ইফতেখারুল হক



‘পরশ’ বাঙলায় তিন অক্ষরের একটি অতি চমৎকার নাম, শব্দতো অবশ্যই । কিন্তু বেশ অবহেলিত ব্যবহারে এবং চর্চায়ও । লিখতে গিয়ে ব্যবহার করি আমরা শব্দটির তবে ঠিক বেশি নয়, সামান্যই । নামের ক্ষেত্রেই,কাজের ক্ষেত্রে নয় । কিছু যদি ব্যবহার করি তবে তার বিশেষ্য রূপটিই ‘স্পর্শ’ ‘স্নেহ’, ‘মায়া’, ‘মমতা’ তাও কৃপণ ভাবেই লেখায়, কাজে ও কর্মে ! কিন্তু যদি খুব গভীর ভাবে ভাবি এর অর্থটি নিয়ে, তবে দেখব শব্দটির ভেতর লুকিয়ে আছে এক অতি দরদ মেশানো আবেদন । আবেদনের যে সুর, উচ্চারণ মাত্রই টেনে নিয়ে যায় গভীর থেকে গভীরে,ক’রে তোলে মাতাল তার রূপটি,গন্ধটি । ঢেউ তোলে মনে । প্রাণে ছুঁয়ে যায় হিমেল হাওয়া । মানুষের মতো অতি সংবেদনশীল এই শব্দটি আজ নানা কারণে বিলুপ্ত প্রায়;বিলুপ্ত বলছি এই কারণে যে, আমরা আজ অনুভূতিপ্রবণতায় ঠিক আগে জায়গায় নেই, সেও নানা কারনেই । আমাদের ভেতর বাহিরের দুটো অবস্থানই নড়বড়ে । আবেগ যেন থেকেও নেই ভেতরে,থাকলেও প্রকাশ নেই বাইরে ! আবেগ ভেতরের, প্রকাশটা বাইরের । কিন্তু দুটো আজ দাঁড়িয়ে গেছে পরস্পরের মুখোমুখি । বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়ে !

খুব দুঃখের কথা, খুব বেদনার কথা এই যে, অসংখ্য অসঙ্গতির মাঝে বিরাজ করছি আমরা । জীবনের পথ চলায় আমরা দেখিনা আমাদের অসঙ্গতি গুলো । দেখলেও গায়ে মাখি না । বুঝি অনেক কিছুই, কিন্তু না বোঝার ভান করে থাকি ! সমস্যাটি কি তাহলে আমাদের মনোজগতের ? শিক্ষার ? নাকি সচেতনতার ? প্রশ্নের পর প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে মনে । মন সমাধান চায় । কিন্তু সমাধান কোথায় ?

এইটুকু বলা যায়, বোঝা যায় খুব না ভেবেও যে, শিক্ষায় এর কোন সমাধান নেই। শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারি আমরা কিন্তু তা দিয়ে কি স্নেহ, মায়া, মমতা, স্পর্শ, আবেগ মোট কথা ‘পরশ’কে অধিগ্রহণ করতে পারি আমরা ? মোটেও নয় । শিক্ষা মনোজগতের পরিবর্তন ঘটাতে পারে, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে, কিন্তু মানুষের মনের পরশটির যে রূপ তা নির্মাণ বা বিনির্মাণ কোনটিই করতে পারেনা । যদি পারত তাহলে একজন শিক্ষিত,উচ্চ শিক্ষিত মানুষের কেন আবেগের প্রকাশ নেই ? কেন নেই স্নেহ, স্পর্শ, মায়া, মমতা ? কেন আছে একজন অশিক্ষিত মানুষের ভেতর এই সব যাবতীয় মানবিক গুণাবলী গুলো ? তাই বোধ করি এসবের চর্চা গুলো যেমন শিক্ষায় হয়না তেমনি শিখিয়ে দিলেও হয় না । বিষয়টি একান্ত মনের ।

আমরা যদি খুলে দিতে পারি মনের দরোজাটি উদার ভাবে তাহলে মনে হয় ওদের যে পরস্পর বিরুদ্ধ অবস্থান এবং তা থেকে যে সংকট সেসবের অবসান ঘটবে । আর তার ফলে এবং বিশ্বাস করি-পরশের আবেশ ছড়িয়ে যাবে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, পরিবার থেকে পরিবারে; সমাজে এমন কি রাষ্ট্রে ।

একজন মানুষের পরশ পেয়ে যদি অন্য আরেকটি মানুষ ফিরে পায় সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন । যদি ফিরে পায় আত্মায় প্রাণ পুনর্বার । যদি স্পর্শে, মায়া, মমতায় কোন মানুষ শান্তির বারতা নিয়ে হাজির হয় । পাশে দাঁড়ায় অন্য আরেকটি মানুষের, তবে ক্ষতি কি ? কি এমন ক্ষয়ে যাবে ? মানুষ তুমি কার কে তোমার ? যদি প্রশ্ন জাগে মনে কোন মানুষের এমনটি । আর্তি জানায় যদি কোন অসহায় মানুষ অন্য মানুষের প্রতি,তাহলে এর উত্তর কি হওয়া উচিৎ ? কেমন করেই বা সাজাবো আমরা উত্তর গুলো ? আপাতত সরল প্রশ্ন মনে হতে পারে আমাদের কাছে; কিন্তু এইসবের উত্তর পাওয়া বেশ কঠিন । কারণ, প্রশ্নের উত্তর গুলো নির্ভর করছে সম্পূর্ণ মানবিকতার উপর আর সমস্যা এখানেই । এবার প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি মানবিক ? আমরা কি সব কিছু বিচার, বিবেচনা করে থাকি মানবিক দৃষ্টি কোণ থেকে ? ভাববার বিষয়ই বটে । ভাবিয়ে তুলে, ভেবে আমরা আতঙ্ক বোধ করি । আরও আতঙ্ক গ্রস্ত হই এর সত্য উদঘাটন করতে যেয়ে। কারণ এখানে আমরা যে ফলাফল পাই তা অত্যন্ত শোচনীয় আর আন্তঙ্কের কারণ এই জন্যেই ! 

মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আরেক নাম মানবতা । মানুষ হিসেবে মানুষকে বুকে টেনে নেবার আরেক নাম মানবিকতা । আমাদের সামান্য পরশে অর্থাৎ স্নেহে, মায়া, মমতায় অপর একজন মানুষ ফিরে পেতে পারে নতুন জীবন । দেখতে পারে নতুন করে বাঁচার সপ্ন। মানুষ যখন বিপদে পড়ে, বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে, বোধ করে অসহায়ত্ব নিজের ভেতর; তখন সে খুঁজে বেড়ায় ভর ও ভরসা । সাধারণত খুব কাছের মানুষের কাছ থেকেই । প্রেম, ভালবাসা, মায়া, মমতা কোন বাজারি পণ্য নয়, চাইলেই কিনতে পাওয়া যায়না । তবে বিলিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে বিনামূল্যে । এই সব কিছুই মানুষের নিয়ন্ত্রণে, মানুষের অধিকারে । বিলিয়ে দেবার ক্ষেত্রে মানুষের স্বদিচ্ছাই যথেষ্ট আর কোন কিছু না ভেবেই । কিন্তু আমরা কি বিলায় এইসব মানুষের তরে ?

আমরা পেরিয়ে এসেছি এমন এক সময় যাকে বলতে পারি সোনালি অধ্যায় । খুব বেশি দিন আগের কথাও নয় । মোটামুটি কয়েক দশক পিছিয়ে গেলেই হবে । তখন মানুষের ভেতর কেন জানি মায়া ছিল বেশি, দয়াও ছিল । প্রেম ছিল, ভালবাসা ছিল । দরদ ছিল, মমতা ছিল ভরপুর । সম্পর্কে স্বার্থ ছিল তবে তা নগণ্য । দেবার এবং নেবার ভেতর  কার্পণ্যতা ছিল না । সমন্বয় ছিল সামঞ্জস্যতা ছিল । আর এখন কি দেখছি আমরা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ? চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন !

তবে কি সময়ের সাথে সময়ের বিরোধ ছিল ? এখনো আছে ? আবারো ভাবনায় পড়ে যাই ।  আহত বোধ করি, পীড়িত হই । পার্থক্য দেখলে, ব্যবধান খুঁজে পেলে । সময় বসে থাকেনা এগিয়ে যায় । পরিবর্তনের পালাবদলে সময়ের এই যে ভেসে যাওয়া তা সময়েরই সহজাত স্বভাব । আটকানোর ক্ষমতা রাখিনা আমরা । একটি উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখি আমরা, দেখি সমাজ উন্নতিরও । দেখি নাকি রাষ্ট্রেরও ? খুব দেখি । এমন স্বপ্নেই বিভোর আমরা আজকাল ।

কিন্তু ফেলে এসেছি যে সময়, যে স্বপ্ন, যে আকাঙ্খা তা কেমন করে ভুলে যাই আমরা ? যে এবং যারা আমাদের চেতনা বিকাশে বলিষ্ঠ ভুমিকা রেখেছিল । আমাদের আজকের অবস্থান গত দিনের স্বপ্নকে লালন করেই । তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে উন্নয়ন ঘটেছে আমাদের, সমাজের, রাষ্ট্রের কোন সন্দেহ নেই তাতে । কিন্তু, আমরা হারাতে বসেছি আমাদের ভেতরের রূপটিকে, সত্তাটিকে আধুনিক মারপ্যাঁচে ! যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি আমরা, সেই সাথে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমাদের মানবিক বোধটুকু ।

আধুনিকতার নামে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের সম্পর্ক গুলো ! নষ্ট করে দিচ্ছে স্নেহ, মমতা বিলিয়ে দেবার ও নেবার ক্ষমতা । অভাব বোধ করছি মুহূর্তে মুহূর্তে এসবের । সম্পর্কের স্তরটিকে আমরা যদি তিনটি ভাগে দেখি আলাদা আলাদা ক’রে তাহলে প্রথমেই বলতে হয় সামাজিক পরশের কথা অর্থাৎ স্নেহ, মমতার কথা ।

পরিবারেই দেখি বাবা-মা ও তাঁদের সন্তানটি ভুগছে স্নেহ, মমতার অভাবে । এমন পরিস্থিতির উদ্ভব খুব ভালো করে তলিয়ে দেখলে দেখব হয়েছে এই আধুনিক সময়টাতেই । সাম্প্রতিক যান্ত্রিক সভ্যতার প্রচলনের যুগে বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের এবং সন্তানের সাথে বাবা মায়ের যে চিরায়ত মমত্ববোধের সম্পর্কটি তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে; কোন কোন ক্ষেত্রে হয়ে গেছেও । আমরা আশা করতে পারিনা, এমনকি ভাবতেও পারিনা যে, বাবা মা তাঁদের সন্তানটিকে বঞ্চিত করছে স্নেহ মমতা থেকে । আশা করতে পারি কি ? ভাবতে পারি কি-অসম, অসংলগ্ন সম্পর্কের জের ধরে কোন কোন বাবা মা তাঁর সন্তানকে হত্যার মতো নির্মম, ঘৃণ্য পথটি বেছে নিচ্ছে ?

ভাবতেতো এটাও পারিনা যে, সন্তান তাঁর বাবা মা’কে অর্থ অথবা স্বার্থ অথবা অন্য কোন কারণে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে । অপমান, অপবাদ দিচ্ছে । অসম্মান করছে । কিন্তু, বাস্তবতা বলছে অন্য কথা, অন্য ভাবে, অন্য ভাষায় ! এর সবকিছুই ঘটছে পরিবারে সমাজে । সময়কে ধরতে গিয়ে, উঁচুতলার সপ্ন দেখতে গিয়ে আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয় আজ স্পষ্ট । ন্যাংটো, নির্লজ্জ হয়ে গেছে মানবতাবোধ । ঢাকা যাচ্ছে না কোন আবরণেই ! অর্থনৈতিক উন্নতির প্রয়াসে লিপ্ত (সেটা যেকোনো পথেই হোক) আমাদের ব্যক্তিসত্তাটির ভেতরে আজ মায়া নেই, মমতা নেই । নেই স্নেহ ! যা আছে, যতোটুকু আছে তা দিই না, দেখাই না পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি । যার ফলশ্রুতিতে সামাজিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে ।

দয়াহীন,মায়াহীন হৃদয়,মন চর্চা করছি কি আমরা ? অনেক কারণের মাঝে ঠিক এইসব কারণেও কি পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন গুলো আলগা হচ্ছে ? বাড়ছে কি খুন, ধর্ষণ, শিশু অপহরণের মতো মারাত্মক মানবতা বিরোধী অপরাধ গুলো ? সন্দেহ নেই হচ্ছে, বাড়ছে এইসব কারণেও । খুব বেশি না ভেবেই বলা যায় এইসব করার পেছনে দয়া,মায়াহীন হৃদয়, মন অন্যতম প্রধান কারণ । তাই চাই সহিষ্ণুতা মন ও হৃদয়ের । মানুষের ভেতরের মানুষটির সহিষ্ণু হওয়া খুব দরকার ।

স্নেহ, মমতা অর্থাৎ পরশের অভাবে যে ব্যবধান তৈরি হয়েছে মানুষ থেকে মানুষের, মানুষের সাথে সমাজের সে পথটি কোনরকম পেরিয়ে এসে যদি আমরা মুখোমুখি দাঁড়াই অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ব্যবস্থার সামনে, রীতিমতো আঁতকে উঠি আমরা । দেখতে পাই অর্থনৈতিক অসাম্যের বিস্তার গোটা সমাজ রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে ! গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার এক দুঃস্বপ্নের নাম অর্থনৈতিক সাম্যতা । ঠিক এখানেও দয়ামায়াহীন মানুষ এবং আরো নিষ্ঠুর । অসাম্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কু-ফল বৈষম্য আর এই বৈষম্যের কারণেই গরীবেরা বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত পুঁজিবাদীদের দ্বারা । ফলে তাঁদের ভেতর দেখা দিচ্ছে অসন্তুষ্টি । তাঁরা হারাচ্ছে ধৈর্য । ফলশ্রুতিতে লুপ্ত হচ্ছে মায়া, মমতা ।  বাড়ছে অর্থনৈতিক অপরাধ সমাজ রাষ্ট্রে ! বসে নেই বিত্তবানেরা, তারাও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির উপর দাপট খাটিয়ে শুষে নিচ্ছে রাষ্ট্রের রক্ত । মায়া মমতাহীন হৃদয়ে তৈরি করে নিচ্ছে অর্থের প্রাসাদ । লুটে নিচ্ছে ব্যাংক, লিজিং কোম্পানি, রাষ্ট্রীয় বীমা সংস্থা গুলো । উন্নয়নের নামে ঋণ নিয়ে আদতে গড়ে তুলছে অর্থের পাহাড় । ধ্বংস করে দিচ্ছে অর্থনীতির অবকাঠামো গুলো । আর রাষ্ট্র বসে বসে দেখছে বিচারের নামে প্রহসনের নাটক ! লোভ থেকে লালসা থেকেই উৎপত্তি এসবের । যখন নষ্ট হয়ে যায় মায়া মমতা; হৃদয়ে ধারণ করেনা আর শ্রদ্ধা বোধ রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রতি তখনই ঘটে এইসব । এইসবের মূলে রয়েছে দেশপ্রেম যা মানুষের ভেতর আর নেই বললেই চলে ।

অর্থ যোগ নীতি একটি বিশেষ শ্রেণীর কাছে বন্দী এখন । অর্থের সু-ফল এবং কু-ফল বোঝে সব শ্রেণীই কমবেশি । কি সাধারণ, কি বিশেষ শ্রেণী । কিন্তু, নীতি বোঝে ক’জন ? একেবারে সাধারণ মানুষেরা যারা কৃষি জমি চাষাবাদ ক’রে অর্থনৈতিক মুক্তির পথটিকে নিষ্কণ্টক ক’রে রেখেছেন, যারা অর্থনীতির উন্নতির পথে আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু তাঁরা অসহায় এখানেই । যে নীতিমালা গুলো তৈরি হচ্ছে আর যারা তৈরি করছেন প্রশ্ন জাগে মনে তাঁরা কি পরম স্নেহে, যথেষ্ট দরদ মেখে তা তৈরি করছেন ? নাকি নিজ স্বার্থ উদ্ধারে যথেষ্ট নিজের অনুকূলের দিকে টানছেন নীতিমালা গুলো ? তাঁরা কি ভাবছেন দেশ ও দশের কথা ? যদি করতেন, যদি ভাবতেন অন্তত গরীবেরা ঠকতো না । দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটি বিশেষ শ্রেণীর মুঠোবন্দী হতো না ।

শিক্ষার সাথে অর্থনীতির কোন বিরোধ নেই । যদি থাকতো তাহলে সম্ভবত অবস্থা, ব্যবস্থা ও নীতির সামঞ্জস্যতা থাকতো । শিক্ষিত, অশিক্ষিত উভয় শ্রেণীই অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে ক’রে তুলেছে জটিল । মাঝ পথে গরীবের ক্ষতি । তাই বলতে পারি এই সব থেকে উত্তরণের পথে আমাদের সুস্থ মনের পরিচয় দিতে হবে । প্রসারিত করতে হবে স্নেহ, মায়া, মমতার মূল জায়গাটি । 
   
অর্থনৈতিক প্রভাব যখন বিস্তার করে রাজনীতির মগজে তখন রাষ্ট্রীয় কাঠামো গুলো ভেঙে পড়ে ধীরে ধীরে । ঠিক এই জায়গাটিতেও ভীষণ অভাব স্নেহের, মায়া মমতার । আমরা রাজনীতির মাঠে অবস্থান করি পরস্পরের শত্রু রূপে । আমরা ভাবিনা দেশের মানুষের কথা, দেশের কথা । এখানেও স্বার্থ প্রকট ভাবে দেখা দেয় । রাজনীতির খেলায় জনপ্রতিনিধিরা প্রায় বিচ্ছিন্ন সাধারণ মানুষ থেকে বিশেষ করে ভোটের পর । ভোটের আগে সাধারণের জন্যে স্নেহ, মায়া মমতার অভাব হয়না তাঁদের । স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে ওরা অভিনয়ের পর অভিনয় করে যায় ।

বিজয় লাভ করে নেমে পড়ে লুটপাটের রাজনীতিতে । খুব সচেতন ভাবেই ভুলে যায় অতীত, আড়াল করে স্নেহ, মায়া মমতা । সাধারণ মানুষেরা তখন সম্মুখীন হয় কঠিন বাস্তবতার । সুষ্ঠু রাজনীতির অভাবে ধ্বংস হয় সমস্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি । পরস্পর বিরোধী অবস্থান ও অনৈক্যের কারণে ক্ষতি হয় পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোটি । আর এর সব কিছুই হয়  রাজনীতির প্রতি  নাগরিকের মায়া মমতার অভাবে ।  শেষ পর্যন্ত আমরা হয়ত সমাধান করে দিচ্ছি সমস্যা গোঁজামিল দিয়ে, প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে । সচল করে দিচ্ছি সমাজ রাষ্ট্রের অনেক কিছু, কিন্তু বিকল হয়ে যাচ্ছে মানবিক বোধটুকু । বিকলতো বলতেই হচ্ছে, কারণ আমরা যদি স্নেহ মায়া মমতার চর্চা না করি মানবতা বোধটুকুর গায়ে জং পরতে বাধ্য । আর জং পরলে বিকল অনিবার্য । একজন প্রকৃত মানব দরদী, দেশ প্রেমি মানুষের জন্য বিষয় গুলো আতঙ্কেরই বটে । 

সময়ের সাথে সময়ের কোন বিরোধ নেই । বিরোধ যদি থাকে তবে তা পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তনের । প্রকারান্তরে বিরোধ আসলে পরিবর্তনের সাথে মনের  । যার সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক গুলোর । খালি চোখে অসম্ভব দেখা সম্পর্কের যোগসূত্রটি । মানুষ সমাজ, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ নানান কারণেই । কিন্তু কতটুকু সচেতন এই ব্যাপারে আমরা ? বলতে গেলে আমরা কি সমাজকে ভালবাসি, মায়া মমতা আছে সমাজের প্রতি ? ভালবাসি কি রাষ্ট্রকে ? দেখাই কি ? আছে কি ? মায়া মমতা । নেই একেবারেই, কথাটি বলা যাচ্ছে না । আছে বৈকি । তবে এই দয়ার সাথে মায়ার; মায়ার সাথে মমতার এবং সব কিছুর সাথে জড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও স্বার্থ !

শুনতে খারাপ লাগে, বলতে মুখে বাধে, লজ্জা হয় এই কথাটি ভেবে যে পরশের সাথে জড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও স্বার্থ । আজ আর বলতে দ্বিধা নেই যে, পরিবর্তন করতে হবে আমাদের নিম্নমানের মানসিকতার গঠনপ্রণালীটি যার নিয়ন্ত্রক একমাত্র মানুষ নিজেই । খুলে দিতে হবে হৃদয়ের দ্বার মানবতার খাতিরে । পরিচর্চা করতে হবে স্নেহ, মায়া, মমতা, দরদের জায়গাটি । সুস্থ, সুষ্ঠু  পরিচর্চায় আমরা পেতে পারি একটি সুন্দর সমাজ ও তাঁর সম্পর্ক গুলো । পেতে পারি একটি ,অসাম্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা । পেতে পারি একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা । আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই তাঁর অপরাধের সীমা পরিসীমা সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান থাকাটা জরুরী । 

ঠিক এই জায়গাটিতে এসে মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথকে যিনি আজীবন মানুষের কথা বলেছেন, মানবতার কথা বলেছেন, বলেছেন আত্মার পরিশুদ্ধি’র কথা । দেখতে পাচ্ছি একটি কবিতায় তিনি বলছেন- 
" ঘরের বাণী ঘরের বাইরে বাজাক বাঁশি \ বাইরের উদাসী এসে দাঁড়াক তোমার আঙিনায়। \ ঘরের হৃদয় ঘরের বাইরে পাতুক আসন,\ সেই আসনে বাইরের পথিক এসে বসুক \ ক্ষণকালের তরে। 

কি বলবো কবিতার এই কথাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ? বলছেন নাকি তিনি মিলনেরই কথা কবিতার ভেতর দিয়ে; যে মিলন জড়িয়ে আছে পরশের সাথে ?  

পরিচিতি  
ইফতেখারুল হক ইফতেখারুল হক Reviewed by Pd on নভেম্বর ২১, ২০১৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.