জামগাছের নীচে তালগোল পাকিয়ে পড়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছিলো, দেহে প্রাণ নাই কিন্তু সাহস করে নেহাল যখন দেখলো: ছুঁয়েই দেখলো মেয়েটার নাড়ি চলছে, আর একমুহূর্ত দেরি নয় বেলির মা অন্তুবিবি আরও কয়েকজন তাগড়া মানুষ মিলে তাকে বয়ে নিয়ে এলো দাসু জোলার বাড়িতে, কারণ এই বাড়িটাই কাছে, মেয়েটার মাথায় পানি ঢালা হলো, চোখমুখে পানি ছিটানো হলো, তারপরেও জ্ঞান আসে না, শেষতক হালিমের নোংরা মোজা শোঁকানো হলো তাকে, এই নিঝুম গ্রামে ডাক্তার কই? নাদের গেছে কোকাপাল ওঝা কে আনতে, তার আগেই মেয়েটার জ্ঞান ফিরে এলো, -কেডা তুমি? কেম্বায় আইলা এদারে?
-জানি না একটা ঝড় আইছিলো, আমারে উড়াইয়া আনলো, মেয়েটা আর কিছু বলে না কেমন চুপ মেরে যায় ।
ঘূর্ণিঝড়ের একটা সম্ভাবনা দিনসাতেক আগে তৈরি হয়েছিলো, মতির বাপ রেডিও শুনে সবাইকে জানিয়েছিলো, মাইকিংও হয়েছিলো, সারা গ্রাম আশ্রয় নিয়েছিলো স্কুলঘরে, এমনকি সব বাথান খালি করে গরুগুলিকে জড় করা হয়েছিলো নৃপেন ঘোষের পোক্ত ভিটায়, হাঁসমুরগি খামারিদের কিছু করার ছিলো না, যা উপরওয়ালার মর্জি ভেবে তারা নিজেদের ঘরেই রয়ে গেলো, এমনকি বুড়ি হাজেরাও আশ্রয় কেন্দ্রে যায়নি । একটা ঝড় হয়েছিলো বটে, পদ্মাও ফুঁসেছিলো কিন্তু কোন ঘূর্ণিঝড়তো হয়নি! পরদিন যার যার ঘরে সবাই ফিরেছে, যা কিছু ভাঙচুর হয়েছিলো তা মেরামত করেছে, কিছু উপড়ানো গাছ কেটেকুটে লাকড়ি বানিয়েছে, এরপর তো আর কোন ঝড় হয়নি! এই মেয়ে কোন কথা বলছে? পোষাক আশাক কথাবার্তায় তাকে সম্ভ্রান্ত লাগে, রাজকন্যার মত, তাছাড়া ঘূর্ণিঝড়ে পড়লে কারো হাঁড়গোড়ও আস্ত থাকেনা ।
হঠাৎ আরেক ঘটনা ঘটেছে, সোমনাথ বাবুর বাড়ি দখল করে নিয়েছে শান্তি কমিটির লোকজন, সে গৃহবন্দী, এমনও হতে পারে তাকে মেরে ফেলা হবে, সব একে একে ওপার পাড়ি জমালেও সোমনাথ বাবু যায়নি, তার পূর্বপুরুষের জমিদারী ইমারত, কিছু জমিজমা এসব মূখ্য নয়, মূল কথা টান, এখানে সে জন্মেছে, ওই তুলসী অঙ্গনে তার নাড়ি পুতে রাখা, তার আবাল্য শৈশব, বল্গাহীন যৌবন, নারীসঙ্গ পরিত্যাগ করা মধ্যজীবন এবং প্রায় আটষট্টির কোঠায় আসা বার্ধক্য, ভাইয়ের সন্তানেরা বহুবার বলেছে, চলে আসো কাকা, সে যায়নি, সেই বাড়িতে শান্তিকমিটির আখড়া! পাকিস্তানী মিলিটারী, গ্রামের অবোধ কিশোরী যুবতীর বন্দী কুঠুরী, বেতাল শরাব উৎসব, কখনও তাকে ভোগের আসরে ধরে নিয়ে যেয়ে অধর্মের উৎসব দেখতে বাধ্য করা হয়, সোমনাথ বাবু ঘোর অসুস্থ, কেউ নেই তাকে দেখার, এমন সময় একজন এলো,
-মিহির ও দাদু তুই শান্তি হইছাস?
-আস্তে কথা কও দাদা, তোমারে কল্কিবাবার আস্তানায় পৌঁছাইতে শান্তিদলের ভেক ধরছি ।
কল্কিবাবা গ্রামের অনেক পুরোনো পীর, হিঁদু মোছলমান সবাই তার ভক্ত, কেউ তাকে ঘাটায় না, সে পাবলিকের ক্ষমতায় ক্ষমতাশালী, অনেককাল আগে এক ভূমিকম্পে একটা মসজিদ সম্পূর্ণ জেগে উঠেছিলো মাটির নীচ থেকে, সঙ্গে এক লাগোয়া কবর, লোকে বলে ওটা জ্বিনের মসজিদ, সেইখানকার ঈমাম সে মসজিদের আশেপাশে বদলোকের প্রবেশ নিষেধ, কল্কিবাবা কিন্তু গাঁজা খায় না, হুক্কায় কল্কি লাগিয়ে জাফরান আর কর্পূর মেশানো ধোয়া পান করে, তার আসল পরিচয় কেউ জানে না, যেমন সে ছাড়া কেউ জানে না মসজিদের তলকুঠুরিগুলির কথা, তার কাছের সেবকও নয় । এখন সেখানে একদল মুক্তিযোদ্ধা আছে, এই তথ্য বাইরে যাওয়া নিষেধ, তাই জ্বিনদের প্রয়োজনের খাদ্য যোগান দিতে সে মুরিদানদের আদেশ করেছে, মিহির সেই মুক্তির একজন, শান্তি সেজে সোমনাথবাবুকে উদ্ধার পরিকল্পনায় ব্যাস্ত, আরও কাজ রয়েছে তার, সেসবে আসছি একটু পরে ।
গ্রামের বৌ ঝিদের অনেককেই বাড়িতে পাওয়া যাবে না, তবে বেশিরভাগই ভিটা ছাড়েনি, স্বল্পশিক্ষিত সাদাসিধে জনগোষ্ঠী হঠাৎ নিয়ম পরিবর্তন পছন্দ করে না, তাদের যেমন বোঝানো হয়েছে, তেমনি বুঝেছে এবং শান্তিকমিটির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে, পাগলেও নাকি নিজের ভালো বোঝে, এরাও তাই এইরকম সময়ে আছে, নিজের ঘর পরিবার রক্ষা করা প্রথম কর্তব্য, এদিকে ঝড়ে পাওয়া মেয়েটিকে পাওয়া যাচ্ছে না, যার ভাষ্যমতে, ঘূর্ণি তাকে উড়িয়ে এনেছিলো! নুরালী জানিয়েছে, সে শান্তিকমিটির দখলে নেই ।
তখন উত্তাল যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হয়েছে, প্রতিটি রণাঙ্গন এখন রক্তেধোয়া, আক্রান্ত হলো সোমনাথবাবুর বাড়ি, সময় কখন হবে আক্রমণের তা মিহির জানিয়েছিলো, আর প্রতিটিমুহূর্তের হিসাব করে বের হয়ে পড়েছিলো সোমনাথবাবুকে নিয়ে একটা ঠেলায় তুলে, গতকাল সবিতা কে পেয়েছে সে, তার স্ত্রী সবিতা, জ্বিন মসজিদের ক্যাম্পে ঝড়ে উড়ে আসা নারীটি । হ্যাঁ, যে রাতে তাদের বাড়ি আক্রান্ত হলো, মা বাবা মরলো আগুনে পুড়ে, তিনটে বোন স্বেচ্ছায় ঝাঁপ দিলো আগুনে, পানাপুকুরের ঢালে বসে সবই দেখেছিলো মিহির, সবিতা, তাদের কিছুই করার ছিলো না, এমনকি মিলিটারী আর তাদের দোসররা যখন পুকুরের দিকে আসছিলো, ওরা নেমে পড়েছিলো পানাভর্তি পুকুরে, নিঃশব্দ ডুবসাঁতার দিয়ে কোন পাড়ে কে পৌঁছুলো ,কিভাবে আলাদা হলো পথ, সবই ধোঁয়াশার স্মৃতি, জোলাবাড়িতে কাটানোর দিনগুলিতে সবিতা নিজেকে আড়াল করেছে, আড়াল তো মিহির পরামানিকও করেছে নিজেকে ।
কল্কিবাবা সাধারণ মানুষ, মসজিদ সংলগ্ন ঘরে তার স্ত্রী এবং সন্তান থাকে, সে সারাদিন মসজিদ সাফ করে, কবর পরিস্কার করে ওখানকার গাছগুলোতে পানি দেয়, ঈমামতি করে, কমিটি তাকে মাসোহারা দেয়, গ্রামের মানুষ শ্রদ্ধাভরে ফলপাকুর, আনাজ দিয়ে যায়, আপাতদৃষ্টিতে বোঝার কোন উপায় নাই সে মুক্তির পক্ষে কাজ করছে, শান্তিকমিটি বহুবার এখানে ঘুরে গেলেও বিষয়টা ধরতে পারেনি । মসজিদের তলকুঠুরিতে তিনটা পথ, একটা ধলেশ্বরীর দিকে, আরেকটা শ্মশানের বটঝোপে, আরেকটা বাজারের সরুপথের তুলাগাছের কাছে, কল্কিবাবার কাছেই সুরাপাঠ শিখলো মিহির তারপর খৎনা করালো, উপায় ছিলো না, ধেড়ে বদমাশগুলো লুঙ্গি খুলে অনুসন্ধাণ করে, এখন ছদ্মবেশ দরকার, শান্তিবাহিনীর দলে সূঁচ হয়ে ঢুকতে হলে কোন খুঁত রাখা যাবে না, সবিতা কে যখন সে দুটো মিথ্যে বলে পটিয়েছিলো, পরে সবিতা জেনে গেলে হেসে বলেছিলো, যুদ্ধ আর প্রেমে সবই ঠিক, কথাটা মনে পড়তে একচিলতে হাসি ফুটে ওঠে মুখে, আজ সবিতাও অস্ত্র ধরেছে, সোমনাথবাবুকেও নিরাপদে কল্কিবাবার জিম্মায় রেখে আসা গেছে, এবার তার সরব যুদ্ধ শুরু হবে ।
আমারে জবান দে লড়বি, বীরের মতন, আমিও লড়ুম, মরুম তবু ইজ্জত দিমু না, তারা প্রতিঞ্জা করেছিলো, কারণ সবিতা ও মিহির মুক্তিযোদ্ধা ছিলো, বাবুসোনা গল্পটা শুনে আমাকে বলেলো,
-তুই শিল্ডারস লিস্টা মুভি দেখে গল্পটা বানিয়েছিস
-গল্প? মুক্তিযুদ্ধ একটা গল্প? প্রতিটা যুদ্ধেই রক্ত আর স্বজন হারানোর ইতিহাস থাকে। শিল্ডারস সাহেব কি ইতিহাসের বাইরের কেউ ছিলেন?
-না, তা নয়, আমি এমন কই বললাম? চল বিজয় উৎসবে যাই
-যা তোরা তোদের একদিনের পতাকা উৎসবে, আমি সবিতা কাকিমার কাছে যুদ্ধের ইতিহাস শুনতে যাবো, মিহির কাকার সমাধিতে, ওখানে তার প্রেম ও যুদ্ধের পবিত্র অস্থিভস্ম বাতাসের সাথে কথা বলে ।
![]() |
পরিচিতি |
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন