সোনালী মিত্র




একটা পিঁপড়ে জীবন দিও
সহনে ও বহনে সক্ষম.....

এই লাইন টা বেশ কিছু কাল আগে এক লিখেছিলাম এবং লেখার সময় ই এক উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসে ,খানিক পাগলামি ও বলা যায় আর কি।আসলে মানুষ হল সেই প্রজাতির জীব যা কেউ কেউ দেখে শেখে (অবশ্যই বুদ্ধিমান রা), বেশির ভাগ ই ঠেকে শেখে (খানিক নির্বোধ অবশ্যই), আর কিছু সংখ্যক দেখে ও ঠেকে শেখার পরোয়াই করেন না তাহার জগত ব্যাপিয়া শিখাইয়া থাকেন (অবশ্যই স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী)। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল এক কথা....যখন কচি ছিলাম স্যারের বাড়ি পড়তে যেতাম, আমার ই এক সহপাঠিনী ছিল, যে সব কথাতেই হাসত, স্যারকে দেখে ছিলাম হাসির বিভাজন করতে, এক- বুঝে হাসি, দুই -না বুঝে হাসি আর তিন- দেখে হাসি। আমি সেই তিন নং আহাম্মকের দলেই পড়ি এতে কোন দ্বিমত নেই। মানে ওই ছাগলের তিন নং বাচ্চার দলে আর কি , দুটি বাচ্চা আয়েশ করে দুধ খায় আর তিন নং টা তা দেখে আনন্দে নেচে নেচে বুড়ো আঙুল চোষে। দেখেছেন তো বলতে গেলাম কি কথা তা না বলে রং সাইডে সোজা হেঁটে চলেছি।আসলে এই বড় দোষ। মূল স্রোতে আসা যাক।

সেদিন টেবিলে দক্ষিণেশ্বরের পুজো দেওয়ার প্যাকেট রেখে গেছি ভুলে, ওমা ঘণ্টা খানিক পর ফিরে এসে দেখি ঝাঁক ঝাঁক ছয় পেয়ে জীবের সে কি তাণ্ডব নৃত্য। তবে বলতেই হবে কি ডিসিপ্লিন মাইরি, আমাদের যদি থাকত এমন তবে বিশ্বযুদ্ধ হত না, পরমাণু গড়ত না, দিদির কাঁথায় আগুণ লাগত না, মাও- ম্যাও কোন কিছুই হত না। মানে রাম রাজ্য থুড়ি পিঁপড়া রাজ্য হত। কিন্তু ওদের দল বদ্ধ স্বজন প্রেম আমাদের উবে যাওয়া বাষ্প।যদি কোন এককালে মেঘ জমে বৃষ্টি ঘটায় তা বড়ই আপেক্ষিক হবে।

সদলবলে দিব্যি মিষ্টত্ব জিভের ডগায় নিয়ে সদর্পে মাড়িয়ে যাচ্ছে আমার অহংবোধ কে। তাজ্জব ব্যাপার ই বটে। ভয় ডর নেই মোটে। আমাদের ও এই সিচ্যুয়েশন আসে বই কি,সেটা বেশ জমাট একটা প্রেম করলে। করব অথবা মরবো। মরতে যদি হয় ই তবে করেই মরবো। যদি রাম ক্যালানী খেতেই হয় তবে কেন বাপু মুখ খালি থাকে!!!মানে এই জাতীয় আর কি।

অনুভবে ধরা পড়ে যায় শীতের ভোরেও ঠাম্মাকে দেখতাম - কুয়াশার চাদর যখন জড়িয়ে রেখেছে ফসলবতী মাঠকে, জংলা নদীর পাড়কে, ধান ভরা গোলায় নিকনো উঠানের ঈশান কোনে বসে গোবর গুলে চলেছেন বাড়ির মঙ্গল কামনায়, কিংবা মা খুলে দিয়েছে আঁচল। সেই আঁচলের ফুপি ধরে বসে আছি আমি, ভাই, বোন, বাবা, পিসি। আমরা যেন সবাই ই মায়ের মমতার দিকে, স্তনের দিকে সদ্য জন্মানো পিপাসার্ত মুখ। আর মাও উদয়াস্ত খেলে চলেছেন সিঁড়ি ভাঙার অংক। মেজে যাওয়া শরীরে রঙ কপালে মস্ত সিঁদুর টিপ,চওড়া সিঁথিতে দগদগে লেপা লালে মা যেন অন্নপূর্ণা আশ্রয়। পৃথিবী ও যেন মায়ের খামারে আশ্রিতা চড়ানো গবাদি বালক।এত ভার বহন মা ই করে থাকেন। বড় দি যে দিন সন্ধেবেলায় বমি করে কাপড় ভাসাল, ওর চোখের নীচের কালি,ফাঁকি গেল না মায়ের চোখের কোণে। বড় দা চ্যালা কাঠ দিয়ে বেদম মারে অজ্ঞান ভরন্ত মেয়ে। মাঝ রাত্তিরে লন্ঠন হাতে বড় অশ্বত্থ গাছে খুঁজে পাওয়া গেল অবৈধ-পোয়াতি বড়দির লাশ। মাকে দেখেছিলাম নির্বাক,শুধু মায়ের চোখ দুটো ছিল অসম্ভব রকম লাল।সে দিন মা খাবার পাতে তিল বেটা দিয়েছিল। ভাগের এক কমলো যে। বাবার গায়ে পাট নিড়ানির গন্ধ,আমাদের ভাতের গন্ধের সাথে মিশে ঘাম ও জল আদর্শ হয়েছিল।কিন্তু যেদিন বাবার ফতুয়ার পকেটে মিলল কুন্তলীনের ভরা শিশি, মা কে খুশি হতে দেখি নি। সমিতির মিটিং এর নামে দেরি করে বাড়ি আসা বাবার মুখে ঔজ্জ্বল্য বাড়তে বাড়তে ঘরের হাড়িতে টান ধরলেও বাবার পকেটে কুন্তলীনের অভাব ঘটে নি। তবুও মা নির্বাক। দিন দিন পাথর যেন রূপান্তরিত মেয়েমানুষ নামে। এত্ত গুলো প্রাণ মা পাখির ঠোঁটের দিকে হা করে চেয়ে,পাখি ডানা বিছিয়ে দিল এক রাশ ছায়ার সাথে।দেখে ছিলাম কি অপার্থিব পরিশ্রম হতে পারে!!! দিনান্ত ধানের থেকে চাল,চালের থেকে সাদা মুক্তর মত মুড়ি ভরে উঠছে উঠান,আমাদের খিদে পেট গুলো যেন সেই মুক্তর দিকে চেয়ে,এরা পয়সা হয়ে আসবে এরা ভাত হয়ে আসবে ক্ষুধার্ত মুখ গুলোয় ঈশ্বর হেসে যাবেন,একই স্থানে লক্ষ্মী মায়ের পদযুগলে ঘুমিয়ে আছেন সরস্বতী, কালী। একেই যদি বলে সহন আর বহন, তবে পিঁপড়ে জীবন মায়ের মত বাঁচা, মেয়ের মত বাঁচা।

ছোট বেলায় বইয়ে পড়েছিলাম, পিঁপড়ে তার ওজনের দশ গুন ভার বহনে সক্ষম .শুধু তাই নয় এরা বেশ দলবদ্ধজীব ও বটে। পৃথিবীতে ১২ হাজার প্রজাতির পিঁপড়ে আছে। এদের মধ্যে বুলেট পিঁপড়ে সবচেয়ে খতর নাক। এটি আমাজন উপত্যকায় মেলে,এর কামড় এতটাই যন্ত্রণাদায়ক তা বন্দুকের গুলি লাগার চেয়েও বেশি বেদনার। কিছু প্রজাতি নিজেদের সহ্য ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্যই ইচ্ছে করে কামড় খেয়ে থাকেন।এবং যে এই কামড় খেয়েও যতক্ষণ না চেঁচিয়ে থাকতে পারে সে ই জয়ী যাত্রায়। এর পর অবশ্যই তাকে বেশ কিছু দিন বিছানা গত হতে হয়। পিঁপড়ে সমাজের সাথে আমাদের বেশ কিছু মিল থাকলেও সবচেয়ে বড় অমিল টা বলে দেওয়া যাক......এদের মধ্যে তিন প্রকার থাকে,রানী,শ্রমিক,এবং সৈনিক।রানী এবং শ্রমিক অবশ্যই মেয়েরা হয়,আর সৈনিক পুরুষ পিঁপড়ে। রানী পিঁপড়ের ই কেবল পাখনা থাকে,এদের কাজ ঘুমানো খাওয়া আর ডিম পারা।আর বাকি দের কাজ হল এই রানীর সেবা করা।একটা বস্তি তে একটা রানী পিঁপড়ে থাকলে লক্ষাধিক পর্যন্ত সেবক পিঁপড়ে থাকতে পার। উফ কম ব্যাপার!!!!!

আবার আসি ফিরে ...

বেশ বড় হবার পরে যখন নিজের কাজের তাগিদে শহরে এসে পড়লাম,যাত্রা পথে ঠাণ্ডা গাড়ির কাঁচের স্বচ্ছতায় দেখা যেত শেষ বর্ষার বিন্দু বিন্দু ঘাম......ফুটের ছেঁড়া ন্যাকড়া জরানো মা পিঠে বাঁধা ছেলেকে সামলে দিব্যি কাগজ কুড়িয়ে চলছে,তিন ইট উননে কালো তোবড়ানো হাঁড়িতে ফুটছে ক্ষুদ-ভাতের ঈশ্বর।আর সেই ঈশ্বর নেবে আসবেন এখুনি,হাঁটু দুটো ও মাথা গুঁজে বসে থাকা নিরুপায় বুড়ো টার ততো ধিক তোবড়ানো গালে।এখানেও কি সহন বহন নেই!!!ভাবতে ভাবতে সিগন্যাল ক্রস করে গাড়ি হু হু করে ছুটে চলে বাইপাস ধরে।

পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে ..
মায়ের মুখে হাজার বার এই প্রবাদ শুনে বড় হওয়া মেয়ের ও সাধ হয় ডানা ওয়ালা পরি না হোক পিঁপড়েতেই হোক মরণ। জীবন যেখানে সহস্র মেগা ওয়াটে ঘুরতে থাকা ব্লেডে একে একে কেটে পড়ে যায় উত্তরাধিকার নাম পদবি,বংশানুক্রমিক সম্পর্ক,আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো বিসমিল্লাহ্‌ শানাই এ নিম গাছের ছাল আমড়া গাছে..........তখনো বাঁচার ইচ্ছে জাগে, তথাকথিত সভ্যজীবিরা লন্ঠন হাতে পথ দেখান....এস, রস বাঁচার রসদ কম নেই,হয়ে ওঠো ছুতমার্গ হীন,ওপেন মাইন্ডেড রানী পিপীলিকা।

ফোনে ব্যতিব্যস্ত করা নীরজ কেমন তলিয়ে যাচ্ছে ঘূর্ণনে,চাকায় পিষে যাচ্ছে গাহস্থ্য, পিষে যাচ্ছে জীবন,দামি গাড়ির কালো কাঁচের আড়ালে বুকে মুখ গুঁজে যদি খানিক স্বস্তি পায় সে পেতে দেওয়া টা কি ভণ্ডামি!!! তা কি পরকীয়া তেই আটকে থাকা যৌবন!!! লোভ, লালসা কিংবা যৌন আগ্রাসী চরিতার্থতাই কি এর সুফল? আর কুফলের ঘরে পড়ে থাকবে সন্তানের হোমটাক্স,স্বামীর সক্সের চূড়ায় সেনসেক্সের অন্ধকারের রাজ্য? জীবন যুদ্ধে ক্ষইতে ক্ষইতে এও কি সহন বহনের নামান্তর নয়!

ইদানীং গ্যামাক্সিন পাউডারের টেম্পার অনেক কম। আমার শ্বশুর মশাই বলেন এটা। আসলে ব্যস্ত জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে শুধু গ্যামাক্সিন নয় টেম্পার যে অনেক কিছুর ই কমে গেছে ছয় সন্তানের পিতা ,এখনো সুঠামদেহী মানুষটা জানেন'ই না। তিনি বোঝেন'ই না বাজারে এত জাপানী তেলের বিজ্ঞাপন বেড়ে চলেছে ,বেড়ে চলেছে সেই সাথেই পাল্লা দিয়ে সানি লিওনের সকাল হোক বা বিকেল হোক বা রাত , বেড রুম হোক বা সোফা ,বাথরুমে হোক বা ...ইত্যাদি ইত্যাদি । ভায়াগ্রার বড়ির চাহিদা যখন ম্যাডিকেল স্টোরে মধ্য যুবার সাথে ষাটোর্ধ পাঞ্জাবীর পকেটে কন্ডোম হয়ে নেমে আসে তখন মনে হতেই পারে ভাগ্যিস লক্ষণের শক্তিশেল ছিল তাই না এই মানুষ গুলো সহনীয় ও বহনীয় অনেক বেশি প্রমাণিত।

আর কি বলি!!! দুই পদ সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টি কর্তা এক নারী দুই পুরুষ .আর মধ্যবর্তী ত্রিশঙ্কু ধারা আটকে থাকা মুখ গুলোর কথা আমরা কি ভেবে দেখি!! তারা শালা পিঁপড়েও অধম। না পরিচয় .না সন্মান। কাপড় তুলে ঘষে দেওয়া জন্মস্থানে ওরা কেবল মৃত্যু লিখে রাখে। এদের সহনশীলতা পরিমাপ কোন ডেসিবল এ মাপতে পার ঈশ্বর?

ঘূর্ণনের চাকায় কেবল ঘুরছি। দিন থেকে রাত ,পুণ্য থেকে পাপ। পাপের পরে কোথায় থাকে আপেল খাওয়া পেট ফোলানো ইভ'রা? লন্ঠনের আলোয় পাট খেতে তেল খেয়ে বডি হয়ে যায় তারা নিমেষেই .আর আদম সমাজ তাল ঠুকে বুক ফুলিয়ে লাল টুকটুকে আপেল জাঙ্গিয়ার অন্ধকারে ভরে এগিয়ে যায় তালশাঁসের দুপুরের দিকে।

পরিচিতি

সোনালী মিত্র সোনালী মিত্র Reviewed by Pd on জুলাই ১১, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.