উপন্যাস- 'বৃষ্টি পড়ার আগে'-
লেখক- বিনোদ ঘোষাল।
প্রকাশনী- আনন্দ পাবলিশার্স।
সাহিত্যিক বিনোদ ঘোষালের থেকে উপহার পেয়েছিলাম 'বৃষ্টি পড়ার আগে' উপন্যাসটি। বইটি সম্পর্কে বিস্তারিত পর্যালোচনা করার আগে ভালো উপন্যাস আর অসাধারণ উপন্যাসের মধ্যে যে সূক্ষ্মতর পার্থক্য আছে সেটা নিয়ে একটু আলোচনা করে নি। ভালো উপন্যাস হল সেইসব উপন্যাস যেগুলো পাঠকের মনে দাগ কেটে যায়। কোনও কোনও চরিত্র বিশেষভাবে রেখাপাত করে। উপন্যাস শেষ করে লেখক গল্পের চরিত্র ও ঘটনাবলীর সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন। লেখকের গল্প বলার ধরণে পাঠক কখনও হাসেন, কখনও আবার নিজের অজান্তেই তার চোখ দুটো ভারী হয়ে আসে। পক্ষান্তরে অসাধারণ উপন্যাস হল সেইসব উপন্যাস যা পাঠককে থামতে দেয় না কখনও। প্রথম থেকে শেষ অবধি পাঠকের আগ্রহকে ধরে রাখে। এই আগ্রহ ধরে রাখার কাজটা ভীষণই কঠিন, বিশেষ করে একটা উপন্যাসের ক্ষেত্রে। উপন্যাসের ছোট ছোট অসংখ্য প্লট থাকে। এই প্লটগুলিকে একত্রিত করে লেখক রচনা করেন তাঁর কল্পনার ইমারত। এই প্লটগুলির মধ্যেকার বন্ধন অনেক দৃঢ় হতে হবে, তবেই উপন্যাসের গাঁথুনি মজবুত হয়। এই বন্ধন আলগা হয়ে গেলেই পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে বাধ্য।
লেখকের বাড়ি কোন্নগর থেকে বাগবাজার ফিরতে ফিরতেই বইটি পড়া প্রায় শেষ করে ফেলেছিলাম। যেটুকু বাকি ছিল সেটা দুপুরে খেতে বসে বইয়ে মুখ গুঁজে শেষ করে ফেললাম। উপন্যাসের চরিত্রগুলো লেখক সাজিয়েছেন এইভাবে।
মমিয়া: ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ই মমিয়া বাবাকে হারিয়েছিল। একটা আন্ডার কন্সট্রাকসন বিল্ডিং-এর সিস্থ ফ্লোর থেকে পড়ে গিয়েছিল মমিয়ার বাবা অনীক চ্যাটার্জ্জী। বাবা কি পা পিছলিয়ে পড়ে গিয়েছিল নাকি...! কানাঘুষোতে মমিয়া অনেক কিছু শুনেছিল। প্রশ্নগুলো বিষ পিঁপড়ের মতো কামড়েছে মমিয়াকে। কিন্তু উত্তর পায়নি। মমিয়া দেখেছে অসীম কাকুর এই বাড়িতে আসা যাওয়াটা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। বাবার ছোটবেলার বন্ধু এই অসীম কাকু। অসীম কাকুর কথায় খুব হাসত মমিয়ার মা। বাবা মারা যাওয়ার ছয়-সাত মাস পর থেকে মা যেন কাকুর কথায় আগের চেয়েও বেশী হাসত। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকটার প্রতি কেমন একটা বিরক্তি বাড়ছিল মমিয়ার। মমিয়া চাকরী পাওয়ার পরও অসীম কাকুর প্রতি নির্ভরশীলতা এতটুকুও কমেনি মা সুছন্দার। সংসারে সামান্য খুঁটিনাটি বিষয়ে অসীম কাকুর পরামর্শ নিত মা। এক এক সময় রাগ যেত মমিয়ার। কথা বলতে ইচ্ছে করত না দুজনার সঙ্গেই। অসীম কাকু কেন বিয়ে করে নি এই প্রশ্নটা মাকে বেশ কয়েকবার করেছে মমিয়া। মা কোনওবার সঠিক উত্তর দিতে পারে নি।
সুছন্দা : মমিয়া সারাদিনের অফিসের পর মায়ের সাথে কিছুক্ষণ গল্প,কিছু সংসারের কাজের কথা,তারপর রাতের খাওয়া সেরে একটু টিভি দেখে যে যার ঘরে। পরেরদিনও একই রুটিন। সুছন্দার এক এক সময় ইচ্ছে করে এই রোজের একঘেয়ে রুটিন ফেলে কোথাও পালিয়ে যেতে। একটা সময় সুছন্দা আর মমিয়ার পাশে কেউ ছিল না। তখন অসীমই ওদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই কৃতজ্ঞতায় ভরাট হয়ে থাকে সুছন্দার মন। অথচ সেই কৃতজ্ঞতার জন্য মমিয়া সব কিছু খোয়াতে রাজী নয়। এই নিয়ে মাঝে মাঝে মা মেয়ের ছোটখাটো মান-অভিমান লেগেই থাকে।
তমাল : তমাল চাকরী বাকরী করে না। শুধু বাড়ি বাড়ি টিউশন করিয়ে বেড়ায়। সঙ্গী একটা ঝরঝরে সাইকেল। চাকরী পাওয়া সেরকম কোনও চেষ্টাও নেই। মমিয়ার ধমক ধামকে মাঝে মাঝে সরকারী চাকরীর ফর্ম ফিল আপ করে। আজকালকার ছেলেদের মত ও একদমই নয় জীবনের প্রতি চরম উদাসীন অথচ তমাল জানে একটা চাকরী জোটাতে না পারলে মমিয়া সাথে সম্পর্ক পরিণতি পাবে না। তিন বছর আগে কোনও এক রবিবার বিকালে মমিয়ার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল তমাল। এমনিতে মুখ চেনা ছিল শুধু। তবু একরকম অচেনা ছেলের মুখে এমন অদ্ভুত প্রস্তাব শুনে প্রথমে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল। মমিয়া ঠিক করে নিয়েছিল যাবে না তবু ‘অপেক্ষায় থাকবে’ শব্দটা এত বিচ্ছিরি যে না গিয়েও পারেনি মমিয়া। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল ছেলেটা ন্যাকা ন্যাকা ভাবে প্রেম নিবেদন করলে সটান না বলে দেবে। কিন্তু ফরসা রোগা লম্বা ছেলেটা একেবারের জন্যও ওইসব কথা উচ্চারণ করেনি। বরং বাঁ-পাশে মমিয়া। এই তিন জন মিলে টানা আড়াইঘন্টা হেঁটেছিল । কতগল্প, কত মজা। সেদিন বিকালের শুরু হওয়া কথা চলতে চলতে প্রায় তিন বছর হয়ে গেল আর ফুরালো না।
নিশা : মমিয়ার অফিস কলিগ নিশা,ফেসবুকে নাম ডিম্পি কাপুর। বয়স-একুশ। ইন্টারেস্টেড ইন মেন......১৯৮৩ জন ফ্রেন্ডস। কয়েকজন মেয়ে ছাড়া বাকি সবাই বিভিন্ন বয়সের পুরুষ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এরা থাকে। প্রত্যেকে ডিম্পিকে চায়। একান্ত শরীর দিয়ে। নিশারও মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে সব কটা ছেলের বেরিয়ে থাকা লালা মাখানো জিভের উপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়তে। ভালোবাসা কি নিশা কোনদিন দেখেনি অনুভব করেনি। ভালোবাসার কথা ভেবেছিল রিংগো নামের এক ডিস্ক জকির সাথে। কিন্তু কিছুদিন পরেই ছেলেটা সিঙ্গাপুরে উড়ে যায়। নিশা উপলব্ধি করে এই ক’মাসে ওরা দুজনের শরীর ছাড়া কিই বা চিনেছে? চেনার ইচ্ছা হয়নি কারোর। রিংগো সিঙ্গাপুরে হয়তো নতুন গার্লফ্রেন্ড হবে। সেখানে নিশাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয়না। আবার নিশার ওখানে গিয়ে ক’দিন ভালো লাগতো তাও জানা নেই। জীবন সম্পর্কে নিশার উপলব্ধি- লাইফ ইজ টু শর্ট টু লিভ, সো এনজয়। খায়ো, পিও, জিও।
শঙ্কর : শঙ্করকে অপেক্ষা করতে বলেছিল রোজালিন্ড। সেই অপেক্ষার বয়স প্রায় পঁচিশ বছর পাড় হয়ে গেছে । এত বছরে একটা চিঠিও আসেনি। শঙ্কর বলেছিল – “আমার আয়ু যতদিন ততদিন অবধি অপেক্ষা করতে পারবো।” সেই ব্লা কথাগুলো এত বছর ধরে রেখে এসেছে। নিঃসঙ্গ, একাকী জীবনে নতুন কাউকে ভালবাসতে ও ভালোবাসার কথা ভাবতে পারেনি। আজ এত বছর পর হঠাৎ কি তবে সেই অপেক্ষায় বিশ্বাস হারাচ্ছে শঙ্কর? কেন? একা হয়ে যাওয়ার ভয়? উত্তরটা জানা নেই শঙ্করের।
নিশা, তাপ্তি, মমিয়া- সমবয়সী। অফিসের কাজের ফাঁকে, ছুটির পর আড্ডা হয় তিনজন মিলে। সেই আড্ডাতেই নিশা বলেছিল ওদের বস শঙ্কর দা স্টিল ইয়ং ফল ইন লভ। মমিয়াও দুম করে বলে বসে অত সহজ নাকি শঙ্কর দার মাথা খাওয়া। নিশা পারবেনা। প্রত্যুতরে নিশা বলেছিল- “আমি একটা মেয়ে। আমি চাইলে অনেক কিছু করতে পারি। চল বেট লড়ি- “উইদিন ফিফটিন ডেজ দ্যাট পুওর ওল্ড হার্ট উইল বি মাইন।” মমিয়াও ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠে বলেছিল- “ডান”
মমিয়া ভাবতে পারেনি শঙ্করদার মত মানুষকেও নিশা প্রেমের অভিনয়ে ফাঁসাতে পারে। ভাবতে পারেনি বলেই শঙ্কর দার বিচ্যুতিগুলো বড় চোখে লাগছিল। একদিন রাগের মাথায় থাকতে না পেরে শঙ্কর দার কাছে আসল সত্যিটা ফাঁসই করে দেয় মমিয়া “এটা একটা গেম নেক্সট মান্থেই ও এই চাকরী ছেড়ে দিয়ে ও অন্য কোথাও চলে যাবে। শঙ্কর মন দিয়ে সব কিছু শোনার পর যা বলল- তাতে মমিয়া হাঁ করে তাকিয়ে রইলো শঙ্করের দিকে। শঙ্কর বলেছিল- “তুই হয়তো ঠিকই বলেছিস যে নিশা আমাকে ঠকাচ্ছে। ফ্লার্ট করছে। বাট বিলিভ মি, ইট মেকস নো ডিফারেন্স টু মি।” আমি ওকে ভালবাসি, তাই আমি ঠকিনি। যে ভালবাসতে পারলো না সেই ঠকলো।
সেদিন রাতে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট অন করে শঙ্কর দেখল শঙ্কর অনলাইন।
“কি রে ঘুমোস নি এখনও?” নিশা কি উত্তর দেবে ভেবে পেলো না। একজন মানুষ এত কিছু জেনে যাওয়ার পরও কি এই প্রশ্ন করতে পারে? নিশা উত্তরে লিখল- “সরি” তারপর সরি লিখতে লিখতে চ্যাট বক্স ভরিয়ে ফেলল নিশা। দুচোখ ভারি হয়ে আসছে। চারিদিক ধোঁয়ার মত। আচমকা দু গাল জুড়ে বৃষ্টি নামলো নিশার। তুমুল বৃষ্টি, সেই জলে ঝাপসা হয়ে যাওয়া পিসি স্ক্রিনে পড়া হল না যে শঙ্কর অফিস থেকে অনেকদিনের ছুটি নিয়ে দার্জিলিং,নিজের দেশের বাড়ি চলে যাচ্ছে ।
এইভাবে চরিত্রগুলো সৃষ্টি করে উপন্যাসের প্লট সাজিয়েছেন লেখক। ছোটছোট সংলাপ রচনার দক্ষতা আর লেখকের নিজস্ব মনঃস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষনে চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে গিয়েছে।
বৃষ্টি পড়ার আগের মুহূর্তে এক অপ্রত্যাশিত রূদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি তৈরী করেছেন লেখক- আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস- সেটাই উপন্যাসের এক নাটকীয় মোড় আনে। সেই আসন্ন ঝড় পাঠকের সমস্ত ভাবনা চিন্তাকে এলোমেলো করে দেয়। অজান্তে কখন দুচোখে বৃষ্টি নামে পাঠক ভেবেও পায় না।
'বৃষ্টি পড়ার আগে'- আধুনিক জীবনের এক চিত্রায়ন। এখানে কান্না হাসির দোলায় দুলতে দুলতে পাঠক কখন চরিত্র সাথে একাত্ম হয়ে যান। মমিয়া,তমাল,সুছন্দা,নিশা,শঙ্কর-সকলেই একটি বৃষ্টিকে খুঁজে বেড়ায়। জীবনের চারপাশে ঈর্ষা, ঘৃণা, রাগ,দুঃখ, মায়া, ভালোবাসা। মমিয়ারা সকলেই কি পারবে বৃষ্টির জন্ম দিতে? আর সেই বৃষ্টির নামই বা কি জানতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে 'বৃষ্টি পড়ার আগে'- উপন্যাস ।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন