রাহুল ঘোষ

পরাজিতদের গল্প     ( ষষ্ঠ পর্ব )     প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি
এতদিনের আলোচনায় আমরা রামায়ণের প্রচলিত কাহিনির সহজ ব্যাখ্যার বাইরে গিয়ে রাবণের প্রকৃত অবস্থান ও গুরুত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা অর্জন করতে চেয়েছি। একথা তো পরিষ্কার যে, রাবণ একদিনে হঠাৎ করেই দেবশক্তির প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে পারেননি। রাবণের দশানন হয়ে ওঠার অন্তরালে ছিল দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতিপর্বের পরিশ্রম, যাকে প্রচলিত কাহিনি শুধুই তপস্যা ও বরপ্রাপ্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেখাতে চেয়েছে। কিন্তু সাধারণ বুদ্ধি দিয়েই তো আমরা বুঝতে পারি যে শুধু তপস্যা করে আর যাই হোক প্রবলতর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতা যায় না, পূর্বসূরীদের হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করা তো অনেক দূরের কথা! তাই এবার দেখে নেওয়া যাক, বিশ্রবা ঋষির দ্বিতীয় পক্ষের প্রথম সন্তানটি ঠিক কীভাবে দেবশক্তিকে পরাজিত করার উপযুক্ত হয়ে উঠলেন।

আমরা আগেই দেখেছি, বিশ্রবার সঙ্গে মেয়ে কৈকেশীর বিবাহের পরিকল্পনা করার পিছনে সুমালীর সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ছিল। সেই চিন্তাভাবনা শুধুই যে দেব ও অসুরশক্তির যাবতীয় সদগুণের সম্মিলনে জন্মানো সন্তানদের সম্ভাবনা-বিষয়ক, তা নয়। বিশ্রবা যেহেতু ব্রহ্মার পৌত্র, তাই ভবিষ্যতে তাঁর সন্তানেরা দেবশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলে যাতে দেবশক্তির একটা অংশের সমর্থন ও সাহায্য পায় বা নিদেনপক্ষে দেবশক্তির একটা অংশ যেন সেই যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকেন, এমন একটা নিশ্চয়তাও এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ধুরন্ধর সুমালী অর্জন করতে চেয়েছিলেন। আর এই পরিকল্পনা যে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি, সেকথা তো রাবণের জীবনকাহিনি অনুসরণ করলেই আমরা বুঝতে পারবো।

আমরা ধরে নিতেই পারি যে, রাবণের বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্রের শিক্ষা পিতা বিশ্রবার কাছেই হয়েছিল। কিন্তু রাবণের জন্মই তো কিছু নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে। বাবার মতো শুধু শাস্ত্রজ্ঞানী হয়ে উঠলেই তো তাঁর চলবে না, তাঁকে হয়ে উঠতে হবে একজন অসাধারণ যোদ্ধাও। নিতে হবে রাজনীতির মৌলিক পাঠ। এসব তাঁকে কে বা কারা শেখাবেন? রামায়ণের কাহিনির পুনর্নির্মাতাদের মধ্যে সুলভ অগ্নিহোত্রীর মতো কেউ-কেউ বলেছেন, মাতামহ সুমালীই এই কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁদের মতে, রাবণের শাস্ত্রশিক্ষা সম্পন্ন হলে কৈকেশীই জ্যেষ্ঠপুত্র রাবণ ও মধ্যমপুত্র কুম্ভকর্ণকে সুমালীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্রবাকে বিয়ে করার ও তাঁর সন্তানদের জন্ম দেওয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য কৈকেশী ভোলেননি এবং তিনি জানতেন, শুধু নিজেদের পিতার সান্নিধ্যেই বড়ো হলে তাঁর ছেলেরা অস্ত্রশিক্ষা বা রাজনৈতিক কলাকৌশল সম্পর্কে অজ্ঞানতার অন্ধকারে থেকে যাবে। আর ঋষি বিশ্রবার গুরুকুলে আগত ছাত্রদের মতোই তারাও শুধু দেব-সংস্কৃতির সঙ্গেই পরিচিত হবে; মাতৃকুলের অসুর-সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের দূরত্ব থেকেই যাবে। অবশ্য কনিষ্ঠ দুই পুত্র-কন্যা বিভীষণ ও শূর্পনখাকে তখনই সুমালীর কাছে পাঠানো হয়নি, সম্ভবত বয়স অত্যন্ত কম থাকার কারণে অথবা বিশ্রবার সন্দেহ হতে পারে, এই আশঙ্কায়। এর ফলে, কিশোর থেকে যুবক হয়ে ওঠার পরে রাবণের মধ্যে দেব-অসুর সংস্কৃতির নিখুঁত ভারসাম্য (যেহেতু তিনি চার ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান) এবং কুম্ভকর্ণের মধ্যে আসুরিক শক্তির প্রাবল্য দেখা গেল। দুর্দান্ত যোদ্ধা হয়ে ওঠার জন্মগত উপাদান রাবণের মধ্যে ছিলই। সুমালীর প্রশিক্ষণে তিনি হয়ে উঠলেন আরও ধারালো। আর কুম্ভকর্ণ যেহেতু জন্মগতভাবেই বিশাল চেহারা ও অসীম শারীরিক শক্তির অধিকারী, তাই তিনি হয়ে উঠলেন পাহাড়ের মতো, কয়েকটা হাতির সমান শক্তিধর! অস্ত্রচালনা নয়, বাহুবলই হলো তাঁর প্রধান হাতিয়ার। অন্যদিকে বিশ্রবার কাছেই বেশি সময় কাটানোর ফলে বিভীষণ হয়ে উঠলেন শাস্ত্রজ্ঞ, ধর্মজ্ঞানী এবং দেব-সংস্কৃতির অনুরাগী। তবে শূর্পনখা হয়তো নারী বলেই (যেহেতু সাধারণভাবে ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যাবেন না বা রাজ্যশাসন করবেন না), তাঁর মধ্যে কী করে দেব-সংস্কৃতির তুলনায় অসুর-সংস্কৃতির প্রাধান্য এল, তা নিয়েই কেউই বেশি শব্দ খরচ করেননি। তবে এইসব চিন্তকদের বাইরেও কেউ-কেউ আছেন, যেমন কবিতা কানে, তিনি এর কারণ হিসেবে শূর্পনখার উপরে মাতামহী তারকার বিরাট প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন।

আগেই বলেছি, আনন্দ নীলকণ্ঠন রাবণের দেবতাদের ত্রাস হয়ে ওঠার পিছনে আত্মগোপনকারী অসুররাজ মহাবলী ও তাঁর অনুগামীদের কাছে নেওয়া প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। যোদ্ধা রাবণকে গড়ে তোলার পাশাপাশি সেই প্রশিক্ষণে ছিল সমরনীতি ও রাজনীতির সমান পাঠ। এখানে দেখে নেওয়া যাক, সেই পাঠ অনুযায়ী মানবচরিত্রের কী-কী বৈশিষ্ট্য একজন আদর্শ যোদ্ধার কী-কী বর্জন ও গ্রহণ করা উচিত :

১. ক্রোধ হলো নিম্নতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ক্রোধ কারও বুদ্ধিমত্তাকে আচ্ছন্ন করতে পারে, তাকে চিন্তাভাবনা না-করেই যুক্তিহীন কাজ করতে বাধ্য করতে পারে। 

২.অহংকার আরেকটি ক্ষতিকারক উপাদান, যার থেকে ঔদ্ধত্য আসে। এই ঔদ্ধত্যই স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষতি করে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও শত্রুকে দুর্বল ভাবতে শেখায়।

৩. ঈর্ষা অন্যের সম্পদের প্রতি লোভী হতে প্ররোচিত করে। পৃথিবীর যাবতীয় যুদ্ধ, হানাহানি, রক্তপাত, সবকিছুর মূলেই আসলে ঈর্ষা। 

৪. আনন্দ

৫. দুঃখ

এই দুটিই দিন ও রাতের মতো চিরকালীন দুটি সত্য। একজন প্রকৃত জ্ঞানী যেমন আনন্দেও উদ্বেল হবে না, তেমন দুঃখেও ভেঙে পড়বে না। একজন সফল যোদ্ধার তাই দুটিকেই সমান নির্লিপ্ত ও শান্তভাবে দেখা উচিত। 

৬. ভয় আসলে একটা অসুখ। যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষের থেকেও বেশি সৈনিককে হত্যা করে তাদের মনে লুকিয়ে থাকা ভয়।

৭. স্বার্থপরতা সবচেয়ে নিন্দনীয় বৈশিষ্ট্য। যে শুধুই নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে, সে-ই আসলে সবচেয়ে অভাগা। কেউ যদি অন্য লোকেদের জীবনে একটুও আলো জ্বালাতে না-পারে, তার জীবনের কোনো অর্থই থাকে না!

৮. আবেগ আসলে একধরনের মায়া। প্রেম, ভালোবাসা, সবই আসলে বেঁধে রাখার কৌশল। একজন প্রকৃত যোদ্ধার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত বিজয়। সে তার বাবা-মা-ভাই-বোন-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, সকলের প্রতিই কর্তব্য পালন করবে, কিন্তু কাউকেই ভালোবাসবে না। ভালোবাসা যোদ্ধাকে দুর্বল করে দেয়। প্রেমের মধ্যে থাকে সেই অদৃশ্য বাঁধন, যা তাকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে উচিত সিদ্ধান্ত নিতে বাধা সৃষ্টি করে । 

৯. উচ্চাকাঙ্ক্ষা সর্বদাই নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত। লাগামহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিপদজনক। অগ্রসর হওয়ার লক্ষ্য থাকা ভালো এবং সেই লক্ষ্য ছোঁয়ার জন্য চেষ্টাও থাকা ভালো, কিন্তু যে-কোনো স্বপ্ন তাড়া করার সময়েও মানুষের দুটো পা যেন মাটিতেই থাকে।

১০.একজন সফল যোদ্ধার কাছে বা বৃহত্তর অর্থে একজন সাফল্যকামী মানুষের কাছেও আগের নয়টি বৈশিষ্ট্যই আসলে পরিত্যাজ্য। একমাত্র গ্রহণীয় বৈশিষ্ট্য হলো বুদ্ধিমত্তা। তার বোধ, জ্ঞান ও চিন্তাশক্তির স্বচ্ছতাই সেই বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ; যেগুলি সে তার গুরুদের কাছে শিক্ষালাভের সময় পেয়েছে, পুঁথিপত্র ও জীবন থেকে পাঠ করেছে, আর অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে। 

কিন্তু রাবণের ছিল অন্য ভাবনা। তিনি মনে করলেন, এসব কেবলই আদর্শের কথা, বাস্তবে যার প্রয়োগ অসম্ভব। তিনি ছাত্র হিসাবে মেধাবী ও দ্রুত শিখতে সক্ষম। কিন্তু তিনি তো চূড়ান্ত বাস্তববাদীও বটে। তাঁর মনে হলো, তিনি যদি অসুর সাম্রাজ্যের হৃত গৌরবের দিন ফেরাতে চান, তাহলে অসুরদের দুরবস্থার কারণ ও ব্যক্তিদের প্রতি তাঁকে ক্রোধান্বিত হতেই হবে। অহংকারকেও তিনি অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করলেন। যদি অসুর সভ্যতা-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তাঁর মনে কোনো অহংকারই না-থাকে, যদি নিজেকে সেই ঘরানার উপযুক্ত উত্তরসূরী হিসাবে মনে করার যথেষ্ট গরিমা না-থাকে, তবে কিসের ভরসায় তিনি দেব-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে নামবেন! তাঁর মতে ঈর্ষাও মানুষের মনের অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি উপাদান, যা না-থাকলে আসলে কেউই কোনোদিন নিজের উন্নতি করার আগ্রহ বোধ করবে না। পৃথিবীতে ঈর্ষা যদি না-থাকতো, তাহলে কখনোই সাম্রাজ্যবিস্তার বলে কিছুই থাকতো না। বস্তুত, আহার-নিদ্রা-মৈথুনের মতোই ঈর্ষাও মানুষের অনিবার্য ভাবপ্রকাশ। 

চূড়ান্ত বাস্তববাদী বলেই রাবণ জানেন, আনন্দ ও দুঃখে সমান নির্লিপ্ত ও শান্ত থাকা বাস্তবিকভাবেই কোনো ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো বিচ্ছেদে-বিরহে অথবা প্রিয়জনের মৃত্যুতে কেউ কি অবিচল থাকতে পারে! সে তো কান্নার মধ্যে দিয়েই সান্ত্বনা খুঁজবে! ঠিক একইভাবে কত ছোটো-বড়ো কারণে আনন্দিত হয়ে ওঠে মানুষ। কোনো প্রাপ্তি বা স্বপ্নপূরণ বা লক্ষ্য অর্জন, অথবা নেহাতই কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অথবা কোনো শিশুমুখের স্বর্গীয় হাসি দেখলে খুশিতে উদ্বেল হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। ঠিক যেমন, ভয়কে জয় করার কথা যতই বলা হোক, মৃত্যুভয় ততটাই স্বাভাবিক। হেরে যাওয়ার ভয়, হারিয়ে ফেলার ভয়, এসব তো মনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এসবই-বা কীভাবে অস্বীকার করা যায়! ঠিক যেমন অস্বীকার করা যায় না, মুখে যে যাই বলুক, প্রত্যেকেই কম-বেশি নিজের ভালো থাকার কথা আগে ভাবে। নিজে ভালো বা সুবিধামতো থাকতে পারলে আনন্দিত হয়, না-পারলে দুঃখিত। একে যতই স্বার্থপরতা বলা হোক, এটাই বাস্তবের ছবি। নাম-যশ-খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা সবাই পেতে চায়, আর তা চাওয়ার মধ্যে কোনো অন্যায়ও নেই। অন্যায় আসলে থাকে কোনো অসৎ পদ্ধতিতে সেগুলি অর্জনের চেষ্টার মধ্যে। একইভাবে প্রেম-ভালোবাসা-স্নেহজনিত আবেগকেও রাবণ অত্যন্ত অপরিহার্য বলে মনে করেন। বাবা-মা-ভাই-বোন-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা শুধু নয়, নিজের জাতি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা না-থাকলে তিনি আর কিসের আগ্রহে পুনরুদ্ধার করতে যাবেন পূর্বসূরীদের হারিয়ে যাওয়া উজ্জ্বল সময়! আর সেই কাজে সফল হতে গেলে উচ্চাকাঙ্ক্ষাও তো অত্যন্ত জরুরি। আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে গেলে স্বপ্ন দেখার অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রিত করলে চলে না। 

উপরোক্ত কারণগুলির জন্যই রাবণ কোনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকেই বিসর্জন দিতে চাননি। তিনি অবশ্যই সাফল্য চান, খ্যাতি এবং প্রতিষ্ঠাও চান। তিনি সর্বশক্তিমান হতেও চান। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি ভগবান হতে চান না। অতএব তিনি বুদ্ধিমত্তার একাগ্র উপাসক না-হয়ে ভালো-মন্দ মিশ্রিত দশটি বৈশিষ্ট্যের সম্মিলনে নির্মিত দশানন হয়েই থাকতে চান। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির এরকম গতিপথ দেখেই বোঝা যায়, রাবণ আসলে একজন রক্তমাংসের মানুষ, যিনি প্রবলভাবে অসাধারণ হয়েও আসলে খুব সাধারণ কোনো ব্যক্তির মতো। এবং এখানেই তিনি রামের থেকে আলাদা। রামায়ণের কাহিনির নায়ক রামের মতো একটি ঐশ্বরিক চরিত্রের বিপ্রতীপে হয়তো রাবণের মতো একটি রক্তমাংসের চরিত্রেরই প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি!

(ক্রমশ)

rahulbabin1@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ