্য খুলে দেবে। তাঁর কথায় অবিশ্বাস? তাঁকেই অসম্মান! না এই স্পর্ধা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। ঠিক সেই কারণেই স্বয়ং শচীন তেণ্ডুলকারও টুইট যুদ্ধে নেমে গিয়েছেন। আর কে না জানে, আপামর ভারতবাসীর শচীনভক্তির কথা। 

পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা রাজস্থান পাঞ্জাব জুড়ে যতই মহাপঞ্চায়েত শুরু হোক না কেন। ওসব আমাদের রাজ্যে হচ্ছে না। হবেও না। দিল্লীর অবরুদ্ধ রাজপথে আইনব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রী, সাধারণ জনতা যতই কৃষক আন্দোলনের পাশে থাকুক না কেন, আমরা আঙ্গুল চুষতেই থাকবো। ২৬শের কৃষক প্যারেডে হাজার হাজার ট্র্যক্টর আর লক্ষ লক্ষ আন্দোলনরত কৃষকদের দিল্লীবাসী যতই ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা করুক না কেন, আমরা তো কৃষি আইন প্রণেতাদের বিশ্বাস করে বসে রয়েছি। এবং বসে থাকবোও। তাতে কারুর তো কিছুই বলার থাকতে পারে না। মনে রাখতে হবে এই আমরাই সেই আঙ্গুল চোষা জনতা। যারা গরুর দুধে সোনা আছে শুনতে জনসভায় ভিড় বাড়াই। আমরাই কিন্তু তিন কোটি বাঙালির নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে বাংলা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকিতে আহ্লাদিত হয়ে উঠি। আমরাই পোশাক দেখে মানুষ চিনতে শিখে গিয়েছি এতদিনে। এবং আমরাই রামনবমী’র অস্ত্রমিছিল থেকে শুরু করে হনুমান বন্দনায় ধর্মের পাঠ নিচ্ছি বিগত ছয় সাত বছর ধরে। ফলে অষ্টমীতে আর মাংস খাওয়া যাবে কি যাবে না, সেটি জেনে নেবো খোদ দিল্লীর মসনদ থেকেই। তাই সেই মসনদকে তো আর অবিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। 

না, দিল্লীর পুলিশ দেশের জনতার টাকায় তৈরী জাতীয় সড়ক খুঁড়ে স্থায়ী ব্যারিকেড বানাতে পারে কিনা। সেই অভুতপূর্ব কাজ কতটা সাংবিধানিক সেসব প্রশ্ন করে আমাদের আঙুল চোষার সময় নষ্ট করার সময় নাই আমাদের। উত্তরাখণ্ডের পুলিশ পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের উদ্দেশে সোশালসাইটে করা পোস্ট চেক করার সাংবিধানিক অধিকার রাখে কিনা, সেসবেও আমাদের আগ্রহ নাই। রাজপথে ধর্ণা দিলে বিহার সরকার সাংবিধানিক ভাবে ধর্ণা দেওয়া নাগরিকের সরকারী চাকরী পাওয়া আটকাতে পারে কিনা, সেসব প্রশ্ন তোলাও আমাদের বারণ। আমাদের রাজ্যে ক্ষমতা বদল হলে ঠিক এই রকম আইন বলবৎ হয়ে যাবে কিনা, সে কথাও ভেবে দেখতে বয়ে গিয়েছে আমাদের। 

দিল্লীর সীমানা জুড়ে কৃষকরা কি বলছে। তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। উত্তরপশ্চিম ভারত সহ অন্যান্য রাজ্যে কৃষক আন্দোলনের পক্ষে কত মানুষ পথে নেমেছেন, নামছেন ও নামবেন তাতে আমাদের বাঙালিদের কি? সরকার কিভাবে সংবিধানের অবমাননা করতে চলেছেন, সেটা সরকারের অধিকারের বিষয়। আন্দোলনরত কৃষকদের পানীয় জল বন্ধ করে দেওয়া, বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করে দেওয়া সহ ইনটারনেট বন্ধ করে দেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার কোন সরকারের থাকে কিনা, সেই বিষয়েও আমাদের কোন আগ্রহ নাই। কৃষকদের উপরে সরকারের দমননীতি নিয়েও আমরা মাথা ঘামাচ্ছি না। ঘামাবোও না। কারণ আমরা শুনেছি, শুনেছি সেই ডাক। আর নয় অন্যায়। এবার গড়ে দেবে সোনার বাংলা। ঠিক যেমন দিল্লীর সীমানায় অবস্থানরত কৃষকরাও শুনেছিল ছয় বছরে কৃষকের আয় দ্বিগুন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। এবং ঠিক যে প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে আজ উত্তরপশ্চিম ভারতের কৃষকরা পথে বসে গিয়েছে। আমরা শুধু জানি ঘুঁটে পড়ে গোবর হাসে। তাই হাসতে হাসতেই আজও আমরা আঙুল চুষে চলেছি। চলব। 

৬ই ফেব্রুয়ারী’ ২০২১

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ