তাপসকিরণ রায়




বয়সের ধর্ম, না মাথার ব্যামো ছিল, বৃদ্ধ সদানন্দ বাবুকে দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। কোন দিন কিছু সময়ের জন্যে তিনি এক ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ করেন। কখনও তিনি নিজের নামই ভুলে যেতেন। মাথার চুল ছিঁড়ার চেষ্টা করতেন, মনে করতে না পারার জন্যে রেগে হাত ছোঁড়াছুঁড়ি করতেন। সদানন্দ বাবুকে সে বার বাড়ি থেকে কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সঙ্গে ছিল তাঁর স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা। 

ঘটনাটা তখনই ঘটে ছিল। হাওড়া স্টেশন থেকে সদানন্দ বাবুকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। এমনি একটা জাগায় সমুদ্র প্রবাহের মত যাত্রী ভিড়ের মাঝে তিনি হারিয়ে গেলেন। প্রভাত, রঞ্জন, রাণু তাঁর ছেলে মেয়েরা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াল। এ জাগা, সে জাগা, বাজার-ঘাট, অলিগলি, বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়েস্টেশন, তার পরে কাগজে কাগজে নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। কিন্তু নেই, নেই, কোথাও নেই লোকটা !

একটা বয়েস ছিল সদানন্দর, স্বামী, পিতা হিসাবে যেটুকু করার তার চেয়েও বেশী করেছেন। ছেলে মেয়েকে দিয়েছেন অপার স্নেহ- ভালবাসা, স্ত্রীকে মন থেকে ভালবেসেছেন। প্রভাত, রঞ্জন ও রানুর কাছে বাবা ছিলেন এক বৃক্ষের মত। অপত্য স্নেহ ছায়ায় বাবাই তো ওদের আগলে রেখেছিলেন। বাবা, বাবা, বাবা, হাহাকারের হু হু করা বাতাস সারাক্ষণ ওদের বুকের মাঝে বয়ে যায়। 

ইতিমধ্যে দীর্ঘ দশটা বছর কেটে গেল। ওদের বাবা থাকলে আজ তাঁর আশি বছর পূর্ণ হত। এমনি এক দিনে ঘরের কুল গুরু বিধান দিলেন, সদানন্দ নিরুদ্দেশ হয়েছে দশ বছর পার হয়ে গেছে, এবার তোমরা গয়া গিয়ে বাবার পিণ্ডদান করে এস। তাঁর শান্তি মুক্তির জন্যে এটা করতেই হবে। 

সে মত দুই ছেলে গয়া চলে গেল। সেখানে বাবার পিণ্ডদানের কাজ সেরে ওরা গয়া স্টেশনে এসে পৌঁছল। ট্রেন এক ঘণ্টার মত লেট, ছেলেরা ট্রেনের অপেক্ষায় বসেছিল। ঠিক এমনি সময় এক হাড়জিরজিরে বৃদ্ধ, ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। পরিধানে তাঁর ছেঁড়া ময়লা তেলচিটে পোশাক। হাতে ধরা তাঁর ভিক্ষার পাত্র। সে কথা বলছে না, ভিক্ষাপাত্র এগিয়ে দিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। 

প্রভাতের চোখ ঐ বৃদ্ধের দিকে পড়তেই সে চমকে উঠলো। ও দেখল, অজস্র দাড়ি গোঁফের জঙ্গলের মাঝেও এক পরিচিত মুখের ছায়া ! রঞ্জনও লোকটাকে দেখে চমকে উঠলো, কে, কে তুমি ? 
লোকটা থতমত খেল, দু হাত ওপরে তুলে বলল, আমি, জগদানন্দ, আমি প্রেমানন্দ, আমি আমি...লোকটা যেন কিছু মনে করে যাচ্ছে... বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেছে। প্রভাত গলায় আওয়াজ নিয়ে বলে উঠলো, আপনার বাড়ি কোথায় ?
বৃদ্ধ আবার চিন্তা করতে লাগল, আমার...আমার বাড়ি ? নদীয়া...নাগের বাজার, না না নোয়াখালী...না না... 

এমনি সময় রেলের এক কর্মচারী সামনে এসে দাঁড়ালো, বলল, ও পাগল, গয়া ষ্টেশনে বহুদিন ধরে আছে। নিজের নাম ঠিকানা ঠিক মত বলতে পারে না। তবে ওর নাম বোধ হয় রাহুল রসিদ। বৃদ্ধ এবার চীৎকার করে উঠলো,হ্যাঁ হ্যাঁ আমার নাম রাহুল না, আমার নাম... 

রেলের লোকটা আবার বলে উঠলো, আপনাদের মত এমনি বাবার খোঁজে আরও দু তিনজন এসেছিল। ওরা ঠিক মত চিনতে না পেরে ফিরে গেছে। 

এবার বৃদ্ধ পাগল নিজের চুল টানছে, হাত ছুঁড়ছে, কাঁদছে। চীৎকার করে বলছে, আমি জীবানন্দ, আমি সদানন্দ, আমি সব আমি, হা হা হা হেসে যাচ্ছে বৃদ্ধ পাগল, বয়সের ভারে কিম্বা পাগলের বিক্ষিপ্ততায়। 

ছেলেরা ফিরে যাচ্ছে। বৃদ্ধ পাগল প্ল্যাটফর্মে স্থির দাঁড়িয়ে আছে, ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। এ মুহূর্তে তাকে দেখলে কেউ পাগল বলতে পারবে না। 

প্রভাত, রঞ্জনদের ট্রেন ছুটে চলেছে। ওদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে এক বৃদ্ধপিতার চেহারা। এক নয়, একক এক বৃক্ষপিতার ছবি--যাকে আর আলাদা ভাবে চেনার কোন উপায় নেই। প্রভাত ও রঞ্জনের মনে হল, ফলদার ছায়াদার এক চিরসবুজ বৃক্ষ ওদের মাথার ওপর থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে !



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ