তেরঙ্গা পতাকা’টা একটা বাঁশের মাথায় ঢুকিয়ে – সমস্ত রাস্তা একা একা হেঁটে এসে লোকটি ক্লান্ত হয়ে একটা ছাতিম গাছের নীচে এসে বসে পরল। তার আগে পতাকা’র ফুট ছয়েক বাঁশটাকে পুতে দিল মাটিতে। তারপর ঝুলির ভেতর থেকে তার প্রিয় বেহালাটাকে বের করে ছড় টেনে সুর বের করতে লাগল ‘’ ও আমার দেশের মাটি তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা’। কেউ কেউ বাজারে যাবার পথে দাঁড়িয়ে একটু শুনছিল , আবার কেউ কেউ চলে যাচ্ছিল নিজের গন্তব্যে। পেছনের কুয়াশামাখা নদীর সামনে মানুষটিকে একটা সাদা সাদা চাদরের সামনে যেন সিল্যুয়েট ছবি মনে হচ্ছিল। পেছনটা যার সর্বদাই আলোকিত।
অনেকেই জানে মানুষটি বিশেষ দুই দিন – পনেরো’ ই আগস্ট অথবা ছাব্বিশে জানুয়ারীতে একটা ফুট ছয়েক লাঠির মাথায় তেরঙ্গাকে নিয়ে , কখনো ঘাড়ে অথবা মাটিতে পুতে দিয়ে বেহালার ছড় টানে। যারা ওকে চেনে না তারা ওকে ভিখারী ভাবে।
মানুষটির বয়স প্রায় আশি। কালো টানটান চেহারাটার মধ্যে অদ্ভুত চোখ দুটো... মায়াময় – স্বপ্লালু। ভিড়ের মধ্যে মধ্যবয়স্ক একজন লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলে ‘ সুধন্য দা – এই বয়সে এসব করে কি লাভ?
- আমার ভালো লাগে। স্বপ্ন ফেরী করতে আমার ভালো লাগেরে ভাই।
যদি রাস্তার মধ্যে কিছু হয়ে যায় ? আরও একজন জিজ্ঞাসা করল।
- তোমরা তো আছ ভাই। দাহ তো করতেই হবে। তা নাহলে মরে গিয়েও তো গন্ধ ছড়াবো।
মানুষটি হেসে ওঠে। প্রথম জন হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল , আপনার স্বপ্ন কি সফল হবে ?
মানুষটি হেসে ওঠে। প্রথম জন হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল , আপনার স্বপ্ন কি সফল হবে ?
- তোমাদের আমি বাতিল করেছি। কিন্তু নতুন প্রজন্মের মধ্যে আমার কথা গুলোকে আমার স্বপ্ন কে ছড়িয়ে দিতে চাই।
কিছু স্কুলের ছেলে-মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর বেহালা শুনছিল। সুধন্য লোকটি দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করল – ‘ হলো না হলো না ... এ দেশটাকে আমরা কিছুই দিতে পারলাম না । যদি তোমরা পার ... সত্যিকারের এই দেশটাকে নতুন করে গড়ে নিতে ‘ ...। অনর্গল বলে চলেছিল লোকটি। সেই সাথে মাঝে মাঝে চলছিল বেহালাতে ছড় টানা।
আজ প্রজাতন্ত্র দিবস। ১৯৩০ সালের ২৬শে জানুয়ারী জাতীয় কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ চায়। একটা স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে প্রতিটি ভারত বাসীর রক্তে দিল নতুন এক ভারত বর্ষ গড়ার ডাক। স্বাধীনতার মুহূর্ত এল ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট মধ্যরাতে। আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম – বিভেদ নয় , ধর্মান্ধতা নয় , ধনী নয় – গরীব নয় – সবাই একই দেশের মানুষ বলেই পরিচিত হবে।
সে উত্তেজনায় প্রতিটি মানুষ স্বপ্নে বিভোর হয়ে রইল। ১৯৫০ সালে ভারতীয় জনগণকে উৎসর্গ করা হল ভারতীয় সংবিধান। সেই সংবিধান সংগে নিয়ে গণতন্ত্রের এক বৃহৎ দেশ বলে বিবেচিত হল এই দেশ। সবাই মিলে দেশ গড়ব – সবাই মিলে বাঁচব একসাথে ... হল না ... হল না ।
স্বাধীনতার সাতষট্টি বছর পরেও সবাই কেমন যেন স্বার্থপর হয়ে একা একা বাঁচতে চায় ... বাঁচতে চাইছে একা একা । পাশের বাড়ীর লোক অনাহারে থাকলেও , কারও কিছু যায় আসে না। এ কেমন দেশ গড়ে তুলেছি আমরা। একা একা বাঁচা যায় না ... না যায় না। প্রথমে আমরা নিজের জন্য নিজের পরিবারের জন্য বাঁচি - তারপর আশে পাশের বাড়ীর লোকের জন্য বাঁচি – একে অপরের পরিপূরক হয়ে বাঁচি – তারপর একটা গ্রাম বা শহরের মানুষের সহমর্মী ... সহযোগী হয়ে বাঁচি। এভাবেই সমগ্র দেশের জন্য বাঁচি । বহু মানুষের সেই স্বপ্ন দেখাটা একটা দুঃস্বপ্ন’ ই রয়ে গেল ...।
লোকটার চোখে জল চিক চিক করছে ... গলাটা ধরা ... বেহালা ধরে আবার সুর তুলতে লাগল ‘ কারার ঐ লৌহ কপাট ‘... সম্মুখের ছাত্রদের উদ্দেশে বলতে থাকে ... তোরা পারবি আর একটা স্বাধীনতা আনতে ? নাগরিক মূল্যবোধের জায়গাটা দৃঢ় করতে ? পারবিনে ?
না আমি হারিনি। বিশ্বয়নের বাজার আমাকে ছুঁতে পারেনি ... কিন্তু আমার ছেলে ... একমাত্র ছেলে হেরে গেছে... । ফ্ল্যাট – গাড়ি – জীবন যাপনের বৈভব ... সব কিছু তার কাছে স্বাধীন ভারতবর্ষের অর্থ। এই জন্য কি ৪২ এর আগস্ট আন্দোলনে পুলিশের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা ? সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হবে ... সব কিছু । আমাকে বাঁচতেই হবে ... দরকার হলে হাজার বছর ।
দূরে একটা হুটারের শব্দ ও অনেক গুলো মটর সাইকেলের মিছিল এগিয়ে আসছে ... সঙ্গে শ্লোগান ... আমাদের নেতা বিবেক বাবু জিন্দাবাদ। সামনে পুলিশের গাড়ী। চকিতে বৃদ্ধের সামনের ভিড়টা ফাঁকা হয়ে গেল। বৃদ্ধ সুধন্য সড়ে গেলেও পতাকাটা তুলতে পারল না। মটর সাইকেলের ধাক্কায় লাঠি সমেত পতাকাটা গাড়ীর চাকার নীচে দুমড়ে মুচড়ে গেল। মিছিল এগিয়ে চলল শ্লোগান সহ গন্তব্যের দিকে।
![]() |
পরিচিতি |
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন