পলাশ কুমার পাল

pakash


                                                                                         
"যেই সেই রাজপুত্রটি রাজকুমারীর গালে হাত বুলিয়ে দিল, ঠিক তখনই রাজপ্রাসাদের ও রাজ্যের সমস্ত লোক প্রায় চারশত বছর পর আবার জেগে উঠল....." নিরুপমা দেবীর কথা শেষ হওয়ার আগেই কৌতুহলবশত ছোট্ট রিপন বলে উঠল,"তারপর?" 
"তারপর....."
গল্প শেষ হওয়ার আগেই বাসন্তীর গলার আওয়াজ,"রিপন, রিপন! পড়ছিস? না ঠাকুমার সঙ্গে গল্প করছিস?" 
"না, মা! পড়ছি।", রিপন চিত্কার করে বলে।

রিপনের এই মিথ্যা কথায় নিরুপমা দেবী অবাক হলেন। তাঁর একমাত্র ছেলে তাপসের একমাত্র ছেলে এই ছোট্ট রিপন। বয়স মাত্র সাত বছর। সে ঠাকুমার কাছে রূপকথার গল্প শুনতে এবং ঠাকুমার সঙ্গে খেলতে খুব ভালোবাসে। অথচ আর সাধারণ মায়ের মতোই পড়ার সময়ে এই গল্প করা বাসন্তীর পছন্দ নয়। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পাঠক্রমের চাপ অনেক। ঠিকমতো পড়াশোনা না করল স্কুলে অভিভাবকের ডাক পরে।

রিপনের বুদ্ধিও ভালো নয়।  তার উপর পড়ার সময়ে যদি গল্প করে তাহলে স্কুলের পড়া হবে না -এই বিশ্বাস বাসন্তীর। তাই ঠাকুমার সঙ্গে রিপনকে গল্প করতে দেখলে বাসন্তী রিপনকে বকাবকি করে।  সেই কারণে রিপন মিথ্যা বলবে এটা নিরুপমা দেবী মেনে নিতে পারেন না।  কারণ শৈশবে মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিলে সেই মিথ্যাই হয়তো ভবিষ্যতে বৃক্ষ হয়ে যেতে পারে- তা যতই প্রিয় মিথ্যা হোক। তাই তিনি বললেন,"দাদুভাই! তুই মিথ্যা বললি কেন ? উম?.. .মিথ্যা কখনো বলতে নেই! মিথ্যা বললে কেউ তাকে ভালোবাসে না। "

রিপন দু'হাতে নিজের দুটি কান ধরে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলে,"সরি, ঠাকুমা! আর কখনো বলব না।"

রিপনের এই ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গি দেখে নিরুপমা দেবী মনে মনে খুশি হন। এই বৃদ্ধ বয়সে ছেলে ও বৌমার তিক্ত ব্যবহারে অতীষ্ট সংসার জীবনে বিধবা নিরুপমা দেবীর একমাত্র শ্বাস এখন এই রিপন।  যতক্ষণ সে কাছে থাকে ততক্ষণ তিনি বাঁচার অক্সিজেন পান। বিশেষ করে নিজের জানা রূপকথার নানা গল্প রিপনকে শুনিয়ে তাঁর হৃদয়ভার অনেকটা লাঘব হত।  নিরুপমা দেবী যখন রিপনের কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে উদ্যত হন তখন রিপন আগের কথার রেশ টেনে বলে ওঠে,"জানো ঠাকুমা, আমি মিথ্যা না বললে মা তোমাকেও বকত!" একটু থেমে আবার বলে,"এবার তুমি গল্পটা শেষ করো তো....."

নিরুপমা দেবী রিপনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। রিপনের এই সরল মনের সঙ্গে তিনি ছোট্টবেলার তাপসের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। যখন তাপস ছোট্ট ছিল কেবল সে মায়ের কোলের কাছে ঘেঁষে বসে গল্প শুনতে চাইত।  রূপকথার নানা গল্প বলা ও শোনার মধ্য দিয়ে মা ও ছেলে-দুইয়ের ক্ষুদ্র সংসারে রাত শীঘ্র শেষ হয়ে যেত।
"বলোনা ঠাকুমা!" রিপনের কৌতুহলকে নিরাশ না করে নিরুপমা দেবী কিছুটা নীচু স্বরে আবার বলতে শুরু করেন,"তারপর সেই রাজ্যের রাজা সেই ভিনদেশী রাজপুত্রকে......"

- "মা! আপনি পড়ার সময় বকবক করছেন। ওর পড়াশোনাটা নষ্ট করতে চান। তাছাড়া এইসব ছাই-পাঁশ গল্প ওর মাথায় ঢোকচ্ছেন!",নিরুপমা দেবীর গল্পের মাঝে বাসন্তী দৈত্যকারে এসে উপস্থিত হল।
- "না, মানে......"নিরুপমা দেবী কী বলবেন ঠিক করতে পারে না। তার এই গল্পগুলি ছাই-পাঁশ? এই শুনেই তো তাপস...."
 তত্ক্ষণাত্ রিপন বলে ওঠে,"না মা! ঠাকুমা কিছুতেই বলতে চায়নি।  আমিই জোড় করেছিলাম, তাই...."
- "তুই চুপ কর! তোকে আর ঠাকুমার গুণ গাইতে হবে না।  বাসন্তীর ধমকে রিপন ভয়ে চুপ করে যায়।  কোলের কাছে ইংরাজী বইটি নিয়ে সেটির দিকে তাকিয়ে থাকে।  কোনো শব্দই দৃষ্টির আয়ত্তে আসে না।  তার মনে হয় রূপকথায় দৈত্য-চরিত্রের সঙ্গে তার মায়ের অনেক মিল আছে।

এদিকে নিরুপমা দেবী ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজার দিকে হাঁটতে থাকেন।  সত্তর বছর বয়সের ভার শরীরে পরেছে।  বাম-পা'টা বাতে ধরেছে।  তাই খুঁড়িয়ে চলেন।  এছাড়া শরীরে আর কোনো রোগ নেই।  এখনও তিনি সংসারের অনেক কাজ করেন। করতে বাধ্য।  না খাটলে খাওয়াবে কে? খাটলে তো শরীরটাও সুস্থ থাকে। তবু নিরুপমা দেবীর বারবার মনে হয় জীবনে এতকালের ত্যাগের পরিণাম কি এটাই!  চৌকাঠে পা দিতে গিয়ে দেখেন গতকালের দেওয়া আলপনাটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে।  একটু থেমে যখন তিনি চৌকাঠে পা দেন বাসন্তী বলে ওঠে,"মা! কাল রাত্রির বাসি বাসনগুলো বের করে দিয়েছি।  ধুয়ে দিন। আমি রিপনকে একটু দেখি।  পড়ছে না।  আর হ্যাঁ, বাসন ধোয়া হয়ে গেলে আনাজগুলো কেটে দেবেন।  রিপন তো ভাত খেয়ে স্কুল যাবে।

নিরুপমা দেবী খোঁড়াতে খোঁড়াতে কলতলার দিকে চলে গেলেন।  তিনি জানেন এই সমস্ত কাজ প্রত্যহ তাঁকেই করতে হয়।  না করলে বৌমা অশান্তি করে। সংসারে বাসনমাজা, কাপড়কাচা, ঝাঁট দেওয়া, ঘর মোছা -সব কাজই করতে হত। কষ্ট হলেও নিরুপায়ভাবে মুখবুজে সব কিছু করত।  তাপসকে বললে সে বলে,"কাজ করলে তো শরীর সুস্থ থাকবে......"
 "কিন্তু....."
 নিরুপমা তার শারীরিক কষ্টের কথা বলার আগেই তাপস তাঁকে থামিয়ে দিত,"কিন্তু কিছু নয় মা।  তোমার বৌমা তোমাকে ভালোর জন্যই বলে।

নিরুপমা দেবীর তাই কোনোদিন বলাই হয়নি তাঁর সঙ্গে বাসন্তীর প্রত্যহ খিটিরমিটির করার কথা।  আসলে বাসন্তী চেয়েছিল নিরুপমা দেবীকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে কলকাতা শহরে স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে  তার বাপের বাড়িতে থাকবে।  মা ও বাবা মারা যাবার পর পিতৃসম্পত্তির অর্ধেক অংশের ভাগ ভাইয়ের কাছ থেকে আদায় করেছে।  সেখানে থাকলে তাপসেরও যেমন অফিস যাওয়ার সুবিধা, তেমন রিপনকে আরও ভালো কোনো স্কুলে ভর্তি করা যাবে। কিন্তু বাসন্তীর এই ইচ্ছায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় নিরুপমা দেবী।  তিনি নিজের স্বামীর ভিটা ত্যাগ করে ছেলের শ্বশুড়ের ভিটাতে গিয়ে বাস করতে চাননি।  তিনি বলেছিলেন,"তোরা যা।  আমি এখানেই থাকব।  কিন্তু তারা পাড়া-প্রতিবেশীর নিন্দার ভয়ে  তাঁকে একাকে ছেড়ে যাননি।

বাসনে কসবাইট ঘষতে ঘষতে নিরুপমা দেবী বর্তমান প্রসঙ্গ থেকে পুরানো স্মৃতিতে চলে যান।  তাঁর মনে পড়ে তাপসের যখন আট বছর বয়স তখন সে পিতৃহারা হল।  সেই সময় লোকের বাড়িতে এইভাবে বসে বাসন মাজত সে।  তা থেকে যেটুকু উপার্জন করত তাপসের লেখাপড়ার খরচাতেই শেষ হয়ে যেত। তাই নিরুপমা দেবী স্বামীর সেলাই মেশিনে বসে রাত জেগে জামাকাপড় সেলাই করত।  তা সত্ত্বেও মাঝে মধ্যে তাঁকে উপবাসে দিন কাটাতে হত।  তবে সে সব কষ্ট নিরুপমা দেবী ছেলেকে বুঝতে দেননি । রূপকথার রাজপুত্রের মতোই তাপসকে লালন করত।  নিরুপমা দেবীর স্বপ্ন ছিল একদিন এই তাপসই তাঁকে সুখী করবে- রূপকথার দেশের মতোই।  আজ সেই ছেলে বড় হয়েছে।  অনেক উপার্জন করছে একটি সরকারি দপ্তরে কাজ করে। অথচ সেদিনের মতো আজও নিরুপমা দেবী বাসনের পোড়া, সগরি তুলে যাচ্ছেন.....ট্যাপের মুখ খুলে বাসন ধুতে ধুতে চোখ ঝাপসা হয়ে যায়।  নিরুপমা দেবীর মনে হয় প্রত্যহ বাসনগুলি এঁটো হয়, প্রত্যহ তাদের ঘষতে মাজতে হয়, প্রত্যহ তাদের ট্যাপের মুখে জলে ধরা হয়......বাসনগুলির কী কোনোদিন শান্তিতে থাকতে পারবে না?

নিরুপমা দেবীর আনাজকাটা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। ঠিক তখনই পিছন থেকে বাসন্তীর প্রশ্ন, - "মা! ঘরটা ঝাঁট দিয়েছিলেন? মুছেছিলেন?"
 -"তুমি ঝাঁট দাওনি?" নিরুপমা দেবী পিছন দিকে ঘুরে অবাক চোখে তাকায়।  নিরুপমা দেবী  ভেবেছিলেন বাসন্তী হয়তো ঝাঁট দিয়ে মুছেছে।  তাই তিনি আর ঝাঁট দেননি।
- আমি কি ঝাঁট দিই? নূতন শুনছেন নাকি! আষ্ঠে-পিষ্ঠে গিলছেন।  গতর খাটাতে হবে না!" বাসন্তী খেঁকিয়ে ওঠে।  শেষ বাক্যটি নীচু স্বরে বললেও নিরুপমা দেবীর কানে পৌঁছায়।  তিনি প্রত্যুত্তরের কোনো ভাষা খুঁজে পান না।  মুখ দিয়ে নিঃসৃত 'বৌমা' শব্দটি অন্তরেই রয়ে যায়।  অপমানে বুক ফেটে যায়।  তবু আর কোনো শব্দ তিনি উচ্চারণ করেননি।

ওদিকে রান্নাঘরে বাসনের ঝন ঝন শব্দের সঙ্গে বাসন্তীর আবার চিত্কার শোনা যায়, - চোখে কি দেখতেও পান না?"
 -কেন? কী হয়েছে?"
 - কী আর হবে? সাঁরাশিতে সগরি লেগে আছে!
 - তুমিও তো ধুতে পারো বৌমা! আমি যা পেরেছি তাই করেছি।  নিরুপমা দেবী অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে।  বারবার অপমান তিনি মেনে নিতে পারেনি। সারাদিন কেবল অজুহাত পেলেই বাসন্তী তাকে খোঁটা দেয়। বাসন্তী নিরুপমা দেবীর এই কথায় আরও তিক্ত হয়ে ওঠেন।  গরম তেলে কোনো কিছু দিলে যেমন ছেঁক করে ওঠে, তেমনই বাসন্তী বলে ওঠে,"আপনার ছেলে আসুক, বলছি।  আমায় বাসন ধুতে হবে? আমি তো বলেছিলাম ঝি রাখতে।  আপনার জন্যই সে রাখেনি।

নিরুপমা দেবী একটু নরম হয়েই বলে, -  ঘরের বৌমা, বাসন ধুতে অপমানের কী হল?
বাসন্তী শ্বাশুড়ির এইরূপ কথায় একটু চমকে ওঠে।  এমন করে তো কোনোদিন সাহসী কথা বলেননি।  যখন যা বলত, মুখ বুজে তিনি সব সহ্য করে নিতেন। তাই কথা না বাড়িয়ে বাসন্তী চুপ করে যায়।  তবে এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মাথার মধ্যে নানা পরিকল্পনা গাঁথতে থাকে।

বৌমা চুপ করে যাওয়ায় নিরুপমা দেবী চুপ করে যান।  রিপন স্কুলে চলে যাওয়ার পর বাসন্তী ঘরে ঢুকে সিরিয়াল চালিয়ে বসে পরে। সারাদিন রান্না ও খাওয়া ছাড়া বাকি সময় টিভি ও কম্পিউটারেই কেটে যায়। নিরুপমা দেবী সাবান জলে ভেজানো এক বালতি কাপড় কেচে, স্নান করে ঘরে গিয়ে শুয়ে পরেন।  নানা কথা মনের মধ্যে ভেসে বেড়ায়- বাদলদিনের মেঘের মতো।  সারাজীবন একটা সুখ চেয়েছিলেন। অথচ? ছেলেকে শিক্ষিত ও উপার্জনী করে তোলবার জন্য পরনের ভালো কাপড় ও গহনার শখ ত্যাগ করেছিলেন। এমনকি খিদেকেও চেপে রাখতে হয়েছিল। ছেলের বিয়ে দিয়ে শ্বাশুড়ি ও বৌমাতে মিলে সুখে সংসার করবে -সেই আশাও আজ মরে গেছে।

কিছুদিন আগে বৌমার সঙ্গে খিটিমিটি হওয়ায় তাপস বলেছিল বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর কথা।  সেদিন নিরুপমা দেবী বুঝেছিলেন তাঁর জীবনের মূল্য।  পৃথিবীতে 'সুখ' শব্দটির অর্থ সবার জীবনে অনুভূত হয় না।  যে মুটের কাজ করে, সারাজীবন তাকে বোঝাই বইতে হয়।  নিরুপমা দেবী জীবনের বিগত সময়ে যে কষ্ট  ও ত্যাগ করেছে, এই শেষ বয়সেও তার থেকে হয়তো তাঁর রেহাই নেই!

নিরুপমা দেবী জানলার দিকে চেয়ে থাকেন।  জানলার পর্দাটি মাঝে মাঝে হাওয়ায় সরলেও, আবারও সেটি যথাস্থানে এসে ঘরটিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রাখছে।  বাইরের কোনো দৃশ্যই চোখে পরছে না।  কলিং বেলের আওয়াজে নিরুপমা দেবীর ঘুম ভাঙে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন সাড়ে চারটে বাজে।  রিপন এলো।  বিকাল হয়ে গেছে খেয়ালই হয়নি। ঘুমিয়ে পরেছিলেন।  দুপুরে বৌমা খেতেও ডাকেনি।  তিনি আর উঠলেন না।  তক্তার উপরেই শুয়ে রইলেন।

প্রায় একঘণ্টা বাদ রিপন ছুটে এলো, ঠাকুমা, ঠাকুমা! ওঠো লুডো খেলব।  এই বিকালের সময় রিপন হয় ঠাকুমার হাত ধরে কোথাও ঘুরতে যায় বা একসঙ্গে ঘরে বসে খেলে।  লুডো খেলতেই রিপন বেশি পছন্দ করে।  লুডো হাতে করে নিয়ে এসে সে ঠাকুমার পাশে বসে।  লুডো খেলতে খেলতে রিপন বলে, ঠাকুমা সেই রূপকথার গল্পটা বল।  সেই দেশে ভিনদেশের  রাজপুত্রের কী হল?

তার তো রাজকন্যার সঙ্গে বিবাহ হয়ে গেল......" এইভাবে ঠাকুমা ও নাতীতে খেলা ও গল্প করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।

সন্ধ্যার সময় তাপস ঘরে ফিরলে বাসন্তী শ্বাশুড়ির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে বিচার চাইল।  না হলে কলকাতা চলে যাওয়ার কথা বলল।  তাপস  বাসন্তীর এইসব অভিযোগ শুনে ভাবল মা'ই দোষী।  মাকে ডেকে বলল,তোমার বয়স হয়েছে।  বৌমা যা বলছে শুনতে পারো না!  তোমায় বুড়ো বয়সে ভীমরুতিতে ধরল নাকি?
নিরুপমা কিছু বলতে যান। কিন্তু তাপস তার মাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই অনর্গল বলে যায়, এরপর হলে আমি অন্য ব্যবস্থা নেব!

নিরুপমা দেবী চুপ করে যান।  কারণ পরিবারে অশান্তি তিনি চান না।  তবে তাপসের কথায় তিনি মনে ব্যথা পান।  সারাদিন অফিসে থাকায় সে জানলই না সংসারের আসল চিত্র। সেই বিচার করল! মায়ের কথাগুলি তো শুনতে পারত। তারপর না হয়...সে বৌয়ের কথাই শুনল? এইভাবে অশান্তির মধ্য দিয়ে প্রায় ছয়মাস অতিক্রান্ত হল।  নিত্যদিনই নিরুপমা দেবী অপমানিত হতে থাকেন। অত্যাচারিতও।  ক্রমশ নিরুপমা দেবী সেই সংসারে একলা হয়ে যেতে লাগলেন।  কেবল রিপনই ছিল তাঁর কিছুক্ষণের আনন্দের শ্বাস।  কিন্তু বাসন্তী রিপনকে ঠাকুমার সঙ্গে বেশি মিশতে দিত না।  ফলে একমাত্র খুশিটি থেকেও নিরুপমা বঞ্চিত হতে থাকলেন। আর খাওয়া নিয়ে শ্বাশুড়িকে বারবার খোঁটা দেওয়া বাসন্তীর অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল।

নিরুপমা একসময় জ্বরের মধ্যে পরলেন।  ফলে সংসারে কোনো কাজ করতে পারলেন না দু'দিন।  দু'দিন পর জ্বর  একটু ভালো হলেও শরীর দুর্বল ছিল। সকালে বারান্দায় পায়চারী করলেও কোনো কাজ করতে পারছিলেন না।  স্নান করে কাপড় ছাড়তে গিয়ে দেখলেন বাসি কাপড়গুলি ময়লা অবস্থাতেই পরে আছে।  জলকাচ পর্যন্ত হয়নি।  বাসন্তীকে বলতে গেলে সে বলে,আপনার কাপড় আমি কাচব কেন? আমি কি আপনার ঝি? আপনি কেচে নিন।   এরই সঙ্গে আরও কিছু ময়লা কাপড় দিয়ে বলে, শরীর তো সুস্থ হয়েছে! এইগুলোও কেচে দেবেন।

নিরুপমা দেবী নিরুপায়ের মতোই অসুস্থ অবাস্থাতেই কাপড় কাচতে বসে যান। তিনি জানেন না করে উপায় নেই। করলে যদি সংসারটিতে শান্তি থাকে! শরীর দুর্বল হওয়ায় কিছুক্ষণ কাপড় কাচার পর মাথা ঘুরে পরে যান। মাথাতে জোড় আঘাতও লাগে। ভাগ্যিস সেদিন অফিসে ছুটি থাকায় তাপস ঘরে ছিল।  সে নিরুপমা দেবীকে তুলে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে এনে শুশ্রূষা করে। 

নিরুপমা দেবীর যখন জ্ঞান ফেরে, দেখেন মাথা গোড়ায় রিপন বসে আছে।  সে পাখা নিয়ে তাঁকে হাওয়া করছে।  তার মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।  নিরুপমা চোখ খুলতেই তার মুখে হাসি ফেরে। সে বলে ওঠে, ঠাকুমা তুমি ভালো হয়ে গেছ? এই জিজ্ঞাসার মধ্যে অন্তরের গভীর টান অনুভব করেন নিরুপমা দেবী।  তিনি রিপনকে পাশে দেখে খুশি হয়ে মৃদু হেসে ঘাড় নাড়েন।  রিপন ছুটে বাবাকে খবরটি দিতে যায়।  আর আসে না।  নিরুপমা শুয়ে শুয়ে বাসন্তীর গলার আওয়াজ শুনতে পান, ভালো হয়ে গেছে যখন আর যেতে হবে না।  স্কুলের পড়াগুলো পড়। বস!

দেয়ালে ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে ঘুরে যায় একইভাবে। জানলার পর্দাটা আজ আর নড়ে না- একইভাবে ঝুলে থেকে ঘরটিকে সর্বদা অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে। 

কতদিন রিপনকে রূপকথার গল্প বলা হয়নি।  সেই রাজার দেশ, রাজপুত্র, রাজকন্যা, রাক্ষস, দৈত্য....... এই পৃথিবীতেও দৈত্যের অভাব নেই। তবু রূপকথার মতো কোনো কাল্পনিক ঘটনা ঘটে না নিরুপমা দেবীর জীবনে। কোনো রাজপুত্র এসে তাঁকে এই সংসার থেকে উদ্ধার করে না।  বা এমন কোনো সোনার কাঠির হদিস তিনি পাননি, যা ছুঁয়ে দিলে সংসারে চিরশান্তি আসে।  ক্রমে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়।  রিপন ঘুম থেকে উঠে ঠাকুমার কাছে ছুটে আসে,"ঠাকুমা এখন কেমন আছো?"
 - ভালো রে।" হাসতে হাসতে বলে। 
 রিপন সেই হাসির মাঝেও একটা বাদলদিনের ছায়া দেখে । সে বুঝতে পারে না ঠাকুমার কী হয়েছে!
 - লুডো খেলবে?"
 - আন!" নিরুপমা দেবী নিজের ভাবনা থেকে দূরে সরে যেতে চাইছিল। 

লুডো খেলতে খেলতে রিপন লক্ষ্য করল ঠাকুমা বারবার অনেকটা এগিয়ে গিয়েও ভুল দান দিয়ে সাপের মুখে পরে নীচে নেমে যাচ্ছে। এটা কি ইচ্ছাকৃত?  না এটাকেই জয় বলে?

খেলা শেষ হলে নিরুপমা দেবী একবাটি মুড়ি খেয়ে শুয়ে পরেন। শরীর দুর্বল থাকলেও ঘুম ধরে না। পাশের ঘরে সিরিয়ালের আওয়াজ শোনা যায়। গভীর রাতে হঠাত্ একসময় সেই সিরিয়ালের আওয়াজকে ছাপিয়ে বাসন্তীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন,"...একটু সেরে উঠলে তুমি ঐ বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসো। আমি আর সেবা করতে পারব না! তাছাড়া কলকাতাতেও......" কথাগুলি শোনার জন্য কৌতুহলবশত ছেলের ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ঠিক তখনই দেয়াল ঘড়িতে এগারোটার ঘরের ঘণ্টা বেজে ওঠে।  বাকি কথাগুলি ঘড়ির ঘণ্টার আওয়াজে চাপা পরে যায়।

নিরুপমা দেবীর বুক ছেঁক করে ওঠে। বৃদ্ধাশ্রম? তাহলে কী........ ভাবতে পারে না।  তিনি তো চাননি এই ভিটা ছেড়ে অন্যত্র যেতে। বারবার শত অপমানেও স্বামীর ভিটাকে আগলে পরেছিলেন। সংসারের সুখের কথা চিন্তা করে বারবার আত্মমর্যাদা ত্যাগ করে ভিটাতে পরেছিলেন। এরপরেও তাঁকে ত্যাগ করবে তাঁরই ছেলে! আর যদি ত্যাগই করে তাহলে ছেলের পয়সাতে তিনি বৃদ্ধাশ্রমে থাকবেন কেন? নানা প্রশ্ন নিরুপমার মাথায় ঘুরপাক খায়।  তিনি যদি চলে যান তাহলে কি সংসারটি সুখী হবে? এই কি তবে সেই রূপকথার দেশের পরীর সোনার কাঠি? রাত ঘন হয় ভাবনার স্তরে স্তরে......

সকালে মায়ের উঠতে দেরী হচ্ছে দেখে তাপস ঘর ঢুকে দেখে নিরুপমা দেবী ঘরে নেই। সারাদিন নানা জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর, কোনো খোঁজ না পেয়ে থানায় ডাইরী করে ঘরে ফেরে। ঘরে ফিরতেই রিপন জিজ্ঞাসা করে,"বাবা, বাবা, বাবা! ঠাকুমা কোথায় গেছে? কই ধরে আনবে বলে গেলে, ধরে আনলে না যে? আমায় কে রূপকথার গল্প বলবে!"

তাপসও সারাদিন ভাবছিল মা কোথায় যেতে পারে? কেনই যাবে? কাল কি তবে মা বাসন্তীর কথাটা শুনেছে? বাসন্তী তো বেশ জোড়েই..... 

তাপস ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না।  তার ও বাসন্তীর থেকে রিপনের উদ্বিগ্নতা অনেকটাই বেশি।  কারণ সে রূপকথার মতোই তার ঠাকুমার রাজপুত্র।  রাজকন্যার জন্য স্বাভাবিকভাবেই রাজপুত্রের উদ্বিগ্নতা থাকবে। তাই কেবল সান্ত্বনার সুরে বলল,"তোর ঠাকুমা রূপকথার দেশে গেছে। একটা সোনার কাঠি আনতে!"


palash
পরিচিতি


পলাশ কুমার পাল পলাশ কুমার পাল Reviewed by Pd on অক্টোবর ০৬, ২০১৫ Rating: 5

1 টি মন্তব্য:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.