ইন্দ্রাণী সমাদ্দার

শব্দের মিছিল

কলিংবেল বেজেই চলেছে। বয়স বাড়ছে, হাঁটু মটমট করছে, কোমর টনটন করছে। সেই নিয়েই জল খাবার বানাচ্ছেন শ্রীমতী রূপা ঘোষ। এরই মধ্যে কলিং বেলের আওয়াজ। সেই অবস্থায় রান্নাঘরের কাজ ফেলে কোনো রকমে দরজা খোলেন​ রূপা। কারণ বাড়িতে এখন দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। কর্তা গেছেন সক্কাল সক্কাল বাজার করতে। বাজার করার​ প্রয়োজনে শুধু যাওয়া নয় বরং​ একটু মানুষের মুখ দেখার​ ​ জন্য মন হাঁকপাক করে শ্রীবিজন ঘোষের । সারা জীবন মফঃস্বল শহরে কাটিয়ে শেষ জীবনে​ ছেলের কথায় রাজারহাটে ফ্ল্যাট কিনে ঘোষ দম্পতির মনে হয় যেন​ ভুল করেছেন।

কলকাতার উপকন্ঠে​ ঝা চকচকে আবাসন, পরিকল্পিত রাস্তাঘাট​ কিন্তু​ প্রাণের বড্ড অভাব। মানুষের সঙ্গে কথা বলেও সুখ নেই। এই শহরের মাঝে বিজনবাবুর নিজেকে বড্ড অগোছালো মনে হয়। এই শহরে তার বড় হওয়া। চাকরি সূত্রে এতো দিন মফঃস্বল শহরে কাটিয়েছেন। সেখানেই বাড়ি করেছিলেন। ইচ্ছে ছিল​ শেষ​ জীবন ওখানেই কাটাবেন। কিন্তু ছেলে জয়​ বাবার চিকিৎসার সুবিধার কথা বলে​ নিজের কাছে ব্যাঙ্গালরে মা-বাবাকে থাকতে বলেছিল। বিজন বাবু রাজি হননি।​ ব্যাঙ্গালোরে থাকার ব্যাপারে​ স্ত্রী রূপারো ইচ্ছে ছিল​ না। ছেলে – বউ সারাদিন​ তাদের কাজে ব্যস্ত থাকে। তার উপর বৌমা সঙ্গীতা অবাঙালী। মেয়েটি খুবই ভালো​ ​ কিন্তু​ শ্বশুর –শাশুড়ির ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দী আর বৌমার ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাঙলায়​ গল্প জমে​ ​ না। রুপার ইচ্ছে ছিল সঙ্গীতাকে বিয়ের পর বাঙলা শিখিয়ে নেবেন কিন্তু ছেলের​ ​ আপত্তিতে সেটা এগোয় নি। উলটে শুনেছেন ছেলে ও বৌমা বাড়িতে হিন্দীতেই কথা বলে। ছেলের আজকাল বাংলা কথা বলতে ভালো লাগে না। যেদিন শুনেছিলেন​ সেদিন কর্তা গিন্নীর ভারি কষ্ট হয়। রূপা বলেছিল ছেলেকে​ বড় করতে কোথাও কোনও গলদ রয়ে গেছে। নাহলে ছেলে আজকাল মাতৃ ভাষায় কথাই বলতে চায়না। ফোনে​ হিন্দী অথবা ইংরেজী শব্দের ভিড়ে বাংলা শব্দ খুঁজে​ পাওয়া দায়।​ কখনো কখনো​ ​ অলস দুপুরে আরাম কেদারায়​ এফ এম শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যান। জকি ছেলেটির জড়ানো বাংলা শুনতে শুনতে ভাবেন তার মতো অন্য কারোর কানেও লাগে এই ভাষার বিকৃতি। আবার অধিকাংশএফ এম স্টেশন হিন্দিতে কথা বলে। অবশ্য নিজের ছেলেই যেখানে মাতৃভাষার থেকে ক্রমাগত দূরে চলে যাচ্ছে সেখানে কিছুই বলার নেই। নদীর মতো কী সময়ের স্রোতে ভাষাও শুকিয়ে যায়?​ ​ ​ বিজন বাবুর কোনো ভাষার প্রতি বিদ্বেষ নেই। কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি তাচ্ছিল্য মনে কষ্ট দেয়।​ সর্বত্র মাতৃ ভাষার এই অবমাননা মানা যায় না।​ আবাসনের আশে পাশে কর্তা – গিন্নী হাঁটতে বেরোলে দেখেন কম বয়সী বাঙ্গালী ছেলে মেয়েরা হিন্দী ও ইংরেজী মিশিয়ে কথা বলে। যেটুকু বাংলা শব্দ কানে আসে তার অনেক শব্দই কানে নতুন ঠেকে। বাঙ্গালা অভিধানে কবে যে এই সব শব্দ সংযোজন হয়েছে।

#

বাজারের ব্যাগ নিয়ে কলিংবেল বাজাতেই অপরপ্রান্তে সাড়া পাওয়া গেলো। বিজনবাবু দেখতে না পেলেও অনুভব করতে পাচ্ছেন দরজার ওপারে রূপা​ পা টেনে টেনে এগিয়ে আসছেন দরজা খুলতে। রাতদিনের লোকের কথা বহুবার বিজনবাবু​ ভেবেছেন কিন্তু নিরাপত্তার কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত রাখা হয়নি। এই শহরে বড়​ হলেও কলেজ জীবনের পর থেকে এই শহর ছেড়ে কর্মসূত্রে অন্য শহরে থাকা। মাঝখানে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। বন্ধুবান্ধব যে কয়েকজনের সঙ্গে​ মোবাইলে যোগাযোগ আছে তারাও নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে খুব চেনা –জানা লোক ছাড়া বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টার লোক রাখতে বারণ করছে। হাঁপাতে হাঁপাতে রূপা দরজা খুললেন। জলখাবার খেতে বসে বিজনবাবুকে আজ একটু অন্যমনস্ক মনে হোলো। রূপা কারণ​ জানতে চাইলে বিজনবাবু বলেন কদিন ধরেই বিজন বাবুর মনে হচ্ছে​ তার শৈশবের শহরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। একদিনে নিশ্চয়ই এই পরিবর্তন হয়নি। একটু একটু করে হয়েছে। কয়েক মাস হয়েছে এই শহরে পাকাপাকি বাস করা। মাটির টানে শহরে ফিরে এসেছেন কিন্তু পরিবর্তন মেনে নিতে পাচ্ছেন না।একটা জাতি মাতৃভাষার​ ​ ইতিহাস না জেনে শুধুই সেই ভাষাকে​ অবহেলা করছে। রূপা বলেন সব দায় ছেলে মেয়েদের নয়। আমার ছেলের মতো সব ছেলে –মেয়ে নিশ্চয়ই নয়। এখনো অনেক ছেলে মেয়েরা আছে যারা বাংলা পরে , বাংলা লেখে , বাংলা ভাষাকে নিয়ে গর্ব বোধ করে। বিজনবাবু চায়ে চুমুক দিতে জানান রূপা​ ঠিকই বলেছেন। অনেকক্ষণ পর দুজনের মুখে এক চিলতে হাসি এসে পড়ে।​ ​


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ