সাতসকালেই জাম গাছের মগ ডালটায় উঠে বসে আছে ভাষা। টপাটপ জাম পাড়ছে আর খাচ্ছে। বিলাচ্ছে নিজের সাকরেদদের মধ্যেও। কারুর কিছু বলার উপায় নেই। গ্রাম সুদ্ধু লোকে ওর উৎপাতে অস্থির। ওর বিধবা মা সবসময় ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে, এই বুঝি নালিশ এলো। কি যে হবে এই ডানপিটে মেয়েটার। সারাদিন একটুও শান্তি নেই ওর। এখুনি এখানে, একটু পরেই আবার অন্য কোথাও। ও একা নয়। ওর সাথে আছে গ্রামের আরও কিছু ডানপিটে ছেলের দল। মেয়েরা সাধারণত ওর বন্ধু হয়না, মানে হতে পারে না। বাড়ির লোকেদের কড়া নিষেধ আছে। পুরো দলটাকেই সবাই ভয় পায়। এদের দলের নেত্রী হল ভাষা। মেয়েটার বয়স দশ কি বারো হবে। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি মেয়েটার। মেয়ে হয়ে এতো বুদ্ধি ওর। গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই তাজ্জব হয়ে যায়। যেকোনো জটিল বিষয় চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই সমাধান করে দিতে পারে ও। খুব মিষ্টি দেখতে ওকে। গায়ের রং উজ্জল শ্যামবর্ণ। ছিপছিপে গড়ন। একমাথা কালো ঘনচুল। মা ভালো করে তেল মাখিয়ে আঁটোসাঁটো করে বেনুনি বেঁধে দেয় রোজ দুবেলা। সুন্দর সুন্দর ফ্রক বানিয়ে দেয় রমা,ওর মা। মেয়ে অন্ত প্রাণ। এতো নালিশ আসে। এতো বকতে হয় মেয়েটাকে। রমার রাতে ঘুম আসে না। ভাষা ঘুমিয়ে গেলে ও বিছানায় শুয়ে কাঁদে।
- তুই কি একটুও বড়ো হবি না রে কোনোদিন! বুঝবি না তোর মায়ের কষ্ট। কতো জ্বালা এই বুকের ভিতর।
ভাষার বয়স তখন দেড় কি দুই হবে। এখন ভালই চলতে শিখে গেছে ও। মিষ্টি হাসি মেয়েটার মুখে সারাদিন। খুব ছটফটে একটা মেয়ে। কোলে রাখাই দায়। ওদের একান্নবর্তী পরিবার। ভাষার বাবারা তিন ভাই,চার বোন। বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই,মা আছেন। বোনেদের সব বিয়ে হয়ে গেছে। যাওয়া-আসা লেগেই আছে। ওর বাবা এ বাড়ির ছোট ছেলে। ওর দাদাদের ঘরে সব ছেলে। অরুণ আর রমারই কেবল একটি মেয়ে। শাশুড়ি একটু বিরক্ত, সেটা বোঝে রমা। ননদরাও পিছনে পরে আছে আরও একটা সন্তান নেওয়ার জন্য। রমা মনে মনে কিন্তু খুব খুশি। ওর মেয়ে হয়েছে বলে। প্রতিদিন বড়ো হচ্ছে ভাষা একটু একটু করে। এর মধ্যে একদিন ভাষার বাবা মাঠে গেছিলো চাষবাস দেখার কাজে। যখন ফিরল তখন সব শেষ। বিষাক্ত সাপের কামড়ে মারা যায় অরুণ। ভাষা কিছুই বোঝে না, তার বোঝার কথাও নয়। কিন্তু রমা! সেদিনের পর থেকে রমা যেন কেমন শক্ত পাথর হয়ে গেলো। দিনরাত শুধু কাজ আর কাজ। একার হাতে সংসারের সমস্ত কাজ স্বেচ্ছায় তুলে নিয়ে দিনরাত নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে লাগলো রমা। হাসি মুখে সবার ফরমাশ খাটে ও। বাকি জায়েদের তো পোয়াবারো। বেশ দিন কাটছে ওদের শুয়ে, বসে, গড়িয়ে, নিন্দে-মন্দ করে।
বেলা গড়িয়ে চলেছে। ভাষার পাত্তা নেই!মনটা আনচান করলেও হাতের কাজগুলো না সেরে রমা ওকে খুঁজতেও যেতে পারছে না। হঠাৎ ও বাড়ির রাঙা কাকিমার চিৎকার শুনে পুকুরঘাট থেকে হাতের কাজ ফেলে ধরমড়িয়ে ছুটে আসে রমা। প্রশ্ন না করলেও ও জানে নিশ্চয়ই ভাষা একটা কিছু কাণ্ড বাধিয়েছে আবার।
- হ্যাঁ গো অরুণের বৌ তোমার মেয়েটার কি লজ্জাশরম বলে কিছুই নেই?
- আবার কি কিছু করেছে ও,কাকিমা? রাঙাকাকিমা মানে রমাদের অল্প বয়সী পাড়াতুতো খুড়শাশুড়ি।
- করেনি আবার? না কি আমি সাধ করে গলা সাধতে বেরিয়েছি পাড়াময় এই ভর দুপুরবেলায়।
রমার মাথা নিচু হয়ে যায়। এক উঠোন লোকজন তখন জড়ো হয়েই গেছে, তামাশা দেখার জন্য। রোজই এ বাড়িতে কিছু না কিছু নতুন ঘটনা। ওরা ঠাট্টা করে বলে ‘বিনে পয়সার তামাশা’। বড়ো বৌ এর কর্কশ আওয়াজ ভেসে আসে রমার কানে।
- নাও দেখি বাপু রাঙাকাকিমা, এবার বলতে শুরু করো। অনেক বেলা হয়েছে। সবার খাওয়া-দাওয়া হয়ে গিয়ে ভাত ঘুমের সময় এখন। এই সময় আবার রামায়ণ শুরু হল। মেজ, সেজ জা মুচকি মুচকি হাসছে দালানে দাঁড়িয়ে।
এদিকে, ভাষা ও তার দলবল খোশমেজাজে আছে। কেউ গা চুলকাচ্ছে। কেউ ফিকফিক করে হাসছে। আবার কেউ মুখ ভেংচাচ্ছে রাঙ্গা কাকিমার দিকে মুখ করে। ভাষা নির্বিকার,নিস্তব্ধ,মুখ খানিতে কোনও চঞ্চলতা নেই-একেবারে ভাবলেশহীন।
- এই জন্য বলেছিলাম ছোট বৌ, মেয়ে কে বাঁচিয়ে রেখো না। জন্মের সাথে সাথেই নুন খায়িয়ে মেরে ফেলো, শুনলে না কথা। এবার সমলাও।রমার শাশুড়ি পান চিবোতে চিবোতে, বিষ ঝরাল কিছুটা।
- মা দয়া করে ওভাবে বলবেন না। বাপ মরা মেয়েটা তো আপনাদেরই বাড়ির সম্মান।
- হুম, কতো সম্মান সেতো দেখতেই পাচ্ছে গ্রাম সুদ্ধ লোকে।
রমার চোখে জল এসে যায়। সেই জন্মলগ্ন থেকে ভাষার মৃত্যু কামনা করে চলেছে এরা। শুধু মাত্র মেয়ে বলেই! ভাষাকে ওর বাবার মৃত্যুর জন্যও দায়ী করতেও ছাড়েনি। কিন্তু রমা বোঝে এইসব কুসংস্কার। দায়ী যদি সত্যিই কেউ হয় তাহলে ওই ওপরে বসে থাকা বিধাতা। উনিই ভাষার বাবার কপালে এতো কম আয়ু লিখেছিলেন জন্মের সময়।
এবার ঝাঁঝালো গলায় তেড়ে ওঠে রাঙাকাকিমা।
- বলি, ও ভাষার মা। তুমি কি তোমার মেয়েকে শাসন করবে না আমিই দেবো লাগিয়ে দু-চার ঘা।
- আজ ও কি করেছে কাকিমা?
- কি করে নি,সেটাই বলো? আমার রান্নাঘরে ঢুকে দুধের বাটি, মাছের বাটি সব চুরি করেছে। কোন বেড়ালের নতুন ছানা হয়েছে তাদের খাওয়াবে বলে।
- কি করে জানলে এই কাজ ভাষা দিদিই করেছে? ভাষার প্রধান সাকরেদ আট বছরের দিপু প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় রাঙা কাকিমার দিকে। রাঙা কাকিমা কিন্তু একটুও ভ্যাবাচেকা খায় না। বরং চেঁচিয়ে ওঠে আরও জোরে।
- মারবো টেনে এক থাপ্পড়। শুধু মুখে মুখে কথা না। দাঁড়া, তোর মাকেও ডেকে পাঠাচ্ছি।
- থাক দিদি। আবার ওর মাকে কেন? এই দিপু চুপ কর। বাড়ি যা, মা চিন্তা করছে। অনেক বেলা হয়ে গেছে।
দিপু চুপ করে যায়। বাড়ি সে যাবে না, ভাষা দিদি যেন মায়ের হাতে মার না খায় সেই দায়িত্ব তো তারও। কারন ওই চুরিতে তাদেরও মদত ছিলো যে।
রমা এবার শান্ত গলায় বলে ...
রমা এবার শান্ত গলায় বলে ...
- আমি বিকালে হারু গোয়ালার থেকে দুধ কিনে তোমাকে দিয়ে আসবো কাকিমা। আর তোমার মাছের দামটাও।
তাতেও সুর নরম হয়না। কটমট করে ভাষার দিকে তাকিয়ে রাঙা কাকিমা বলে ওঠে। আর দুপুরে কি আমি সাদা ভাত চেবাবো? বড়ি পোস্ত, ফুলকপির ডালনা, কলাইয়ের ডাল...এই দিয়ে কি ভাত খাওয়া যায়?
এবার তামাশা দেখতে জড়ো হওয়া সবারই একটু হাসি পায়। হাসি পায় রমারও, কিন্তু সে হাসলে এখুনি লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে যাবে। তাই অনেক কষ্টেই নিজেকে সামলায় রমা।
- সেই তো। ঠিক আছে, আমি এখুনি আমার আর ভাষার ভাগের মাছের টকটা গিয়ে তোমার ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসছি কাকিমা। শাশুড়ি কটমট করে রমার দিকে তাকায়।
- আদিখ্যেতা দেখলে গা জ্বলে যায়। সহ্যের একটা সীমা আছে ছোট বৌ। ওই মেয়েটাকে হয় শাসন কর, না হও মা-তে মেয়েতে মিলে বিদেয় হও এই বলে দিলুম আমি। এইভাবে কোনও সংসারে লক্ষ্মীর বাস হয়না। সেলাই করে দু-চার পয়সা সংসারে দাও বলে তোমার যখন যা ইচ্ছে তুমি করবে মনে করেছো? চলবে না আমার সংসারে এইসব একেবারেই চলবে না এই বলে রাখলুম আমি।
রমা মাথা নিচু করে থাকে। ভাবে কোথায় যাবো ও। এই বাড়ি থেকে ভাত উঠলে আমরা মা-মেয়ে যে না খেয়ে মরবো। রাস্তায় শেয়াল-কুকুরের অভাব নেই, সে কথাটা খুব ভালো করেই বোঝে ও। আর যাবেই বা কোথায়! থাকার মধ্যে আছে এক ভাই ও ভাইয়ের বউ, তারা ভয়ে খোঁজ নেয়না। যদি ঘাড়ে চেপে বসে ওরা। তাই মুখ কাঁচুমাচু করে, ভয়ে ভয়ে হাত জোড় করে রমা বলে।
- আচ্ছা মা, আমি বোঝাবো যেন ও আর কখনও এইরকম কাজ না করে। তামাশা দেখতে আসা লোকগুলো হঠাৎ জোরে হেসে ওঠে। রমার সেজ যা বলে ওঠে।
- বোঝাবে তোমার ওই ধিঙ্গী মেয়েকে? থাক রমা থাক। কাদের মিথ্যে সান্ত্বনা দিচ্ছো তুমি! সারাজীবন ওই মেয়েকে নিয়ে জ্বলে মরবে তুমি,আর সাথে আমরাও। এই বলে দিলুম, মিলিয়ে নিও। রমার মুখে টুঁ শব্দ নেই। ওর ঠিক জানা নেই এর উত্তর।
- নাও নাও অনেক হলো বাপু। ছোট বৌ মাছের টক দেবার হলে দাও। নাহলে বাড়ি গিয়ে সাদা ভাতই চিবোই। খেঁকিয়ে ওঠে রাঙাকাকিমা।
তাড়াতাড়ি হেঁসেলের দিকে ছুটে যায় রমা। নিজের আর মেয়ের ভাগের মাছটি দিয়ে ওকে এখনের মত বিদায় করে ও। আজকের মতো তামাশা শেষ হয়। দু-পিস মাছের টক নিয়ে হাসি মুখে বাড়ি ফেরে রাঙা কাকিমা। হাসিঠাট্টা করতে করতে সবাই যে যার ঘরে চলে যায়। পুকুরঘাটে নিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে স্নান করায় ছোটবউ। দুপুরে শাক ভাজা আর অল্প একটু ডাল দিয়ে ভাত খায় মা-মেয়েতে মিলে। কতো বোঝায় রমা তার মেয়েকে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বারবার চোখ মোছে আঁচলে। আর ভাষা? সে তখন নির্বিকার মুখে মায়ের চোখের জলের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে যায়, মায়ের ঠোঁট নাড়া দেখে মায়ের শব্দ বোঝার চেষ্টা করে যায়... ওর যে এছাড়া কোনও উপায় নেই। কারন ভাষা যে জন্মলগ্ন থেকেই ভাষাহীন। শব্দেরা ওর কাছে আসা যাওয়া করে না কখনই।
1 মন্তব্যসমূহ
আমিও ভাষাহীন। তাও বলি অসামান্য , অসাধারণ।
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন