শর্মিষ্ঠা দে








রাতে রান্নার মাসির বানানো চিকেন আর রুটি খেয়ে অন্যদিনের চেয়ে একটু তাড়াতাড়িই শুতে চলে গেল শুভময়।নাহঃ,আজ আর বুবাই এর ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকবেনা। আগামীকালের নতুন শুরুর জন্য বরং মনটা ছটফট করছে। কাল শুভময় যাবে এমন কিছু মানুষের কাছে, যারা তাকে নতুন করে জীবনটাকে দেখতে শিখিয়েছে।

আজকের শুভময় আর বরোদা ব্যাঙ্কের রিজিওনাল ম্যানেজার শুভময়ে অনেক তফাত , আজ বেশ বুঝতে পারে সে। কাজ পাগল ওই মানুষটার জীবনে তখন শুধু কাজ আর ছুটে চলাই ছিল সব।  জীবনের সেই ঘোড়দৌড়ের লড়াইতে সামিল হয়ে শুভময় সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়েছে একসময়। এমনকি নিজের বউ ছেলেকেও।

কল্যানীর খুব শখ ছিল নববর্ষের দিনটা দুজনে একসাথে কাটাবে। সেটা ছিল কল্যানীর জন্মদিনও। কিন্তু বিয়ের পর প্রথম দুবছর ছাড়া আর কখনও হয়ে ওঠেনি। অবশ্য কল্যানী এক-দুবারের বেশি আর বলেওনি। নিজের সাথেই থাকতে শিখে নিয়েছিল যেন। এমন না যে শুভময় ওর বউ ছেলেকে ভালবাসতনা,তারও ইচ্ছা করতনা। কিন্তু ওর সময় হতো না। কেরিয়ারের সিঁড়ি চড়তে গেলে হয়ত এরকম কিছু বলিদান থাকে। আর তাছাড়া ও এসব করছেই বা কাদের জন্য? নিজের বউ আর ছেলেকে আরামে আয়েশে রাখার জন্যই তো? নিজেকে বুঝিয়েছিল। 

তবুও সবকিছু কি সবসময় বোঝা যায়? তাই কখন যে সে আর কল্যানী দুটো আলাদা আলাদা দ্বীপ হয়ে গিয়েছিল,একটু ভুল বলা হলো হয়ত, শুভময়,কল্যানী আর তাদের ছেলে সায়ন্তন – একই বাড়ির মধ্যে তিনটি আলাদা আলাদা দ্বীপ হয়ে গিয়েছিল, বুঝতেই পারেনি শুভময়। আচ্ছা, কল্যানী কি কিছু বুঝেছিল? সে কি বুঝেছিল যে তার স্বপ্নের সংসারটা তিনটে চেনা কিন্তু অচেনা মানুষের পাশাপাশি থাকা হয়ে যাচ্ছে? তা নাহলে বুবাই যখন বিদেশে পড়তে যাবার জন্য সব দরখাস্ত জমা দিয়ে জানিয়েছিল,”বাবা,ভাবছি এরপর ডিগ্রীটা বিদেশ থেকেই নেব।প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করার পর ওরা ডেকে পাঠিয়েছে”, তখন কল্যানী একটুও অবাক হলনা কেন? কেন অন্য অনেক মায়ের মত ছেলেকে ছেড়ে থাকতে হবে বলে বলল না “না বুবাই তোর বিদেশ যাওয়া চলবে না।” 

বরং ও কিছুটা নিষ্পৃহভাবেই ছেলেকে বলেছিল, “তোর কেরিয়ারের জন্য যেটা ভাল হবে সেটাই করিস।সিদ্ধান্ত সব সময় ভেবে চিন্তে নিবি।” নাকি ও জানত যে বুবাই শুভময়েরই মত কেরিয়ারিস্টিক। আজ অবসরের পর একলা বসে এসব কথাগুলো শুভময়ের বারেবারেই মনে পড়ে।

শুভময় ভেবেছিল এখন না হয় সে ওদের জীবনটাকে আর একটু গুছিয়ে নিক, আর একটু উন্নতি করতে হবে অবসরের আগে। কিন্তু কখন যে জীবনটাই হারিয়ে দিয়েছিল তাকে বুঝতেই পারেনি। কল্যানীর শরীরে বাসা বেঁধেছিল মারণরোগ, জানতেই পারেনি ওরা কেউই। যখন জানতে পেরেছিল সময় ছিলনা বেশি। শুভময় চেয়েছিল কল্যানীর সব অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করতে। কিন্তু নিজের স্ত্রীকে কতটুকুই বা বুঝে উঠতে পেরেছিল সে? সুদীর্ঘ নয়, কিন্তু কষ্টের একটা লড়াই এর পর চুপচাপ একদিন চলে গিয়েছিল কল্যাণী-  শুভময়কে একা ফেলে দিয়ে,তাও আবার একটা পয়লা বৈশাখ এরই দিনে। যেন এটাই ছিল কল্যানীর নীরব প্রতিবাদ।

ওর মৃত্যুর পর শুভময় আর একলা ঘর – যতই সকালে হাঁটা, ক্লাব এসব থাকুক না কেন, তাও কল্যানীর না থাকাটাই ওর থাকার গুরুত্বটা আরও প্রকট করে তুলেছিল শুভময়ের কাছে। কল্যানীর একটা খাতা থেকে শুভময় জেনেছিল অনেক কিছু। বুবাই হবার পর ওর নাম সুকল্যান রাখার ইচ্ছা ছিল তার, কিন্তু গুরুদেবের পছন্দ করা নামের কাছে তার চাওয়া টেকেইনি। এটা নিয়ে কল্যানীর মনেও যে ক্ষোভ ছিল, বুঝতেই দেয়নি ও। আসলে শুভময় কতটা চেষ্টা করেছে ওকে বোঝার। নাহলে কল্যানী যে “কিশলয়” এর মত একটা অনাথআশ্রম এর সাথে যুক্ত। সে যে ওখানে যায়, সে খবর রাখেনি। অবশ্য কল্যানী একবার উৎসাহের সাথে বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তখন কি যেন একটা নিয়ে ব্যাস্ত ছিল সে। 

নাহঃ, তখনই ঠিক করে নিয়েছিল আর কল্যানীকে একলা বৈশাখ কাটাতে দেবেনা সে। ওর ভাললাগার সেই “কিশলয়” এর ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা গুলোর সাথেই এবারের নববর্ষ কাটাবে শুভময়। আর তাদের জন্য থাকবে শুভময়ের একটা উপহার, তার বাড়ির দলিল, ওই বাচ্চাগুলোর নামে রেজিস্ট্রি করে দেওয়া,কল্যানীর শেষ ইচ্ছা- ওই ডায়রীতে লেখা। যা দিয়ে বাচ্চাগুলোর একলা শৈশবে আসবে সত্যিকারের নববর্ষ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ