আকাশ নীল বিশ্বাস

শব্দের মিছিল

■বিবর্ণ বাঁশরি


গৌরচন্দ্রিকা :- 'সখী শ্যাম না এলো' - প্রেমিক মাত্রেরই হৃদয় আলোড়িত হয় শ্রীরাধিকার এই কাতর আর্তি শুনলে। প্রেমাস্পদার প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে বৃন্দাবনে প্রেমিক কৃষ্ণের প্রত্যাবর্তন যে ঘটেনি একথা নিঃসন্দেহেই সর্বজনবিদিত। পরবর্তীতে বহুবিচিত্র ঘটনা-পরম্পরার মধ্যে দিয়ে রাধিকার কানাই পরিণত হয়েছিলেন দ্বারকাধিপতি বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণে; কর্তব্যের টানে নিজের প্রেমের কবর খুঁড়েছিলেন স্বহস্তে। কিন্তু কি হয়েছিল শ্রীরাধার অন্তিম পরিণতি? রাধেশ্যামের মিলন কি ঘটেছিলো শেষাবধি? করুণরসে নিমজ্জমান কাব্যকথার মধ্যে দিয়ে চেষ্টা করেছি এ প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণের, যাবতীয় মনোবেদনাকে নিংড়ে চেয়েছি বিষাদসিক্ত, বিরহজর্জর এক কাল্পনিক অ্যাখ্যান শোনাতে। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক কিংবা মহাকাব্যিক কোনো অ্যাখ্যানধর্মী কাহিনী নয়, অকবির মনের এক অবরূদ্ধ কল্পকথা মাত্র। কাব্যপ্রতিভাহীন অপদার্থের এহেন অপচেষ্টাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখবেন, এটুকু ভরসা পাঠকবন্ধুদের ওপর করাই যায় - এর বেশি কোনো দাবী নেই তাদের কাছে।


(১) বিরহবেদনা

কে তোলে ওই সুরলহরী, মন করে আনচান
বাঁশির স্বরে বেজে ওঠে, চিত্তবীণার তান।
দ্বারকার এক পথের ধারে বেদনাবিদ্ধ রাধা
গাঁথছিলো যে বসে বসে অশোকফুলের মালা,
প্রাণের কানাই আর যে তাকে চিনতে নাহি পারে!
কাজ কি আর এই জনমে, দুখের পারাবারে?
কৃষ্ণকে যে সঁপেছে প্রাণ জীবনমরণ ভরে,
আয়ানকে সে কেমন করে জীবনসঙ্গী মানে?
বংশীবাদন শুনিয়া যাহার হয়েছিলো সে কলঙ্কিনী,
সেই যদি আর চিনতে না পারে, কেমনে তা সহ্য করি?
ধিক্ তোমারে কানহাইয়া, এই কি ছিলো তোমার প্রাণে?
পরজন্মে হয়ে দেখো আমি, বুঝবে কি ছিল রাধিকার মনে
তোমার টানে আকুল এ প্রাণ ছুটতো যে তাই বারেবারে
গঞ্জনা যত মাথায় নিয়ে, আকুল প্রাণে যমুনার তীরে।
পাগল এ প্রাণ ব্যাকুল হতো শুনতে শুধুই তোমার বাঁশি
করতে হরণ, মনটা যে মোর, মনে পড়ে সেই কথা কি?
শেষের সেদিন চাইতে বিদায়, এসছিলে যবে রাধার কাছে
আবেগভরা সেসব কথা স্মৃতি হয়েই রয়ে যাবে।
গেছিলে দিয়ে প্রতিশ্রুতি, প্রেম যে মোদের অমর হবে
প্রেমের বচন, সত্যভাষণ, আর কি তোমার মনে আছে?


(২) প্রেমলীলা

না পেয়ে হদিশ, কৃষ্ণমনের, চললো রাধা বৃন্দাবনে
হারিয়ে গেছে শৈশবস্মৃতি, দ্বারকার এক রাজার মনে।
অঙ্গরাগের লগ্নে রাধার শিহরিত যে হচ্ছিল প্রাণ
হায়রে রাধা, অভাগিনীকে কি মনে আছে কানহাইয়ার?
সত্যভামা-জাম্ববতী-রুক্মিণী-কালিন্দী মাঝে
হতভাগিনী শ্রীরাধিকা বনমালীকে পায়না খুঁজে
চাঁচর কেশ আর নীলকান্ত, নয়তো এ তার প্রাণের কানাই
দ্বারকাধীশ সে এখন যে তার গয়লানিকে আর মনে নাই!
মনের দুঃখে বিরহব্যথায় চললো ফিরে শ্রীরাধিকা
থাকুক মনে বনমালী তার, দ্বারকাধীশকে আর চাইনা।
তাইতো রাধা পথের ধারে, গাঁথছিলো মালা অশোকফুলের
পরিয়ে দেবে বনমালীকে, মণি যে তার রুদ্ধ মনের
কৃচ্ছসাধনে কৃশতনু আজ আয়ান-ঘরণী রাধার দেহ
পথকষ্ট যে আর না সহে, সহায় কি তার হবে কেহ?
কে হবে আজ রাধার সহায়? দুঃখ-যাতনা করবে মোচন,
কোথায় গেলে প্রাণের কানাই, রাধার বুকের অরূপ রতন?
আর যে রাধার পা চলেনা, শ্রান্তি-ক্লান্তি আর না সহে
পড়তে গিয়ে পথের ধুলায় পড়লো রাধা এ কার হাতে?
কার বাহুডোরে পড়লো রাধা? ঝাপসা যে আজ দুচোখ তারি,
অশ্রুভরা দুই চোখে তার উঠলো ভেসে বনমালী
বিষাদভরা কন্ঠে রাধা, বললো তুমি এসছো কানাই?
নাকি সবই দুচোখের ভুল, রাধাকে তো তার আর মনে নাই!
বললো মাধব, বিভেদ মোদের ঘটল কবে? এমন দিন কি জানা আছে?
কৃষ্ণরাধা পৃথক হলো, এমন দিন আর এল কবে?
রাধার কপালে রেখে অধর, চুপিসাড়ে তারে বললো কেশব
রেখেছি নিজ প্রতিশ্রুতি, এসছে ফিরে তোমার মাধব।
কৃষ্ণগুলালে রাঙলো রাধা, চললো না পালা অভিমানের
ঠোঁটের উপর রাখলো যে ঠোঁট, ঘটলো মিলন রাইকানাইয়ের।
কাতরকন্ঠে চাইলো রাধা, শুনতে বাঁশির লহরধ্বনী
করতে পূরণ ইচ্ছা রাধার, বাজলো শ্যামের বংশীখানি -
- মূর্ছনাতে উঠলো মেতে, স্তব্ধ যে হলো সপ্তসাগর
বিলীন হলো সপ্তলোকে, প্রেমপিপাসু রাধামাধব।
পাখির ডাক আর স্রোতধ্বনী, সবেতেই আজ মধুসূদন
তৃপ্তি পেলো রাধার হৃদয়, হলো রাইয়ের ইচ্ছাপূরণ।
চরাচর যে ডুবছে আজি রাইকানাইয়ের হৃদয়মাঝে
বংশীখানি গাইছে যে গান, সিক্ত সে সুর বিষাদরসে।
সহসা রাধার তৃপ্ত বদন, পড়লো ঢলে শ্যামের কোলে
চমকে উঠি কৃষ্ণ দেখে, অভাগিনী গেছে চলে
প্রেমের খেলায় জিতে শেষে, দুনিয়ার মায়া কাটলো রাধার
সাঙ্গ হলো মিলনপালা, থামলো বাঁশি কানহাইয়ার।।


(৩) করুণরস


চললো যে রাই তোমায় ছেড়ে, নিয়ে গেলো তোমার হাসি
কি করে আর ভুলবে এ মন, শুনে শুধুই তোমার বাঁশি!
সহসা মাধব রাখতে যে মান ভাঙলো তাহার বংশীখানা
রাধাকে ছাড়া মিটবে না আর বিচ্ছেদের এই অপূর্ণতা।
রাধার কপালে রেখে অধর, সজলচক্ষে বললো কানাই
হবেই অমর প্রেম যে মোদের, শ্যামের বাঁশির রইলো দোহাই।
শূন্য মনে দ্বারকাধিপতি, চললো ফিরে রাজপ্রাসাদে
বর্ণহীন আজ এই বসন্ত, হারিয়েছে শ্যাম রাধিকাকে।
স্বর্ণকান্তি দ্বারাবতী আজ উঠছে সেজে নতুন সাজে
কৃষ্ণ আর রাধাচূড়া যে সারাপথে তার ছেয়ে আছে
ছেড়েছিলে যাকে কানহাইয়া, আজ সে তোমায় ছেড়ে গেলো
তার ফুলে কি তোমার মালা শেষমেষ আর গাঁথা হলো?
রমণীমোহন নৃশংস মন প্রেমের ঠাকুর মধুসূদন
দর্পহারীর দর্পের আজ উঠবে কি সেই বিজয়কেতন?
ছিন্ন যে হলো শৈশবস্মৃতি থাকলো না কোনো অভিমানী
মৃত্যু হলো রাখালরাজের রইলো না কোনো পিছুটানই!



(৪) বিষাদসিন্ধু


দ্বারাবতী আজ উঠছে মেতে, রংবেরঙের হোলিখেলায়
রাধামাধবের বিরহজ্বালা বোঝে সেজন এখন কোথায়?
হায় রে রাধা মরলে কেন কানহাইয়াকে ভালোবেসে
বেদনা ছাড়া আর কি পেলে, হেথায় তাকে খুঁজতে এসে?
ভাসছে সুখে দ্বারকা যে আজ, মাপছে কে আজ দুঃখ শ্যামের?
রাধার বিরহে কাঁদছে এ প্রাণ, কি হলো আজ কৃষ্ণমনের?
পারলে না কেন কানহাইয়া, রাইকে তোমার করতে আপন?
প্রেমের টানে ছিঁড়তে তোমার, সকল মায়ার অলীক বাঁধন?
কিসের তরে ব্যর্থ হলে প্রেমকে দিতে পূর্ণতা?
বিচ্ছেদেই কি শেষ হলো তবে রাধেশ্যামের অমরতা?
কেমন করে প্রেমিক মানি তবে আমি তোমায় বলো?
প্রেমকে তোমার করতে স্বীকার, শেষে এতই দ্বিধা কেন?
প্রেমের লীলা করে শেষে ভাঙলো তব মিলনমেলা
উঠলো কবে বিস্মরণের আগল এবং অবহেলা?
কাঙাল হলো শ্যামের ভুবন করলি কি তুই সর্বনাশী?
রাইকে বিনা শূন্য হিয়ায় বাজবে কি সেই মোহনবাঁশি!
সাঙ্গ হলো প্রেমের গাথা, শূন্য হলো মন যে শ্যামের
মৌন কেন দ্বারকাধীশ আজ হলো কি তব অহংকারের?
পারলে নাতো রাখতে যে মান তোমার করা অঙ্গীকারের?
শেষে প্রেমকেই দিলে বলি রাখতে মান এই উচ্চপদের?
অনিশ্চিতকে আলিঙ্গনের এতই যদি ভয়,
এ পথ তবে নয় গো তোমার, এ পথ তোমার নয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ