ভাষার কথায় মনে এলো এক প্রিয়জনের কথা। সে যা বলেছিলো হুবহু মনে নেই তবে অনেকটা এরকম __ ভাষা দুরকমের, এক, যে ভাষায় আমরা কথা বলি। অর্থাৎ ধ্বনি, অক্ষর, শব্দে, বাক্যে মনের ভাবপ্রকাশ করে পারস্পরিক ভাববিনিময় করি। এটি হলো জৈবিক ভাষা। আরো একটি ভাষা আছে, তা হলো অনুভবের ভাষা। যে ভাষায় শব্দ নয়, বাক্য নয় শুধু অনুভব আর উপলব্ধি দিয়ে পড়ে নেয়া উল্টোদিকে থাকা মানুষটির আবেগ অনুভূতি মন ও মনন। হোক না তা ভৌগোলিক সীমারেখা নিরপেক্ষ। এ ভাষা আত্মার ভাষা। যার মাধ্যমে গড়ে ওঠে আত্মিক যোগ।
আজ মাতৃভাষা দিবস। দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে যা আন্তর্জাতিকতায় উন্নীত হয়েছে। 'একুশে ফেব্রুয়ারী' মানে একটা রক্তরাঙানো ইতিহাস। পৃথিবীর মানচিত্রে ভাষাভিত্তিক দেশগঠনের অবিসংবাদিত ইতিহাস। সালাম, জব্বার, বরকত, রফিকের সাথে আরো অজস্র অনুচ্চারিত নামের রক্তের মূল্যে প্রতিষ্ঠা যে ভাষার, বরাকের মাটিতে যে ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন আরো এগারো জন।কানাইলাল, চন্ডীচরণ, হিতেন, সত্যেন্দ্র, কুমুদ, সুনীল, তরণী, সুকোমল, শচীন্দ্র, বীরেন্দ্র, কমলা প্রমূখ।(এই ইতিহাসটা আমাদের অনেকেরই জানা, তাই আর নতুন করে চর্বিতচর্বনে গেলাম না) তাদের রক্তের দাগ লেগে আছে যে স্বাধীন বর্ণমালার গায়ে। তার প্রতি আমরা কতোখানি দায়বদ্ধ? কতোখানি শুদ্ধতা রেখেছি সে ভাষার! আজকের এই কলোনিয়াল সংস্কৃতির যুগে সে প্রশ্ন কিন্তু খুবই প্রাসঙ্গিক। আমরা বাঙালিরা (বাংলাভাষায় যারা কথা বলি) এমনিতেই আবেগপ্রবণ। আর এই সহজাত আবেগপ্রবণতা থেকেই ফেব্রুয়ারী এলেই ভাষা নিয়ে এক দুর্দমনীয় উন্মাদনায় মেতে উঠি। আর কদিন বাদেই সহজাতভাবেই অন্যকোন অজুহাতে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখি মাতৃভাষার প্রতি যাবতীয় আবেগ। দায় ও দায়িত্বের কথা ছেড়েই দিলাম। আমাদের মাতৃভাষার দৈন্যদশা নিয়ে একদল শোকে মুহ্যমান হবেন আবার অন্যদল এর উৎকর্ষতার চরম শিখরে ওঠার স্টাটিসটিক্স দিতে ব্যস্ত হয়ে গুগল সার্চ করে হাতেগরম তথ্য পেশ করবেন। কিন্তু যে কথাটা আমরা জেনেও না জানার, বুঝেও না বোঝার ভান করছি তা হলো বিশ্বের চতুর্থতম প্রাণবন্ত ভাষা, তিরিশ কোটি মানুষের কথা বলার বাংলাভাষা কিন্তু আজ কলোনিয়ালিজমের দূষণে দুষ্ট। একথা অনস্বীকার্য যে, যে কোন চলমান ভাষা অন্য ভাষা থেকে শব্দ নিয়ে নিজের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করবে। এটা দোষণীয় নয়। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবেনা যে নিজস্বতাকে যেন তা কোনভাবে খর্ব না করে।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে, যেখানে সোশাল মিডিয়া (প্রিন্ট ইলেক্ট্রনিক উভয়তই) আমাদের ভাষা সংস্কৃতিচর্চার এক অবিকল্প মাধ্যম। সেখানে বাংলাভাষার প্রয়োগ দেখলে শিউরে উঠতে হয় বইকি! এক তো ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা তায় গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বাংলা ইংরেজী হিন্দীর মিশেলে ককটেল ভাষা শুনলে মনে হয় এ কোন অদ্ভুত আঁধার! এইজন্যই কি প্রাণ দিয়েছিলেন ভাষাশহীদগণ? ইংরেজী মাধ্যম স্কুল ছাড়া সন্তানদের 'মানুষ' করার কথা আমরা ভাবতেও পারিনা।বাংলা স্কুলে পড়লে সমাজে সে কথা উচ্চারণ করতে জিভ আড়ষ্ট হয় আমাদের। আবার আমরাই ভাষাদিবসের বক্তৃতামঞ্চে বাংলাভাষার জাত গেল বলে রব তুলি। সত্যি বলছি এরকম দ্বিচারী জাত বোধহয় পৃথিবীতে আর দুটো নেই। মানছি বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে ইংরেজী, শেখাটা জরুরী। তবে শুধু ইংরেজি কেন, যে কোন ভাষা শেখাই একজন মানুষের মানসিক বিস্তৃতির সোপান। তবে তা মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা, উপেক্ষা করে বা বিসর্জন দিয়ে নয়। অথচ আমাদের এবং যতোটুকু জেনেছি ওপার বাংলার বিষয়ে (মিডিয়া থেকে) তাতে সর্বত্র ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে বাংলাভাষা ভীষণভাবে ব্রাত্য। এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন অনেক মানুষকে চিনি যিনি বাংলাভাষায় সাহিত্যচর্চা তথা লেখালেখি করছেন অথচ সন্তানের সাথে বাড়িতে বাংলায় নয়, কথা বলছেন ইংরেজিতে। কারণ স্কুল বলে দিয়েছে স্কুলে ইংরেজি ছাড়া অন্যভাষায় কথা বললে 'ফাইন' দিতে হবে। তাই বাড়িতে কথা বললে অভ্যাসবশত বাচ্চা যদি ভুল করে স্কুলে বাংলা বলে ফ্যালে!তাহলে তো জাত যাবে!! এই হলো আমাদের মাতৃদুগ্ধস্বরূপ মাতৃভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা। এর শুদ্ধতা, এর পবিত্রতা রক্ষার নৈতিক কর্তব্যবোধের নমূনা।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে, যেখানে সোশাল মিডিয়া (প্রিন্ট ইলেক্ট্রনিক উভয়তই) আমাদের ভাষা সংস্কৃতিচর্চার এক অবিকল্প মাধ্যম। সেখানে বাংলাভাষার প্রয়োগ দেখলে শিউরে উঠতে হয় বইকি! এক তো ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা তায় গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বাংলা ইংরেজী হিন্দীর মিশেলে ককটেল ভাষা শুনলে মনে হয় এ কোন অদ্ভুত আঁধার! এইজন্যই কি প্রাণ দিয়েছিলেন ভাষাশহীদগণ? ইংরেজী মাধ্যম স্কুল ছাড়া সন্তানদের 'মানুষ' করার কথা আমরা ভাবতেও পারিনা।বাংলা স্কুলে পড়লে সমাজে সে কথা উচ্চারণ করতে জিভ আড়ষ্ট হয় আমাদের। আবার আমরাই ভাষাদিবসের বক্তৃতামঞ্চে বাংলাভাষার জাত গেল বলে রব তুলি। সত্যি বলছি এরকম দ্বিচারী জাত বোধহয় পৃথিবীতে আর দুটো নেই। মানছি বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে ইংরেজী, শেখাটা জরুরী। তবে শুধু ইংরেজি কেন, যে কোন ভাষা শেখাই একজন মানুষের মানসিক বিস্তৃতির সোপান। তবে তা মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা, উপেক্ষা করে বা বিসর্জন দিয়ে নয়। অথচ আমাদের এবং যতোটুকু জেনেছি ওপার বাংলার বিষয়ে (মিডিয়া থেকে) তাতে সর্বত্র ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে বাংলাভাষা ভীষণভাবে ব্রাত্য। এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন অনেক মানুষকে চিনি যিনি বাংলাভাষায় সাহিত্যচর্চা তথা লেখালেখি করছেন অথচ সন্তানের সাথে বাড়িতে বাংলায় নয়, কথা বলছেন ইংরেজিতে। কারণ স্কুল বলে দিয়েছে স্কুলে ইংরেজি ছাড়া অন্যভাষায় কথা বললে 'ফাইন' দিতে হবে। তাই বাড়িতে কথা বললে অভ্যাসবশত বাচ্চা যদি ভুল করে স্কুলে বাংলা বলে ফ্যালে!তাহলে তো জাত যাবে!! এই হলো আমাদের মাতৃদুগ্ধস্বরূপ মাতৃভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা। এর শুদ্ধতা, এর পবিত্রতা রক্ষার নৈতিক কর্তব্যবোধের নমূনা।
আবার পাশাপাশি লেখক কবির সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুণ। বাংলাভাষায় লেখা সাহিত্য অনুদিত হচ্ছে বহুভাষায় এটাও বিরাট প্রাপ্তি আমাদের। একথা অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই বাংলাভাষা প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অনেকটাই বলিষ্ঠতা অর্জন করেছে।কিন্তু শুধু লেখ্য সাহিত্যের বিচারে কোন ভাষার প্রাণবন্ততা নির্ভরশীল নয়। ভাষা জীবন্ত থাকে যাপনের প্রকাশে অর্থাৎ কথনে, আর এই ডিজিটাল যুগে মেসেজ, কমেন্ট, এসবের আঙ্গিকে। সেই কথ্যভাষাই আজ সবচেয়ে দুষিত।বাসে ট্রেনে, শপিংমলে, জমায়েতে, বর্তমান প্রজন্মের মুখের ভাষায়, তার টিউনিং এ প্রতিমুহূর্তে বিপন্ন মাতৃভাষার গোপন আর্তনাদ শুনতে পাওয়া যায়। এ যেন উৎকর্ষতা আর অবনমনের এক যুগপৎ প্রক্রিয়া চলছে।
এভাবেই প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারী আসবে।ভাষা দিবসের মঞ্চজুড়ে আলোচিত হবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। উচ্চারিত হবে "আমার ভাইএর রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী। আমি কি তোমায় ভুলতে পারি?" একুশের গানে কবিতায় মুখরিত হবে বাংলাদেশের আনাচকানাচ। এপার বাংলার অলিগলি। তরজা হবে বাংলাভাষার ভুত ভবিষ্যৎ নিয়ে।তারপর সময়ান্তে নিজস্ব নির্মোক খুলে পরে নেবো কলোনিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজের উদ্ভুতুড়ে লেবাজ। তবু এটাই বা কম কি এই একটি মাসজুড়ে যদি বাংলাভাষা আমাদের রক্তের ভেতরে, বোধের ভেতরে ক্রমাগত চাগিয়ে যায় শাশ্বত শিকড়। যদি নাড়িয়ে দেয় আমাদের মনোভুমি নতুন করে। নবীকৃত করে আমাদের ভাষার প্রতি ভালোবাসাকে। আর আবারো আমরা প্রভাতফেরীর ভোরে গেয়ে উঠি "আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই। আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই।"
anishakrk333@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন