রুমকি রায় দত্ত

রুমকি রায় দত্ত
রাঁচি থেকে দশম জলপ্রপাতঃ

এক রাঁচিতেই কতকিছু যে দেখার আছে,জানতামই না। সন্ধের একটু আগেই হুড্রু থেকে হোটেলে ফিরেছি। না, যতই ক্লান্তি থাকুক শহরটাকে পায়ে হেঁটে না দেখলে যেন কিছুতেই মন ভরে না। যথারীতি বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। আমরা ছিলাম,শহরের একেবারে প্রাণ কেন্দ্রে।অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে যায় এই শহর সন্ধের ঠিক পরেই।প্রচন্ড যানজট। সন্ধের চা টা তখনও খাওয়া হয়নি। ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহে রাঁচি বেশ ঠান্ডা। দুপুরের দিকে সোয়েটার গায়ে রাখা না গেলেও,সন্ধের পর শুধু সোয়াটার নয়, টুপিও মাথায় দিতে হয়। রাস্তার ভিড় কাটিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছি। রাস্তার ধারে ফাস্টফুডের ঠেলা। দু’চোখ ঘুরিয়ে একটু খুঁজতেই দেখলাম, একটা দোকানের সামনে লোকজন হাতে পেপারকাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে গল্পের ফাঁকে চুমুক দিচ্ছে। বুঝলাম ওখানেই আছে আমাদের অমৃত। আমি চিরকালই একটু চাখোর টাইপের। একটা ফিনফিনে ঠান্ডা, চায়ের কাপ হাতে, চোখের সামনে ভেসে চলেছে ব্যস্ত শহরের জনস্রোত। শুরু হল দোকানে দোকানে ঢুঁ মারা। ঝারখন্ড হ্যান্ডলুমের দোকানটি মনকাড়া। কিছু না কিনলে মন ভালো লাগে না। ঝোলা ভরে ফিরলাম হোটেলে। সকালে একটা নতুন রাঁচির পথে ছোটার অপেক্ষা নিয়ে একটা ক্লান্তির ঘুম।


ঠিক ন’টা। অটো দাদা হোটেলের সামনে এসে ফোন করলেন। আমরাও প্রস্তুত ছিলাম,বেরিয়ে পড়লাম। আগের দিন যেদিকে গিয়েছিলাম,এবার চলেছি ঠিক তার বিপরীত দিকে। দশম প্রপাতের পথে। আস্তে আস্তে পালটে যাচ্ছে বাইরের প্রকৃতি। শহুরে ব্যস্ততা ও উষ্ণতা ছেড়ে আমরা ক্রমশ প্রবেশ করছি গ্রাম্য শীতলতায়। রাঁচি থেকে প্রায় ঘন্টাখানেক যাওয়ার পরই একটা মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল আমাদের অটো। দাদা বললেন, “রাঁচির বিখ্যাত ‘দেউরিয়া মন্দির’ এটা। আমি এখানেই দাঁড়াচ্ছি,আপনারা গিয়ে দেখে আসুন”। অটোতেই জুতো খুলে শালপাতার ঠোঙায় ফুলের মালা আর প্রসাদ নিয়ে এগিয়ে গেলাম মন্দিরের দিকে। লাইনে দাঁড়িয়ে পুজো দিতে গেলে সারাদিন লেগে যাবে। সেদিন কোনো একটা বিশেষ তিথি ছিল। দূর দূর থেকে স্থানীয় দেহাতি মানুষের ভিড়ে ঢেকে আছে মন্দির। ভিতরের মন্দিরটি বহু প্রাচীন কালো বালিপাথরের। মন্দিরের ভাঙাচোরা ও কালো বর্ণ বুঝিয়ে দেয় এই মন্দির অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। ভিতরে রয়েছেন ষোলো ভূজা দেবী। এই প্রাচীন মন্দিরের বাইরে তৈরি হয়েছে রঙিন আধুনিক মন্দির,যার দেওয়ালে ছাদে আঁকা রঙিন দেবদেবীর ছবি। একসময় এই প্রাচীন মন্দিরটির কথা অনেকেই জানতেন না। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের তৎকালীন ক্যাপ্টেন ধোনি ও তাঁর পরিবার প্রতিদিন আসেন এই মন্দিরে পুজো দিতে এমনিটাই জানাগেল স্থানীয় মানুষদের মুখথেকে।


মন্দির দর্শন ছেড়ে আমরা আবার এগিয়ে চললাম। এই রাস্তাটা রাঁচি জামশেদপুর জাতীয় সড়ক। আমাদের গন্তব্য দশম প্রপাত। পথে দেখেনিলাম রাঁচির বিখ্যাত সূর্যমন্দির। ১৮টা চাকার রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছে সাতটা ঘোড়া। রথের আকারে গড়ে তোলা মন্দিরটা পুরোটাই শ্বেত পাথরের তৈরি। ভিতরের আরাধ্য দেবতা সূর্যদেব। অপূর্ব স্থাপত্যের নিদর্শন এই মন্দির! এরপর আরও কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়া। সামনে অপেক্ষারত দশম প্রপাত। অপেক্ষারত বলাটা ঠিক হল কিনা জানি না, কে কার অপেক্ষা করছে! আমরা অপেক্ষায় আছি দু’চোখে ভরে নেব এই প্রকৃতির খেয়ালকে। একটা গ্রাম্য পথ বেয়ে টোটো যেখানে এসে দাঁড়াল,জায়গাটায় চারপাশে বেশ কয়েকটি দোকানপাট। না, দোকান মানে মোটেই শহুরে দোকান বা পরিবেশ নয়। একেবারে খাঁটি গ্রাম্য পরিবেশ। ছোটো ছোটো দোকানপাট খাবারের। মাঝ-দুপুর প্রায়। প্রচন্ড খিদে পেটে। চারপাশের দোকানগুলোতে টুকটাক খাবার ছাড়া তেমন কিছু নজরেই এল না প্রথমে। একটু এগোতেই দেখলাম, কয়েকজন একটা কাপড় দিয়ে ঘেরা স্থানে চেয়ারে বসে কিছু খাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম। নয়া, কোনো হোটেল নয়। একজন দেহাতি মহিলা নিজেদের সামান্য খাবার বেশি পরিমানে বানিয়ে রেখেছে। কেউ খেতে চাইলে সেটাই অর্থের বিনিময়ে খাওয়াচ্ছে। দেখে ভক্তি হবে না সে খাবার, কিন্তু খিদের মুখে দু’গ্রাস মুখে ঢুকাতেই মনে হল যেন অমৃত।না, এ খিদের মুখে খাওয়ার জন্য মনে হওয়া নয়। বাঁধাকপির ট্যালট্যালে ঝোল,বেশ শক্ত মোটা চালের ভাত আর আলুমাখা। বাঁধাপকপির ঝোল যে এত সুস্বাদু হতে পারে,না খেলে সত্যিই জানতে পারতাম না। 

এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে দশম জলপ্রপাতকে। উপর থেকে নীচের দিকে লাফিয়ে পড়ছে। প্রবল গর্জন আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। খুব ইচ্ছা করছে ঐ জলের কাছে যেতে। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, খাদের মধ্যে সবুজ জল জমে আছে, কিন্তু কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। এখানে আসার আগেই শুনেছিলাম, এখন আর নীচে জল্প্রপাতের সৃষ্ট ঐ জলাশয়ে স্নান করতে দেওয়া হয় না। অতটা উচ্চতা থেকে লাফিয়ে পড়া জলের ধারায় সৃষ্ট গভীর খাদের সবুজ জলাশয়ের যতই আকর্ষণ থাকুক,বিপদ তার থেকেও অনেক বেশি। প্রচুর মানুষ তলিয়ে গিয়েছেন ঐ জলে। আমরা আসার একমাস আগেই সেখানে এক যুবক তলিয়ে যায়, তারপর থেকেই ঐ কাঁটাতারের ব্যবস্থা। একটা স্থানীয় লোক আমাদের পথ দেখাল। আমরা নিচে না নেমে,একটা গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রপাতের উপরের অংশে পৌঁছালাম। ভয়ঙ্কর সেই রাস্তা। এতক্ষণ আমরা যেখান থেকে জলের ধারাকে লাফিয়ে নিচে নামতে দেখছিলাম, দেখলাম আমরা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের পায়ের তলা দিয়েই বয়ে যাওয়া জলধারাই লাফিয়ে নামছে নিচে। একহাত দূরেই রয়েছে খাদের কিনারা। ভয়ঙ্কর সেই পথ! কিভাবে গেলাম সেখানে এখন ভাবলেই বুকের ভিতরে দ্রুত হৃদ্গতির শব্দ শুনতে পাই। স্বচ্ছ কাচের গুলির মতো চকচকে জল, জমে আছে পাথরের খাঁজে খাঁজে। বাইরে রোদের তীব্রতা তখন যথেষ্ট। জুতোর ভিতরে পা ঘেমে উঠছে। জুতো খুলে সেই স্বচ্ছজলে পা ডুবিয়ে বসতেই শরীর জুড়ে নেমে এল শীতলতা। বড় বড় পাথর পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের অলিতে গলিতে এঁকে বেঁকে বয়ে চলেছে জলধারা। এক পাথর থেকে আরেক পাথরে যেতে হলে ডিঙাতে হবে বহমান জলধারা। কিভাবে যেন হাঁটতে হাঁটতে এমন জায়গায় এসে পৌঁছালাম চারিদিকে বড় বড় পাথর শুধু। যেদিকেই যাচ্ছি সামনে বিশালাকার পাথর। কাছাকাছি কাউকে দেখতেই পেলাম না। ক্ষণিকের জন্য মনে হল,পথ হারিয়ে ফেলেছি। 



একটা অজানা ভয়ের সাথে রোমাঞ্চ জুড়ে তখন মনের এক অদ্ভুত অবস্থা। দেখলাম একটা পাথরের পিছন দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। ঐধারা ডিঙিয়ে ওপারে যেতে পারলেই রাস্তা পাব। পেরতে গিয়ে পা পিছলে গেল।ঠান্ডা কনকনে জলে ভিজে গেল জুতো। তখন দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে চলেছে। ভেজা জুতোয় বেশ কাঁপুনি ধরে গেল। উপর থেকেই দেখতে পেলাম সূর্যটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে যাচ্ছে যেন,আর ভীষণ রকম লাল দেখাচ্ছে। আসলে দিগন্ত ছোঁয়ার প্রস্তুতি। আস্তে আস্তে নেমে এলাম সেই গ্রামের পথে। অটো আমাদের নিয়ে ফেরার পথ ধরল। রাস্তায় ধারে অজানা গাছে লাল লাল কচি পাতা ধরেছে। ছুটে চলতে চলতে দেখতে পেলাম,লাল কচি পাতার আড়ালে ধীরে ধীরে ঢাকা পড়ছে সূর্য। একটা দিন বিদায় নিচ্ছে, নতুন দিনের জন্ম দেবে বলে। কোথা দিয়ে যেন কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। হাতে আর মাত্র একটা দিন। আগামীকালই রাঁচিতে আমাদের শেষ দিন। অনেক জায়গা দেখা বাকি। মনটা কেমন যেন বিষন্ন হয়ে উঠছে...সারা দিন প্রকৃতির কোলে কাটিয়ে ফিরে এলাম আবার রাঁচির শহুরে ব্যস্ত জনস্রোতের মাঝে।

ক্রমশ...।। আগের পর্ব পড়ুন
rumkiraydutta@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ