রাহুল ঘোষ

পরাজিতদের গল্প / সপ্তম পর্ব / অপরাজেয়?
এতদিন রাবণের অপরাজেয় যোদ্ধা হয়ে ওঠার কাহিনি ও তার বাস্তবসম্মত আলোচনায় আমরা ছিলাম। পিতা বিশ্রবার কাছে কাছে শাস্ত্রশিক্ষা ও মাতামহ সুমালীর (মতান্তরে আত্মগোপনকারী অসুররাজ মহাবলীর) কাছে অস্ত্র ও রাজনীতি-শিক্ষার পরে তিনি আক্ষরিক অর্থেই অপরাজেয় হয়ে উঠেছেন। তাঁর খ্যাতি এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে, তাঁর সঙ্গে সরাসরি কোনো যুদ্ধে যাওয়ার আগেই দেবকুল রীতিমতো শঙ্কিত এবং তাঁকে কীভাবে আটকানো যায় তা নিয়ে ভয়ানক ভাবিত! দেবতাদের সমস্যা বেড়েছে আরও দুটি কারণে। একে তো রাবণ ব্রহ্মার প্রপৌত্র, তার উপরে আবার তিনি অসুর-পরম্পরা অক্ষুণ্ন রেখে দেবাদিদেব মহেশ্বরের একনিষ্ঠ ভক্ত। ফলে রাবণের কোনো ক্ষতি করতে গেলে এই দুই মহাশক্তি যে তাঁকে রক্ষা করবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

এখানে বলে রাখা ভালো, ব্রহ্মার কাছে অমরত্বের বর পাওয়ার জন্য রাবণের দীর্ঘ তপস্যার গল্পটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। মতভেদ আছে এমনকি তপস্যার সময়কাল নিয়েও। তবে যেটা নিয়ে কোনো মতভেদ নেই তা হলো, ব্রহ্মা রাবণকে অমরত্বের বর দিতে অসম্মত হলে অন্য একটি বরে এসে প্রপিতামহ ও প্রপৌত্রের মধ্যে রফা হয়। এই বর অনুযায়ী রাবণ সমস্ত দেব, দানব, রাক্ষস, যক্ষ, নাগ, গন্ধর্ব ও বন্যপশুর দ্বারা অবধ্য হলেন। লক্ষণীয় বিষয়, এখানে মানুষের কথা নেই! নেই বানরের কথাও। বন্যপশুর কথা থাকলেও কেন আলাদা করে বানরের কথা বললাম, সে-প্রসঙ্গে পরে আসবো। আপাতত মানুষের কথায় মনোনিবেশ করি। এক্ষেত্রেও দুটি ব্যাখ্যা চালু আছে। এক, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী রাবণ ভাবতেই পারেননি যে মানুষের মতো সাধারণ ক্ষমতার জীব তাঁর মতো মহাযোদ্ধাকে পরাজিত ও হত্যা করতে পারবে। দুই, বর চাওয়ার সময় তিনি মানুষের কথা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। প্রথম ব্যাখাটিই বেশি জনপ্রিয়, আর তা এই কারণে যে, বরের এই ফাঁকটি ব্যবহার করেই বিষ্ণু ভবিষ্যতে রাম হয়ে মানবজন্ম নেবেন, এবং রাবণকে পরাজিত ও হত্যা করবেন। 

এখন কথা হলো, ব্রহ্মা কেন রাবণকে অমরত্বের বর দিলেন না? রাবণ জ্ঞানী, বীর, সাহসী, মহাযোগী এবং দৃঢ়চেতা। এককথায়, এমন বর পাওয়ার জন্য সবদিক থেকেই যোগ্য। এই বিষয়ে সুলভ অগ্নিহোত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর ব্যাখ্যায়, ব্রহ্মা রাবণকে জানাচ্ছেন, কাউকে অমরত্বের বর দেওয়া প্রকৃতিবিরুদ্ধ একটা ব্যাপার। জন্মালে মরতেই হবে। এমনকি ব্রহ্মা নিজেও অমর নন, নিজের যোগলব্ধ ক্ষমতাবলে তাঁর জীবনকাল সাধারণের থেকে অনেক বেশি, এটুকুই যা! প্রসঙ্গত, দেবতার মানবায়নের এই প্রচেষ্টা মুক্তচিন্তার অনুশীলনের জন্য অত্যন্ত জরুরি, যা বাল্মীকি ও তাঁর অনুসারীদের ভাবনায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বাস্তবোচিত এই ব্যাখ্যাকে পাশে রেখে আমরা যদি ব্রহ্মার দেওয়া বরটির আলোচনায় ফিরে যাই, তাহলেও প্রশ্ন আসে, রাবণ না-হয় সাধারণ মানুষের ক্ষমতার প্রতি অশ্রদ্ধাবশত বা ভুলে গিয়ে মানুষেরও অবধ্য হওয়ার বর চাইতে ভুলে গেলেন, কিন্তু ব্রহ্মা তাঁকে মনে করালেন না কেন? এরকম ফাঁকে ভরা একটি বর, যা বৃহৎ অর্থে আদৌ কোনো বরই নয়, কেন দিলেন? তাহলে তিনিও কি, যতই রাবণ তাঁর প্রপৌত্র হোন, বিষ্ণুর জন্য ফাঁকটা রেখে দিলেন? রাবণই-বা কেন ফাঁকিটা ধরতে পারলেন না? এমনও তো হতে পারে যে, দীর্ঘ কঠোর তপস্যার পরে সাফল্যের উত্তেজনায় এই ফাঁকিটা তাঁর ভাবনাতেই আসেনি! যে-কোনো বিষয়ে খুব নিবেদিতপ্রাণ হলে, এমন হওয়ার সম্ভাবনা তো থাকেই!

আগেই বলেছি, রাবণ ঠিক কখন ব্রহ্মার বর পেলেন, তা নিয়ে মতভেদ আছে। একটা গল্পকে সত্যি মনে করে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে, যা হয় আর কী! ঠিক যেমন, রাবণের সঙ্গে তাঁর আরাধ্য মহেশ্বরের সাক্ষাৎ নিয়েও একটা গল্প আছে, এবং সেই সাক্ষাতের সময়কাল নিয়েও বিস্তর মতভেদ আছে। তবে সেই সাক্ষাতেই যে রাবণ তাঁর অসীম ভক্তির পুরষ্কার হিসেবে শিবের কাছে দৈব তরবারি 'চন্দ্রহাস' উপহার পান, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এই চন্দ্রহাস-ই ভবিষ্যতে অসুর-সাম্রাজ্য বিস্তারে রাবণের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠবে। মজার ব্যাপার হলো, এর প্রথাগত বর্ণনায় শিবের সঙ্গে রাবণের সংঘর্ষেরও একটি গল্প আছে। ব্যাপারটা হলো, আরাধ্য দেবতার সঙ্গে দেখা করতে রাবণ একদিন কৈলাসে পৌঁছলেন। কিন্তু শিব তখন পার্বতীর সঙ্গে নিভৃতে ছিলেন বলে তাঁর অন্যতম অনুচর নন্দীর কাছে রাবণ বাধাপ্রাপ্ত হলেন। এতে রেগে গিয়ে রাবণ নন্দীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে থাকেন, নন্দীর হাস্যকর চেহারা নিয়েও কটাক্ষ করেন। তখন নন্দী নাকি বলেন, এরকম হাস্যকর চেহারার বানরেরাই একদিন রাবণের পতনের অনুঘটক হবে। যাই হোক, গোলমাল শুনে মহাদেব বেরিয়ে আসেন এবং রাবণের ঔদ্ধত্যে ক্রুদ্ধ হয়ে রাবণকে শাস্তি দেন। তখন রাবণ তাঁর অনুপম সঙ্গীতপ্রতিভা দিয়ে শিবের স্তোত্র গেয়ে আরাধ্য দেবতাকে সন্তুষ্ট করে তাঁর আশীর্বাদ ও চন্দ্রহাস উপহার পান। প্রসঙ্গত, যুদ্ধবিদ্যা ও বেদ-উপনিষদে দক্ষতার মতো সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও রাবণের খ্যাতি প্রচলিত। শুধু তাই নয়, আরাধ্য দেবতার নামে 'শিবতাণ্ডব স্তোত্রম'-এর রচয়িতা রাবণকেই মানা হয়। তাঁর সঙ্গীতচর্চার প্রধান উপকরণ রুদ্রবীণাও তো মহেশ্বরেরই নামাঙ্কিত। তাছাড়া রাবণ তাঁর মাতৃকুলের প্রভাবে বড়ো হয়ে উঠেছেন, যেখানে শিবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এখন প্রশ্ন হলো, এহেন নিবেদিত উপাসক হয়েও রাবণ হঠাৎ আরাধ্যকেই চ্যালেঞ্জ করে বসলেন কেন? এর কোনো ব্যাখ্যাই কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? নাকি এই গল্পও দীর্ঘকালের অসুরবিরোধী প্রোপাগান্ডার অংশবিশেষ?

এবার আসা যাক, রাবণ সত্যিই কতটা অপরাজেয় ছিলেন, সেই প্রসঙ্গে। বলে রাখা ভালো, এখানেও সময়কাল নিয়ে বিস্তর মতবিরোধের মধ্যে দিয়েই আমাদের এগোতে হবে। যতই অপরাজেয় যোদ্ধার শিরোপা তাঁর মাথায় উঠুক না কেন, অন্তত দুটি সম্মুখ সমরে একের বিরুদ্ধে এক লড়াইয়ে রাবণ পরাজিত হয়েছিলেন বলে কথিত আছে । প্রথমটি মাহিষমতীর রাজা কার্তবীর্য অর্জুনের কাছে। তাঁর অন্যান্য নাম সহস্রার্জুন, সহস্রবাহু ইত্যাদি। কারণ, তাঁর নাকি হাজারটি হাত ছিল! অলৌকিক ব্যাখ্যাকে বেশি গুরুত্ব না-দিয়ে আমরা যদি বাস্তবসম্মত চিন্তা করি, তাহলে বুঝতে পারবো এই সহস্রবাহু আসলে প্রচণ্ড বলশালী এক ব্যক্তি, যাঁর শক্তি নাকি হাজারখানেক লোকের সমান! অনেকটা রাবণের দশ মাথা ও কুড়ি হাতের মতো ব্যাপার, আর কী! মাহিষমতী ছিল নর্মদা নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে, আজকের মধ্যপ্রদেশের কোনো জায়গায়। কাহিনি বলছে, সেই নর্মদার তীরেই মাটি দিয়ে শিবলিঙ্গ বানিয়ে রাবণ তাঁর আরাধ্য দেবতার উপাসনায় বসেছিলেন। ঠিক সেই সময়েই কাছাকাছি কোথাও কার্তবীর্য অর্জুন তাঁর অজস্র পত্নী-উপপত্নী নিয়ে জলকেলি করতে নেমেছিলেন নর্মদায়। এই বিপুল জলকেলির ফলে নদীতে তুমুল জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হলো, যার ঢেউয়ে কিছুদূরে উপাসনারত রাবণের শিবলিঙ্গ ধুয়ে চলে গেল। এতে ক্রুদ্ধ রাবণ সম্মুখসমরে আহ্বান করলেন অর্জুনকে এবং শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন।কার্তবীর্য রাবণকে হত্যা করলেন না বটে, তবে যা করলেন তা হত্যার চেয়ে অনেক বেশি অপমানজনক! রাবণকে বন্যজন্তুর মতো খাঁচায় বন্দি করে মাহিষমতী নগরে বাসিন্দাদের দর্শনের জন্য রাখা হলো। তবে রাবণের পিতামহ পুলস্ত্য ছিলেন কার্তবীর্যের বিশেষ শ্রদ্ধেয়। পুলস্ত্যের অনুরোধে তিনি তাই রাবণকে মুক্তি দিলেন, এবং কোনো-কোনো ব্যাখ্যা অনুযায়ী রাবণের সঙ্গে বন্ধুত্বও স্থাপন করলেন। এখানে আমরা ধরেই নিতে পারি যে, এই পরাজয় নির্ঘাত রাবণকে ব্রহ্মার বর পাওয়ার পরেই হজম করতে হয়েছিল। কারণ, রাবণ যদি জানতেন যে মানুষের মধ্যেও এরকম শক্তিশালী কেউ থাকতে পারে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তিনি মানুষের কাছে অবধ্য হওয়ার বর চাইতে ভুলতেন না! 

সম্মুখসমরে রাবণের দ্বিতীয় পরাজয় কিষ্কিন্ধার বানররাজ বালীর কাছে। আজকের কর্নাটকের কোপ্পাল জেলায় হাম্পির কাছাকাছি তুঙ্গভদ্রা নদীর আশপাশে কিষ্কিন্ধা ছিল বলে মনে করা হয়। মল্লযুদ্ধে এবং গদাযুদ্ধে বালী অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। কিংবদন্তি আছে যে বালী যার সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতেন, তার শক্তির অর্ধেকও নাকি বালীর পরাক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতো! ফলে কেউই আর বালীর বিরুদ্ধে জিততে পারতেন না। স্বাভাবিকভাবেই রাবণও পরাজিত হলেন। তবে তাঁর শৌর্যে মুগ্ধ হয়ে বালী রাবণের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করলেন। এই বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু বালীর প্রসঙ্গ এখানেই শেষ নয়, পরাজিতদের গল্পে তাঁর কথায় আমাদের আবার ফিরে আসতে হবে। যাই হোক, এখানেও রাবণের অপরাজেয় আখ্যা ধাক্কা খেল। আমাদের মনে হতেই পারে, তাহলে ব্রহ্মার বরে তো আদৌ কোনো কাজ হলো না! অলৌকিকে বিশ্বাসীরা অবশ্য এক্ষেত্রে বলবেন, ব্রহ্মার বরে বানরের বিরুদ্ধে অপরাজিত থাকার কথা ছিল না। তাছাড়া বরটি ছিল অবধ্য হওয়ার, অপরাজিত থাকার নয়।

এখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগবে, তাহলে রাবণকে কেন অপরাজেয় যোদ্ধা বলা হবে? কীভাবেই-বা তিনি ত্রিলোকবিজয়ী হলেন? ত্রিলোক মানে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল; যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যায় যাকে বলা যায় উচ্চভূমি, সমতল বা লোকবসতিপূর্ণ অঞ্চল এবং জনবিরল অঞ্চল। রাবণ প্রথম বড়ো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন লঙ্কা দখল করার জন্য। আনন্দ নীলকন্ঠন জানিয়েছেন, মহাবলীর অনুগামীদের একটা বিরাট অংশ রাবণের বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। মাতামহ সুমালীর অনুগতদের তো তিনি উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন।অন্যান্য প্রজাতির অসুরেরাও রাবণের বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। লঙ্কার সাধারণ প্রজাদের মধ্যেও রাবণকে নিয়ে উচ্ছ্বাস ছিল। ফলে, তাদেরও কেউ-কেউ রাবণের বাহিনীতে যোগ দিয়ে থাকতে পারে। সম্মিলিত এই অসুরবাহিনীর শক্তিতে ভয় পেয়েই কুবের রাবণের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধে গেলেন না। পরাজয় মেনে নিয়ে লঙ্কা থেকে নিজের সামান্য কিছু অনুগামীদের নিয়ে চলে গেলেন। বিনা রক্তপাতে প্রথম জয় এল। অসুরদের হৃত সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র লঙ্কা তাদের দখলে ফিরে এল। কিন্তু রাবণ এখানেই থামলেন না। তথাকথিত দেবতাদের পরাজিত ও বিতাড়িত করার দিকে তখন তাঁর অপার আগ্রহ। এর ফলেই তিনি দেবরাজ ইন্দ্রের অধীন দেবলোক ও মৃত্যু তথা ধর্মদেবতা যমের অধীন পাতাললোক আক্রমণ করলেন। দুটি যুদ্ধেই তিনি জয়ী হলেন। কাহিনি বলছে, এরপরে প্রপিতামহ ব্রহ্মার অনুরোধে তিনি উভয়কেই সিংহাসন ফিরিয়ে দেন। ত্রিলোক সরাসরি রাবণের দখলে রইলো না বটে, তবে ত্রিলোকের গায়ে তাঁর চিরকালীন ছাপ পড়ে গেল। 


rahulbabin1@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ