মৌ দাশগুপ্ত




নতুন বছরের ২৬তম দিন, ২৬শে জানুয়ারী ২০১৫, সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতবর্ষের ৬৬তম প্রজাতন্ত্র দিবস। এ দিনটি শুধু ক্যালেন্ডারের পাতার কোনো জ্বলজ্বলে লাল তারিখ নয়, নয় কেবল শীতশীত আলসেমিমাখা মাঘ মাসের ছুটির একটি দিন, বছরের এই দিনটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য্য কিন্তু কোনভাবেই ফেলনা নয়।

ছোটবেলা থেকেই জানি প্রজাতন্ত্র দিবস মানেই একটা গোটা ছুটির দিন।ইচ্ছামত চলার দিন। স্কুলের মাঠে, খেলার ক্লাবে,মোড়ের মাথায়, পাড়ার শহীদ বেদীতে তেরঙ্গা পতাকা তোলার ভীড়,দড়ি ধরে একটা টান, তারপর,ফুলের পাপড়ীগুলো ঝরঝর ঝরলেই, কচিকাঁচাদের গলা ছাপিয়ে মাইকে কান ফাটানো দেশভক্তির গান, একটা কলা কি কমলালেবু ,দুটো লজেন্স, কি একমুঠো বোঁদে,সাথে ফ্রী ভাষণ। নেতাজী, গান্ধী, জহরলালের ছবিতে টাটকা ফুলের মালা।পাড়ার স্টেশনারী দোকানে, হকার্স কর্ণারে অঢেল তিনরঙ্গা ফেস্টুন,টুপি,পতাকা,রিস্টব্যান্ডের স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল। বাবা- কাকার শার্টে সেফটিপিনে আটকানো কাগজের তেরঙ্গা,আজ আকাশটা তিনরঙা না হলেও অনেক তিরঙ্গা আকাশের পটভূমিকায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দেখছি।‘এ্যয় মেরে প্যারে বতন…’

….” তেরঙ্গা,শুনছেন কি,আজ প্রজাতন্ত্র দিবস,
ভোর হলেই দড়িতে বাঁধা পড়বেন আজ,
সন্ধ্যায় পাটে পাটে ভাঁজ হয়ে ঘুমাবার আগে অবধি,
সারাটি দিন ডোরবাঁধা ঘুড়ির মত আকাশে উড়বেন,
ঘুড়িও সুতো কাটলে পাখীর মত স্বাধীন-
আপনি কিন্তু নিয়মবন্দী, 
গতকাল যা ছিলেন, আজও তাই, আগামীকালও…”…

প্রজাতন্ত্র দিবস মানেই মাইকে বা টিভিতে তারস্বরে দেশভক্তির গান বা সিনেমা , লালকেল্লার সরকারী অনুষ্ঠান, সামরিক বা বেসামরিক কুচকাওয়াজ, স্কুল বা বিভিন্ন ক্লাব প্রতিষ্ঠানের তরফে প্যারেড।আর আমরা কি করছি? ‘ভারতের আম জনতা’? এই ‘আমি - আপনি’র দল? ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপের প্রোফাইল পিকচারে জাতীয় পতাকা, বা ভারতের ত্রিবর্ণ ম্যাপ, স্ট্যাটাসে দেশভক্তির চরম পরাকাষ্ঠা, ওদিকে ছুটির দিন বলেই বোধহয় মা নলেনগুড়ের পায়েস বানাচ্ছেন, গন্ধটা হাওয়ায় ভাসছে, রান্নাঘর থেকে যাতে শোনা যায় তাই টিভির ভল্যুমটা বাড়ানো আছে, গানটা বেশ ভালো লাগছে শুনতে তো, ( ‘ভারত আমার ভারত বর্ষ,স্বদেশ আমার স্বপ্ন হে,’ রবীন্দ্রসঙ্গীত? নাকি আধুনিক? আমার বস বাংলা গান টান অত আসে না, তবে বেশ দেশভক্তির স্মেল আছে, ) আজকের মত ফেসবুক স্ট্যাটাস হয়ে যাক! ওয়াও! পোস্ট করতে না করতে এতো লাইক, কমেন্ট! অনলাইন শপিং, শপিং মলে দেদার ছুট,  ক্রেডিট কার্ডে আত্মহারা হয়ে ভাবছি ঈশ, আরেকটা ছুটী এক্সট্রা..তবে আর কি, গা ভাসাও দেশপ্রেমের  জোয়ারে, ‘লেট আস সেলিব্রেট’! আজ তবে পিকনিক হয়ে যাক, নাকি থিয়েটার,কি সিনেমা দেখা? বাড়ীতেই একটা জম্পেশ গেট টুগেদার,  অথবা, দুপুরে মাংসভাত শেষে বিকেল অবধি বেশ জমাটি ঘুম,সন্ধ্যায় আবার নারী নির্য্যাতন নিয়ে প্রতীকী মোমবাতি মিছিল আছে কিন্তু! তাহলে থাক, ওদিকে মোবাইলে প্রজাতন্ত্র দিবসের স্পেশাল রিংটোন বাজছে, ‘সারে যাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা’…

আমার কিন্তু মনে একটাই প্রশ্ন  উঁকি দেয়, সেটা হল, একদিন মাইক বাজিয়ে আর প্যারেড করে কি সত্যিই প্রজাতন্ত্র উদযাপন করা যায়? আরে বাবা নাচাগানা তো শোনপুর মেলাতেও হয়, অমুকবাবু তমুকবাবু হাতে মাইক পেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও রক্ত গরম করা ভাষণ দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে নির্বিকার চিত্তে নাক ডাকাতে পারেন,তারজন্য ‘প্রজাতন্ত্র’দিবসে’র বাহানাটা খুব জরুরী কি? 'জনগণমন' ইস্কুল থেকে শুনতে শুনতে মনের ওপর এমন ঘূণধরা এফেক্ট করেছে যে এখন গানটা বাজলে আমাদের মধ্যে কতজন  হাতের কাজ ফেলে দু’পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ার সৌজন্যটুকু দেখান সেটাও প্রদীপ হাতে খুঁজে দেখতে হয়। ‘বন্দেমাতরম’ গানটাই বা আজকাল আমাদের মনে কতোটা এফেক্ট করে? ছোটবেলায় রেডিওতে যে বন্দেমাতরম-র সুর শুনে বড় হয়েছি তার থেকে এ.আর.রহমানের 'মা তুঝে সালাম' –এর বন্দেমাতরমের সুর আজকের প্রজন্মকে বেশি আবেগাপ্লুত করে না কি? বিতর্কিত বিষয় সন্দেহ নেই। কিন্তু আরো বিতর্কিত বিষয় হল, প্রজাতন্ত্র বাপারটা কি? খায় না মাথায় দেয়? দেশ প্রজাতান্ত্রিক হলে প্রজা থুড়ি দেশবাসীর ক’টা লেজ গজায় নাকি ক’টা শিং গজায় এই সব কূট প্রশ্নের উত্তর পাই কোথায়? ...

আচ্ছা,গোড়া থেকেই তবে শুরু করা যাক। এই ‘প্রজাতন্ত্র’ জিনিষটা ঠিক কি? খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে পড়েছি বটে, কিন্তু সম্যক ধারনা নেই। একটু দেখা যাক। প্রথমেই সর্বজ্ঞানের ভান্ডার গুগল কি বলে দেখা যাক। “একটি প্রজাতন্ত্র হল এমন একটি সরকার ব্যবস্থা যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করে জনগণ বা জনগণের একাংশ। ইংরেজি ভাষায় "প্রজাতন্ত্র" শব্দের প্রতিশব্দ "republic" এসেছে  লাতিন শব্দবন্ধ res publica শব্দবন্ধটি থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ "জনগণ-সংক্রান্ত একটি বিষয়"। সাধারণত রাজশক্তি-বিহীন রাষ্ট্রকেই প্রজাতন্ত্র বলা হয়।

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট, এ দেশের মানুষ অনেক আত্মদান, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করল । পতাকা বদল হলো, ইউনিয়ান জ্যাকের বদলে উড়লো তিরঙ্গা। আমরা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে অখন্ডতা খুইয়ে স্বাধীনতা পেলাম। যদিও গান্ধীজি বলেছিলেন, দেশভাগ হলে আমার লাশের ওপর দিয়ে যেতে হবে। তবুও দেশভাগ হল, দু’ দুটো নতুন দেশ ‘হিন্দুস্তান’ (ভারত) ও ‘পাকিস্তান’ (বর্তমান বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল) তৈরী হল।  দিল্লীর মসনদে মোগলসাম্রাজ্যের পতনের পর বিদেশী শক্তির হাতে প্রায় দু’শো বছর পরাধীন থাকার পর এই যে ইংরাজ শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম…কেন? এ প্রশ্ন তো আসেই। মাঝরাতে চুপিসারে দেশ চালানোর ক্ষমতা দুধসাদা আচকানের পকেটে পুরে নিয়ে নেহেরুবাবু  স্বাধীন ভারতবর্ষের জন্মক্ষনে বলেছিলেন- "At the stroke of the midnight hour when the world will sleep India will awake for life and freedom".  এ প্রসঙ্গে পরে আসছি, আপাতত বলি, আমাদের এই স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল প্রধানত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং অর্থনৈতিক মুক্তি। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সঙ্গে গণতন্ত্রের যোগাযোগ ওতপ্রোত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ছিল গণতন্ত্রের আকাঙ্খা। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান প্রণীত হয় এবং আমাদের দেশ সেদিন থেকেই বিশ্বের দরবারে ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সেই থেকে দিনটি আমাদের দেশের প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে। প্রজাতন্ত্র দিবস, মানে যে দিন স্বাধীনতা লাভের পর ভারত এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তার প্রথম সংবিধান গ্রহণ করেছিল,  তার মানে ভারতীয় সংবিধানের জন্মতিথিই হল ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস। যাক এতটুকু তো ক্লিয়ার হল, কিন্তু এরপর? 

পরের প্রশ্ন আসতেই পারে, যে, তাহলে এই ‘সংবিধান’ জিনিষটা আবার কি? সংবিধান হল রাজনীতির নীতিমালার সেই কাঠামো যা এক সমতামূলক রাষ্ট্রের বুনিয়াদ তৈরী করতে প্রয়োজন… শক্ত কথা নিঃসন্দেহে। কাগজে ছাপার অক্ষরে এমন কতশত গালভরা কথা তো বলাই যায় কিন্তু বাস্তবে? পূর্বপুরুষদের যে রক্ত আমাদের শিরায় ধমনীতে বইছে তার কণায় কণায় তো বৈষম্য শব্দটি শিকড় গেড়ে আছে। সেখানে রাষ্ট্রের সব মানুষের জন্য সমানাধিকার? বলে কি? জাতি ধর্ম নির্বিশেষে শিক্ষার সমান অধিকার, আইনের সমান অধিকার, রুজি রোজগারের সমান অধিকার, ধন সম্পত্তি কায়েমের সমান অধিকার, এমনকি লিঙ্গ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি নবজাতকের ও নবজাতিকার সমান বাঁচার অধিকারও নাকি সংবিধানে স্বীকৃত! “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে”…

বলে কি! ঐ রতন টাটা, আমাদের পি এম নরেন্দ্রমোদী, সি এম মমতাদিদি, সুদীপ্ত সেন, ছাপোষা কলমপেষা সরকারী কর্মচারী এই অধম আমি আর ঐ ফ্লাইওভারের তলায় সন্ধ্যার  অন্ধকারে কেরাসিন কূপি জ্বালিয়ে চাট বিক্রি করা মদনা সাউ সংবিধানের চোখে, থুড়ি, সংবিধানের হিসাবে, (না মানে… ঐ যাকে বলে কিনা, সংবিধানের গুঁতোয় ) সবাই এক? কিংবা আমার ঘরের পুতুপুতু যত্নে মানুষকরা শিবরাত্রির সলতে আর সাতবাড়ীর বাসন মাজা ঘরের কাজের মাসীর সাতনম্বর মেয়ে, নাকে শিকনি, তেলছাড়া বাদামীচুলে জট, ইজের সম্বল ফেলনী … দু’জনে এক? কোন মানে হয়? আজ্ঞে হ্যা, ঠিকই বলছি, কাগজে কলমে বড় মহান বড় উদার আমাদের এই ভারতীয় সংবিধান , এখানে সব মানুষ সমান। এ-সংবিধান এ-দেশের সকলের জন্য সুবিচার, স্বাধীনতা, সমতা ও সৌভ্রাতৃত্ব কায়েম করার নীতিমালায় বিশ্বাসী। পাগল না পাজামা? এখন লজ্জাস্কর ব্যাপরটা হল, স্বয়ং ভীমরাও রামজি আম্বেদকর, (পশ্চিম ভারতের সেই ‘অস্পৃশ্য’ জাতির মানুষটি, যিনি দলিতদের নেতা হিসাবেই বেশী পরিচত ছিলেন, ১৯৪৭-এ যিনি সদ্যগঠিত ভারত সরকারের আইনমন্ত্রীও ছিলেন, যিনি ভারতের সংবিধান প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন…তিনি ) জীবিতবস্থাতেই দেখে যান যে সংবিধানে ‘অস্পৃশ্যদের’ বিরুদ্ধে বৈষম্য আইনত নিষিদ্ধ করার পরেও সমাজের প্রাত্যহিকতায় ঘটনাটা আদতে কতটা অসম্ভব! সংবিধানের এই অসাড়তা, এই অপমান, সংবিধান প্রণেতাকে ঠিক কতটা দুঃখ দিয়েছিল তা এইমুহূর্তে আমাদের জানার কোন উপায় নেই। তবে ১৯৫৬ সালে তিতিবিরক্ত এই প্রবীণ পোড় খাওয়া রাজনীতিকটির প্রায় দুই লক্ষ দলিত অনুগামীকে নিয়ে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের মধ্যে দিয়ে আমরা কোন নীরব প্রতিবাদ খুঁজে পাইনা কি?

... "গাল ফুলিয়ে গাইছি মোরা “মেরা ভারত মহান”।
রাজনীতির দাবার চালে স্বয়ং ভুতও ভগবান
স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের দেশে আমরা সবাই পুতুল, 
যেমন খুশী নাড়ো চাড়ো, বন্ধ মুখে আঙ্গুল।
নতুন যুগে পা রাখছি, নবভারতের আউটলেট,
হাতে হাতে ছড়িয়ে দেবো প্রজাতন্ত্রের লিফলেট।“ …

প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে সারা ভারত জুড়েই নানা রকম জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ,যেমনটি প্রতিবার হয় আর কি। তারপর, দিল্লীর চওড়া রাজপথে দেশবিদেশের সম্মানিত অতিথিদের সামনে এবং অবশ্যই আপামর সর্ব সাধারনের জানার জন্য  আরও কিছু কমন ফ্যক্টরও যথাবিহিত মর্য্যাদা সহকারে পুনঃপ্রদর্শিত হয়, যেমন,সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ সহ নানা ধরনের সামরিক যন্ত্রপাতি, আমরা জানতে পারি আমাদের সামরিক শক্তি কতটা, আমাদের বিভিন্ন স্কুলের বাচ্চারা প্রজাতন্ত্র কতটা বোঝে এবং নাচগান করে অন্যকেও বোঝানোর চেষ্টা করে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকাল আবার 'হ্যাপী রিপাব্লিক ডে' বলে শুভেচ্ছা জানানোটাও সভ্যজনের এটিকেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে ঢেলে বিকোচ্ছে 'হ্যাপী রিপাব্লিক ডে' গ্রীটিংস কার্ড। স্বাধীনতা দিবসের মত বছরের এইদিনেও সারা ভারতের সরকারী অফিস-আদালত, জেলখানা থেকে পাগলাগারদ সব জায়গাতেই একটা খুশির আমেজ দেখা যায়। ব্যক্তিগত উদ্দোগ্যে ভাল খাবার-দাবার,কখনো সখনো নতুন পুরানো জামাকাপড়, শীতবস্ত্র পরিবেশন করা হয় অনাথাশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম, কিছু হাসপাতাল, অর্থনৈতিক অনগ্রসর মহল্লায়। সুবেশা মহিলারা সেজে-গুজে অমুকবাবু তমুকবাবুর সাথে হাসিমুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দান-ধ্যান করেন ও মিডিয়াকে জানান দেন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ চমকায়। বছরের আরো একটা  দিন (আরেকটা দিন ১৫ই আগস্ট, আমাদের স্বাধীনতা দিবস) বরনীয় স্মরনীয় দেশপ্রেমিকের বছরভোরের জমে থাকা ধুলোমোছা বাঁধানো ছবি কি কাক চিলের পূরীষ মোছা আবক্ষমূর্তি বা পূর্ণাঙ্গ মূর্তিতে ছুঁড়ে দিই গাঁদা কি রজনীগন্ধার মালা, না শোনার মত করে শুনি গুটি কয়েক দেশাত্মবোধক গান, গোলটুপি /লম্বা টুপি/ টুপিছাড়া নেতা (মোড়ল /দাদা)-দের কাগজে লিখে মুখস্থ করে উগড়ে দেওয়া কিছু বাঁধা গতের কথা... তার পর শুধু ভুলে যাওয়া... নিজেকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নেওয়া... শুধু স্বার্থ আর অহঙ্কারের মায়াজালে, পরিবারতন্ত্রের  নেশায়, ক্ষমতা কুক্ষীকরনের আশায়… দেশকে, সমাজকে, শোষণ করা। প্রাদেশিকতার নামে, ধর্মের নামে, ভাষার নামে, রাজনীতির নামে টুকরো টুকরো করা...সংবিধান বলে আমার আপনার তো দেশ একটাই, আমাদের “ভারত বর্ষ”. সারে যাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা… সেটাই তো আর হয়ে ওঠে না। অথচ পরেরদিন খবরের কাগজ জানায় ২৬শে জানুয়ারীতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত ‘যথাযোগ্য মর্যাদা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ৬৬তম প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করেছে’ এবং এই উপলক্ষ্যে ‘সারা ভারতে এক অপরিসীম আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে’।

মোদ্দা কথা হল তাহলে প্রজাতন্ত্রের  কোন সুফলটা আমারা পাচ্ছি? কেন আমরা প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করছি? আজো বৈষম্য আমাদের সঙ্গী, “নগরীর এক প্রান্তে খাদ্য কিন্তু খিদে নেই, অন্য প্রান্তে খালিপেটে জ্বলছে খিদের আগুন কিন্তু খাদ্য নেই,” মহাজনী টিপ-ছাপে গায়ে গতরে বাড়ছে চাষীর ক্ষেতের সবুজ শীষ,খাল পাড়, রেল লাইনের ধারবরাবর বাড়ছে বাস্তুহারাদের ভীড়, বিদ্যাসাগরের ছবি আজ ক্যালেন্ডারেও দুষ্প্রাপ্য, তার থেকে অনেক বেশী পরিচিত নাম বিদ্যাবালান,  রাংতামোড়া নেশার ধোঁয়ায় ম্লান হচ্ছে আগামী দিনের সকাল। লাল জলে, মাদকের ঘোরে বেচা কেনা হচ্ছে মানুষের নীতিজ্ঞান,অপুষ্টি, অশিক্ষা,আবাদিতে বাড়ছে আগামী প্রজন্ম। ‘অমিতাভ’ লিখে শূন্যস্থান পূরন করতে দিলে মোড়ের মাথার চা দোকানের ‘বয়’,পথশিশু বিল্টু ‘বুদ্ধ’ লেখে না, লেখে ‘বচ্চন’।আজ সুবিধাবাদ হয়ে উঠেছে জাতীয় বৈশিষ্ট্য, সন্ত্রাসবাদ পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। মাঝে মধ্য তো সন্দেহ হয় গান্ধী নেহেরু ছাড়া অন্য কেউ এ দেশের জন্য আদৌ কিছু করেছেন কি? যাবতীয় সরকারী প্রকল্পের নাম দেখুন, সন্দেহ জাগতে বাধ্য হবেই। গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র নয় নিরেট পরিবারতন্ত্র ও বান্ধবতন্ত্রের এমনই লীলা। না, না, সংবিধানে এ সব লেখা নেই। আছে রং (Wrong ও বলতে পারেন অনায়াসে)-বিধানে।  ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে।’ গণতন্ত্রে তো আবার ‘সবার রঙ’ বলে কিছু নেই, চোখ খুললেই আলাদা আলাদা  রাজনৈতিক দলের আলাদা আলাদা রং। সবুজ, নীল, লাল,নীল-সাদা, গেরুয়া, এমনকি জাতীয় পতাকার অনুকরনে তেরঙ্গা অবধি ছাড় পায়নি। সুকুমার রায়কে নকল করে বলা যায়,’রঙের আমি রঙের তুমি রঙ দিয়ে যায় চেনা’। রঙে রঙে রঙ্গীন আমাদের প্রজাতন্ত্র, রঙে রঙে গলাগলি, লাঠালাঠি, রঙের শাসন বা ‘রংবাজি’ই (পড়ুন বিচ্ছিন্নতাবাদ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ধর্মীয় অনুশাসন ) আমাদের সাংবিধানিক থুড়ি সংসদীয়  রাজনীতির মূল গল্প। প্রজাতন্ত্রের মূল ক্ষমতা জনগনের ভোট ভিত্তিক, অতএব ইমামি ফতোয়ার জোরে, গান্ধীবাবার ছবি ছাপা নোটে, বস্তাবন্দী চাল-গম, বা কম্বলের বিনিময়ে মাপা হচ্ছে ভোটের পারানি। অনেক জায়গাতেই সীসার গুলি, বন্দুকের নল, রক্তের দাগ লাগা মাটি ও ঘরছাড়া নিরাপত্তাহীন মানুষদের সামনে নতজানু আমাদের ‘বিবেক’বাবু।অন্যদিকে সব জেনেশুনেও কানুনের দেবীর মত চোখবন্ধ করে আমি.. আপনি.. আমরা সবাই.. একদিনের দেশপ্রেমিক সাজছি । ‘মেরে দেশপ্রেমীয়ো, আপসমে প্রেম করো দেশপ্রেমীয়ো।‘

তবু ঐ যে কথায় বলে না ‘আশায় মরে চাষা’, আমাদেরও সেই হাল, সবই জানি, বুঝি, অনুভব করি, তবু বছরের পর বছর ‘কলুর বলদের’ মত ঠুলিপরা চোখে একই বৃত্তাকার পথে ঘুরে চলেছি,সেই নির্বাচন, সেই প্রহসন, সেই একই ট্রাডিশনের পুনরাবৃত্তি, সেই একই ভাবে আরেকটু ভালোর আশায় থাকা, আরেকটু জাতীয় স্বাচ্ছ্বন্দ্যকে অনুভব করতে চাওয়া। বাঙ্গালী/ গুজরাটি/ বিহারী / ওড়িয়া প্রাদেশিকতা বা হিন্দু / ক্রিশ্চান/ মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিভেদ ভুলে ‘চক দে ইন্ডিয়া’র মত অন্তত একবার নিজেকে ‘শুধু ভারতীয়’ ভাবা । প্রারম্ভিকভাবে এটাই না হয় আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবসের চাহিদা হোক। তাতেই বা মন্দ কি?

পরিশেষে একটাই কথা, সীমান্তে কোথাও মাইনাস কুড়ি, কোথাও চল্লিশ ছুচ্ছে পারদ,অতন্দ্র পাহারায় খাকি পোশাকের ক‘টি মানুষের মত মানুষ,বাড়ী ছেড়ে, পরিবার ফেলে যাদের রোজ মৃত্যুর সাথে লুকোচুরী,আপনার আমার স্বার্থে দেশের সীমানার সুরক্ষায় জেগে ভারতীয় সেনা,ওরা আছে বলেই নিশ্চিন্ত আমার দেশে ধর্মের বোলবালা,ডাস্টবিনে কন্যাভ্রূণ,নারী নির্য্যাতন, ধর্ষন,ডাইনি হত্যা, আরো কত কি,ওরা আছে বলেই পুরো দেশ উৎসবে মগ্ন আর কাগজকলম নিয়ে প্রজাতন্ত্র দিবসের  প্রলাপ লিখছি আমি। "মিলে সুর মেরা তুমহারা…’

প্রজাতন্ত্র দিবস আসলে আমার আত্মসমালোচনার দিন...ভালো থাকুন সবাই, ভালো রাখুন, কাব্যলক্ষ্মীর সংস্পর্শে আনন্দে থাকুন। আপনাদের সবাইকে আমার শুভ সদচিন্তা দিবসের, আত্মসমালোচনা দিবসের,প্রজাতন্ত্র দিবসের অমলিন অমল শুভ্র শুভেচ্ছা।।

পরিচিতি  


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ