আন্দোলনজীবী। এটা কি নতুন কোন গালাগাল? দেশদ্রোহী, রাষ্ট্রদ্রোহী, খালিস্তানী, পাকিস্তানী, আতঙ্কবাদী, মাওবাদী, চীনের দালাল, সেকুলার, নাস্তিক, আরবান নকশাল ইত্যাদি ইত্যাদি’র মতো? চাটুকার মিডিয়ার হাতে নতুন কোন অস্ত্র তুলে দেওয়া হলো না কি? সরকার বিরোধী, প্রতিষ্ঠান বিরোধী যেকোন আন্দোলনকে দমন করতে কালিমালিপ্ত করতে মোসাহেব মিডিয়ার এমনিতেই জুড়ি মেলা ভার। তারপর এমন একটি বিশেষণকে হাতে গরম গালাগালিতে পরিণত করতে কয় মিনিট সময়ই বা লাগবে? এবার থেকে সরকার বা সরকারের নীতি কিংবা কার্যক্রম বিরোধী যে কোন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কিংবা আন্দোলনের সমর্থনকারীদেরকে সহজেই আন্দোলনজীবী বলে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিতে বেশি দেরি হবে না। নিশ্চয় তাতে সরকার ও সরকারে অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির বিশেষ সুবিধা হবে। বশংবদ মিডিয়ার দৌলতে দেশব্যাপী ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক শ্রেণীর জনমত সংগঠিত করা সহজ হবে। অন্তত এমনটাই আশা সরকার প্রধানের। নয়ত সংসদীয় গণতন্ত্রের উচ্চতম কক্ষে দাঁড়িয়ে দেশব্যাপী আন্দোলনকারীদের আন্দোলনজীবী বলে বিদ্রুপ করার প্রয়োজন পড়তো না নিশ্চয়।
হ্যাঁ সরকারী ক্ষমতার শীর্ষে থেকে নিজ দেশের নাগরিকদের একাংশের প্রতি এমন বিদ্বেষমূলক বিদ্রুপ সত্যই নজির বিহীন। বিশেষ করে আন্না আন্দোলনকে সিঁড়ি বানিয়ে যে রাজনৈতিক শক্তি বর্তমানে রাষ্ট্র ক্ষমতা অধিকার করে বসে রয়েছে, তার পক্ষে তো বটেই।
আন্দোলন তখনই সঠিক, যখন সেই আন্দোলন আমাকে ক্ষমতা দখলে সাহয্য করবে। আর আন্দোলন তখনই বেআইনী, যখন সেই আন্দোলন আমার ক্ষমতাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসবে। বাহবা নন্দলাল! সেটা তো হতে দেওয়া যায় না কোনভাবেই। তাই ছলে বলে কৌশলে সরকারী ক্ষমতার সিংহাসনে একবার বসে গেলেই, সরকারের নীতি বিরেধী যে কোন আন্দোলনই দেশবিরোধী রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র। আর সেই আন্দোলনে অংশ নেওয়া জনতা মাত্রেই আতঙ্কবাদী আন্দোলনজীবী। একেবারে সরল সমীকরণ। একবারে সুস্পষ্ট সীমারেখা। সরকারের ভজনা করলে তবেই দেশপ্রেমী। না করলেই দেশদ্রোহী। সরকারের নীতি বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিলেই আন্দোলনজীবী। আতঙ্কবাদী। রাষ্ট্রদ্রোহী। আর সরকারের সকল কুকর্মের সমর্থন মানেই দেশভক্তি। দেশভক্তি আর ক্ষমতার পায়ে আত্মসমর্পণ সমার্থক! এই যে নতুন একটি ফর্মুলা তৈরী করে দেওয়া হয়েছে বিগত সাত বছরে, এটাই স্বৈরতন্ত্রের প্রথম লক্ষ্মণ। এই লক্ষ্মণরেখায় ভারতবর্ষকে ঘিরে ফেলা হয়েছে সম্পূর্ণ। তাই সংসদীয় অধিকারকে কাজে লাগিয়েই যখন তখন সংবিধান অবমাননার কাজ চালিয়ে যাওয়া, মাখনের ভিতর ছুরি চলানোর মতোই সহজ এখন। সরকার ধরেই নিয়েছে, কেউ কোন প্রশ্ন করবে না। করলেই তা রাষ্ট্রবিরোধী। আর যে করবে সেই আতঙ্কবাদী। এবং সেই আতঙ্কবাদীদের আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করা কিংবা সমর্থন করা মানেই আন্দোলনজীবী হয়ে যাওয়া। তাই সরকারের সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত, হয় তুমি সরকারপন্থী। নয় তুমি আন্দোলনজীবী।
না কথা অবশ্য এইখানেই শেষ নয়। কথা আরও রয়েছে। সরকারের ডিকশনারী অনুযায়ী এই আন্দোলনজীবীরা আসলেই পরজীবী গোত্রের জীব। অর্থাৎ অন্যকে শোষণ করে ব্যবহার করার ভিতর দিয়েই এদের অস্তিত্ব রক্ষা। সংসদের উচ্চতম কক্ষে দাঁড়িয়ে নিজের দেশের নাগরিকদের একটা বড়ো অংশের প্রতি এহেন বিদ্বেষমূলক আচরণ সত্যই অভুতপূর্ব। কথায় আছে, বাবু যত বলে, পারিষদগণ বলে তার শতগুন। ফলে সরকারের বিরোধিতা করা, সরকারের নীতিমালা আইন ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করা আপামর আন্দোলনকারীকেই এখন থেকে পরজীবী বলে অভিযুক্ত করে দেওয়া যাবে। দেশব্যাপী লাগাতার প্রচার করা যাবে। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু জনমত সংগঠিত করা যাবে। এবং সংসদের উভয় কক্ষেই যে কোন আন্দোলনকে কোনঠাসা করতে এখন থেকে এই দুইটি শব্দের বহুল ব্যবহার শুরু হয়ে যাবে। আন্দোলনজীবী ও পরজীবী।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলে সাধারণ জনগণের করের টাকায় প্রভুত সুযোগ সুবিধা ও ক্ষমতা ভোগকারী ব্যক্তিবর্গ নিশ্চয় পরজীবী নন। কি করেই বা হবেন? তাঁরা তো পুলওয়ামা আর বালাকোট আবেগর উপরে ভর দিয়ে এবং কোথাও কোথাও ইভেএমের বদান্যতায় ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছিয়ে গিয়েছেন। এখন বাকি কয় বছর নিশ্চিন্ত। ফলে জনতার করের টাকায় ভোগদখলের অধিকার তো সংবিধান স্বীকৃত। জনগণের করের টাকায় হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশ ভ্রমণ। জনগণের করের টাকায় হাজার হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপনী প্রচার। সেই জনগণের করের টাকায় হাজার হাজার কোটি টাকার বিবিধ সুযোগ সুবিধা ভোগ। না, এইসব কোনকিছুই পরজীবী হয়ে ওঠার কোন নিদর্শন নয় নিশ্চয়। পরজীবী হওয়ার একমাত্র শর্ত হল, শাসকের কুকর্মের বিরুদ্ধে সরব হওয়া জনতার সমর্থনে দাঁড়ানো। দাঁড়ালে তবেই তিনি পরজীবী। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের তেমনই বিধান। গণতন্ত্রের উচ্চতম বেদী থেকেই এই বাণী প্রচারিত যখন, তখন এই বিষয়ে সন্দেহের আর অবকাশ কই? সন্দেহ নাই, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের উত্তরাধুনিক সংস্কৃতিতে এখন থেকে আন্দোলনজীবী ও পরজীবী বলে তাঁদেরকেই তুলোধনা করতে থাকা হবে, যাঁরাই সরকারী ক্ষমতার রোষের কবলে পড়ে যাবেন। সরকারী ক্ষমতার মোসাহেবীরত বিপুল শক্তিশালী প্রচারযন্ত্র যখন হাতেই রয়েছে। তখন আর চিন্তা কিসের।
চিন্তা আছে তবুও। গোটা দেশের অধিকাংশ জনতাই যদি এখন হঠাৎ করে পথের দখল নিয়ে নেয়, আমরা সবাই আন্দোলনজীবী ঘোষণা করে? জাতপাত সম্প্রদায়, উঁচু নীচু, ধনী দরিদ্র্য, শিক্ষিত অশিক্ষিত এই সব পরস্পর বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীর একটা বড়ো অংশই যদি ‘আমরা সবাই আন্দোলনকারী’, এমন ব্যানারের তলায় সমবেত হয়ে জোট বাঁধতে শুরু করে দেয়? সেই ক্ষেত্রে আসলেই যারা পরজীবী গোত্রের উজ্জ্বল সমুজ্জ্বল মুখ, তাঁরা তাঁদের ক্ষমতার অলিন্দ ঠিক মতো সুরক্ষিত রাখতে পারবে তো? কারণ যে অবস্থাই হোক। দেশটা সংবিধান অনুসারে এখনও গণতান্ত্রিক। সেই গণই যদি তন্ত্রকে সঠিক ভাবে সংশোধন করে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তবে সামলাবে কে? পুলিশ আর মিলিটারী? বেতনভুক প্রচারযন্ত্র আর আঙুলে সুতো বাঁধা পুতুল নাচের দুই একজন কারিগর? একশ আটত্রিশ কোটির দেশে কাজটা একটু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে নাকি?
সুদূরপ্রসারী অভিঘাতের চিন্তা এখনই হয়তো ততটা প্রাসঙ্গিক নাও হতে পারে। তবুও এই মুহুর্তে এমন সুতীব্র আক্রমণের কোন ফলাফলই দানা বাঁধবে না, এমন ভাবাও অতিরিক্ত আত্মপ্রত্যয়ের বিষয় বলেই মনে হয়। আত্মপ্রত্যয় নিঃসন্দেহে কার্যকারী। কিন্তু অতিরিক্ত আত্মপ্রত্যয় হটকারিতারই নামান্তর। ক্ষমতার মদমত্ততায় যেকোন মানুষেরই সেই বোধ অবলুপ্ত হতে পারে। সেটা যদি সাময়িক হয়, তবে ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়ে ঝুঁকি কম থাকে। কিন্তু বিষয়টা সাময়িক না হয়ে দীর্ঘমেয়দী কিংবা স্বভাবজাত প্রকৃতির অঙ্গ হয়ে গেলেই বিপদ। ক্ষমতা যে মানুষকে অন্ধ করে তোলে, ইতিহাসই তার সাক্ষী। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই যে পতনের প্রথম ধাপ, ইতিহাসই সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এখন প্রশ্ন হলো, এই যে জোড়া ফলা শানিয়ে আক্রমণ! আন্দোলনজীবী ও পরজীবী। এই আক্রমণ কতটা সুতীব্র হয়ে দেশব্যাপী আক্রমণ শানাতে শুরু করে সেটাই। বেতনভুক প্রচারযন্ত্র কিভাবে পরিচালিত হয়, মূলত তার উপরেই নির্ভর করছে গোটা বিষয়টি। উল্টোদিকে, দেশের যুবসমাজ, কৃষক সমাজ এবং সাধারণ জনতা কিভাবে কতটা আক্রমণ প্রতিহত করতে উদ্যোগী হয়, দেখতে হবে সেটিও। একথা অনুমান করতে অসুবিধা হওয়ার নয়, সরকার পক্ষ যদি অশনি সংকেত দেখতে পায়, তখন নতুন কোন একটি বিষয়ে শোরগোল তুলে জনতার নজর অন্য কোন দিকে ঘুরিয়ে দিতে প্রয়াসী হবে নিশ্চয়। তার একটা বড়ো কারণ রয়েছে। ভারতবর্ষের মতো একটি দেশ। যেখানে জনতার একটা বড়ো অংশই আপন সাংবিধানিক অধিকার সম্বন্ধে সচেতন নয়, সেখানে জনতার স্মরণশক্তি স্বভাবতই ততটা শক্তপোক্ত নয়। খুব সহজেই সাধারণের নজর একটা বিষয় থেকে অন্য একটা বিষয়ে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। যদি শক্তিশালী প্রচারযন্ত্রকে নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা সম্ভব হয়। আর হাতে বেতনভুক প্রচারযন্ত্র থাকলে তো কোন কথাই নাই।
ফলে, এইযে আন্দোলনজীবীরা এসে গিয়েছে। এইসব পরজীবীদের হাতেই দেশটা গোল্লায় যাবে। রাতদিন সাতদিন টিভির পর্দা জুড়ে এমন হেডলাইনের লম্ফঝম্ফ শুরু হয়ে গেলে আদৌ অবাক হওয়ার কিছুই নাই। নিজের স্বার্থ ও বুদ্ধিমত্তার ভিত্তিতে হয় সেই লম্ফঝম্ফের শরিক হবে মানুষ। নয়তো মানুষই শেষ কথা বলবে। অন্তত সেটাই গণতন্ত্রের মূলকথা।
১৩ই ফেব্রুয়ারী’ ১৪২৭
1 মন্তব্যসমূহ
দাদা, মালাউন, কাফের এগুলো বেশ পুরনো গালি। এসব নিয়েও একদিন লিখবেন কি?
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন