সাঈদা মিমি




দুলাল যখন ভালোবাসা বুঝতো, তখন কেউ তাকে ভালোবাসেনি। যখন বুঝতো না, তখনও কেউ ভালোবাসলো না! সে বাউল স্বভাব নিয়েও বৈষয়িক হয়ে গেলো । সেটা পরের গল্প, বৈষয়িক তো একদিনে হয়নি সে! আগে বড় বেশি দিলদরাজ ছিলো, গলা ছেড়ে গান গাইতো, এক রূপসীর জন্য বিলিয়ে দিয়েছিলো সব মুগ্ধতা । বড় এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তো ভাবতো, রূপসী তাকে চায় । কিন্তু বিষয়টা ঘোলা ঘোলা আবেশের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেলো একদিন, তরুণী তাকে নয়, সম্পদের মোহে আকৃষ্ট! বিয়ে করে প্রবাসী হয়ে গেলো, ধাক্কাটা কোনদিনই দুলাল সামলে উঠতে পারেনি । নারীজাতির ওপর মন উঠে যাওয়ার পর, সে দেশোদ্ধারে নামলো । কতগুলো বছর কে জানে? আমি জানি না । দুলাল বুঝতে পারলো, যেখান থেকে শুরু করেছিলো, সেখানেই আসলে সে রয়ে গেছে! সব ছেড়ে ঘরমুখো হলো একদিন ।

বিয়ে করলো দুলাল, চাকরি নিলো, যদিও ভালোবাসা সে বোঝে না, কিন্তু প্রয়োজন বোঝে, আর বিয়ে করাও জরুরী । ঘর কে না চায়? সে সংসারী হলো, বাবা হলো, কিন্তু আরেক যন্ত্রণা, স্বামী হওয়া ঠিক হয়ে উঠলো না তার! এখানে দাবী আর আব্দারের টিলা, পাহাড় হচ্ছে । মায়া কই? জোড়া কোথায়? কোন আঠা নেই, কেবল দায়িত্ব এবং, অতঃপর, দায়িত্ব । সারাদিন গাধার পরিশ্রম বাসায় ফিরতেই স্ত্রীর নানা অভিযোগ, ক্রুর বাক্য, সন্দেহ বিষ, নিত্য কলহ । এভাবে থাকা যায়! অসহায় দুলাল, সন্তানদের মুখ না দেখে থাকতে পারবে না সে, সন্তানেরা তার দূর্বলতা । দুলাল মেনে নিলো, যদিও প্রতিরাতে একই পৌনঃপুণিকতা; আব্দার, ক্ষোভ, হিংসা, ঈর্ষা, সন্দেহ, কুৎসিত বাক্যবান ।

দুলাল অফিসে যায়, ফেরার সময় পার্কে বসে আরও দুঘন্টা ব্যয় করে, নাইট শো দেখে, মেয়েবন্ধু নিয়ে ঘোরে, বাসায় যায়, কেউ কিছু বলার আগেই প্রবল গর্জন করে সব থামিয়ে দেয়, তারপর নিজের কামরায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে একটা দীর্ঘ শাওয়ার নেয়, নিজের মত করে খেয়ে, কামরায় ঢুকে গান চালিয়ে দেয় এবং কতগুলো বই নিয়ে আয়েশ করে শুয়ে বেডসাইড বাতি জ্বালিয়ে দেয় । স্ত্রী খাটে এলে সে নিচে ম্যাট্রেস ফেলে বিছানা করে নেয় । অবজ্ঞার উত্তর দিতে শিখে যাওয়ার পর, দুলাল অপমান ফেরত দিতেও শিখেছে । স্ত্রী তেঁড়ে এলে সে নিস্পৃহকন্ঠে বলে, বেরোনোর দরজা ওইদিকে ।

রাত ঝিমুতে শুরু করলে দুলাল ভাবে, আমি কি এত অন্যায় করেছিলাম? কার ক্ষতি করেছিলাম আমি? কাকে কাকে ঘৃণা করেছিলাম? যুদ্ধের বছরে ফ্রণ্ট থেকে ফ্রণ্টে ছুঁটে চলা দিনগুলির কথা মনে পড়ে । প্রিয় বন্ধুর লাশ কাঁধে নিয়ে ছুঁটে চলার ছবিটা চোখে ভাসে । কিছুই বদলায়নি, যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু তার ভাগ্য বদলায়নি। দেশের পরিস্থিতী অশুভ পথের দিকে হেঁটে গেছে, সে কিছুই করতে পারেনি । স্বাধীনতার পর চোরাকারবারী আর গুদামজাত চক্রের আঁখড়া থেকে চাল, ডাল, তেল, আনাজ লুট করেছিলো তারা, বিলিয়ে দিয়েছিলো অভুক্ত মানুষদের মাঝে । ধরা পড়ে কয়েকবছর জেলের ঘানি টানতে হয়েছিলো তাকে । সবই কি ইতিহাস! তবে কি সে ভুল করেছিলো? এতগুলি মানুষ কিভাবে ভুল করে! যেমন এই মস্তিষ্কের ব্যবহার না জানা মহিলা কিভাবে তার অর্ধাঙ্গিনী হয়! সে অন্ধকারে পাঁজরের হাঁড় গোনে, সবকটাই আছে । তাহলে! এই নারী আমার অংশ থেকে আসেনি, সে ভুল সময়ের হিসেব না মেলা অংক ।

আজ অফিসে প্রচুর কাজ ছিলো । বেরোনোর পর প্রথমেই মনে হয়, বাসায় ফিরে লম্বা একটা ঘুম দেবে । পরক্ষণেই আঁতকে ওঠে, ঘর? তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া এক নরক । আশার কথা মনে পড়ে, ও বলেছিলো, তার স্বামী ব্যাবসার কাজে বিদেশে গেছে, দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছেও বটে । আশা স্বেচ্ছ্বাবন্ধ্যা, সে সন্তান নিতে রাজি হয়নি । অগত্যা তার স্বামী কে দ্বিতীয় বিয়ে করতে হয় । সেই বউ ইংল্যাণ্ডে থাকে । তাতে আশার কোন ক্ষতি হয়নি, সে মারদাঙ্গা রূপসী, স্বামীকে বশে রাখতে জানে। আজ দুলাল আশার বাসায় যাবে, ওখানেই রাত্রিযাপন । দু’জনের সন্ধ্যা মোহঘোরে কেটে গিয়েছিলো, রাতের শুরুতেই বাসা থেকে ফোন, কোথায় তুমি? সমান তেজে সে উত্তর দিয়েছিলো, আজ বাসায় ফিরবো না । আরও কি একটু এগোয় কথা? দুলাল লাইন কেটে দেয় । আবার ফোন, এবার মোবাইল সুইচড অফ করে রাখে সে । আজকের রাত আলাদা ফাল্গুন । আজ কেবল সে আর আশা ।

আশা, প্রিয়া, বাবলি, স্বর্ণা কেউ আসলে তার নয় । যারা একের পর এক এসেছে, সবাই একটা প্রয়োজন শেষে আলাদা, এখন অন্য কেউ আছে তাদের জীবনে, আবার অন্য কেউ আসবে । একধরণের না বুঝতে পারা হতাশা তাকে যাতায় ফেলে পিষতে থাকে, আমি এইরকম ছিলাম না! আমার স্বর্ণাভ উত্থান ছিলো !পবিত্র জীবনবোধ ছিলো! কারা আমাকে নষ্ট করলো? দুলালের চোখ ঠেলে জল আসে ,নিজেকে সে বাঁধা দেয় না । আজও তাকে বাধ্য হয়ে ঘরে ফিরতে হবে, সে আকাশের দিকে তাকায়, ঈশ্বর কে কোথাও দেখা যায় না । তিনি ভারী আমুদে, নিজে খেলেন না, খেলা দেখতে ভালোবাসেন ।

পরিচিতি 


সাঈদা মিমি সাঈদা মিমি Reviewed by Pd on জুলাই ১১, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.