সুমনা সাহা

অহল্যা
নিষ্পাপ ফুলের মতো মেয়েটি। পবিত্র, সুন্দর। সে এক ঋষি পত্নী। নাম অহল্যা। মহাজ্ঞানী গৌতম ঋষি তার স্বামী। মন দিয়ে স্বামীসেবা করে সে। ঘুম থেকে ওঠে সূর্য ওঠার আগে। বাগানের ফুল তুলে, মালা গেঁথে, চন্দন ঘষে স্বামীর পূজোর জোগাড় করে দেয়। নদী থেকে জল তুলে আনে। গৌতম ঋষির গুরুকুলের ছাত্রদের জন্য রান্নাবান্না করে। সমস্ত কাজ সে একা হাতে করে। সেজন্য তার কোন নালিশ নেই—মনের আনন্দে গুনগুন করে গান গায় সে, আর বন্য ঝর্নার মতো প্রফুল্ল দেহমনের সবটুকু সেবা-যত্ন তার তপোবনের সংসারে ঢেলে দেয়। প্রকৃতির কোলে ফুটে ওঠা একটি ফুলের মতো সৌরভময় ও পবিত্র তার জীবন।

কিন্তু এরই মাঝে তার জীবনে ঘটে যায় এক বিপর্যয়। বনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে পুষ্পচয়ন করে অহল্যা ঋষির পূজোর জন্যে, ফলমূলের সন্ধানে ঘোরে বনের এপ্রান্তে সেপ্রান্তে। নাম না জানা সুগন্ধি বুনোফুলে সাজায় তার কবরী। কখনও সে বন্য ঝর্নার স্বচ্ছ জলে করে আনন্দ-স্নান আর একলা মনের আগল খুলে দেয় গুনগুন গানে, নির্ঝরিণীর কলতানে সে সঙ্গীত মিশিয়ে দিয়ে সৃষ্টি করে এক অশ্রুতপূর্ব রাগ—কেউ তার খবর রাখে না! দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করেন এক দেবতা। সৌন্দর্যপিয়াসী তিনি। শ্রেষ্ঠ স্থপতির ভাস্কর্যের মতো সৌন্দর্য যে নারীর দেহে, তার কদর করেন না তপস্বী বৃদ্ধ স্বামী, আর সে কন্যাও নিজের শরীরী সম্পদ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অসচেতন। এহেন এক নিষ্পাপ সৌন্দর্য-ভূমি অভিযানের শখ জেগে ওঠে দেবতার মনে, বনে বনে অহল্যার আনমনা বিচরণ দেবতাকে করে তোলে দেহে-মনে তপ্ত, কামাতুর। অহল্যার অপরূপ রূপ-যৌবন ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ সেই দেবতার সাহস হয় না ঋষি পত্নীকে প্রেম নিবেদনের। তার উপর তেজস্বী গৌতমের শাপের ভয়! অগত্যা ছলনার আশ্রয় নিতে হল। মায়াশক্তিতে গৌতমের রূপ ধরে কামপীড়িত দেবতা এলেন সরলা অহল্যার অবসরের মুহূর্তে, চাতুরী-অনভিজ্ঞা নিষ্পাপ ঋষিপত্নীর মর্যাদা নষ্ট করলেন এক কামকলাকুশল দেবতা।

সরলা কন্যা বুঝতেও পারল না—তার শান্ত মধুর জীবনে নেমে এল কী নিদারুণ বজ্রাঘাত! সব কিছু জেনে ক্রোধে উন্মত্ত হলেন স্বামী গৌতম। অহল্যার আকুল অশ্রু বিফল হল। স্বামীর পায়ে ধরে মিনতি করল সে, কিন্তু মন গলল না তপস্বীর। জ্ঞান ও তপস্যা তাঁর স্বামীত্বের অধিকারবোধ খর্ব করতে পারেনি। তপোবল তাঁকে অব্যর্থ শাপ দেওয়ার ক্ষমতা দিলেও অন্তরে ক্ষমাসুন্দর উদারতা দান করেনি। সুতরাং ত্যক্ত হল অসহায়া নারী। পুরাণে পাই, গৌতমের শাপে অহল্যা পাষাণ হয়ে গেল। আসলে তা রূপক। সমাজ সংসারের কাছ থেকে, এমনকি নারীর পরম আশ্রয় তার স্বামীর কাছ থেকেও লাঞ্ছনা ও প্রত্যাখ্যান পেয়ে সেই সরলা অবলা হয়ে উঠল পাথরের মতো কঠিন। নীরবে চোখের জল মুছে ‘নষ্ট মেয়ে’-র অপবাদ নিয়ে চলে গেল ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর আড়ালে—নিজেকে গুটিয়ে নিল কাঠিন্যের আবরণে। 

শুরু হল অহল্যার এক অন্য জীবন। মানুষের প্রতি, জগৎ সংসারের প্রতি তার এল গভীর বিতৃষ্ণা! তীব্র বৈরাগ্যে সে মৌন অবলম্বন করল। গহীন বনের এক কোনে পড়ে থেকে নামমাত্র ফলমূল খেয়ে কঠোর সাধনায় ডুবিয়ে দিল সে নিজেকে। কত গ্রীষ্মের কালবৈশাখী ঝড় লণ্ডভণ্ড করল শান্ত জঙ্গল, কত বর্ষার অঝোর ধারায় ভেসে গেল মাঠ-বন, কত বসন্ত ঝরালো অজস্র আমের মুকুল, কৃষ্ণচূড়ার রেণু—অহল্যা তার হিসাব রাখে না। জগতের রং-রূপ তার কাছে মূল্যহীন। এক লালসার হাত অপবিত্র করেছে কেবল তার দেহ, কিন্তু তার মন? সে যে অপাপবিদ্ধা! আর মনেরও পারে যে অবিনাশী সত্তা—সে তো চির অম্লান জ্যোতিস্বরূপ! কিন্তু কই? সেই দিব্য জ্যোতি যে তার অধরাই থেকে যায়! আরও কঠোর হয় তার সাধনা। ক্রমে আহার নিদ্রা সব ত্যাগ হয়। মাথার পেলব কেশ এখন রুক্ষ জটাভার। ধ্যানমগ্ন নিস্তব্ধ পাষাণের মতো তার শরীরে খানিক নৃত্য করে যায় কাঠবিড়ালীর সঙ্গে সকালবেলার সোনারোদ। অহল্যা সত্যিকারের পাষাণ হয়েছে। 

তারপর এল এক দিন! যেই দিনটার কথা লেখা হয়ে থাকবে পুরাণে। যেই দিনটার কথা লোক মুখে মুখে ফিরবে। যে দিনটার জন্য যুগ যুগ ধরে মানুষ বলবে ‘ধন্য অহল্যা’! তার দেহের পাপের কথা কেউ মনে রাখবে না। স্বামীর দেওয়া শাপের বজ্র মাথায় নিয়ে কী দুঃসহ জীবন কাটালো এক নিষ্পাপ নারী—সেকথাও লোকে ভুলে যাবে। জেগে থাকবে চিরভাস্বর জ্যোতির মতো সেই কথাটি শুধু—‘রামচন্দ্র এসেছিলেন! পাষাণী অহল্যার অঙ্গ স্পর্শ করেছিল তাঁর চরণ-কমল-পরশ! সেই সোনার কাঠির পরশে পাষাণ হল মানবী’। 

ঐ পবিত্র পদস্পর্শের মুহূর্তটিই প্রত্যেক সাধকের জীবনে মোক্ষম—এক পলকে যেন জড় থেকে চেতন হয়ে ওঠা— যেন হাজার বছরের অন্ধকার ঘরে একটি প্রদীপ জ্বেলে এক লহমায় আঁধার ঘুচিয়ে আলো এনে দেওয়া! ধন্য তুমি অহল্যা। স্বামীর অবহেলায় কেঁদেকেটে নদীতে ঝাঁপ দাওনি। সহস্র লাঞ্ছিতা নারীর ভীড়ে হারিয়েও যাওনি। তুমি তপস্যা করেছিলে। তুমি রামচন্দ্রের আগমনের প্রতীক্ষা করেছিলে। তুমি নিজের জীবত্বের তুচ্ছতা ঘুচিয়ে শিবত্বের অমৃত পাওয়ার প্রতীক্ষায় ছিলে...অহল্যা, তোমাকে আমাদের প্রণাম!

পৌরাণিক গল্প তো কেবল রূপক মাত্র! রূপকের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক প্রাণদায়ী, অবিনাশী সত্য—যা ভাবীকালের মানুষকে পথ দেখায়, দেখায় আলোর দিশা। পাষাণী অহল্যার পুরাণ-কথার আবরণে আমরা খুঁজে পাই জীবনের এক অমোঘ বাণী, মৃত্যুকে তুচ্ছ করে জীবনকে ভালবাসবার এক সুমহান আদর্শ! জীবনে যাই ঘটুক না কেন, যে কোনও খারাপ অবস্থা থেকেই আবার নিজেকে উন্নীত করা যায়। হতাশায় ভেঙ্গে না পড়ে অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা যায়। মানুষের দেওয়া সমস্ত আঘাত, দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করেও একমাত্র ঈশ্বরের করুণার মুখাপেক্ষী হয়ে শান্ত ও অবিচল ভাবে প্রতীক্ষা করা যায়, এবং এই অটুট ধৈর্যের পুরস্কার স্বরূপ তাঁর কৃপা, করুণাও লাভ করা যায়! যে ঈশ্বর-বিশ্বাসী নয়, সেও উত্তরণের তপস্যায়, আত্মবিকাশের সাধনায় লাভ করে নিশ্চিত জয়-ফল।

( তথ্যসূত্রঃ বাল্মীকি রামায়ণ; আদিকাণ্ড; শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক অহল্যা উদ্ধার )
 *লেখাটি বালি/বেলুড় অঞ্চলের স্থানীয় পত্রিকা 'দ্রিমিত'-এ প্রকাশিত


sumanasaha948@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ