একটি কালো মোরগের কাহিনী
■ পিন্টু ঘোষ
এই ছেলে তার নিজের নয়, ছেলেটার মুখ দেখলে সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। কি সুন্দর টানাটানা চোখ, কোঁকড়ানো চুল, দুধে আলতা গোলা ফর্সা রঙ ; এ ছেলে তার হতেই পারে না ! এমন রঙ তার বংশের কারো কখনও থাকলে সে নিশ্চয় জানত। ঠাকুমা'র কাছেও অন্তত একবারও সে শুনতে পেত। বংশের কে কেমন দেখতে ছিল, তা মুখস্থ ছিল বুড়িটার ! তার বউয়ের বংশেরও তো সবাই কালো ! আরে রঙ চুলোয় যাক, চোখ-মুখের গঠন তো কিছুটা হলেও তাদের দু'জনের মতো হত নাকি !
তবে শালা রবি'র কথাই ঠিক–কাকের বাসায় কোকিল কখন ডিম দিয়ে যায়, তা শিবের বাবাও জানে না, আর এই সামান্য রবি জ্যোতিষ জানবে কি করে ! আর যে রবি পেটের উপর তেল ফেলে, সেটার গড়ান দেখে ছেলে হবে না মেয়ে হবে বলে দেয়, সে-ই যখন জানে না তখন উচ্চমাধ্যমিক ফেল করা রোহন মল্লিক জানবে কেমন করে !
নার্সিংহোমে জন্মানোর পর-ই ছেলেটাকে দেখে এই এক-ই কথা মনে হয়েছিল তার। বলেও ফেলেছিল কিছুটা। নার্সেরা বোঝাতে এলে এমন একটা কথা বলেছিল যে, তারা আর কথা বলার সাহস পায়নি। কথাটা শোনার পর নার্স গুলোর মুখের অবস্থা যা হয়েছিল, সেটা মনে পড়লেই হাসি চলে আসে —ছেলেটাকে পাশে নিয়ে বসে এই কথাগুলোই এতক্ষণ মনে মনে ভাবছিল রোহন। নার্সদের মুখের অবস্থার কথা মনে পড়তেই এবারও হো হো করে হেসে উঠল সে।
– এ বামনিয়া,বামনিয়া —সেহারা-উচালন-বামনিয়া ...
বীরহাটা বাসস্ট্যান্ডে বসে থাকতে থাকতে কখন যে বাস এসে গেছে, খেয়াল করেনি। বাস ছেড়ে দিয়েছে দেখে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে লাফিয়ে বাসে উঠল, একটা সীট দেখে বসে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।
এই হচ্ছে জীবন ! যে যত বেশি লাফ দেবে, সে তত বেশিদিন টিকে থাকবে পৃথিবীতে ! বেঁচে থাকতে হলে লাফাতে হবে, পড়াশুনাতে লাফাতে হবে, না হলে শালা সবই তোর মতো রোহন – লবডঙ্কা !
উচ্চমাধ্যমিক ফেল করার পর যদি না সেদিন অনিরুদ্ধ থাকত, তাহলে তার ভাগ্যে আজ কি অপেক্ষা করত কে জানে ! সেদিন অনিরুদ্ধ নিজের থেকেই তো বলেছিল – ভাই রোহন, চিন্তা-ফিন্তা বাদ দে শালা! আমার গাড়ির ডাইভার হয়ে যা মাইরি! দেখবি, পুষিয়ে যাবে। সেদিন থেকেই সে কাজটা নিয়ে নিয়েছিল।
তারপর একটা মেয়ে দেখে অনিরুদ্ধ ওর বিয়ে দিল। বিয়েতে বহু টাকা ঢেলেছিল ছেলেটা। তাই সবাই যাই বলুক সে অনিরুদ্ধকে কৃপণ বলতে পারে না। অনিরুদ্ধও নিশ্চয় তাকে ভাইয়ের মতো মনে করে, নইলে এত টাকা , ভাবা যায় !
ফুলসজ্জা রাতটাও যে কি কেটেছিল ! উফ ! ভাবলেই তার তলপেট সুড়সুড়ি দিয়ে ওঠে।
কিন্তু এই ছেলেটা হওয়ার পর থেকেই কেমন যেন সব পাল্টে যেতে লাগল। সব সুখ যেন কোনো এক হ্রদের তলায় তলিয়ে গেল। এই হচ্ছে জীবন ! প্রথম কয়েক মাস পরেও যখন তার বউ কোনো সন্তানের জন্ম দিতে পারেনি, তখন অনিরুদ্ধই এক ক্লিনিকে যোগাযোগ করে দিয়েছিল। এটাও তো ওকে সে ভাইয়ের মতো মনে করে বলেই। অনিরুদ্ধ অনিরুদ্ধই , সে ছাড়া রোহনের জীবন সত্যিই পূর্ণতা পেত না।
ডাক্তারখানা থেকে ফিরে সেই পার্টি ! শুধু মদ আর মাংস ! এটাও অনিরুদ্ধই দিয়েছিল। তবে সেদিন একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল তার। কখন বিছানায় গিয়েছিল, কখন অনিরুদ্ধ বাড়ি গিয়েছিল, সে কিছুই জানে না। নেশার ঘোরে সেদিন শুধু তার মনে হচ্ছিল, পাশে যেন ঝড়ের শব্দ হচ্ছে, তপ্ত বালির উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলে যে শব্দ হয়, সেই শব্দ ! মনে হচ্ছিল , কে যেন বলছে – উঃ! সব তো পোড়ালে, এবার এই গুলোও পোড়াবে !
পরের দিন সকালেই গাড়ি নিয়ে অনিরুদ্ধ'র কাজে চলে গিয়েছিল সে। বাড়ি ফিরতে রাত হয়েছিল। প্রতিদিনের মতোই হাল্কা নেশা করে বাড়ি ফিরে বউয়ের কাপড়ে টান দিতেই বুক থেকে কাপড়টা সরে গেলে বুকে বোরোলিনের নিচে একটা পোড়া ক্ষত দেখতে পেয়েছিল। জিজ্ঞেস করলে বউ বলেছিল – রাঁধতে গিয়ে তেল ছিটকে ছিল বোধহয়, খেয়াল হয়নি।
তারথেকে নয় মাস দশ দিন পরই তো এই ছেলেটাকে পেয়েছিল। সবই অনিরুদ্ধ'র ভাইয়ের মতো ভালোবাসার ফল। কিন্তু ভাই এ কেমন ভালোবাসা, এ কার ছেলে !
– পাপা, পাপা - চকো...
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল, বুঝতে পারেনি। ছেলেটার ডাকে চোখ মেলে তাকাল রোহন। বাসের মধ্যে পড়ে থাকা আধখাওয়া চকোলেটটাকে ছেলেটা তুলতে গেলে, ধমক দিয়ে ওঠে সে।
– এই ! ওটা নিবি না, শুয়োরের...। কথাটা শেষ করল না। যদি সত্যিই ছেলেটা তার হয় তবে সে নিজেই শুয়োর হয়ে যাবে, সেই ভয়ে।ছেলেটাকে নিয়ে দীঘলগ্রামে নেম পড়ল সে। ডাক্তার দেখানো হয়ে গিয়েছে, এবার ছেলেটাকে স্কুলে দিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে তাকে। তারপর বাড়িতে বউয়ের সাথে লুডো খেলবে, কুট-ছক্কা, কুট-ছক্কা – উফ! ভাবতেই আবার তলপেট সুড়সুড়ি দিয়ে উঠল। আজ বিকালে অনিরুদ্ধ দার্জিলিং যাবে বলেছে। নিজের গাড়িতেই যাবে। সাথে তাকে এবং তার ছেলে-বউকে নিয়ে যাবে, কথা দিয়েছে। গাড়িটা অবশ্য রোহনকেই চালাতে হবে। এখন আপাতত নিজের গাড়িটাকে চালানো যাক, এসব ভাবতে ভাবতে ছেলেকে স্কুলে দিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াল রোহন।
বাড়ি পৌঁছে সে একটু অবাক হয়ে গেল – আরে, এটা কার গাড়ি ? অনিরুদ্ধ'র না ! নম্বর প্লেটের দিকে তাকাল সে। হ্যাঁ, অনিরুদ্ধরই তো ! দার্জিলিং যাবে বলে এখনই এসেছে নাকি? ভাবতে ভাবতে দরজা ঠেলল রোহন। আরে দরজা তো ভিতর থেকে বন্ধ ! অনিরুদ্ধটাই কোথায় গেল? বউকে ডাকবে একবার ঘর খোলার জন্য? কিন্তু ভিতর থেকে হাল্কা কিসের শব্দ আসছে ওটা ! দরজার কীহোল দিয়ে একবার দেখলে কেমন হয় !
দরজার কীহোলে চোখ রাখল রোহন। খাট দুলছে। ওটা কে? অনিরুদ্ধ? শালা! আমার সাথে ঢ্যামনাপনা হচ্ছে ! দুটোকেই দেখে নেব শালা! অস্ফুট স্বরে বলে উঠল।
– না, এখন নয় ; প্ল্যান করতে হবে, তারপর এক ঢিলে মারব দুই পাখি ! ঘুঘু আর ফাঁদ দুটোকেই দেখে নেব। ছেলেটাকে আনতে সে স্কুলের দিকে চলে গেল।
ছেলেটাকে নিয়ে যখন ফিরল অনিরুদ্ধ তখনও রয়েছে, তবে দরজা এখন খোলা। চেয়ারে বসে অনিরুদ্ধ চা পানে ব্যস্ত। তাকে দেখে অনিরুদ্ধই প্রথম কথা বলল।
– কোথায় ছিলি বে? তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে, এক্ষুনি তো যেতে হবে।
– এইতো, একেবারে ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে ফিরলাম। এলি কখন?
– এই কিছুক্ষণ।
রোহন কিছুই জানে না, এমন ভাব করে গাড়িতে উঠে বসল। সব জিনিসপত্র নেওয়া হয়ে গিয়েছে। অনিরুদ্ধ বসল রোহনের পাশের সীটে। পিছনে রোহনের ছেলে আর বউ। গাড়ি চলতে শুরু করল।
দার্জিলিং এ তারা পৌঁছে গিয়েছে , কিন্তু অনিরুদ্ধ যে হোটেলে থাকবে বলে বলেছে, সেখানে পৌঁছাতে ৬ কিমি বাকি। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ; গাড়ি চালাতে একটু সমস্যাও হচ্ছে তার। হঠাৎ ছেলেটা বলে উঠল, আমি পাপা'র কাছে বসব, পাপা'র কাছে –
এ শালা সব ঐ খানকিটার প্ল্যান ; তবে এটাই সুযোগ, সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না, ভেবে গাড়ি থামাল রোহন। বলল, ভাই অনি, তুই পিছনের সীটে আমার বউয়ের কাছে বসবি? ছেলেটা যখন আসতে চায়ছে...
– হ্যাঁ, এ আর কি ব্যাপার ! বসলেই হল। বলে পিছনের সীটে চলে গেল অনিরুদ্ধ, আর ভাবল, এতো শালা মেঘ না চায়তেই বৃষ্টি ! গোঁফের গোড়ায় হাসি ঠেলে ঠোঁটের উপর জিভ বোলাল সে।
পাহাড়ি পথ। এই সুযোগ ! এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না রোহন। কিছুতেই না ! রাস্তার দুপাশ ভালো করে দেখে নিল সে — বামদিকটা সোজা গিয়ে খাদে মিশেছে। একবার গাড়িটা কাত হলেই সব শেষ হয়ে যাবে ! কিন্তু এ ছেলেকে সে মারবে না, এত সুন্দর ছেলে – ছেলেটার দিকে একবার তাকাল রোহন। একহাতে ছেলেটাকে নিজের কাছে টেনে নিল। একটু গেটটা খুলল। স্টিয়ারিংটা ঘুরিয়ে দিয়ে কোনোরকমে লাফিয়ে পড়ল সে।ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরে উঠে বসল রোহন। শুধু রোহন মোরগ নয় শালা ! অনিরুদ্ধ, তুইও একটা মোরগ, আস্ত একটা মোরগ শালা !
ছেলেটা কাঁদছে। সাথে রোহন শুনতে পাচ্ছে, ধাক্কা খেতে খেতে গাড়িটার খাদে পড়ার শব্দ। হঠাৎ কারা যেন প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠল, সাথেসাথেই গাড়িটাও দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।
তার মনে হল পাশের পাহাড়টা যেন তাকে বলছে, শুধু সে বা অনিরুদ্ধই মোরগ নয়–এই পৃথিবীতে নিজের অজান্তে কখন কে যে মোরগ হয়ে যায়, কেউ জানে না !
মনে হল পাহাড়ের পাশ থেকে যেন একটা আস্ত মোরগ ডেকে উঠল। ভোর হচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে, একটা নতুন সকালের অপেক্ষায়।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন