জয়া চৌধুরী

আজাইর‍্যা বাজার কথন ১৪ / জয়া উবাচ

গায়ত্রী স্পিভাকের নাম কে না জানেন বিদ্বজনেরা! সেদিন রোটারি সদনে আকস্মিক একটি নিমন্ত্রণ পেয়ে গেলাম ওঁর বক্তৃতা শোনার। “চিন্তার দুর্দশা” ছিল সেদিনের বক্তৃতার শিরোনাম। আধুনিক পৃথিবীতে চিন্তার দৈন্য সমস্যাটি নিয়ে বহু দার্শনিকই চিন্তিত। আজ থেকে একশ / দেড়শ বছর আগের পৃথিবীটা নিদেন পক্ষে ভারতের কথা মনে করুন। লোকসংখ্যা কত কম! অথচ সে সময়েই স্বামীজির লেখার ছত্রে ছত্রে মানুষের না খেতে পাওয়ার কষ্টের কথা পাওয়া যায়। ভারতের মানুষের মুখে অন্নের জোগানের চিন্তায় কী নিদারুণ আত্মক্ষয়
করেই না তিনি চেষ্টা করেছিলেন।

তেমনটি আরো অনেক মহাপুরুষই চেষ্টা করেছেন। আপাতভাবে দেখলে আজকের ভারতে খাদ্যের অভাব হয়ত সেদিনের মত নয়। জানি জানি এক্ষুনি পাঠক বলে উঠবেন – বাজে কথা । এই মুহূর্তে ভারতের ৬০ কোটির বেশি জনসংখ্যা দারিদ্র্য সীমার নিচে বা আশেপাশে। ৬০ কোটি!!! পৃথিবীতে কটা দেশের সম্পূর্ণ জনসংখ্যা এর ধারে কাছে? তবু যদি জনসংখ্যা ও খাদ্যের যোগানের একটা তুলনামূলক সমীক্ষা করা যেত তবে হয়ত বোঝা যেত গরীব আগের চেয়ে গরীবে হলেও, অন্ততঃ মধ্যবিত্তের খাবারের যোগান আগের চাইতে বেশিই এখন। ধনীদের প্রসঙ্গ আলোচনার মানে নেই এখানে। কেননা সব যুগেই চিন্তার ভার মধ্যবিত্তেরাই মূলত নেয়। ধনীদের নিজেদের ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের আগ্রহই থাকে মূখ্য আর গরীবের অন্নাভাবে চিন্তা করার সময় থাকে না এসব নিয়ে। তো দার্শনিক স্পিভাক সেই চিন্তার দুর্দশা নিয়েই চিন্তিত। বক্তব্য এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব মিলিয়ে প্রায় ঘন্টা দেড়েক সময়ে কতভাবেই না তিনি তুলে ধরলেন তাঁর চিন্তার কথা। তাঁর সবচেয়ে প্রথম উদবেগ ছিল Ethics শব্দটির অর্থ নেই। দৃঢ় গলায় তিনি শব্দটির প্রচলিত অর্থ “নীতি” কে মেনে নিতে অস্বীকার করলেন। তাঁর মতে Ethics শব্দটি সীমায়িত কোনো অর্থ হতে পারে না। এক্ষেত্রে তিনি বেছে নিলেন তন্ত্র শাস্ত্রে প্রচলিত শব্দ “পরাশক্তি” ও “অপরাশক্তি” শব্দের ভেতরে দ্বিতীয়টি। পরাশক্তি তবু সংজ্ঞায়িত করেছেন বিদ্বানেরা। কিন্তু অপরাশক্তি শব্দটির মধ্যেই এক অব্যাখ্যাত অঞ্চল থাকছে যেটি আসলে মানুষের স্বামী বিবেকানন্দ বর্ণিত “অসীম” সম্ভাবনার কথাই মনে করিয়ে দেয়। একজন মানুষের ethics এর পরিধি বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে অসীম হতে পারে। কিংবা অনন্ত কোনো শুভবোধ Ethics কে পরিচালিত করতে পারে বলে তিনি মনে করেন। আর একারণেই Ethics এর বাংলা অর্থ হিসেবে অপরাশক্তিকে মেনে নিতে তাঁর আপত্তি নেই।

এখন মানুষ বড় অসহিষ্ণু ও আত্ম কেন্দ্রিক। নিজেকে চিন্তার কেন্দ্রে রাখতে এমনিতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয় কিন্তু ‘নিজেই’ যদি ভাবনার সর্বশেষ গন্তব্য হয় তাহলে চিন্তার বইকি! এখনকার ভারতে কেউ কারো কথা ভাবা তো দূরস্থান শুনতে পর্যন্ত আগ্রহী নয়। সাম্প্রদায়িক হিংসা যেভাবে দেখা যাচ্ছে, লিঞ্চিং মানে গণধোলাই যেভাবে সাধারণ ঘটনায় পর্যবসিত হচ্ছে সেরকমটি আগে কখনও দেখা যায় নি। “আমি” যা ভাবছি, বলছি, খাচ্ছি, পরছি, শুনছি সব সব কিছুই শেষ কথা। আমার দুনিয়ায় আমি ছাড়া কেউ নেই। এত অনুদার ভারত তো আমাদের ভারত নয়। কত হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার দেশ আমাদের । এভাবে “আমি” বোধ কখনও চাগাড় দেয় নি গণ মানসে। কথা প্রসঙ্গে তিনি দুজন মনীষীর কথা তুলে ধরলেন। একজন রবীন্দ্রনাথ আর অন্যজন সারদামণি চট্টোপাধ্যায়। এই অপরাশক্তি র লক্ষণ হল কোনো মানুষ যখন নিজের চিন্তার সম্পূর্ণ বিপরীত একটি চিন্তাকে একই রকম সম্মান ও আদর দিতে পারে। মা সারদা যখন বললেন- “আমি সতেরও মা অসতেরও মা”, তখনই তিনি ব্যক্তি জননীর সীমাবদ্ধতা ছেড়ে বিশ্বজননীর মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে গেলেন।

সৎকে ভালবাসা তো সহজ, কিন্তু অসৎএর বেদনায়ও সমান দুঃখ পাওয়ার জন্য তাকে আশ্রয় দেবার জন্য যে অনন্ত সাগরের মত উদার মন প্রয়োজন এখনকার মানুষের মনে সেই উদারতা আনতে হবে। অন্তত আনার চেষ্টা করতে হবে মানুষকেই। সারদা মা নিজের জীবনে সেই সমদর্শী হওয়ার অভ্যাস করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভাবনাও কিন্তু সেই বিপরীত মতকে শ্রদ্ধা জানানোরই ভাবনা। গায়ত্রী স্পিভাক ফরাসী দার্শনিকের উদ্ধৃতি বলে কিংবা পুরুলিয়ার গ্রামের এক শিক্ষকের সাক্ষাৎকারের স্লাইড শো দেখিয়ে বারবার বোঝাতে চাইলেন এখনকার ভারতে গন্ডিবদ্ধ চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা কতটা জরুরী। শ্রীমতী স্পিভাক তো শুধু খাতায় কলমে দর্শন চর্চা করেন না তিনি সমাজসেবা মূলক বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন তত্ত্বের ফলিত প্রয়োগ করার জন্যই। বাংলার ঘরে ঘরে জাতপাতের কী অসম্ভব শিকড় চারানো সেকথা বলতে গিয়ে তাঁর মত তীক্ষ্ণ মেধাবিনীরও কন্ঠ নরম হয়ে আসে। একটি স্কুল করেছেন তিনি প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানকার এক মাধ্যমিক পাশ বাড়ির বউকে গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর কাজে নিয়োগ করেছেন। তবু তুলনামূলক আলোকপ্রাপ্ত মেয়েটি নিজেই তথাকথিত নিচু জাতের ঘরের মেয়ে, তবু সেও গ্রামের আরো নিচু জাতের ছেলেকে পড়াতে পারছেনা, কিছুতেই সে জাত পাতের সীমাবদ্ধত্তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। সুতরাং স্কুল কলেজে শিক্ষা দেওয়া মানে অক্ষর চেনানো আর নম্বর পাওয়াই যে শিক্ষা নয় সে বাস্তব তুলে ধরছেন তিনি। আসলে মনের শিক্ষা জরুরী। মনের ঔদার্য আসা সম্ভব সেই প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই। শ্রীমতি চক্রবর্তী নিজেকে ঈশ্বর বিশ্বাসী বলতে রাজি নন। যদিও তাঁর বাবা যে স্বয়ং সারদামণির কাছে দীক্ষা পেয়েছিলেন সেকথা উল্লেখও করেন গর্বের সঙ্গে। এ মনোভঙ্গীকেও আমি বলব নিজের চিন্তার বিপরীত ধারাটিকেও সমান সম্মান জানানোর দৃষ্টান্ত। 

এখনকার ভারতে গৌরী লঙ্কেশ, কালবুরগি, পানেসর এর মত চিন্তকদের যখন নিহত হতে হচ্ছে আচমকা তখনই দেখতে পাছি প্রাচীন ভারতের ঔদার্য যেন ভুলে যাচ্ছে সমাজ। তাঁদের হত্যা করা মানে তো শুধু ব্যক্তিটির প্রাণ নেওয়া নয়, সেই সঙ্গে মানুষগুলির দর্শনটিরও গলা টিপে দেওয়া। এ ভারত আমাদের ভারত নয়, চেনা ভারত নয়। দার্শনিকের সেই সন্ধ্যার বক্তৃতায় বারবার ঝরে পড়ছিল সেই দুশ্চিন্তার কথা। আর ঠিক স্বামী বিবেকানন্দের মতই এই অসততাকে তিনি সততা বা সদর্থক মানসিকতা দিয়েই মোকাবিলা করার কথা বললেন। শেষে রোহিঙ্গা জনজাতির দুর্দশার কথাও তাঁর কথায় উঠে এল। উপস্থিত বিদগ্ধমন্ডলীর সামনে তিনি অনুরোধ করলেন এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। রোহিঙ্গাদের সমর্থনে অন্ততঃ মিছিল করে যেন মানুষ। 

আজকের আজাইর‍্যা বাজার কথন পুণ্যস্নাত হোক সেই মানুষটির অমূল্য উদ্বেগের কথা মনে রেখে। আমরা যেন চিন্তায় দীন না হই, যেন পরমতসহিষ্ণু হই, আর একটু সহ্য করতে শিখি। যে সয় সে রয়/ যে না সয় সে নাশ হয়...


jayakc2004@yahoo.co.in

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ