■ শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

শব্দের মিছিল

এ কোন তমসা

১৯শে জানুয়ারি বোম্বে হাইকোর্টের হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চের একটি রায় বেরোনোর কয়েক দিনের মধ্যেই তা নাকচ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ভারত সরকার নিজে সেই রায়ের প্রভাব বিপজ্জনক হতে পারে বিবেচনা করে অ্যাটর্নি জেনারেল মারফত সর্বোচ্চ আদালতে পিটিশন দাখিল করেছিলেন। কিন্তু সেই ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে ঐ একই বিচারপতি ২৯শে জানুয়ারি আবারও সাঙ্ঘাতিক একটি রায় দিয়ে বসলেন। কথাটা ‘পতি’ হলেও বিচারকর্ত্রী একজন নারী – পুষ্পা গানেরিওয়ালা। যাঁর বিবেচনায় নাবালিকার ত্বক স্পর্শ না করে পোশাকের ওপর দিয়ে স্তন পীড়ন করাটা যৌন অপরাধ নয়, তাঁর পক্ষে পুরুষদের ইচ্ছাকৃত গোপনাঙ্গ প্রদর্শনও (exhibisionism) যে আপত্তিকর মনে হবে না, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। ভদ্র(?) মহিলার যে বিচারকের আসন ছেড়ে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত, সেই মন্তব্য করলে সম্ভবত আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে হবে না; কারণ পরপর এবংবিধ বিচিত্র রায়দানের পর মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট নিজেই তাঁর স্থায়ী নিয়োগের সুপারিশ খারিজ দিয়েছে। POCSO (Protection of Children from the offense of Sexual Assault) আইনটি যে উনি পড়েননি বা পড়লেও মানেননি, তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট।

আসলে সারা দেশেই কী নারী কী শিশুর--নৃশংস থেকে নৃশংসতম ধর্ষণ হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে শুধু রাজনীতি হয়েছে। বছর দুয়েক আগে পর্যন্ত জাতীয়তাবাদীরা এইসব নরপিশাচদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে সোচ্চার ছিল, যেখানে এক শ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মানবাধিকার কর্মীরাই অপরাধ যতই নিষ্ঠুর ও জঘন্য হোক, মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করে গেছে, হয়তো ঘটনাগুলোর সাম্প্রদায়িক চরিত্রটি সনাক্ত করে। আবার মিথ্যে ঘটনাও সাজানো হয়েছে শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতার স্বার্থে। এই ভয়ানক আগুন নিয়ে খেলার পরিণতিতে গোটা সমাজেই এক মারাত্মক ধর্ষকাম ও নারী বিদ্বেষ উস্কে গেছে। এখন দেশপ্রেমিকদের একটা অংশও নারী নিগ্রহের প্রতিবাদে কিছু লিখলে বিদ্ররূপাত্মক 'হা হা' প্রতিক্রিয়া দেয়, screen shot নিয়ে খাপ বসিয়ে তাকে মাকু/মাকুনি দেশদ্রোহী প্রমাণের চেষ্টা করে। ধর্ম নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত স্পর্শকাতর পুরুষদের নারী বিদ্বেষ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যে শ্রীকৃষ্ণের জীবন থেকে রাধারাণীকে বাদ দেওয়ার জন্য নতুন তত্ত্ব আমদানি হয়েছে, এমনকি পরিলক্ষিত হয়েছে মাতৃপুজোকেও বিরোধিতা কিংবা বিদ্রূপ করার প্রবণতা। বাস্তব ঘটনাগুলোর প্রতিকার হচ্ছে না। যারা বলছে "সুজ়েট শিপ্রা প্রমীলা মাম্পিদের বেলা তোরা কোথায় ছিলি", তারাও এখন মোটেই আর সেইসব ঘটনার অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে উত্তাল নয়, বরং বীরত্ব ফলানোর উপায় হিসাবে ধর্ষণের হুমকিকেই বেছে নিচ্ছে।

এই আবহে বেশ মানানসই বোম্বে হাইকোর্টের মহিলা বিচারকের রায় -- skint to skin touch না হলে নাবালিকার ক্ষেত্রেও লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতন ধরা হবে না। তাই অপ্রাপ্তবয়স্কদের যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইন POCSO-র আওতায় জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি ও কমপক্ষে তিন বছরের কারাদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তি থেকে অপরাধীকে মুক্তি দেওয়া যাবে, অথবা লঘুতর শাস্তি দিয়েই খালাস করা যাবে। ইচ্ছাকৃত পুরুষাঙ্গ প্রদর্শনও যেহেতু ত্বকে ত্বকে স্পর্শ নয়, তাই একই যুক্তিতে সেই কুকর্মটিকে যৌন নির্যাতন হিসাবে সনাক্তই করা হয়নি। হাত ধরে টেনে অপকর্মটি করা হলেও বিচারপতি সেখানে ‘সংস্পর্শ’ দেখতে পাচ্ছে না। উনি স্বীয় পদে আসীন থাকলে হয়তো শুনতে হত, পায়ু বা মুখ আক্রান্ত হলে, সেটাও যৌন নির্যাতন নয়, যেহেতু উভয়ের জননাঙ্গ মিলিত হয়নি। প্রসঙ্গত POCSO-র আওতায় ছোট ছেলেরাও পড়ে যারা বয়স্ক পুরুষদের দ্বারা কদর্য অভিজ্ঞতার শিকার হয়।

আসলে এই ‘যৌন’ শব্দটা বেশ বিভ্রান্তিকর। আমি sexual assault কে "যৌন" নির্যাতন বলার পক্ষপাতী নই, কারণ যোনি বেচারির কোনও দোষ থাকে না। তার থাকা না থাকার ওপর নিগ্রহ নির্ভর করে না। যৌন সুখ লাভের বদলে তাকে অধিকংশ সময় ব্যবহার করা হয় যন্ত্রণা ও অপমান প্রদানের অঙ্গ হিসাবে। অবার অসুস্থ ধর্ষকামীর দ্বারা সবসময় ব্যবহৃতও হয় না। নিগ্রহের ধরণ যাই হোক না কেন, সেটা হয় লিঙ্গের উপস্থিতির জন্য। তাই এগুলোকে “লিঙ্গ-কেন্দ্রিক” (phalacentric) নির্যাতন বলাই সঙ্গত। কোনও মেয়েকে যখন মেয়ে বলেই মারধর অপমান বা বন্দী এমনকি শিক্ষা ও বহির্জগৎ থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়, তা করা হয় পুং লিঙ্গের ও পুরুষ হরমোনের বেয়াড়া প্রবৃত্তির তাগিদেই। তাই তো সমাজতাত্ত্বিকরা এই অপরাধপ্রবণ সমাজকে androcratic society বলেন।

এমন সমাজে অনেক অবাঞ্ছিত কাজই স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়। বিতর্কিত রায়দুটির প্রথমটায়, মানে যার দ্বারা পোশাকের ওপর থেকে মেয়েদের বুক স্পর্শ করাকে ঐ মহতী বিচারক POCSO আইন থেকে ছাড় দিয়েছেন, সে রকম অভিজ্ঞতা হয়নি, এমন ভাগ্যবতী কজন আছে, সেটাই তো মস্ত প্রশ্ন। বাসে ট্রেনে বয়স নির্বিশেষে এই ঘটনা এত ঘটে চলে এবং সেইসব পুরুষরা অচেনা অজানা ও অশনাক্ত থেকে যায়, সে রেকর্ড রাখাই সম্ভব নয়। যে মেয়েটিকে আপত্তিকর ভাবে স্পর্শ করা হল, সেও দুদিন রাগ চেপে গুমরে ভুলে যেতে বাধ্য হয়। নারকীয় ঘটনাগুলোর তুলনায় তাই হয়তো গুরুত্বে পিছিয়ে গেছে বুকে হাত দেওয়ার মতো ছিঁচকেমি। কিন্তু তাই নিয়ে দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হওয়ার পর, এমনকি ভারত সরকার স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ঐ রায়ের ওপর সর্বোচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ আনানোর পরেও ঐ মহীয়সী পুনরায় আরও বিপজ্জনক সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন কী করে?

কারণ আর কিছুই না। ‘নারী নির্যাতন’ ‘শিশু নির্যাতন’-কে এখন আর সত্যিই আর অপনয়নযোগ্য সামাজিক ব্যাধি ভাবা হচ্ছে না। এটি কখনও রাজনৈতিক হাতিয়ার, কখনও বা পণ্য। নারী ও শিশুর প্রতি হিংস্রতা হল পিতৃতন্ত্রের এক অবশ্যম্ভাবী পরিণাম। তাই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কোনও নারীকে ক্ষমতা ভোগ করতে হলে পুরুষতান্ত্রিক অমঙ্গল দ্বারাই পরিচালিত হতে হবে, যার উদাহরণ আমরা বহুবার পেয়েছি, এখনও পাচ্ছি এবং পেয়েই চলেছি। তার থেকে মুক্তি পেয়ে একটা সাধারণ সুস্থ স্বাভাবিক সমাজব্যবস্থা চাওয়াই বরং ‘ফেমিস্ট ইউটোপিয়া’-র মতো কল্পনাবিলাস প্রতিপন্ন হচ্ছে।

আমাদের পরম সৌভাগ্য রামমোহন বিদ্যাসাগররা ব্রিটিশ আমলে এসেছিলেন। এখন জন্মালে কপালে দুঃখ ছিল। তাঁদেরও, এবং আমাদেরও। কারণ স্বাধীন ভারতবর্ষে শাসকেরা সচরাচর সমাজ সেবক ও সংস্কারকদের শত্রু অথবা প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ধরে নেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। একমাত্র যদি প্রকৃতি বিধ্বংসী হয়ে প্রতিশোধ নেয় তো অন্য কথা।

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ