![]() |
পরিচিতি |

ট্রেন যেন আমার আদুরে প্রেমিক। রাতের বেলায় ট্রেনে যখনই চাপি...কাচে নাকগাল ঠেকিয়ে দেখতে থাকি নির্নিমেষ- নিকষ অন্ধকার কেটে আমায় নিয়ে ছুটতে থাকে ট্রেন আর আমি উদযাপন করি আমাদের নিজেদের নতুন বড়-বউয়ের মিষ্টি বকবকম...মনে মনে।
শিলিগুড়ি স্টেশনে নেমেই ক্যাচর ম্যাচর ডুগডুগি ওয়ালার সঙ্গে দরদাম করতে করতে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের মিউনিসিপ্যালিটি গেস্ট হাউস। সারাটা রাস্তা হই চই ফাঁকা জানলা দিয়ে ভোরের হাড় কাঁপানো হাওয়া আর আনন্দমের দলবাজি। জীবন এক্কেবারে জী-বাংলার মত ভরপুর।
মন্দ নয় ব্যবস্থা। টপাটপ আস্নান করে টুপি পেন্টুলুন জ্যাকেট শোভিত আমি চায়ে ফুঁ দিয়ে সুড়ুৎ করতে না করতেই পিঁক পিঁক করে হর্ন বেজে উঠল কানে... স্ব-স্বামী শর্মি দুয়ারে দন্ডায়মান। শিলিগুড়ি আগে না আসাতে অনেক কিছুই দেখা বাকী। শর্মিরা নিয়ে গেল মহানন্দা স্যাংচুয়ারী। আমি যখনই স্যাংচুয়ারী শব্দটা শুনি অমনি ভাবতে থাকি যাক নিশ্চিন্তে জন্তুজানোয়ার দেখা যাবে। ভুলে যাই যে ওটা তাদের জন্য অভয়ারণ্য, মানুষের জন্য নয়। শালপ্রাংশু সব মহীরুহ দেখে দেখে চোখ ডুবিয়ে নিতে থাকলাম বন্য সৌন্দর্য-এ। একটু এগিয়ে বনের গভীরে ঢুকতে যাবো...হাঁ হাঁ করে দৌড়ে এলো চৌকিদার। না না আর যাওয়া যাবে না। হাতি বেরিয়েছে নাকি! আমি শহুরে ভীতুর ডিম সহসা বীরত্ব দেখিয়ে শর্মির হাত টেনে যেই ঢুকতে পা বাড়িয়েছি... চৌকিদারের ত্রিনেত্র ঊর্ধ্ব মুখী রূপ দেখে রণে ভঙ্গ দিতেই হলো। দুদিকের চোখ জুড়ানো সবুজের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে সুকনা-র কেবিনে ত্রিমূর্তি-র স্বল্প বিশ্রাম। এবার ছুট গেস্ট হাউসে বিকেলে নাটক আছে দীনবন্ধু মঞ্চে।
রাতে শর্মির বাড়ি ডিনার সেরে মাতা পুত্র ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। সেখানে তখন আসর সরগরম দুর্দান্ত অনুষ্ঠান করার সাফল্যসুখে।
ভোর ভোর সব্বাই তৈরী হয়ে মাল জংশন । আজ যাবো গরুমারা অভয়ারণ্য। মাল জংশন নামটি তার অপরূপত্ব সম্বন্ধে উল্টো ধারণা দিলেও আসলে তার রূপ ভোলা কঠিন। আমি তাকে এর আগে বিকেলের সূর্যাস্তে দেখেছি ... সেই নিঃশব্দ হেঁটে যাওয়া ঘন্টাভর আর কানে বেজে যাওয়া কাঁদালে তুমি মোরে...। ভোরের স্টেশন দেখে মনে হলো সূর্য এতই লাল... ভাগ্যিস আবার এলাম। বঞ্চিত থাকতাম না হলে এ জীবনে এ রূপ দেখা থেকে। যাবার পথে দুইধারে চা বাগান... আর যা হয়! হ্যাংলা ক্যালকেশিয়ান গুলো আদেখলার মত পটাপট ছবি তোলা, পোজ দেওয়া...আর ইস কি সবুজ, কি সুন্দর, কিইইইই। গরুমারা থেকে বেশ খানিকটা দূরে এক হোটেলে ডেরা বাঁধলাম। হেন কালে অকস্মাৎ/ আসিয়া নারদ গোঁসাই/ কর্ণে দিলেন এই বার্তা- “ আসামে দিন কয়েক আগে বোমা বিস্ফোরণে আদিবাসী নিধনের প্রতিবাদে আজ আদিবাসী বিকাশ পর্ষদ এর ডাকে ১২ ঘন্টার বন্ধ” । যাঃ সব প্ল্যান যে মাটিইই কী হবে! কুছ পরোয়া নেহি। আমরা না দমে নানা চেষ্টায় গাড়ি ভাড়া করে আবার চা বাগানের মধ্য দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তিস্তার চরে। এ বাবা এর নাম তিস্তা নদী? এটা নদী না নালা? হতচ্ছাড়া বোকারাম আমাদের ধারণাই নেই যে শীতের পাহাড়ি নদী এইরকম বেচারী দর্শনাই হয়ে থাকে। আমরা কলকাতার বাসিন্দারা ভরাভর্তি দেবী সুরেশ্বরী কে দেখে দেখে, আর কল কারখানা থেকে বিশ্রী বর্জ্য মল মুত্র ভাসিয়েও তাকে শুকোতে না দেখে ভুলেই যাই সব নদী মা নয় যে অনাদরেও কলকল করে বয়ে চলবে। তবে যা দেখলাম তাইই সই। কারণ নদীটি শীতে শীর্ণ হলেও উত্তরবাংলা র প্রকৃতি অকৃপণ সৌন্দর্য তো দিয়েই রেখেছেন। তাই খানিক পান করলাম সবাই।
এবার যাওয়া বালাজী মন্দির। মন্দির আমায় সবসময়ই ভাল লাগায়। কারন মন্দির মানেই ভক্ত প্রার্থী আর অর্থী দের ভীড়। আমার মানুষ দেখতে বড্ড ভালো লাগে। বালাজি মানে আমার ধারণা ছিল কৃষ্ণ ঠাকুর। এখানে দেখলাম তাঁর সঙ্গে শিব ঠাকুর আর হনুমানজির ও পূজা হয় । যখন গেছি তখন আরতি চলছে। সুর মোটামুটি আকর্ষণ করে। যাই হোক মন্দির গাত্র দেখতে দেখতে একটা মজার জিনিষ চোখে পড়ল। কোন এক হনুমদ্ভক্ত একটি বৈদ্যুতিক ঢাক উপহার দিয়েছেন। সেটি বেসুরো তারস্বরে গেয়ে চলা ভক্তি গীতিকে আরো অ-সুর করে তুলছে সোৎসাহে। ছবি তুলতে যেতেই হাঁ হাঁ করে উঠলো স্বেচ্ছাসেবক। পেন্নাম করে মানে মানে বিদায় হলাম।
হোটেলে ফিরেই অপেক্ষাকৃত কচি জেনারেশনের মনে হলো আজ রাতে গরুমারায় যখন যাওয়াই হলো না তাহলে বৃথা যেতে দেবো না। আজ ২৮ তারিখেই ৩১ডিসেম্বর উদযাপন করবো। ব্যস। হোটেলের ঘরে পাক্কা দেড় ঘন্টার একটি অনবদ্য বিচিত্রানুষ্ঠান হলো। বিনা আড়ম্বরে এত চমৎকার প্রতিভাদীপ্ত আন্তরিক নিবেদন গরুমারা বেড়াতে না যেতে পেরে হোটেলে আবদ্ধ থাকার দুঃখ কখন যেন ভুলিয়ে দিল অবলীলায়। আজ তাড়াতাড়ি ঘুমোতে হবে কাল ভোরে ট্রেন...গন্তব্য দমনপুর।
ঘুম চোখে কম্ফর্টার সোয়েটার জ্যাকেট পরিহিত পর্বতারোহী ব্যাটেলিয়ন ট্রেনে চেপে বসতেই আবার বন্ধ। এবার এক্কেবারে ট্রেন লাইনের ওপর শুয়ে পরে। কারণ সেই একই। আমি ভেবে পাই না এভাবে প্রতিবাদ কি সত্যি ই ফলপ্রসূ হয়েছে কখনো? অসহায় ঘন্টা খানেক কাটাবার পরে পুলুশ পার্টি লাঠিপেটা করে বিপ্লব সরিয়ে দিতেই ট্রেন কু ঝিক ঝিক ঝিক। পথে তিন তিনটে সুড়ঙ্গ। আনন্দম বাহিনীর হো হো রবে যৎপরোনাস্তি বিরক্ত কামরার সবাই। যাকগে বকে ঝকে সামাল দিতে দিতে চাপড়ামারি ফরেস্ট বাংলো। আহা প্রাণ জুড়ানো তার শোভা। উঁচু উঁচু নাম না জানা গাছ বাংলোর প্রায় গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে। পেছনের কাঠের সিঁড়িতে দাঁড়ালে দেখা যাচ্ছে বন চিরে সরু পথ পায়ে হাঁটা...আচ্ছা ছবিতে দেখা সুন্দর তবে আমার দুয়ারে আজ সত্যি অপেক্ষমাণ? মনবাহাদুর দৌড়ে গরম জল আনতেই নাহানা সেরে চমৎকার স্থানীয় কোন এক মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মুখে দিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। মিশন বক্সার দুর্গ। দুর্গে যাবার আড়াই কিলোমিটার আগে গাড়ি থামাতে হলো। আর যাবে না মাইজি। এর পড়ে আপুনাদের হেঁটেই যেতে হবে। দলের অর্ধেক সদস্য রেডি...আমিই বা ছাড়ব কেন? সোৎসাহে পা বাড়ালাম। পিছন থেকে অনিন্দ্য সঙ্গ নিল... তিনিও নাকি দুর্গ দেখতে পায়দল যাবেন। গাড়িতে বসে রইল কাকলি ও তাদের কন্যা সহ আরো ক’জন। খানিক উঠেই টের পেলাম বিপ্লব। সে শুধু কাগজ কলমেই ভালো। র্যা পার পড়ে লাঠি হীন পাহাড়ে ওঠা আর যেই পারুক এই শর্মার কম্মো নয়। গুটি গুটি ফিরছি দেখি দন্ত ব্যাদান করে অনিন্দ্য ও ফিরছেন। জয়া, ভাইটি আমি বুড়ো হয়েছি ও আমার দ্বারা সম্ভব নয়। চলো বরং নিচে নেমে গিয়ে দেখি আশে পাশে আর কি করা যায়। অগত্যা একত্রে গল্প করতে করতে ঠুক ঠুকিয়ে নিচে নেমে একটি দোকানে বসে আমরা লাল চা সেবন করতে করতে আর অন্য ক্রেতা ক্রেতিদের লাল আসব পান দেখতে লাগলাম। ঘন্টা আড়াই যথেষ্ট বোর হবার পরে বক্সার দুর্গ বিজয়ী সোনার টুকরোদের দল একগাল হাসি, ধুলো আর হই হই করে নেমে এলে আমরা গাড়িতে উঠে পড়লাম। এবার যাবো জয়ন্তী নদী ও পাহাড়।
আহা দূর থেকে লাল পাহাড় দেখে মোহিত হতে হতে ভাবলাম লাল কেন? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ও হরি! সূর্য দেব অস্তাচলে যাবার উপক্রম করছেন আর তাঁর ছটাতেই জগত রক্তিম। চরের ধুলোর মধ্যে হেঁটে পৌঁছলাম নদীর ধারে। পাহাড়ী নদী সে যতই ক্ষীণ হোক কাছে যেতেই টের পেলাম খরস্রোতা। ফটাফট ফটো সেশন সারলাম সব্বাই। তার জন্য মরা গাছের ডালে চড়তেও দ্বিধা নেই। সন্ধ্যে ঝুপ করে নেমে এলো। পাশের চায়ের দোকান থেকে চা খেয়ে বাংলো ফিরলাম। অন্ধকারে জঙ্গল চিরে গাড়ি করে যাওয়া এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আমাদের তাড়া আছে। আর একটু পড়েই আগুন জ্বালিয়ে বার বি কিউ হবে। বাংলো পৌঁছতেই বাহাদুরের হাসিমুখ গরম গরম মোচার চপ আর চা...আঃ। গল্প আড্ডা দিতে দিতে রাত ঘন। মাঠের মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল। ধুনি জ্বালিয়ে সাধুরা তাঁর নাম করেন আর আমরা চিকেন শিকে গুঁজে বসে আছি, কখন ঝলসানো হবে। গান আড্ডা আর শিককাবাব... আগুনের তাতে একটু ঘাম ঘাম লাগছে। উদ্দীপিত সবাই কেমন আনন্দে ভরপুর। হিম রাতে আগুন জ্বালিয়ে ওম পাওয়ার অভিজ্ঞতা পেতে পেতে আমি চট করে নিয়েনডারথ্যাল যুগের কথা ভাবতে চেষ্টা করলাম। আমাকে নিয়ে এই এক বিপদ... বর্তমানে আর অতীতে মুহুর্মুহু শাফল করি।
রাত দুপুরেও গান গল্প চলল। কাল আনন্দমের কলকাতায় ফেরার ট্রেন। সকালে উঠেই স্থির করা হলো নৌকা ভ্রমণে যাব। আমার তো বাপু নৌকা বলতে দৌড় নলবন। তবু যাবার আগে এইটুকুই বা করবো না কেন? এই না ভেবে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কয়জন। সচিবের পৈ্টিক গন্ডগোল হওয়াতে তিনি স্বস্বামী বাংলোয় রইলেন। সুকিয়াঝোরা নাম শুনেই প্রেমে পড়েছিলাম। সত্যি সত্যি নৌকায় চড়েও প্রথমে বুঝি নি কি দেখো আর একটু পরেই। প্রকৃতি যে কি সুরেলা তা এই নৌকা ভ্রমণে না এলে জানতেই পারতাম না। সাবধান করে দিয়েছিল আগেই শশশ কথা বলবেন না কেউ। নিঃশব্দ ছলাৎ ছলাৎ । ।সর সর টিট্টিভ মাছরাঙ্গা আরো কত পাখি আর শব্দ ...তাদের শব্দ।।আমাদের কোলাহল নয়। ওই যে হাতির পায়ের ছাপ। আজ ভোরে জল খেয়ে গেছে। পাতা ডালপালা মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে... উফফ মাথা সরিয়ে নিই। একঘন্টা কেটে গেল...কতদিন কতবছর ? কোনদিনই কি এভাবে জেগে থেকে কোন কাজ না করে শুধু প্রকৃতি দেখেছি আমি?
একবুক অক্সিজেন ভালোলাগা আর ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা নিয়ে উঠে এলাম পাড়ে। রওনা হবার আগে ফিরে তাকালাম ডাকবাংলোটার দিকে। মিস করব। মনে পড়বে এই বৃক্ষ, কাঠের বাংলো, আর মধুর ভাষী মনবাহাদুরকে। গাড়ি রওনা দিল এন জে পি স্টেশনের দিকে। যাবার পথে হাসিমারা চা বাগান দিয়ে যাব। সবুজের সমারোহ দেখে বুক ভরে যায়।বিকেল হয়ে এল। ফোন আসছে। শর্মির ফোন। তিন বাত্তির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে আর রুকুকে নিতে এসেছে ওরা। এই ছুটির বাকীটা ওদের সঙ্গে কাটবে। পেট্রোল পাম্পের নিয়ন আলোয় চকচক করছে ওঁর মুখ। একগাদা খাবার আনন্দমের সবার জন্য। সবাইকে হাত নাড়ালাম। চড়ে বসলাম ওদের গাড়িতে। বাকীরা আজ কলকাতাগামী ট্রেন এ উঠবে। পাশে বসে আছে শর্মি। সামনে বসে আছে রুকু আর অনির্বাণ। আজকে সে-ই চালক। গৃহস্বামী স্বয়ং এসেছেন অতিথি আপ্যায়ণে। আমার ভরপুর মনের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল মনবাহাদুরের গলা...মেমসাহাআআব পানি দিবো?
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন