হিমাচলের হাতছানিঃ পাহাড় দেখা যাদের নেশা,তাদের কাছে পাহাড়ের মায়াবী হাত ছানিকে উপেক্ষা করা কোনো মতেই সম্ভব নয়।হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য,পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা রহস্য আর পাহাড়ের কোল বেয়ে রক্তিম সূর্যের উদয় ও অস্ত যাওয়ার দৃশ্য শতবার দর্শণের পরও ফিকে লাগেনা। প্রতিদিন ভোরের আলোর সাথে যেন একটা নতুন প্রকৃতি সৃষ্টি হয়,যা আগে কোনো দিনও দেখা হয়নি। গৃহকোনে বাঁধা পড়ে থাকা মনের সাথে হঠাৎ যদি জুড়ে যায় এক অদৃশ্য ডানা,সেই ডানায় প্রকৃতির রঙ মেখে উড়ে বেড়াতে কে না চায়।আর সেই প্রকৃতির রঙ যদি হিমাচলের হয়,তবে কেমন হয়? প্রিয় পাঠক আসুন আপনাদের হিমাচলের প্রকৃতির রঙ দেখাই।
হিমাচল পর্যটন বিভাগ এই রাজ্যটিকে চারটি ভাগে ভাগ করেছে। ক) সাতলুজ সার্কিট খ) বিয়াস সার্কিট গ) ট্রাইবাল সার্কিট ঘ) ধৌলাধার সার্কিট । প্রতিটা সার্কিটে এত গুলো দর্শণীয় স্থান আছে যে, একবারে তো নয়ই,বেশ কয়েক বারেও সব জায়গা দেখে ওঠা সম্ভব হবে না হয়তো। আমি আপনাদের যে যে জায়গায় নিয়ে যাব সেগুলি হল হিমাচলের রাজধানী সিমলা ও তার পার্শ্ববর্তী কিছু স্থান,পান্ডো ড্যাম,রিভার ভিউ পয়েন্ট,কুলু ও মানালি।
সালটা ২০০৮,ফেব্রুয়ারি মাস। একঘেঁয়ে পানসে জীবনে হঠাৎ হিমালয়ের হাতছানি আনুভব করলাম।যদিও সিমলা যাওয়ার আদর্শ সময় মে-জুন ও সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বর মাস।কিন্তু বসন্তের একটা আলাদা গন্ধ আছে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি শুক্রবার আমাদের সিমলাগড়ের বাড়ি থেকে শুরু হল আমাদের যাত্রা।সন্ধ্যা ৭:৪০ মিনিটে আমরা উঠে বসলাম কালকা মেলে। অদ্ভূত এক উত্তেজনা চলছে তখন মনে। ট্রেন কিছুটা দৌড়াতেই ধীরে ধীরে প্রশমিত হল পাহাড়ে যাওয়ার উত্তেজনা। সামনের সিটে দুই বাংলাদেশী যুবক নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত। বাঁ-দিকের আপার ও মিডিল সিট দুটি আমাদের মানে আমার আর আমার হাবির। পঞ্চম ও ষষ্ঠ ব্যক্তি দুজন উঠলেন বর্ধমান থেকে। রাত গড়িয়ে ভোর, তারপর দুপুর আবার রাত। মাঝের সময়ে সহযাত্রী দুই বাংলাদেশীর সাথে আলাপ ও হল। গল্প বেশ আত্মীয়তায় পৌঁছালো। বাংলাদেশী অল্পবয়সের যুবকটি আপু আপু বলায় বেশ ভালোই লাগছিল। একটা পেয়ারা কেটে খাওয়ার জন্য এগিয়ে দিতেই পড়লাম ঝামেলায়। এতো গল্প, এতো আত্মীয়তা কিন্তু খাবার খাওয়ার সময়ই যে বারবার মনে পড়ে যেতে লাগলো বাড়ির লোকের সাবধান বাণী “অচেনা কারোর কাছ থেকে কোনো খাবার খাবে না”। তাদের এই সাবধান বাণী অবশ্য অমূলক নয়, খবরেরে কাগজ, টেলিভিশনের নিত্য দিনের খবরে এমন একটা খবর রোজই দেখা যায়।কিন্তু উপায়? মুখের উপরে না বলি কি করে? অগত্যা হাত পেতে নিলাম।চোখের ঈশারায় ঠিক করলাম, আমি আগে খাবো তারপর আধঘন্টা কাটলে সুজিত খাবে। আমরা যখন নিজেদের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখন ওদের মাথায় হাত। অল্প বয়সের ছেলেটি রাতে মাঝে বাঙ্কে শুয়ে ছিল, আর মাথার কাছেই ছিল তার কোটটি।সকাল থেকে সেটি পড়ার প্রয়োজন ছিল না।হঠাৎ সেটি গায়ে পড়তে গিয়ে দেখে,চটচটে কি যেন ওর কোটের গায়ে লেগে।মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো সে। দামি কোটটা বুঝি গেল। কিন্তু লাগলো কি আর কেমন করেই বা লাগলো? তদন্ত করে জানা গেল তার মাথার উপর যিনি শুয়ে ছিলেন,তার লিভারের অসুখ। ভালবাসে বাড়ি থেকে দেওয়া লিভারের পলিবিওন নাম ওষুধের শিশিটি খালি হয়েছে ওনার কোটের গায়ে। এরপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে চললো বাঙাল ভাষায় তরুণটির বিলাপ। ঠিক রাত সাড়ে আটটা-ন’টার সময় বাংলাদেশী দু’জন নেমে গেল দিল্লীতে।আমারা আবার রাতে শোয়ার প্রস্তুতি নিলাম। তৃতীয় দিন অর্থাৎ রবিবার খুব সকালেই আমরা পৌঁছে যাব কালকা। ভোর তিনটে—সাড়ে তিনটে হবে। ট্রেন গতি ধীর করে থেমে যেতেই ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম এক শুনশান স্টেশনে এসে থেমেছে ট্রেনটা। দরজার কাছে এসে দাঁড়াতে এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে ঝাপটা মারলো মুখে।
হীমশীতল সে পরশ। বাইরে কুয়াশার চাদরকে ভেদ করে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোষ্টের আলো গিয়ে পড়ছে একটা সাইনবোর্ডে। দেখলাম লেখা আছে ‘চন্ডীগড়’। ট্রেন আবার গা ঝাড়াদিয়ে চলা শুরু করলো। ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে আবার দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম।
অপূর্ব সে মনমোহিনী দৃশ্য আজও ভুলতে পারিনি। ট্রেনের গতি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। ঘন সাদা কুয়াশার আস্তরণ ছিঁড়ে ধীর লয়ে ট্রেন যত এগিয়ে যাচ্ছে তত স্পষ্ট হচ্ছে চার পাশে ঘন কুয়াশার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা, ঘুমন্ত পাহাড়ের গা থেকে ঠিকরে পড়া অসংখ্য আলোক বিন্দু। যেন শতসহস্র পাহাড়ী কণ্যা জ্বলন্ত প্রদীপ হাতে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন