"এক কাগজওয়ালা
ও মৃত স্বপ্নেরা "
"কিছু কিছু পুরনোকে জড়িয়ে থাকার মধ্যে একটা নিবিড় প্রশান্তি থাকে।" আজকের এই স্মার্ট জমানায় পুরনো ট্রানজিস্টার রেডিয়োটা নিয়ে বন্ধু মহলের মশকরার জবাবে এটাই বলেন রিটায়ার্ড আর্মি ফারহান। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই রেডিয়োটা একহাতে অন্যহাতে জমানো পচা চাপাতার জারটা নিয়ে ছাদে চলে এলেন রায়হান। উদ্দেশ্য টবের ফুলগাছগুলোর গোড়া নরম করে তাতে দেবেন। রেডিয়োটা অন করতেই ভেসে এলো ''আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই...''একুশে ফেব্রুয়ারীর সকালটা ভরে গেলো এক অদ্ভুত ভালোলাগায়। খুরপি দিয়ে টবের মাটি আলগা করতে করতে আনমনা হয়ে পড়েন তিনি। মনে ভেসে ওঠে কিশোরবেলার কতো স্মৃতি। প্রতিবার এই দিনটিতে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে সবাই স্কুল মাঠে জড়ো হওয়া তারপর ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে মাইক বেঁধে চলতো একুশের প্রভাতফেরী। ধূপের গন্ধে, একুশের গানে কবিতায় সে এক স্বর্গীয় সকাল। তারপর একদিন সবকিছু ছেড়ে দেশের টানে, কিছুটা বা পেটের টানে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া। মাঝখানের ওই বছরগুলোয় একুশ আসতো তবে নিঃশব্দ পদচারে। তখন হয়তো কোন এক সেনা ছাউনিতে শত্রুপক্ষের আক্রমণের শঙ্কিত অপেক্ষায় থেকেছেন আর মনে মনে স্মরণ করেছেন দুখিনি বর্ণমালাকে।
রিটায়ারমেন্টের পর গ্রামের বাড়িটাকেই সুন্দর করে সাজিয়ে পাকাপোক্তভাবে বসত। অবসর সময়ের জন্য বেছে নিলেন সকালে ফুলবাগান আর কিচেন গার্ডেনের পরিচর্যা, কয়েকটি খবরের কাগজ আদ্যোপান্ত পড়া, দুপুরে গ্রামের কিছু ছেলেকে বিনি খরচায় পড়ানো আর সন্ধেটা নিজের হাতে জমানো বইএর লাইব্রেরীতে কাটানো।গান শোনা আর লেখালেখির নেশাটাও তাকে সঙ্গ দেয় ভীষণরকম। মাঝে মাঝে যে এ রুটিনের হেরফের হতোনা তা নয়। কোন কোন দিন বন্ধুরা চলে আসেন, জমাটি আড্ডা হয় সাহিত্য সঙ্গীত এসব নিয়ে। রাজনীতি বিষয়টাকে বরাবরই তিনি অপছন্দ করতেন। তাই ও প্রসঙ্গ এলে সযত্নে এড়িয়ে যেতেন।
স্কুলের নাম 'ভোরের আকাশ'। স্কুল বলতে গ্রামেরই হতদরিদ্র জনাচল্লিশেক ছেলেমেয়ে।তাদের পড়ানোর বাঁধাধরা কোনো বিষয় নেই। ছেলেমেয়েগুলোকে জীবন ও সময়োপযোগী করে তোলাই এই স্কুলের লক্ষ্য। তাই পড়াশোনার সাথে সাথে শরীরচর্চা, মাতৃভাষার প্রতি, দেশের প্রতি দায়িত্বশীলতা,লিঙ্গ সাম্য জাগিয়ে তোলাএসব সম্পর্কে সচেতন করা শ্রমের মর্যাদা দেয়া, কোন কাজই যে ছোট নয়। সেই বোধ জাগানো আর একটু বড়ো হলে স্থানীয় উপকরণ সহযোগে কোন হাতের কাজ বানিয়ে তা থেকে রোজগারের পথ খোঁজা। ব্যাঙ্ক,পোষ্ট অফিস, হাসপাতাল এসব জায়গায় মাসে একদিন নিয়ে যাওয়া।এসবের পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের নিজের হাতে সবজি চাষ করতে শেখানো সবই হয় 'ভোরের আকাশে'। দুপুরে সামান্য খিচুড়ি, কোনদিন সবজি ভাতের আয়োজন থাকে।ছেলেমেয়েরা তাই খেয়ে মহানন্দে পড়াশোনা করে এখানে।
এই 'ভোরের আকাশে'ই একদিন ফারহান খুঁজে পেলেন এক শুকতারাকে। তার বাড়িতে পেপার দিয়ে যায় যে লোকটি ওরই ছেলে। নাম অঙ্কিত শর্মা। বয়স তখন কতো হবে, সাত কি আট। একুশে ফেব্রুয়ারীর সকালে প্রভাতফেরী থেকে ফিরে সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফারহান মাতৃভাষার গুরুত্বের কথা, ভাষা আন্দোলনের কথা বলছিলেন। অঙ্কিত শুনছিলো নিবিষ্ট মনে। শুধু শুনছিলো না যেন শিরায় শিরায় অনুভব করছিলো ফারহানের কথাগুলিকে।সেদিনের সেই ছোট্ট অঙ্কিত পড়াশোনায় যেমন তুখোড়, খেলাধূলা গানবাজনা সবেতেই দুর্দান্ত। আর খুব সহজেই ওর সুন্দর স্বভাবের দ্বারা ফারহানের খুব কাছের হয়ে উঠলো।
গতবছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর অঙ্কিত সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। অনেক আশা আর আশঙ্কা বুকে নিয়ে যাবার সময় চোখের কোণে একইসাথে ঝিলিক দিয়ে উঠেছিলো বাবার কাঁধে কাঁধ দিয়ে দাঁড়ানোর মতো হওয়ার আনন্দ আর সবকিছু ছেড়ে নিশ্চয়তাহীন জীবনের পথে পা বাড়ানোর আশঙ্কা। প্রথম পোষ্টিং কাশ্মীর সীমান্ত। তিনমাস হলো কাশ্মীরে আছে।
টবের মাটি আলগা করতে গিয়ে অন্যমনস্কতাবশত বাঁহাতের বুড়ো আঙুলটায় কেটে গেল বেশ খানিকটা খুরপি দিয়ে। নীচে এসে হাতটা ধুয়ে ব্যান্ড এইড লাগিয়ে বারান্দায় ইজি চেয়ারটায় এসে বসলেন ফারহান। মনটা থেকে থেকেই বিমনা হয়ে যাচ্ছে। কোন কার্যকারণ সূত্র খুঁজে পাচ্ছেন না। আবার অস্বস্তিটাকে তাড়াতেও পারছেন না। থেকে থেকে অঙ্কিতের মুখটা মনে পড়ছে। মনে মনে ঠিক করলেন আজ একবার যোগাযোগের চেষ্টা করবেন। ছেলেটা তার নিজের অজান্তেই সন্তানের জায়গা করে নিয়েছে কিভাবে যে বুঝতেই পারেন নি।
খবরের কাগজে, টিভিতে শোনা যাচ্ছে সীমান্তে অস্থিরতার কথা। মাঝে মাঝে বড় হতাশ লাগে ফারহানের। এই দুই দেশ কোনদিন আন্তরিকভাবে সীমান্ত সমস্যা মেটাতে তৎপর হয়নি বলেই যুগ যুগ ধরে তরতাজা ছেলেগুলোকে এভাবে জীবন দিতে হচ্ছে। রাজনীতি নিয়ে মাথা না ঘামালেও এটা অন্তত সাদা চোখেই ধরা পড়ে সদিচ্ছা থাকলে এই সমস্যা কোন সমস্যা নয়। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে এটাকে জিইয়ে রেখে দেয়া হয়েছে। যাক গে, এসব জাহাজের খবরে তার মতো আদার ব্যাপারীর মাথা না ঘামালেও চলবে। ভেবে মন থেকে অস্বস্তিটা তাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। ঠিক তখনই রামানুজ অর্থাৎ অঙ্কিতের বাবা তার লজঝরে সাইকেল খানা নিয়ে খবরের কাগজগুলো হন্তদন্ত হয়ে দিয়ে সাইকেলে প্যাডেলে পা রাখলো। এখন ও অনেক বাড়িতে খবরের কাগজ দেয়া বাকি তার।
সকাল থেকে ছেলেটার জন্য মনটা বড় উচাটন হয়ে আছে রামানুজের। শরীরটা কিছুতেই টানছেনা। তবু কাগজগুলো বিলি না করলে লোকের কাছে কথা শুনতে হবে ভেবে ক্লান্ত হাতে সাইকেলটা টেনে নিয়ে এজেন্টের বাড়ি থেকে পেপারগুলো নিয়ে চলতে লাগলো। অন্যদিন খবরবিলি করতে করতে সবার কুশল মঙ্গল জানতে চায়। আজ আর মন চাইলো না। সবার বাড়ি বাড়ি কাগজকটা দিয়েই বাড়ি গিয়ে একবার ফোন করবে ছেলেকে। অঙ্কিত যদিও বারবার বলে দিয়েছে কাজটা ছেড়ে দিতে। রামানুজ নিজেই দেয়নি। কি করবে ঘরে বসে থেকে? তারচেয়ে সকাল সকাল সাইকেল চালালে শরীরটাও ভালো থাকে। গ্রামের লোকজনের সাথে দুটো ভালোমন্দ কথাও হয়। দুটো পয়সাও ঘরে আসে। ছেলেরওতো নতুন চাকরী।
আনন্দবাজারটা খুলেই প্রথম পাতায় চোখ আটকে গেল ফারহানের। 'সীমান্তে জঙ্গী হানা, নিহত চল্লিশ জওয়ান।" তড়িঘড়ি পড়তে লাগলেন 'এ পর্যন্ত যাদের চিহ্নিত করা গেছে তাদের নামের তালিকা খুঁজতে গিয়ে চোখ আটকে গেল সতেরো নম্বরে সর্বকনিষ্ঠ জওয়ান অঙ্কিত শর্মা।.....আর পড়তে পারলেন না। হাতথেকে খসে পড়লো কাগজটা। প্রাণপণে নিজেকে সামলে চিৎকার করে ডাকতে গেলেন রামানুজকে। পারলেন না। গলার কাছে থমকে গেল স্বর।কি বলবেন তিনি রামানুজকে! কিভাবে বলবেন। খানিকক্ষণ স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে হাত নেড়ে ডাকতে গেলেন বারবার। ওদিকে রামানুজ ও হাত নেড়ে বোঝাতে চাইছে কিছু একটা। কাগজ কটা বিলি করেই আসার কথাই হয়তো বলতে চাইছে। লোকটা জানতেই পারলোনা এইই যে ঘরে ঘরে খবরের কাগজ নিয়ে ছুটে যাচ্ছে তার প্রথম পাতায় তারই আত্মজের ছিন্নভিন্ন শরীরের ছবি!
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন