কবি অরুণ চক্রবর্তী


আজকের ‘একমুঠো প্রলাপে’ ‘আত্মার সান্নিধ্যের’ পাঠকদের সামনে উপস্থিত উত্তরবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং ‘চয়ন’ নামক ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক , শ্রী অরুণ চক্রবর্তী । প্রবীণ এই সাহিত্যিক আরও অসংখ্য সাহিত্য পত্রিকার সাথে প্রত্যক্ষ এবং  পরোক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং আছেন । ‘আত্মার সান্নিধ্যের’ পক্ষ থেকে কবির সুদীর্ঘ নীরোগ কাব্যময় জীবনের জন্য অনেক শুভকামনা । 

কলকাতায় কফি হাউস তো শিল্পী সাহিত্যিকদের মক্কা ... দেখা শোনা , মত বিনিময় , তর্ক , আড্ডা সব মিলিয়ে জমজমাট প্লাটফর্ম ... উত্তরবঙ্গ এই জায়গাটায় মার খেয়ে গ্যাছে বলে মনে করেন ? আপনি কি মনে করেন না এখানেও দরকার এমন একটা জায়গা যেখানে শুরু হতে পারে একটা সমান্তরাল ধারা ? 

অবশ্যই এরকম একটা আবহাওয়া দরকার এখানেও ... তবে বিক্ষিপ্ত ভাবে সাহিত্য চর্চা কেন্দ্র কিছু এখানেও গড়ে উঠেছে , রায়গঞ্জেই তো শনিবাসরীয় আড্ডা বসে ... শিলিগুড়িতে হকারস কর্নারে ‘বুকস’ বলে একটি বইএর দোকানে রেগুলার আড্ডা বসে , আরও কিছু আঞ্চলিক আড্ডা আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে । 

 আপনার অধুনা কর্মস্থল আর বাস তো উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ এ ... জন্ম কোথায় ? আপনার পড়াশুনো , পারিবারিক পরিমণ্ডল সম্পর্কে যদি একটু বলেন ... কিভাবে আপনি এলেন  লেখালেখির জগতে ? কার অনুপ্রেরণায় ?


আমাদের আদি বাড়ি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল এ ... আমার জন্ম অবশ্য এপারেই , ডালিম গাঁ তে ... পড়াশুনো রায়গঞ্জ কলেজ এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ... বিষয় অর্থনীতি । 
সালটা ১৯৬৬ , প্রথম প্রকাশ হল আমার লেখা ‘যুগান্তর’ এ , ১৯৭১ এ কলেজ ম্যাগাজিন ‘প্লাবন’ এর সম্পাদনা এবং নিজেও লেখা , ১৯৭৫ সাল থেকে ‘প্রত্যয়’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা , এরপর ১৯৭৮ সাল , সম্পাদনা করা শুরু করলাম , ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা চয়ন , এটি এখনো নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ।  প্রথম লেখার অনুপ্রেরণা আমার মা আর বাবা , তারা নিজেরা না লিখলেও আমায় উৎসাহিত করে গ্যাছেন , আর বলতে হয় , সাহিত্যিক তপন কিরণ রায় এর কথা , যার জন্য নিয়মিত লেখা লেখির জগতে এসে পড়া ।    

কবিতায় শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে শুদ্ধতা নিয়ে আপনার কি মত ... এলিয়ট , ইয়েটস এর কবিতায় দেখি অন্য কালচার , রিলিজিয়ন থেকে অগুন্তি শব্দের ব্যবহার ... আপনি নিজে কি বলেন বিশুদ্ধবাদীদের ? 



আমি পরীক্ষা নিরীক্ষায় বিশ্বাসী , কে কোন শব্দ কতোটা বিশুদ্ধ ভাবে প্রকাশ করছে , তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সেটা সার্থক ভাবে ব্যাবহৃত হচ্ছে কিনা ... জীবনানন্দও তো সচেতন ভাবেই তাঁর কবিতায় সাধু চলিত শব্দের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন । 


উত্তরবঙ্গের কবি সাহিত্যিকরা প্রায় ই আফসোস করেন , দক্ষিণের হাওয়া অনেক প্রিভিলেজড ... এ বিষয়ে আপনার কি মত ? আপনি কি মনে করেন , লেখালেখির জন্য ভৌগোলিক অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ ?  


একেবারেই না, আসলে আমরা উত্তরের সাহিত্যিকরা অনেক সময় ই নিজেকে ঠিক ভাবে প্রকাশ করতে কুণ্ঠা বোধ করি ... সবসময় যে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে তা নয় । এটা অনেকাংশে নিজেদেরই দায়িত্ব । আমাদেরও খানিকটা এগিয়ে আসতে হবে । উদ্যোগ নিতে হবে সকলের কাছে পৌঁছনোর । 

 সাহিত্যিকদের কি সচেতন ভাবে রাজনীতি বর্জন করা উচিৎ ? 




 না, তা কখনো করা যায় না ... একজন সাহিত্যিক সমাজ কে বাদ দিয়ে চলতে পারে না । একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে সে তো মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে না তার চারপাশের রাজনৈতিক সামাজিক ঘটনাবলী থেকে ... রাজনীতি সবসময় ই সাহিত্য কে প্রভাবিত করেছে , শুধু কবিতা নয় , ছোটগল্পেও এই জিনিস দেখেছি আমরা । 

পরিবর্তনশীল সমাজের সাথে সাথে কি পরিবর্তিত হন সাহিত্যিকও  ? 




 অবশ্যই ... পরিবর্তিত মূল্যবোধ অবশ্যই প্রভাবিত করে একজন সাহিত্যিক কে । লেখাতেও তার ছাপ পড়ে । 



প্রথম সাহিত্য সৃষ্টি কবে ? 




 তখন ক্লাস টেন ,প্রথম লিখলাম ছড়া ...  




অনেকদিন ধরে তো লিখছেন । কবিতা ছাড়া আর কি লিখতে ভালো লাগে ?




কবিতার বাইরে প্রবন্ধ লিখেছি প্রচুর , ছোটগল্প মাত্র গোটাচারেক । তবে কবিতাই প্রথম  পছন্দ ।  




সাহিত্যের বাইরে নেশা কি ? 




আমি সিনেমা দেখতে ভালোবাসি , সুযোগ পেলেই সিনেমা দেখি । 




আগের উত্তরের রেশ ধরে বলি , সিনেমার ক্ষেত্রে কি ভালো লাগে ? বাংলা , হিন্দি , ইংরেজি , সেকাল , একাল ? প্রিয় নায়ক নায়িকা কে ? 



আমার কোন বাছবিচার নেই , ভালো সিনেমা হলেই হোল । প্রিয় নায়ক নায়িকার কথা বলতে গ্যালে উত্তম সুচিত্রার কথাই মাথায় আসে । 



ধরুন , আপনি কবিতার ক্লাসের মাস্টারমশাই ... কি বলবেন ছাত্রদের ?




বলব , নিষ্ঠাভরে কাব্যচর্চা করতে । সফল হতে হলে যে কোন ক্ষেত্রেই নিষ্ঠা দরকার ।  




স্বপ্ন দ্যাখেন ? 




অবশ্যই । স্বপ্ন দেখি , আরও ভালো লেখার , সম্পাদিত পত্রিকা ‘চয়ন ‘ যতদিন বাঁচব , চালিয়ে যাবার । 



আক্ষেপ আছে কোন ?




না, আমার কোন আক্ষেপ নেই । আমি যা পেয়েছি তাই নিয়েই সন্তুষ্ট । 




অনেকদিন তো সাহিত্য সেবা করছেন ... স্বীকৃতি পেলেন কি যথাযোগ্য ? 




স্বীকৃতি অনেক ই পেয়েছি । এক লহমায় অত কিছু মনেও পড়ে না ... যেটুকু মনে পড়ছে তাও অনেক , ‘কবিতা কাঞ্চন পুরস্কার ’, ‘শনিবারের সাহিত্য বাসর পুরস্কার ’, ‘উত্তরবঙ্গের প্রগতি সন্ধান’, ‘হিতেন নাগ স্মৃতি পুরস্কার’, ‘মড়ক সাহিত্য পত্রিকা পুরস্কার ‘, ‘ হলদিয়া সাহিত্য উৎসব,’, ‘দিনহাটা সাহিত্য উৎসব’ আয়োজিত পুরস্কার’ ইত্যাদি । 

এখন পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা কত ? আর কি আছে আমাদের জন্য ঝুলিতে ? 




এখনও অবধি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চারটি ... যুগ্ম ভাবে ‘শব্দের ধুলো ওড়াই’, ‘ হাতে অনেক কাজ’ , ‘চুপচাপ এই কারাবাসে’, ‘রক্ত নিঃশ্বাস যুদ্ধ চায়’... খুব অল্পদিনের মধ্যেই আরও দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেতে চলেছে , কাজ চলছে , আশা করছি ২০১৫ তেই পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে । 

উত্তরবঙ্গের কাব্যচর্চার ধারা নিয়ে আপনার কি মত ? 




‘রায়গঞ্জ কবিতার শহর’, বলে গেছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় । সত্তরের দশকে এখান থেকে অগণিত লিটিল ম্যাগ প্রকাশিত হত । একটা জোয়ার এসেছিল যেন । পরবর্তীকালে এই বেগ খানিকটা ঝিমিয়ে এলেও এখনও যা চলছে যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক । ভালোই করছে সব । আমি আশাবাদী ।  

কবিতা পত্রিকা সম্পাদনার জন্য অগুন্তি নবীন লেখকের সংস্পর্শে রোজ আসেন ... কেমন বুঝছেন সাহিত্যের ভবিষ্যৎ ? 

 হুম , গোটা পশ্চিমবঙ্গের অসংখ্য উঠতি এবং বিখ্যাত লেখক ই লেখেন নিয়মিত ভাবে আমার পত্রিকায় । আমি লেখা চেয়ে নতুন দের সাথে যোগাযোগ করি । তাদের লেখার সাথে আমার সম্পাদক হিসেবে নিবিড় যোগ । আমার তো ভালোই লাগে , তাদের নতুন নতুন ভাবনা চিন্তা , ধরণ , কাব্য ভাষা । বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ এদের হাতে সুরক্ষিতই ।



আমাদের জন্য আপনার মূল্যবান সময় এতটা হাসিমুখে ব্যয় করলেন , কবিকে অনেক ধন্যবাদ । ভালো থাকুন । ভালো লিখুন । আমাদের জন্য ...



শর্মিষ্ঠা ঘোষ
কবি অরুণ চক্রবর্তী
পরিচিতি
পরিচিতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ