শুক্লা স্যানাল



পায়ের বিষাক্ত ঘা টা কিছুতেই সারছে না ফুলমতিয়ার। অনেক গাছ-গাছালি, ওঝা, গুনীন, ঝাড়-ফুঁক কিছুতেই কিছু হলো না। অবশেষে ফুলডাঙ্গা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাগদার বাবুর ইংরাজী দাওয়াই-ই ভরসা। যদিও গাঁয়ের মোড়ল বলেছিল উ ডাগদার বাবুর কাছে যাস না তুরা। মারাং গুরু গুসাটা হবেক। ফুলমতিয়ার মা শোনেনি। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ফুলডাঙ্গা ব্লকের একেবারে মাঝখানে। পূবদিকে ঘন জঙ্গল আর আদিবাসি সমাজের বাস। পশ্চিম দিকে ছোট্ট আধা শহর। হাইস্কুল, বিডিও অফিস, পঞ্চায়েত অফিস, কিছু শিক্ষিত লোকের বাস। দক্ষিনে এক নাম না জানা নদী। বর্ষায় খরস্রোতা, অন্য সময় শান্ত .নিরীহ। উত্তরে শাল, পিয়াল, মহুয়া আর পলাশের বন। কিছু টুকরো টুকরো পাহাড়। সব মিলিয়ে ফুলডাঙ্গা নয়নাভিরাম। ডাক্তার তাপস রায় কলকাতা ছেড়ে এই আদিবাসি এলাকায় আসতে চায়নি কিন্তু আসার পর এই দু বছরে ফুলডাঙ্গাকে সে ভালবেসে ফেলেছে। বিশেষ করে এলাকার সহজ সরল অকৃত্রিম মানুষ গুলোকে। শহরের লোকেরা নাক কুঁচকিয়ে যাদের বলে বুনো জংলা তাদের সঙ্গে না মিশলে বোঝা যায় না তারা কতটা সরল। হ্যাঁ, রাগলে ওরা বুনো জানোয়ারের মতই গোঁয়ার। কিন্তু কেউ যদি বোঝায় বা ওরা বুঝে তাহলে আবার শিশুর মতোই সরল। প্রকৃতির আদিম অকৃত্রিম সন্তান ওরা। ফুলমতিয়ার মা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছেই হাঁউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে ই ডাগদারবাবু আমার বিটিটাকে বাঁচাই দে কেনে। দ্যাখ, ঘায়ের বিষে আমার চাঁদপানা বিটিটা শুকায় যেছে রে। সঙ্গে মলুয়া, ভুলু, বাঘা এসেছিল। ওরা চেঁচিয়ে বলে , তু থাম কেনে ডাগদার বাবুকে দেখতে দে। ফুলমতিয়া বছর আঠারোর ডাগর যুবতী। আঁটসাট শরীরের বাঁধন, খোঁপায় বনফুল, গলায় পুঁতির হার, নাকে নোলক। চাপা নাক, ভাসা চোখ। একেবারে ঢলেঢলে চেহারা। ডাক্তার রায় ভালো করে পরীক্ষা করে বললেন, শোন ! এ ঘায়ে পচন ধরেছে। রোজ ইনজেকশন লাগাতে হবে। রোজ ড্রেসিং করতে হবে। ডুকরে ওঠে ফুলমতিয়া। উই উই মা ! সূঁই লাগালে মরিং যাবো রি। ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বলে, না লাগালেও মরবে। যা অবস্থা, পা কেটে বাদ দিতে না হয়। তা শুনে মা মেয়ে তারস্বরে চেঁচাতে থাকে। পা কাটা বিটির বিহা হবেক লাই। ও মারাং গুরু বাঁচা কেনে। ডাক্তার নার্সকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ওদের ড্রেসিং রুমে যেতে বলে। সেই শুরু। তারপর থেকে টানা দুমাস ফুলমতিয়ার চিকিৎসা চলেছে। মাঝখানে পায়ের অবস্থা খুব খারাপ থাকায় ডাক্তার ওকে ভর্তি করে নিয়েছিল যাতে দেখাশোনা ঠিকমতো হয়। ফুলমতিয়া এখন ভালো আছে। হাসপাতাল থেকেও ছুটি হয়ে গেছে। এখন ১৫ দিন পরপর আসলেই হবে। ওষুধপত্র যতটা সম্ভব ডাক্তার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। জানে ওদের ওষুধ কেনার সামর্থ নেই।

বসন্ত এসে গেছে। পলাশের রঙে রঙিন উত্তরের পাহাড়, মাটি, জঙ্গল। হোলির আর বেশি দেরী নেই। সেদিন আদিবাসী মহল্লা থেকে ভূলু বাঘারা এসে ডাক্তারকে সবিনয়ে নেমতন্ন করে গেছে। হেই ডাগদারবাবু ! তু আমাদের ভগমান আছিস। না হলি ফুলমতিয়া বাঁচতক লা রে ! ডাগদারবাবু তু আমাদের হোলির পরবে যদি একটু পাঁয়ের ধুল্যাটা দিস আমরা খুব খুশি হবক রে। ডাক্তার রায় মৃদু হেসে বলেছে ... অত করে বলতে হবে না, আমি যাবো। ওরা কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ডাক্তারের মন এত উদাস কেন ? এই নেমতন্ন পাওয়াতে মনটা উথাল পাথাল করছে কেন ? পরবে যাওয়ার ছলে ফুলমতিয়াকে আর একবার দেখতে পাওয়ার বাসনা কি তার মনকে আকুল করে তুলছে না ? ফুলমতিয়ার খালি বেডটার দিকে তাকালেই মনের ভিতর কেন শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এমন তো আগে কখনও হয়নি। সত্যি কি বসন্তের ছোঁওয়া তার মনে লাগল। অস্থির হয়ে ওঠে ডাঃ তাপস রায়। মনে পড়ে যেদিন ছুটি হলো ফুলমতিয়া আস্তে আস্তে বলেছিল, ডাগদারবাবু একটা কথা বুলি ? গুঁসাটা করবিক লা তো ? ডাক্তার মধুর হেসে বলে, তুমি তো অনেক কথা বলো কোনটাতে রাগ করি বলো তো ? ফুলমতিয়া বলে তু আমার ঘাটো ভালো কেনে কুরলি ? আমি ডাক্তার রোগ সারানোই আমার কাজ । কিন্তু কেন ? রোগটা ভালো হইঙ গেলো। তুকে তো দেখতটো পাবক লাই। কেঁপে ওঠে ডাক্তার। নার্সের হাতে কোনদিন ইনজেকশন নেয়নি ফুলমতিয়া। চিৎকার করে ডাকতো ডাগদারবাবু তু আয় কেনে। ডাক্তার এলেই কেমন স্থির হয়ে যেত। অবাক বিস্ময়ে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। ইনজেকশনের কোন ব্যথাই তাকে কাতর করতো না। কতদিন রাউন্ডে আসলে ডাক্তারের হাতটা আলতো করে ধরে বলতো ফুলমতিয়া ... ডাগদারবাবু বস কেনে একটু আমার কাছটাতে ? কখনো বা কোন অবসরে জিজ্ঞেস করতো ... ডাগদারবাবু তু বিহা করিস লাই কেনে ? ডাক্তার হেসে বলতো, মেয়ে পাইনি যে। কেনে তুদের কলকেতাতে মেয়্যা লাই ? আছে, তবে তোমার মত নেই। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠতো ফুলমতিয়ার মুখ। বলতো তবে লিয়ে চল কেনে আমাকে ? ডাক্তার ওর চুলটা আলতো করে ঘেঁটে দিত। আজ সবই কেন মনে পড়ছে ? তবে কি সে ভালোবেসে ফেলল ফুলমতিয়াকে ? 

ফুলমতিয়ার কিছু ভালো লাগে না। না খায়, না ঘুমায়। ঘুরেফিরে ডাগদারবাবু চোখের সামনে ভাসে। যেন শ্রীরাধার পূর্বরাগ। সে দিনের কথা মনে পড়ে ফুলমতিয়ার যেদিন ও কলকাতা যেতে চেয়েছিল। ডাক্তার হাসতে হাসতে বলেছিল কলকাতা যেতে হলে তোমার এ ভাষা ছাড়তে হবে। নইলে কলকাতার লোক হাসবে যে ! ফুঁসে ওঠে ফুলমতিয়া। কেনে ? ভাঁষা কেনে ছাড়তে হবেক ? ই আমার মাতরি ভাষা। মুখের ভাঁষা, বুকের ভাঁষা। ই আমি ছাড়তে পারবক লাই। ই ভাষার লিগ্যে আমি পরাণটো দিতে পারি। তু বুল ডাগদারবাবু ! তু পারবিক তুর কলকেতার ভাঁষাটো বাদ দিতে ? চোখে মুখে তেজ যেন উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল সেদিন। আর ডাগদারবাবু নির্নিমেষ চেয়ে ছিল তার দিকে। ফুলমতিয়ার মা ভাবে তার মেয়ের উপর বুঝি অপদেবতার ছায়া পড়েছে। মনে মনে মারাঙগুরুকে প্রণাম করে সে।

হোলির পরবে এসেছিল ডাক্তার। ধন্য হয়ে গিয়েছিল ওরা। ওদের সাধ্যমত আপ্যায়ন করেছিল। বন মোরগের মাংস, লাল চালের ভাত, পায়েস, মহুয়া। আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল ডাক্তার। ফুলমতিয়াকে আজ বড় সুন্দর দেখাচ্ছে। চাঁদের আলোয় বড় মোহময়ী লাগছিল ওকে। এক ফাঁকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিল আমাকে আজ ক্যামুন লাগছে বুল। ডাক্তার বিড়বিড় করে বলে ... বন জ্যোৎস্নার মতো। কি বুললি ? ফুলমতিয়া অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করে। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায় ফুলমতিয়া। আজ তো তুমি পরবের রানী। ফুলমতিয়া লজ্জারুন হয়ে ওঠে।

পরবের পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ডাক্তারের মন লাগে না কাজে। খ্যাপা বাউল মন ঘুরে ফিরে পৌঁছে যায় ফুলমতিয়ার ঘরে। তাই ঠিক করে ছুটি নিয়ে কদিন কলকাতা থেকে ঘুরে আসবে। খবরটা আদিবাসী পাড়ায় পৌঁছায়। ভুলুয়া চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে ... তুরা শুনছিস কেনে, উ ডাগদারবাবু কলকেতা পলাই যেছে রে। বদলিটা হইঙ যেচে। কথাটা ফুলমতিয়ার কানে পৌঁছায়। এক মূহুর্ত্তে ও মনস্থির করে নেয়। 

ভোরের আলো তখনও ফুটেনি। সকাল ৭-১০ এর ট্রেনটা ধরতে হবে। স্টেশন বেশ কিছুটা দূরে। ভোর ভোর বেড়িয়ে পড়ায় ঠিক। দরজায় তালা দিয়ে এগিয়ে যায়। একি ! চমকে ওঠে ডাক্তার। গেটের সামনে গুটিসুটি মেরে কে বসে আছে ? কে ? কে ওখানে ? ছায়া মূর্ত্তি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে আসে সামনে। মুখের আবরন সরিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। ফুলমতিয়া ! তুমি এখানে ? কখন এলে ? কেন এসেছো ? ফুলমতিয়ার ডাগর দুটি চোখে টলটলে জল। কেঁপে কেঁপে বলে ... তুর লেগ্যে ডাগদার বাবু ! তুর লেগ্যে। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ