কৃষ্ণা রায়

ঈর্ষার তিন-পর্ব
খুব সকালে আশি- ছোঁয়া মা বলল, হ্যাঁরে পুপু, আজ নাকি মাদার্স-ডে? 

বললাম ,তাইতো দেখছি।রাইমা এইমাত্র ফেসবুকে গালভরা মেসেজ পাঠাল, “ফিলিং প্রাউড ফর মাই সুইট মম। , ক্যুরিয়রে তোমার জন্য গিফট পাঠাচ্ছি। পারলে তুমিও দিদার জন্যও একটু সেলিব্রেট কোরো”। কিন্তু তুমি আবার এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ নাকি আজকাল? 

নারে, কথাটা টেলিভিসনে কাল রাতে শুনলাম কিনা । এ বেশ! আমরা সারা জীবন কত স্বাধীনতার স্বাদ পাইনি। এখনকার মানুষ এসব বুঝেছে বলেই না—

- তুমি এ কথা বলছ মা? কই আমায় তো বিয়ের আগে কোন স্বাধীনতা দিতে চাওনি।

-সে তখন কার কথা আলাদা। তাছাড়া এখন তো তুই ...

আমি কী মা এখন? কী বলতে চাইছ? স্বামীর সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে চলতে পারিনি এইতো? 

- তা সেটাওতো মিথ্যে নয় । তোমারও তো জেদ কম ছিলনা।

- কি বলি বল, আমার বাবা তোমায় সব সময় আগলে রাখত। আমার মত তোমাকে তো কোন হ্রদয়হীন মানুষের সঙ্গে ঘর করতে হয়নি । সে যাকগে। এ জীবনে কত কি দেখলাম , কত পর্ব পেরিয়ে এলাম , বিশ্বাস-পর্ব, বিদ্বেষ-পর্ব পেরিয়ে একসময় তো আরো কত কি দেখলাম, নিজের মেয়ের কাছেও । জানো, ছোটবেলায় টেলিভিসনের গ্ল্যামার-গার্লদের দেখিয়ে রাইমা প্রায় জিগ্যেস করত , মা একে দেখতে ভাল? সেই বয়সে আমি ছিলাম ওর বিশ্বাসের কেন্দ্র। বড় হয়ে নিজের মতামত গজালো, আমার বিবেচনা তখন বিলকুল না-পসন্দ । আরো পরে বন্ধুরাই হয়ে উঠল ফিলোসফার, গাইড। মা তখন কে? ব্যাক-ডেটেড, জেনারেসন গ্যাপে আটকে থাকা খিটখিটে বিরক্তিকর গার্জেন মাত্র। 

- ওসব বাদ দে। তা, হ্যাঁরে! তুই আমার জন্য আজ কিছু করবিনা? রাইমার মত? আমি কী আর জানিনা আগে আগে রাইমা সারাক্ষণ তোকে প্রতিপক্ষ ভাবত। আর এখন ? বলেছিলাম না, বড় হলে এসব পাগলামি সেরে যাবে। বুঝলি , প্রথম মেয়ে সতীনের অংশে জন্মায়। 

আমি চরম প্রতিবাদী, হই! ছিঃ! তুমিও বুঝি আমাকে এই রকম ভাবতে? তবে জানো মা, রাইমা আজকাল স্বামী  –সংসার সামলেও আমার শরীর –স্বাস্থ্য নিয়ে খুব ভাবছে।

- বা! সেতো ভাল কথা। 

-হ্যাঁগো, প্রথমে ভেবেছিলাম, এবার ঠিক বেবি- সিটিং করার প্রস্তাব আসবে। লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন শেষমেষ প্রশ্নটা করতেই মেয়ে হেসে অস্থির, বী ক্যুল মা, আমরা ডিসাইড করেছি চাইল্ডলেস থাকব, বাই চয়েস। খুব লজ্জা হল। বুঝলাম, করুণা পর্বটি তবে নেহাতই খাঁটি। যাক গে, আজ তুমি কি চাও বলো? 

মার মুখ নির্বিকার , দুচোখে বিদ্রূপের মৃদু ঝিলিক, আমি আর কী চাইব পুপু? দিও যা তোমার খুশি। এই বয়সেও শুধু দিতে নয়, পেতেও মন্দ লাগেনা। তবে বাছা, তোমার বয়সই বেড়েছে , বুদ্ধি শুদ্ধি তেমন পাকেনি। 

-কেন? কি আবার হল? চিরকাল তুমি শুধু আমার খুঁত দেখেই গেলে। 

- তা ভাবলে আর কি করব? আরে, মা হয়েও এতকাল, নিজের ভেতরে আলো ফেলোনি? 

মনে মনে ভাবি কোন অন্ধকারে আলো ফেলার কথা মা বলছে? 

আমাকে নিরুত্তর দেখে এবার চূড়ান্ত উপসংহারটি মা নিজেই টানলেন, পুপুরে! মা-মেয়ের মধ্যে পোষাকি ভদ্রতা চলেনা ঠিক, কিন্তু করুণা-পর্বেরও খাঁজখোঁজে কত যে গভীর ঈর্ষা-পর্ব ঘাপটি মেরে থাকে, নিজে কখনো সেটি বোঝোনি?

না কি তোমায় দেখে আমি কখনো বুঝিনি?

krishna.roy@rediffmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ