তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

 উদাসীনতা নয়, হৃদয়ে স্থান দরকার
ফেব্রুয়ারি এলে আরও বেশি করে এই গেল গেল রবটা ওঠে। বাংলা ভাষা গোল্লায় যাচ্ছে। সর্বনাশের পথে যাচ্ছে। একদিন হয়তো বিলুপ্তই হয়ে যাবে – এরকমই একটা নিদান দিয়ে দেওয়া হয় প্রায়।

আশংকাটা সত্যি নয় জেনেও উদ্বেগটাকে মান্যতা দিতেই হয়। বাংলা কোনমতেই বিপন্ন ভাষা নয়, বিলুপ্তও হয়ে যাবেনা কোনোদিন। তবু কিছু ক্ষতি নীরবে হয়েই থাকে। যেখানে একেবারেই প্রয়োজন নেই তাও সেখানে ইংরাজি বা হিন্দি শব্দের বা বাক্যাংশের মিশেল দিয়ে কথা বলা অনেকেরই অভ্যাস। সেটাই যেন স্ট্যাটাস। উচ্চারণও বিকৃত করা হচ্ছে। সবাই যে জেনে বুঝে করছেন তা হয়তো নয়, কিন্তু হয়ে যাচ্ছে। এতে আর যাই হোক ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা হচ্ছেনা। অন্য ভাষার অনর্থক অনুকরণে বাক্যের বিন্যাস পালটে যাচ্ছে। জন্মদিন পালন না করে জন্মদিন মানানো হচ্ছে। আগে পরের অর্থ গুলিয়ে দিয়ে পরের স্টপেজে নামবো বোঝাতে বলা হচ্ছে আগে নামবো। সব মিলিয়ে অনেকেই বেশ কনফিউজড। অন্তত অভিযোগ তেমনটাই। 

কোনও ভাষা বেঁচে থাকে পরিবর্তন হয় বলেই। ভাষার অস্তিত্বই তো নির্ভর করে তার নমনীয়তার উপর, সহনশীলতার উপর। যে ভাষা অন্য কিছু গ্রহণ করেনি, নমনীয়তা দেখায়নি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পরিবর্তন করার উদারতা দেখায়নি, সে ভাষা লুপ্ত হয়ে গেছে। পরিবর্তন মেনে না নিলে তো এখনও মাগধী প্রাকৃত ভাষাতেই যোগাযোগ রক্ষা করতে হত বাঙালিকে। সেই চর্যাপদের যুগের প্রাচীন বাংলা থেকে মধ্যযুগ পেরিয়ে, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী ইত্যাদির নিদর্শন রেখে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যে আধুনিক বাংলার প্রচলন সে তো এক লম্বা জার্নি। ক্রমশ পরিবর্তন হতে হতে আজকের দিনে তো তা অনেকটাই পালটে গেছে! এখানেই তো ভাষাকে তুলনা করা হয় নদীর সঙ্গে। আর ভাষা যদি নদীর মতো হয়, তাহলে সে গ্রহণ করবে, বর্জন করবে, ভাঙবে, গড়বে। তবেই তার পরিপূর্ণতা। তবেই সে সমৃদ্ধ হবে। আসলে ভাষা কোন অজড় অনড় চিরস্থায়ী বিষয় নয়। ভাষা চলে নিজের নিয়মে। কারও খেয়ালখুশি বা জবরদস্তি মানেনা।

সেইটিকে মাথায় রেখে ভাবতে হবে ভাষার বিষয়টি। শুধু ফেব্রুয়ারি এসে গেলেই নয়। শুধু আবেগ থেকে মিছিল করে, স্টেজে বক্তৃতা দিয়ে, অমর একুশের স্লোগান তুলে, ব্লগ লিখে বা ফেসবুকে ছবি সহ পোস্ট দিয়ে খুব বেশি কিছু করা যাবেনা। ভাবতে হবে প্রতিটি দিন। বছরের অন্য সময় উদাসীন থাকলে হবেনা, ভালবাসতে হবে প্রতিনিয়ত।

যারা সত্যিকারের বাংলা ভাষাকে আন্তরিক ভালবাসছেন, যারা সেই ভালোবাসা তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তাঁদেরও মর্যাদা দিতে হবে। কথা বলা এবং লেখার ক্ষেত্রে কিভাবে নিজেরা বাংলার প্রয়োগ করছেন লক্ষ্য রাখতে হবে সেদিকে। যত্ন নিতে হবে লেখার ক্ষেত্রে ভুল বানান, ‘র’ আর ‘ড়’ এর পার্থক্য ইত্যাদি বিষয়গুলির দিকে আর বলার সময় উচ্চারণ বিকৃতির দিকে। আরও অনেক ডিটেল আছে যেগুলির ঠিকঠাক যত্ন নিলে অন্তত নিজেরা বাংলা ভাষার উপযুক্ত চর্চা করছি মর্যাদা দিচ্ছি সেই কথাটি ভাবা যায়।

কিন্তু সেটিই তো ঠিকমত হয়না। আমাকে তাই বিভ্রান্ত করে একধরণের দ্বিচারিতা। জীবনযাত্রায় মনোভাবে পুরোপুরি সাহেবিয়ানা, ছেলেমেয়েরা নামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, তাদের ‘বাংলাটা ঠিক আসেনা’ বলে প্রকাশ্যে গর্ব করা অথচ বাংলা ভাষার দুর্দিনের আশংকায় মেকি দুশ্চিন্তা – এগুলোই বাংলা ভাষার আসল প্রতিবন্ধকতা মনে হয়। কিছু অন্য ভাষার শব্দের প্রয়োগ ততটা নয়। যারা কিছু ইংরাজি হিন্দি শব্দ বাংলায় কথা বলার সময় ব্যবহার করেন – সেগুলি সহজ না হলে, উপযুক্ত না হলে, মনের ভাব প্রকাশের জন্য সবচেয়ে সুন্দর প্রতিশব্দ মনে না হলে টিকবেনা। মানুষই ‘খারিজ’ করে দেবেন। আর যদি বাংলার চেয়ে সেই শব্দগুলিরই দাবি বেশি হয় কথার মানে বোঝানোর জন্য,, তাহলে একসময় সেগুলোও বাংলা হয়ে যাবে। যেমন অনেক শব্দ কে এখন আর্বি ফার্সি বা ইংরাজি উর্দু বলে চেনা যায়না। তাছাড়া ডিজিটাল এই যুগে এমন অনেক শব্দ নতুন করে ব্যবহার করতে হয় সবাইকে যেগুলির বাংলা প্রতিশব্দ বোধ হয় সৃষ্টি হয়নি। আর হলেও অরিজিনাল শব্দগুলিতেই ইতিমধ্যে সবাই স্বচ্ছন্দ। সেগুলি আসলে সমস্ত ভাষাভাষীর জন্যই সর্বজনীন শব্দাবলী।

এই প্রসঙ্গে এসে যায় আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কথাও। অর্থনীতি যেহেতু ভাষার চাইতে বেশি শক্তিশালী, তাই ভাষাকে সেকেন্ড বেঞ্চেই থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে যারা ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ান, তাঁরা আসলে না পড়িয়ে পারেননা। এই লিমিটেশনটা আমাদের মেনে নিতে হবে, স্বীকার করে নিতে হবে। শিক্ষানীতি এবং সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে সেইসব বিষয়। কিন্তু তাতেও আসলে বাংলাভাষার বিপদ সেরকম নয়। বরং ইংরাজি ভালো জানলে বাংলাও ভালো করে জানা যায় যদি অবহেলা না থাকে, উদাসীনতা না থাকে, যদি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি একটু ভালোবাসা থাকে। হৃদয়ে বাংলার জন্য সেই স্থানটি থাকলেই বাংলা ভাষার হারিয়ে যাওয়ার কোন ভয় নেই।


tarasankar.b@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ