আজকের ‘একমুঠো প্রলাপে’ আমরা মুখোমুখি কবি, গল্পকার, নাট্যকার ,প্রাবন্ধিক এবং ঔপন্যাসিক শৌনক দত্ত র মুখোমুখি । সীমানা ভাঙা এবং আদ্যন্ত বিনয়ী এই ব্যক্তিত্বের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় আমরা ঋদ্ধ হলাম । ধন্যবাদ কবিকে । শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা আন্তর্জাতিক শব্দের মিছিল এবং তার মূল পৃষ্ঠপোষক ‘আত্মার সান্নিধ্যের ‘ পক্ষ থেকে ।
তুমি তো যাকে বলে ভারসেটাইল জিনিয়াস । কবি , নাট্যকার , গীতিকার , ঔপন্যাসিক বহুবিধ ভূমিকায় দেখি তোমাকে , কিভাবে এতকিছু হ্যান্ডেল কর একই নৈপুণ্যে ?
জিনিয়াস টিনিয়াস কিচ্ছু না।আমার সব কিছু ঘিরে থাকে একাকী এক সময় কিন্তু কথা বলার কেউ থাকেনা তাই নিজের সাথে যা বলি তা লিখে রাখি।তোমরা তার নাম দাও।এতে নৈপুন্য আছে কিনা জানিনা তবে প্রচুর স্নেহ ও ভালবাসায় ডুবে আছি বলতে পারি,দ্বিধাহীন।

তোমার পড়াশুনো কোচবিহারে , এম বি এ করেছ ব্যাঙ্গালোর থেকে , এখন থাক বাংলাদেশে , বছরের বেশিরভাগ সময় ঘুরেই বেড়াও সাঁটল ককের মত , ভারত আর বাংলাদেশে , তোমার শেকড় আসলে কোথায় ?

পড়ালেখার কথা আমি কখনো বলিনা।আমার ভাল লাগেনা তাছাড়া ঐসব ডিগ্রি আমি আজো বিক্রি করে কর্পোরেট জীবন বেছে নেইনি।বেছে যে নিলাম না তা বোধ করি গর্বের নয় তাই ঐ বিষয়টিতে আমি কখনোই আমার উচ্ছ্বাস দেখাই না কেউ জানতে চাইলে স্বাক্ষর পরিচয়টুকুই বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।না বলতে হলে আরো খুশি। শেকড়!আমার তো কোন মাটিই নেই,শেকড় ছড়াবো কোথায়?বাংলাদেশ,কোচবিহার কিংবা কোথাও যখন গিয়েছি মেনেছি সেখানে আমার দানা রাখা আছে,আমি পাখি।যদিও আজো জানা হয়নি পাখিদের বর্ণমালা!

তোমার কবিতায় বারবার সাগর দীঘি , সুনীতি একাডেমীর মেয়েদের কথা পাই । সত্যিই কি ছিল বা আছে তোমার কোন প্রেম এসব জড়ানো ?
প্রেম যদি আমি তুমি হয়,তা ছিলো কিন্তু বুঝিনি যখন বুঝেছি সে ছেড়ে গেছে পৃথিবীর স্টেশন।আর প্রেম যদি তুমি কে ছাড়িয়ে বেড়ে যায় তবে তা আজো আছে তবে হ্যাঁ সময়ের নিয়মে আমারও যেমন বয়স বাড়ছে তেমনি সুনীতি স্কুল কিংবা সাগরদীঘির ও বয়স বেড়েছে।তাই অনেক কিছু ফিকে হয়ে এলেও প্রেম কমেনি বরং ইতিহাস হয়ে গেছে।তারচেয়ে বড় কথা কোচবিহার এমন একটি জায়গা যেখানে কেউ একটি বছর ও কাটিয়েছে তার স্মৃতির কুঠিরের অনেক জায়গা ঘিরে থাকে কোচবিহার।যেখানে যখন গেছি কোচবিহারে কাটানো মানুষের মুখে সেই অতীত দিনের কথা বারবার শুনেছি।কবি রত্নদীপা দে ঘোষ কিংবা অনির্বান ঘোষ দা সহ আরো প্রচুর নাম করতে পারি যারা কোচবিহারে নেই বহুকাল কিন্তু সাগরদীঘি,সুনীতি কিংবা জেনকিন্স বা নৃপেন্দ্র নারায়ন স্কুল,মদনবাড়ী,মরাপোড়ার দীঘি,রাজবাড়ী জড়ানো প্রেম থেকে বেরুতে পারেনি।
তুমি স্বছন্দে মুখে মুখে অসংখ্য কবিতা রচনা কর , হাঁটতে হাঁটতেই , কতটা পরে রিকভার করতে পার ? আদৌ কি পারো ? নাকি হারিয়ে যায় অসংখ্য দুর্দান্ত কবিতা ?
প্রথমে বলি মুখে মুখে যা ইনস্ট্যান্ড বলে ফেলি তা কবিতা হয় কিনা যে বা যারা শোনে তারা বলতে পারবেন ভাল।যদি কবিতা হয় তবে বলি হাতে মোবাইল থাকলে রিকভার হয়ে যায় এডিট সহ তবে অধিকাংশই হারিয়ে যায়।রায়গঞ্জের নদী পাশে,শ্মশানের এপারে এমন অনেক কবিতা হারিয়ে গেছে তখন শীতকাল সর্ষে ক্ষেত আর ফিরে যাবার আগে ভালবাসাময় একটি কালো জ্যাকেট আজো ডাকে না হারানো স্মৃতিবুকে।
চিঠি তোমার কবিতায় , গল্পে , উপন্যাসে একটা অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ । সত্যিই কি চিঠি লেখ কাউকে ? নাকি এটা একটা ফ্যান্টাসি ?
একটা সময় খুব চিঠি লিখতাম। নিজের জন্য যতগুলো লিখেছি তারচেয়ে বহুগুণ বন্ধুবান্ধব,সিনিয়ারদের লিখে দিয়েছি।এখন প্রযুক্তির উত্কঠর্ষ সময়ে চিঠি লেখা হয়না কাউকে তবে আমি এই চিঠি প্রেম থেকে বের হতে পারিনি তার এই প্রেমটিকে আমি আমার স্ট্রং জোন হিসেবে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা করে যাচ্ছি নিরন্তর।
তোমার লেখা নাটক অভিনীত হয়েছে বাংলাদেশে । বেশ সফল প্রযোজনা তা । মনে হয় নি ফুলটাইম নাট্যকার হতে ? মনে হয় না , কোন একটা দিকের ওপর মনোনিবেশ করতে ... নাকি রবীন্দ্রনাথের মত নিজেকে কেবলি বিস্তার করে যেতে চাও ? 
যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে আমি যখন লিখি তখনও যুদ্ধ শিশু বিষয়টি এত প্রচার পায়নি।কনসেপ্টটা বোঝাতেও হয়েছে অনেককে।তবে হ্যাঁ একটি বিষয়ে আমি কখনই স্থিত হতে পারিনি আজো।রবীন্দ্রনাথ নয় আমি শৌনকের মতই শৌনকীয় ঢং এ বিস্তার করে যেতে চাই জানার পিপাসায়।

বিভিন্ন ব্লগে পড়েছি তোমার গল্প । গল্প লিখিয়ে হিসেবেও তুমি যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছ । কি কি গল্পগ্রন্থ আছে তোমার এযাবৎ প্রকাশিত ?

একুশে বইমেলা যেমন বাংলাদেশে , ভারতে কোলকাতা বইমেলা । কোলকাতা বইমেলায় এসেছ কখনো ? এলে তার অভিজ্ঞতা কেমন , আর না এলে বল , আসতে ইচ্ছে হয় ? অনেকেই তো আসেন ...

চলে আসবো কখনো।এই যে কোচবিহার থেকে বাংলাদেশ গেলাম কিংবা বারবার ফিরে আসি এখানে সেখানে যেমন আজ উনিশে মে এর ভাষা শহীদ অনুষ্ঠানে দিল্লিতে আছি তেমনি কখনো সময় ই ডেকে নেবে আমায় তখন চলে আসবো।

বাংলাদেশ থেকে কবি , সাহিত্যিকরা এলে এদেশে সাহিত্য সম্মেলন আয়োজিত হয় । তার নানা পোষ্ট দেখি ফেসবুকে । তুমি তো এতবার আসো , তোমার সেরকম পোষ্ট চোখে পড়ে না কেন ? প্রচার বিমুখতা নাকি অন্যকিছু?

যদিও এইসময়ে নিজের ঢোল নিজে পেটানোই রীতি।কিংবা আগেও হয়ত তা ছিলো তবে আমার এই আত্মপ্রচারে অনীহা আছে আমার এই ধারনা আজকের দিনে বাতিল বলবে সবাই জানি কিন্তু আমার মনে হয় সূর্য বা চাঁদের আলো আঙুল তুলে দেখানোর প্রয়োজন হয়না তার উত্তাপ কিংবা জোছনাই বলে দেয় তার অস্তিত্ত্ব।বাকী ঐসব কবিতা পাঠের ছবি কিংবা সংবর্ধনার ছবি পোস্ট করা বা স্ট্যাটাস দেয়া আমার কাছে একজন প্রকৃত মানুষের বা পরিস্কার করে বললে একজন কবি বা সাহিত্যিকের আইডেন্টটিটি ক্রাইসিস মনে হয় কেননা আমি বিশ্বাস করি একজন সত্যিকারের মানুষ বা কবি,সাহিত্যিকের আইডেন্টটিটি ক্রাইসিস থাকতে পারেনা।
আজকাল অনেকেই দুই দেশের যৌথ প্রচেষ্টায় বই প্রকাশ করছেন । দুই বাংলায় থাকা তাদের ভক্তকুল এতে তাদের বই সহজে হাতে পান । তুমি কি এরকম কিছু ভেবেছ ?
কোজাগরী পূর্ণিমা রাতে নদীতীরে ঘুরে বেড়াও । মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের কবিতা লেখ । ফেসবুকে এবং বাস্তবে তোমার অগুন্তি গুণমুগ্ধ পাঠিকা । তুমি এখনো আইবুড়ো কেন ? একটা বৈবাহিক সম্পর্ক অসংখ্য বুক ভাঙবে বলে ?
আইবুড়ো বলে বয়সে বুড়ো হয়ে গেছি তার আওয়াজ দিলে কি?আসলে কেউ তো আসেনি এখনো আর আমি যে কার আশায় আশায় পথ চেয়ে আছি জানি না।অগুন্তি শব্দটা একটু বাড়িয়ে বলা হয়ত,তাছাড়া অসংখ্য বুক ভাঙবে যখন বলছো তবে কি আরেকটু অপেক্ষা করা উচিত কেননা একটি লাইন মনে এলো,[সবকটি বুক ফাঁকা হলে পরে আমিও বুকের পাশে বুক রেখে ঘুমিয়ে পড়ি।
তুমি পৈতৃক সূত্রে হার্ডওয়ারের দোকানের মালিকানা পেয়েছ । কিভাবে মানাও ব্যাবসায়িক আর শৈল্পিক স্বত্বাকে ?
অন্যদেশ আর অঞ্জলি সেনগুপ্ত আমাকে সে সুযোগ দিয়েছে।এখন যেটা দরকার সেটা তোমার ও তোমাদের সাহায্য সহযোগিতা।সাগরময় ঘোষ সবসময় আমার কাছে একটি অন্যরকম স্রষ্টার নাম।দেখা যাক আগামী সময় সফল পক্কতা নাকি অপক্কতা, কি নিয়ে প্রতীক্ষা করছে।তবে উত্তরপূর্ব ভারতে অন্যদেশ প্রিন্ট তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল।চেষ্টা থাকবে ওয়েব এর গুণে প্রিন্টকে ছাপিয়ে যাবার।
তোমার মধ্যে একটা বাউল , বোহেমিয়ান যুবক আছে । আবার অসুস্থ বাবা মায়ের সংসারের দায় তোমার ওপর । দরকারে রান্নাবাড়া ঘরকন্নাও সামাল দিতে হয় । ইচ্ছে করে না , দায় টায় ঝেড়ে একটু স্বার্থপর হয়ে উঠতে , সাহিত্যের স্বার্থে ?
তোমার প্রশ্নের মাঝেই উত্তর নিহিত আছে। বাউলের যেমন সংসার হয় না তেমনি দায়িত্ব পালনকারীর নিজেকে দেখার অবকাশ কোথায় তাছাড়া এমন বাউল,মানচিত্রহীন শেকড়হারার সাথে কেউ নিজেকে জুড়তে চায় কোথায়?এছাড়া দায় ঝাড়তে গিয়ে দায় যে বাড়বে না তা বলা কঠিন হয়ত!
দুটি শহর,দুটি জেলার কাব্যচর্চার ধারাতেই ফারাক থাকে এতো দুই বাংলা।অবশ্যই দুই বাংলার কাব্যচর্চার ধারায় ফারাক আছে।তবে একটি ক্ষেত্রে দুই বাংলাই হুবুহু এক।কোন দিকে,দুই বাংলাতেই সাহিত্য বলতে রাজধানী প্রধান।রাজধানীর বাইরে যেন কোন চর্চা নেই কোন কবি বা সাহিত্যিক নেই এই একটি দিক থেকে দুই বাংলার ধারা একদম সমান্তরাল। লেখা পড়ি যা পাই সবই তাই ভাল লাগার তালিকাটাও বেশ লম্বা।
গ্রুপে লেখার সময় , বা ফেসবুক থেকে তোমার প্রচুর লেখা চুরি হয়েছে , বা নষ্ট হয়ে গেছে । তার পরও এই মাধ্যমে নিয়মিত লিখে যাচ্ছ । এত ক্ষমাশীল , নির্বিকার থাক কি করে ? 
হ্যাঁ তা হয়েছে এখনো হয়।৩৩০টি লেখা হারিয়েছি কিংবা চুরি হয়েছে।যার কোন কপি আমার ছিলো না।তাছাড়া অনেক লেখা অনেক নামী দামী তার নামে নিয়ে গেছেন।প্রতিবাদ করেছে অনেকে আমার মনে হয়েছে এই একটি জিনিস যা এখনো অফুরন্ত আমার কাছে।হয়ত সংখ্যার বিচারে তিনশত ত্রিশ অনেক বড় সংখ্যা কিন্তু এটাও তো ঠিক মানুষের উপর থেকে যদি বিশ্বাস উঠে যায় সাহিত্য মরে যাবে।
এটা খুব মজার।ছোট্টবেলায় আমি আর ভাই নীলাঞ্জন দত্ত অনেকগুলো খেলার মধ্যে একটি খেলা খেলতাম যার নাম ইন্টারভিউ।ঐ খেলায় এই প্রশ্নটা কোথা থেকে যে আমরা জুড়েছিলাম আজ আর মনে করতে পারিনা অথচ এত বছর পর একই প্রশ্ন শুনে মনে হচ্ছে এত কঠিন প্রশ্নটির কি সহজসরল উত্তর ছিলো আমাদের অথচ আজ বড্ড কঠিন লাগছে।আসলে এপিটাফ লিখতে হলে শর্মিষ্ঠা ঘোষের লেখা একটি লাইন দিতাম হয়ত এখন মনে হচ্ছে। অসংখ্য কৃতজ্ঞতা তোমার জন্য....
শৌনক দত্ত
Reviewed by Pd
on
জুলাই ১১, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
জুলাই ১১, ২০১৫
Rating:

কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন