শ্রীশুভ্র

shreesuvro













সামাজিক পরিসরে আমাদের ব্যক্তি জীবনে সংস্কার বিশ্বাস ও পূজার ভূমিকা অত্যন্ত গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ! এমনকি যিনি নাস্তিক তাঁর জীবনেও এই একই কথা সমান ভাবে প্রযোজ্য। সংস্কার বিশ্বাস ও পূজা কিন্তু শুধুই আধ্যাত্মিকতা ও সাম্প্রদায়িক ধর্মাচারণের বিষয়ীভূত নয়। জীবনের অন্যান্য সকল বিষয়েই এই তিনটির বিশেষ ভুমিকা দেখা যায়। বস্তুত আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের পরতে পরতে এই তিনটির প্রকাশ সুস্পষ্ট হয়েই ধরা পরে। একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায় হামাগুড়ি দিতেদিতেই আমরা পারিবারিক নানান সংস্কারের সাথে একাত্ম হয়ে উঠতে থাকি। আর সেই একাত্ম হয়ে ওঠার সূত্রেই ধীরে ধীরে যে বিশ্বাসগুলি আমাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে অধিকার করে বসে, সেইগুলিকেই বেড়ে ওঠার সাথে সাথে আমারা পূজা করতে শুরু করি। এইযে ক্রম বিন্যাস, সংস্কার থেকে বিশ্বাস তার থেকে পূজা, এইটি সাধারণ ভাবে আবিশ্ব সকল সমাজে, সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দেখা যায়। যিনি নাস্তিক, তাঁর জীবনেও এই ক্রম পর্যায় পরিলক্ষিত হতে পারে। একটি নাস্তিক পরিবারের শিশু সেই হামাগুড়ির সময় থেকেই নাস্তিকতার পারিবারিক সংস্কারের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠতে থাকলে কালক্রমে সেই নাস্তিকতাকেই সে বিশ্বাস করতে শুরু করবে ও পরিণত চেতনায় সেই বিশ্বাসকেই পূজা করবে। এইটিই মানব জীবন। 

বড় অসহায় বড় দিশেহারা বড়ো সংশয়াচ্ছন্ন এই মানব জীবন। এত বেশি প্রশ্ন ও এত কম উত্তর যে দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা প্রায় অসম্ভব। বিজ্ঞানের এত উন্নতি ও প্রযুক্তির এত অগ্রগতি সত্তেও অধিকাংশ মূল প্রশ্নগুলি আজও নিরুত্তর। যুক্তি যতই ধারালো হোক মানুষের মননে সেই ধার বড়োই পলকা। অমীমাংসীত প্রশ্নের উত্তরে যখন তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়তে থাকে শান দেওয়া যুক্তির সমস্ত ধার তখনই আমাদের আরও একবার আশ্রয় নিতে ছুটে যেতে হয় সেই বিশ্বাসের কাছে। যে বিশ্বাসকে পূজা করতে করতে কালক্রমে সৃষ্টি হয় এক একটি সংস্কারের। মানুষের ইতিহাস এই বিশ্বাস থেকে পূজা, পূজা থেকে সংস্কারের ক্রমবিন্যাসেরও ইতিহাস। একটু তো অদ্ভুতই। পাঠক নিশ্চয় খেয়াল করেছেন পূর্বেই বলা হয়েছে আমাদের ব্যক্তি জীবন গড়ে ওঠে মূলত সংস্কারকে কেন্দ্র করে বিশ্বাসের আশ্রয়ে পূজার উদ্বোধনে। অর্থাৎ সংস্কার থেকে বিশ্বাস। বিশ্বাস থেকে পূজা। কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই ক্রমটি একটু ভিন্ন। আগে বিশ্বাসের উৎপত্তি। তারপর সেই বিশ্বাসকেই পূজা করা। ও কালক্রমে সেই বিশ্বাস ও পূজাই জীবন সমাজ ও সভ্যতার সংস্কার হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। 

কিভাবে ঘটে এই ক্রমবিন্যাস? আসুন একবার ইতিহাসের সুবিস্তৃত পটে মূল চিত্রটিকে একটু দেখে নেওয়া যাক। পৃথিবীর জীবচক্রে মানুষের আবির্ভাব একে বারে শেষ পর্যায়ে। জীবচক্রের দিকে তাকালে আমরা যে প্রধান বৈশিষ্টটি দেখতে পাই তাহলো বুদ্ধির ক্রম বিকাশ। বড়ো ধীর গতির এই বিকাশ, মানুষের পর্যায়ে এসে যেন একটি নতুন সুদূরপ্রসারী দিগন্তের উন্মোচন ও উদ্বোধন করে দিলো। প্রাণী জগতে যে বৌদ্ধিক বিকাশ ছিল নিতান্তই আত্মরক্ষা কেন্দ্রিক, মানব জগতে পৌঁছিয়ে সেই বিকাশই আত্মরক্ষার নিতান্তই সীমাবদ্ধ গণ্ডীকে অতিক্রম করে গেল। সে প্রশ্ন করতে শুরু করলো, এট কি, ওটা এমন কেন? কিভাবে ঘটছে এসব? কোথা থেকে আর কোথায়? এই সব নিরুত্তর প্রশ্নের সামনে অসহায় মানবাত্মা তার বৌদ্ধিক চিন্তার দিগন্তে যখন প্রথম বুঝতে পারলো নারীর গর্ভ থেকে শুরু মানব জীবনের, তখনই তার চিন্তার পরিধি আরও বিস্তৃত হয়ে খুঁজতে থাকল, তবে এই ভুবনের সৃষ্টিকর্তা কে? মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশের প্রথম পর্যায়ে মানুষ বুঝতে পারে সকল সৃষ্টিরই পেছনে থাকে একজন সৃষ্টিকর্তা। শিশুর জন্ম যেমন নারীর গর্ভে, ঠিক তেমনই এই ভুবনটুকুও কোন এক মহাশক্তির গর্ভজাত এই ধারণায় পৌঁছালো প্রথম চিন্তাশীল মানুষ। সেই শুরু হলো তার অন্তহীন যাত্রা। 

এক একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর খোঁজার প্রবল তাগিদ। সেই তাগিদ থেকেই নিরুত্তর প্রশ্নের সাথে জীবনের সামঞ্জস্য স্থাপনের অন্তহীন প্রচেষ্টা মানব মনে জন্ম দিতে থাকলো এক একটি কাল্পনিক বিশ্বাসের। আর বিশ্বাসের সেই পথেই গড়ে উঠল মহাশক্তিধর ঈশ্বরের ধারণা। মহাশক্তিধর কারণ, মানুষের বৌদ্ধিক চেতনায় মানুষ অনুধাবন করলো তার শক্তির সীমাবদ্ধতার সত্যকে। কিন্তু প্রাণীজগতের সাথে মানুষের অন্যতম প্রধান পার্থক্য, তার সীমাহীন আকাঙ্খায়, সীমাহীন চাহিদার অদম্য প্রবল তাড়নায়। সেই কারণেই প্রাণীকুল যেখানে নিজেদের শক্তির সীমাবদ্ধতা নিয়ে চিন্তিত নয়, চিন্তিত নয় সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার তাগিদ নিয়ে, মানুষ কিন্তু তার সেই শক্তির সীমাবদ্ধতার চৌকাঠে নিরন্তর মাথা ঠুকেছে আরও শক্তি আরও শক্তি করায়ত্ত করার সুতীব্র বাসনায়। সেই বাসনারই প্রথম পদক্ষেপ মহাশক্তিধর কাল্পনিক ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস। আর পরবর্তী পদক্ষেপ জ্ঞান বিজ্ঞান দর্শনচর্চার দিগন্ত। যা শুরু হতে কেটে গিয়েছিল সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ। কবির কথায় সে অনেক শতাব্দির মনীষীর কাজ। ঠিক সেইটিই মানুষের সমাজ সভ্যতারও ইতিহাস। 

যেকোন বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের সীমাব্ধতাই আমাদের মনে জন্ম দেয় সেই বিষয় সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের। অর্থাৎ বিষয়টি সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞানের অভাব থাকলেই হয় আমরা সেইটির সম্বন্ধে মনগড়া প্রচলিত ধারণাকে আমাদের পারিবারিক বা সামাজিক বা সাম্প্রদায়িক সংস্কার অনুয়ায়ী বিশ্বাস করে বসি, অথবা সেই ধারণাটিকে অবিশ্বাস করি। আর এইভাবেই সীমিত বুদ্ধিতে বিষয়টিকে বুঝে নেওয়ার দূ্র্বল প্রয়াসে নিজেদের সান্ত্বনা জুগিয়ে উত্তরহীন প্রশ্নগুলির সাথে জীবনের সমন্বয় সাধন ও সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করি। যতদিন প্রমাণ হয়নি পৃথিবী সূর্যের চারিধারে ঘুরছে, ততদিন শুধুমাত্র সত্য জ্ঞানের অভাবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে আমরাই তো বিশ্বাস করতাম- সূর্যই পৃথিবীর চারিধারে ঘুরছে! এবং সেইদিন আসল সত্যটি কেউ বলে দিলেও আমরা তার কথাকে অবিশ্বাস করেই উড়িয়ে দিতাম নিশ্চয়ই। বিশ্বাস ও অবিশ্বাস সম্বন্ধে এই হলো শাশ্বত সত্যের বাস্তব চিত্র। অর্থাৎ প্রকৃত জ্ঞানের ভিত্তিতে যখন কোন সত্যকে অনুধাবন করা যায়, তখন কিন্তু আর কোন বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের উপর আমাদের কাউকেই নির্ভর করতে হয় না। তাই ঈশ্বর আছেন কি নেই, থাকলেও তিনি সাকার না নিরাকার এই বিষয়ে আমাদের ধারণাও সেই অজ্ঞানতা প্রসূত মনগড়া কাল্পনিক অস্তিত্ব সম্বন্ধে বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের উপরেই। এই যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব সম্বন্ধে আমাদের ধারণা সেই বিশ্বাস অবিশ্বাসের গণ্ডীতেই অন্ধের মতো আবর্তিত হতে থাকে, তার মূল কারণ বিজ্ঞান কিংবা দর্শন আজও অভ্রান্ত ভাবে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারে নি। ঠিক যেমনটি দিয়েছে, সূর্যের চারিধারে পৃথিবীর আবর্তনের ক্ষেত্রে।

সভ্যতার সেই আদি যুগে ঈশ্বর বিশ্বাস ছিল মূলত প্রাকৃতিক শক্তিকে সন্তুষ্ট রাখার দুর্বল প্রয়াস, যাতে প্রতিদিনের জীবনযাপন ও জীবনরক্ষা সহজসাধ্য হয়ে ওঠে। প্রতিদিনের জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে নানাবিধ ভয়। এই যে ভয়, সে ভয় হল অজানাকে না জানার কারণজাত। যাকে সামনে দেখা যায় না, ধরা যায় না বোঝা যায় না, কিন্তু কখন কোন পথে বিপদ ওঁৎ পেতে থাকবে কেউ জানে না আগে থেকে, সেই ভয় মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সর্বদা। অধিকাংশ প্রশ্নেরই কোন উত্তর ছিল না তার হাতের কাছে। তাই নানবিধ সাম্ভব্য অসাম্ভব্য বিপদ আপদের ভয় থেকে পরিত্রাণ পেতেই সে উদ্ধারের আর্জি নিয়ে উপস্থিত হলো বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির কাছে। এইভাবেই সৃষ্টি হতে থাকল এক এক প্রাকৃতিক দেবদেবীর। এইভাবেই দূ্র্বল মনে নানাবিধ জাগতিক আশঙ্কার ভয় থেকে পরিত্রাণ পেতেই শুরু হল যাগযজ্ঞ নানবিধ দেবদেবীর পূজা উপাচার। যা জাতি ধর্ম বিশেষে স্বভাবতঃই ভিন্ন। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ও ভাবনায় সাযুজ্য সম্পন্ম। চিন্তা ভাবনার ব্যাপ্তির সাথেই মানুষের মনে হতে থাকল এইসব প্রবল প্রাকৃতিক শক্তির অন্তরে নিশ্চয়ই কোন এক অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিসত্ত্বা বিদ্যমান। যার সচেতন ইচ্ছার সৃষ্টি এই জগত সংসার। যাঁর ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল মানুষের ব্যক্তি জীবন। ফলত মানুষের মনে হতে থাকল এই সর্বশক্তিমানকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই বিভিন্ন ইচ্ছাপুরণ সম্ভব। দূ্র্বল মন কল্পনা করে যাকে আরাধনা করে যাগযজ্ঞ পূজার মাধ্যমে খুশি করতে পারলে তাঁর আশ্রয়ে নিশ্চিন্তে সুরক্ষিত রাখা যাবে নিজের ও প্রিয়জনের ভুত ভবিষ্যৎ বর্তমানকে। এই অন্ধ বিশ্বাসকেই আঁকড়ে ধরে কাল্পনিক ঈশ্বররের আরাধনা! আর এই ভাবেই মানব সভ্যতায় বিশ্বাসের ফলশ্রুতিতে শুরু পূজা আরাধনার।

এই আরাধনা এই পূজা প্রজন্মের পর প্রজন্মে উত্তাধিকার সূত্রে প্রবাহিত হতে হতে পরিণত হয়ে যায় এক একটি সংস্কারে। পারিবারিক সংস্কার। সামাজিক সংস্কার। সাম্প্রদায়িক সংস্কার। ধর্মীয় সংস্কার। আর আলোচনার প্রারম্ভে যেমন বলা হয়েছিল, ঠিক তেমনই আমাদের ব্যক্তিজীবন গড়ে ওঠে সেই রকমই এক একটি সংস্কারের মধ্যে দিয়েই। যে সংস্কারজাত বিশ্বাসের গণ্ডীতেই আমাদের চিন্তাভাবনার গতিপ্রকৃতি হয় পরিচালিত। এবং যার পরিণতি সেই বিশ্বাসেরই আরাধনায়। তাকেই পূজা করার মধ্যে। সংস্কার থেকে বিশ্বাস। ও তারপর বিশ্বাসকেই পূজা। এইভাবেই সম্পূর্ণতা পায় সমগ্র বৃত্তটি। অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিরুত্তর প্রশ্নজনিত দুর্বলতা ঢাকতে বিশ্বাসের জন্ম। যাকে পূজা করার সংস্কারের মধ্যেই সামঞ্জস্য বিধানের মরিয়া প্রয়াস। আর সেই প্রয়াসজনিত সংস্কারের মধ্যেই জন্ম বৃদ্ধি যে ব্যক্তি জীবনের, সেই সংস্কারকে বিশ্বাস করতে শুরু করেই ক্রমে পূজা আরাধনার সংস্কৃতি। এইভাবেই আবর্তিত হয় মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে সমাজ সংসার সভ্যতা। 

এতো গেল সংস্কার বিশ্বাস ও পূজা আরাধনার আধ্যাত্মিক অধ্যায়ের আলোচনা। কিন্তু আধ্যাত্মিকতার পরিসরের বাইরেও জীবনের যে বিস্তৃত অঙ্গন পড়ে থাকে, সেখানের চিত্রগুলি কেমন? বস্তুত বিশ্বাস বিষয়টিই অজ্ঞনতা প্রসূত বলেই, যেখানেই বিশ্বাসের অস্তিত্ব, বুঝতে হবে তার গোড়াতেই রয়েছে কোন না কোন বড়সর গণ্ডগোল। যেখানেই সংস্কার, বুঝতে হবে তার গোড়াতেই রয়েছে কোন না কোন অন্ধত্ব! যেখানেই পূজা বুঝতে হবে তার গোড়াতেই রয়েছে কোন না কোন দুর্বলতা। মানুষের সমাজে ব্যক্তিজীবনের পরতে পরতে এই বিশ্বাস পূজা ও সংস্কারের নানবিধ ধারাই প্রত্যেককে পরিচালিত করে এক এক রকম ভাবে। সে তিনি ধার্মিকই হোন কিংবা অধার্মিক। আস্তিকই হন কিংবা নাস্তিক। মূর্খই হোন কিংবা পণ্ডিত। কিন্তু যে ধরণেরই বিশ্বাস পূজা বা সংস্কার হোক না কেন এসত্য কোনক্রমেই অস্বীকার করার উপায় নাই যে, বিশ্বাস আমাদেরকে অন্ধ করে রাখে। পূজা আমাদেরকে মানসিকভাবে আপাত শান্তি দিলেও দুর্বল করে রাখে। সংস্কার আমাদেরকে খর্ব করে রাখে। আমাদেরকে যদি পরিপূর্ণ আত্মবিকাশের পথে এগোতে হয়, তবে এই তিন রিপূকে যেভাবেই হোক জয় করতে হবে। হবেই। নয়তো আমরা একই জায়গায় আবর্তিত হতে থাকব বারবার। এখন দেখা যাক কিভাবে আমরা এই তিনটি রিপুকে জয় করতে পারি। 

পূর্বেই বলা হয়েছে, বেশ কিছু শতাব্দী আগে পর্যন্ত মানুষ বিশ্বাস করতো সূর্যই পৃথিবীর চারিধারে ঘুরছে, চোখে দেখা বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে। কিন্তু সবাই যদি সেই বিশ্বাসকেই আঁকড়ে ধরে অন্ধের মতোন জীবন কাটাতো তবে তো আসল সত্য আবিস্কৃত হতে পারতো না কোনদিনই। কিন্তু একজন যখন সেই বিশ্বাসজনিত দৃঢ় ও জমাট অন্ধকার থেকে মুক্ত করতে পারলেন নিজেকে, খুলে গেল সত্যের নতুন দিগন্ত। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। জোর যার মুলুক তার। এইটিই তো সনাতন রাজতন্ত্র সামন্ততন্ত্র থেকে শুরু করে আধুনিক পুঁজিবাদের শেষ কথা। কিন্তু সেই সংস্কার থেকে একজন নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন বলেই না সাম্যবাদের মানবিক দিগন্তে উদ্ভাসিত হয়েছিল মানুষের ইতিহাস। সে যতই ক্ষণস্থায়ী হোক না কেন। তার অভিঘাত আজও ক্রিয়াশীল। ভবিষ্যতে তা যে আরো সার্বিক ভাবে ক্রিয়াশীল হবে না কোনদিন, সে কথা আজ আমারা নিশ্চিত করে বলতে পারি না কেউই। স্মরণ করা যাক গৌতম বুদ্ধের কথা। স্মরণ করা যাক যিশুখৃষ্টের কথা। স্মরণ করা যাক হযরত মহম্মদের কথা। এঁরা কেউই কিন্তু তাঁদের সময়ের প্রচলিত পূজা আরাধনার আবর্তে নিমজ্জিত রাখেননি নিজেদের। সেই প্রচলিত সামাজিক সাংসারিক সাম্প্রদায়িক ধারা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করে নিয়েই খুলে দিয়ে ছিলেন মানব জীবনের এক একটি নতুন দিগন্তের। ঘটনাচক্রে কালের শ্যাওলায় যে খোলা দিগন্তগুলি কালক্রমে একএকটি অচলায়তন হয়ে উঠে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে মানুষের পরিপূ্র্ণ আত্মবিকাশকেই। কিন্তু তার কারণ ভিন্ন। সে আলোচনাও এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু তাই বলে এঁদের সাধনায় খুলে দেওয়া নতুন দিগন্তগুলি কোন ভাবেই খাটো হয়ে যায় না। আজও সেইখান থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন যুগের মানুষ এগিয়ে যেতে পারে আরও উন্মুক্ততর খোলা দিগন্তে। কিন্তু পারছে কই? আজকের সমাজ সভ্যতার পরিসরে সেই ঘটনা আমরা আর দেখতে পাচ্ছি না কেন। পাচ্ছি না কেন, সেই একই কারণে। প্রচলিত সংস্কারজাত বিশ্বাসের গণ্ডীতেই পূজা আরাধনা সীমাবদ্ধ রাখলে কোনদিনই সেই উন্মুক্ততর খোলা দিগন্তের হদিস পাবো না আমরা। যে হদিসটুকু তাঁদের জীবনে তাঁরা পেয়েছিলেন তৎকালীন প্রচলিত সংস্কারজাত বিশ্বাসের আরাধনার সীমাবদ্ধ সংকীর্ণ গণ্ডী থেকে নিজেদেরকেই মুক্ত করতে পেরে। জয় করতে পেরেছিলেন আজন্ম লালিত সংস্কার বিশ্বাস ও আরাধনার রিপুকেই। আর সেইটিই প্রকৃত মুক্তির পথ। সেই পথে এগোতে হলে আমাদেরকেও জয় করতে হবে এই তিনটি রিপুকেই, সংস্কার বিশ্বাস ও আরাধনা। 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ