২১শে ফেব্রুয়ারী, এখন আর শুধুই বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয় নয়। একুশ এখন আবিশ্ব মাতৃভাষা দিবস। অর্থাৎ বিশ্বায়নের এই যুগে একুশ আবার আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই। লড়াই প্রতিটি ভাষার আত্মমর্য্যাদা সুরক্ষিত রাখার। লড়াই আবিশ্ব কোন একটি ভাষার একছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধেই। তাই ২১শে ফেব্রুয়ারী আজ আর কেবল বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিবস পালন নয়। একুশ এখন বিশ্বের সকল ভাষার জন্যেই একটি আন্দোলনের প্রতীক। এই আন্দোলন কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নয়। এই আন্দোলন বিশ্বায়নের গড্ডালিকায় নিজের ভাষাকে সুরক্ষিত রাখার জন্যে নিজের সাথে নিজেরই।
অর্থাৎ, আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে বিশ্বায়ন যেমন নির্দিষ্ট একটি ভাষার একাধিপত্য দাবি করে, আমরা কি সেই দাবির কাছে আমাদের মাতৃভাষাকে বিসর্জন দেবো, অবহেলা করবো আপন মুখের ভাষাকে, না কি আমার ভাষাকেও বিশ্বের অন্যতম প্রধান একটি ভাষা রূপে মেলে ধরবো বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে? ২১শে ফেব্রুয়ারী আমাদেরকে আরও একবার সেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আবিশ্ব এখানেই আজ একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রধান তাৎপর্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কে কিভাবে সেই যৌক্তিকতাকে দেখবে, সেটা এক একটি দেশের মানুষের, তার সংস্কৃতির একান্তই নিজস্ব বিষয়। কিন্তু আমরা বাঙালিরা যারা ১৯৪৭ থেকে একাধিক রাজনৈতিক ভুখণ্ডের বাসিন্দা হয়ে পরস্পর বিছিন্ন হয়ে সুখে কালাতিপাত করছি, তারা কিভাবে দেখছি একুশে ফেবরুয়ারীর এই নতুন তাৎপর্য কে? কিংবা দেখছি তো আদৌ?
আমরা যারা কাঁটাতারের এপারে বিগত অর্দ্ধশতকের সমাজজীবনের সাক্ষী, দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে আমাদের এপারের বঙ্গসমাজ ২১শে ফেব্রুয়ারী সম্বন্ধে আদৌ সচেতন ছিল না কোনদিন। আমাদের অধিকাংশ নাগরিকদেরই চেতনায় একুশ পড়শী একটি বিদেশী রাষ্ট্রের ভাষা আন্দোলনের বেশি কিছু ছিল না কোনোদিনই। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জে ইউনেস্কো কর্তৃক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি স্বরূপই আজ আমাদের কাছে একুশ একটি আন্তর্জাতিক দিবস মাত্র। অন্যান্য নরীদিবস, হিরোশিমাদিবস, মানবতাদিবস, প্রভৃতি দিবসের মতোই ইউনেস্কো স্বীকৃত একটি আন্তর্জাতিক দিবস পালনের বেশি কিছু নয়। যে দিনটির সাথে আমাদের সমাজ জীবনের কোনো আত্মিক যোগ নেই; কি করে সেই দিনটির প্রধান তাৎপর্য সম্বন্ধে আমরা সচেতন থাকব? সমস্যাটি ঠিক এইখানেই।
কাঁটাতারের ওপারে মাতৃভাষা চর্চার উপর দখলদার রাষ্ট্রের ফতোয়া নেমে এসেছিল। সেই ফতোয়া সমাজজীবনের ভিতেই শিহরণের কাঁপন লাগিয়ে দিয়েছিল তীব্র ভাবেই। যে কম্পনে জীবনজীবিকার নিশ্চয়তাই আনিশ্চিত হয়ে পড়তে চলেছিল। মানুষ তাই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হিসেবেই অনুভব করেছিল একুশের চেতনাকে একদিন। কিন্তু এপাড়ে মাতৃভাষা চর্চার উপর রাষ্ট্রব্যবস্থার কোন খাঁড়া নেমে আসেনি কোনদিন। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে একদিকে ইংরেজী ভাষার উপর জীবনজীবিকার নির্ভরশীলতার শ্রীবৃদ্ধি ও অন্যদিকে বিনোদন সংস্কৃতির ভাষা হিসেবে হিন্দীর তুমুল উত্থান, এই দুই মিলিয়ে আমাদের সমাজ জীবনে মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব ক্ষয় পেতে শুরু করেছিল বহুদিন আগে থেকেই, ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই। এপারে বাঙালি মাত্রেই তাই হয় ইংরেজী নয় হিন্দিমুখী, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। তাই পাকিস্তান বাংলাদেশের বিষয়ে যে ভুলটি করেছিল, দিল্লীর কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে কোনদিনই সেই ভুলটি করতে হয়নি পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে। এপারের বাঙালি নিজেই নিজের মাতৃভাষাকে আজ ফেলনা করে অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলেছে নিশ্চিত ভাবেই। কারণ সে জানে অর্থনীতির ভাষা নয় বাংলা। সে জানে ধনসম্পদ অর্জনেরও ভাষা নয় বাংলা। সে জানে শিক্ষাদীক্ষার ভাষাও নয় বাংলা। সারা ভারতের সাথে যোগোযোগের ভাষাও বাংলা নয় আদৌ। সে জানে বিনোদনের ভাষাও বাংলা নয় আর। তাই ভালোভাবে বেঁচে থাকতে গেলে সুখ আর সমৃদ্ধিকে করায়ত্ত করতে গেলে মাতৃভাষাকে আকঁড়ে থাকলে চলবে না। অনেকেই মনে করেন, মাতৃভাষা ঐ মাতৃদুগ্ধের মতোই। শৈশবের পরও যদি কেউ মাতৃদুগ্ধই আঁকড়ে পড়ে থাকে, তবে তার যেমন আর কখনই বৃদ্ধি ঘটবে না, বাংলাভাষাকে আঁকড়ে পড়ে থাকা মানুষেরও তেমন শ্রীবৃদ্ধি ঘটতেই পারে না। তাই বাংলাকে ছাড়তেই হবে। তার জায়গায় পারদর্শী হয়ে উঠতে হবে ইংলিশে। প্রথমত রাজভাষা বলে কথা। তারপর বর্তমানে তো বিশ্বায়নেরই ভাষা ইংলিশ। আর স্কুল কলেজের চৌকাঠ না পেরোতে পারলেও অসুবিধে নাই, বিনোদনের সূত্রে হরদম হাতের কাছে মজুত রাষ্ট্রভাষা হিন্দি। সেই ভাষাতেও সড়গড় হয়ে গেলেই অন্তত কাঁচা পয়সার অভাব হবে না কোনদিনই। তাই ওপারের বাঙালি যেমন জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নেই বাংলাকে সজোরে আঁকড়িয়ে ধরে ছিল একদিন, তেমনি এপারে সেই জীবনজীবিকার সূত্রে অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নেই আমরা বাংলাকে পরিত্যাগ করেছি বহুকাল আগেই। হ্যাঁ সচেতন ভাবেই।
আর তাই একুশ এপারে আজ আরও বেশি ভাবেই অপ্রাসঙ্গিক। আমাদের সমাজ জীবনে বাংলা মাধ্যমের স্কুল কলেজের গুরুত্বই আজ আর অবশিষ্ট নেই। অনেক সরকারী স্কুলেই ইংরাজীস মাধ্যমে সমান্তরাল পঠন পাঠনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরা আর বাংলা মাধ্যমের স্কুলে যায় না। উদয়াস্ত খেটেও অধিকাংশ নিম্নবিত্ত পরিবারের অভিভাবকরা সন্তানকে অধিক ব্যায়ের প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুলে ভর্ত্তি করানোর জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন। দুধের শিশুরা বহুকাল ধরেই অ আ ক খ’র সাথে পরিচয়ের আগেই এ’য়ে আ্যাপেল বি’য়ে ব্যাট সি’য়ে ক্যাট শিখে যায় অভিভাবকদের মুখে সুখতৃপ্তির মধুর হাসি ফুটিয়েই। আর ঠিক এইখানেই এপার বাংলায় ২১শে ফেব্রুয়ারীর অপ্রাসঙ্গিকতা। বরং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আমরা বিশ্বের অন্যান্য ভাষার গুরুত্বকে সম্মান দিতে শিখছি সম্প্রতি। যদিও সেই গুরুত্বের সিংহভাগই ইংলিশ আর হিন্দীর প্রতি বর্ষিত হচ্ছে খুবই স্বাভাবিক ভাবেই। এইটুকুই আজ মাতৃভাষা দিবসের প্রাসঙ্গিকতা এপাড় বাংলায়।
বৃটিশ কলোনির মানসিকতায় পুষ্ট একটি গোটা জাতি, চিরকালই ইংরেজীকেই যে পাখির চোখ করবে, সেটা স্বাভাবিক। কারণ বাঙালির কোনদিনই জাতিসত্ত্বার উন্মেষ ঘটেনি। আর ঘটার কথাও নয়, কারণ বিদেশী প্রভুর চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা ব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা ধেড়ে খোকা আমরা, তাই আমাদের মধ্যে জাতিসত্ত্বার উদ্বোধন কখোনই সম্ভব নয়। জাতিসত্ত্বার উদ্বোধন স্বদেশি শিক্ষা ছাড়া কোনোদিন কোথাও ঘটেনি, আর ঘটবেও না! আর তাই আমরা চিরকালই পরধন লোভে মত্ত। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সম্বন্ধে সচেতন নই। শুধু জেনেছি, ইংরেজী জানলেই আমাদের সমাজে ভালোভাবে রাজত্ব করা যাবে। তাই ইংরেজী শুধুমাত্র একটি ভাষাই নয়, এটি একটি অত্যন্ত কার্যকারি অস্ত্র যা দিয়ে পাঁচজনের উপর প্রভুত্ব বিস্তার ঘটানো যায়। সমাজে নাম যশ প্রতিপত্তির বিস্তার ঘটানো যায়। যে কাজ মাতৃভাষায় সম্ভব নয়। তাই সেই সমাজে একুশের চেতনা বা বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসের প্রাসঙ্গিকতা যে কতটাই অপ্রাসঙ্গিক, সে কথা আনুধাবন করতে বেশি বুদ্ধি লাগে না। বুদ্ধিমানের ভাষাও তাই ইংরেজী।
আমরা বাঙালিরা চিরকালই বুদ্ধিমান জাতি। তাই জানি কখন কোন মন্ত্র আউড়াতে হয়। কোন মন্ত্রেই কার্যসিদ্ধি। তাই একসময়ে সংস্কৃত আউড়িয়ে সমাজে ছড়ি ঘুড়িয়েছি। মাঝে কিছুদিন আরবী ফার্সী আউড়িয়ে নবাবী মহলে আখের গুছিয়ে নিয়েছি। আর বিগত তিনশ বছর ধরে এ বি সি ডি আউড়িয়ে করে কম্মে খাচ্ছি। তাই আমরাই ভালো জানি মাতৃভাষার দৌড় কতটুকু, আর ইংরেজি আর হাল আমলে হিন্দীর হাত কতটা লম্বা। তাই বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস ক্যালেণ্ডারের একটি দিন মাত্র, সাধারণ জ্ঞানের আসরে জানলেই হল। তার সাথে বাংলার কোনোই গুরুত্ব বা তাৎপর্য নেই। এবং আজকের বিশ্বায়নের যুগে, বিশেষ করে তথ্য প্রযুক্তির এই ভুবন জোড়া বিস্তারে বাংলা ভাষার তো কোনই ভুমিকা নেই। ফলে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসই হোক আর বাহান্নর ২১শে ফেব্রুয়ারই হোক, কাঁটাতারের এপারে ভাষা হিসেবে বাংলার আর কোন তাৎপর্যই নেই। নেই কোন ভবিষ্যৎ। এবং বাঙালিকে যদি টিকে থাকতে হয় তবে হয় ইংলিশে আর নয় ন্যূনতম পক্ষে হিন্দীতে পারদর্শী হতে হবে, বিশ্বায়নের সুযোগ সুবিধে নিতে হলে এটাই বাঙালির একমাত্র রক্ষাকবচ। হ্যাঁ আপামর বাঙালির এটাই দৃঢ় বিশ্বাস।
ফলে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসে বিশ্বের অন্যান্য দেশে একুশ যে চেতনার নতুন এক প্রতীক হয়ে ওঠার সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে, আমাদের বাংলায় বিশেষত কাঁটাতারের এপারে সেই সম্ভাবনার ছিঁটে ফোঁটাও আর অবশিষ্ট নেই। বিশ্বায়নের এই যুগে সকল উন্নত দেশ ও সমাজই মাতৃভাষা দিবসের চেতনায় নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির অবস্থানকে দৃঢ় করে তুলতে স্বচেষ্ট হবে। স্বচেষ্ট হবে বিশ্বায়নের সুযোগকে কাজে লাগিয়েই নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের কোণে কোণে ছড়িয়ে দিতে। সেইখানেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল তাৎপর্য। সেই তাৎপর্য আমাদের মতো ইংরেজী নবিশ বাঙালিদের কাছে যতই অপ্রাসঙ্গিক হোক না কেন!
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন