ফারহানা খানম



রুপকথা ইকোনমিক্স ক্লাস শেষ করে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়।  নুপুর  পরীক্ষা দিচ্ছে আর  আড় চোখে একবার  স্যার কে দেখছে আবার ঘড়ি দেখছে সময় যেন আজ শেষই হচ্ছেনা, দুজনে মিলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে, বিকেলে ওর জন্মদিনের পার্টী কতো কাজ বাকী এখনো ।

খুব ছোটবেলা থেকেই ওরা প্রানের বন্ধু , পার্থক্য একটাই রুপকথা পড়ে ইকোনমিক্স এ আর নুপুর কেমিস্ট্রি তে। ওদের দুজনের বন্ধু সার্কেল মোটামুটি কমন । সবাই সবার বন্ধু ।

রুপকথার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে আজকের দিনটাকে নিয়ে । আজকের পার্টীতে ওর কাজিন রিফাত ও থাকবে। রিফাত ইউ এস তে পড়াশুনা করে চাচা-চাচিও ওখানেই সেটেল। এখানে ও রিসার্চের কি কাজে এসেছে দেশে আর উঠেছে ওদের বাড়িতেই। নুপুরের  মা -বাবার ইচ্ছে রিফাতের সাথে নুপুরের বিয়ে হোক ওরা একে অপরকে পছন্দ করলেই ব্যাপারটা নিয়ে চাচা- চাচির সাথে কথা বলবেন নুপুরের বাবা। তাই নুপুরের  এর মা মানে খালামনি রুপকথাকে বিশেষ ভাবে বলেছেন যেন রিফাতকে নিয়ে আসে আর ওদের দুজনের মাঝে আলাপ করিয়ে দেয়। রুপকথার মাও তাই চাইছেন আসলে উনিত নুপুরকে নিজের মেয়েই ভাবেন । রুপকথার ওপর অনেক দায়িত্ব আজ  । আচ্ছা এ বিয়ে টা  হলে ও কি  নুপুরকে কে ভাবী বলে ডাকবে? ভাবতেই আনমনে হেসেফেলে রুপকথা, মাঠের    কৃষ্ণচূড়া  ফুলের গাছটা কি লাল  হয়ে আছে ফুলে ফুলে , আহ! নুপুরের  জন্ম কি সুন্দর সময় তাই , তাই কি ও এত সুন্দর ! এত সরল! ওর সম্পর্কে এই কথাটা বন্ধু মহলে বহুল প্রচলিত কথা, কেউ কেউ ওকে খুব বোকাও ভাবে কারন, অবলীলায় ও সবার সাথে নোটস আর পড়া শেয়ার করে ।

একা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাবনায় ডুবে যায় ও ,  একটা সপ্নালু হাওয়া নাড়া দিয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে ছোট বেলার কত কথা মনে পড়ে । এসময় কাছে এসে দাঁড়ালো শর্মি, তিতির আর জিয়া কিরে একা একা কি করছিশ বলতো? তিতির প্রশ্ন করে ,
--- অপেক্ষা করছি , 
---ওহ নুপুরের  জন্য ? ওর জন্মদিনে কি দেব বলত?বলে জিয়া , 
----দিশ যা তোদের ইচ্ছে । 
এসময় বেড়িয়ে আসে নুপুর  বলে উফফ সময় যেন শেষই হয় না । এত  তাড়াতাড়ি  লিখেও সময়ের সাথে তাল মেলাতে হিমশিম খেতে হল। 
জিয়া বলে আমরা সেই কখন বেড়িয়েছি আর তুই এখন ! বেশি জানিশ তো তাই ! এবার নির্ঘাত তুই জাহিদ কে বিট করবি ।
----ধুর ! কি যে বলিশ ওকে বীট করা কি সহজ ! জাহিদ এখনো লিখছে তা জানিশ?  তাছাড়া আমার কারো সাথে কোন কম্পিটিশন নেই , যা হয় হবে ।
তুহিন পাশেই ছিল বলল নারে মৌ তুই না করলেও এবার তুইই ফার্স্ট হবি দেখিশ জাহিদ ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড কি থার্ড ও হতে পারে  । 
আহত গলায় রুপকথা বলে কি বলছিশ এসব ? ও  বরাবর প্রথম হয়ে আসছে এবার কেন হবে না ? নুপুরের মত জাহিদ ওওর ছোট্ট বেলার বন্ধু । 
নুপুর  বলে আরে এরা সব দুষ্টুমি করছে বুঝিশ না ও কি ইচ্ছে করে খারাপ করবে নাকি ওর কি মাথা খারাপ? আচ্ছা কই জাহিদ ?  এই না বের হোল ! ওকে কিন্তু সাথে নিয়ে আসবি জিয়া । টুটুল ,  তিতির আর অর্পা পরের ক্লাসটা করেই আসছে বলে করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে ।

 দুই বান্ধবী হাঁটতে লাগলো বাড়ির পথে। নুপুর বলল এই তুই রিফাত ভাইকে আনতে যাবি কখন? রুপকথা বলল আনতে যাব কেন? ও বাসা চেনে চলে আসবে , আমি আসার সময় দেখলাম তোর জন্য গিফট কিনতে বেড়িয়েছে , নুপুর এর মনে যেন একশ প্রজাপতি ডানা মেললো ! উচ্ছল কণ্ঠে জানতে চাইলো আমাদের বাসায় দুপুরে খেতে আসবে না? মা'তো  বলেছিলেন  ওনাকে। শুনে  রুপকথা হেসেই খুন বলে,  তুই তো আর বলিসনি বলেই বলল বাব্বাহ! বিয়ে না হতেই এত চিন্তা করছিশ বিয়ে হলেত আমাদের ভুলেই যাবি রে , তাও থাকবি বিদেশে , শুনে হাসল নুপুর  মনের ভেতরটা  কেমন উথাল পাথাল ঢেউ ভাঙছে যেন ।

জিয়া আর তুহিন  ক্যান্টিনে বসে চা খেতে খেতে    বলতে থাকে দেখলি এই মেয়েটা কি ন্যাকা যেন বোঝেইনা জাহিদ ওকে কত পছন্দ করে । তুহিন বলে, জাহিদ কাল রাতে কিছু পড়েনি জানিশ বলল,   এতদিন যা পড়েছি তা দিয়েই পাশ করে যাবো । সারারাত সে জেমস জয়েেসের বই হাতে  নিয়ে বসেছিল , অনেক তর্কের পর ওর কথায় এটাই বুঝলাম যে ও নুপুর  কে চান্স দিতে চায় । প্রয়োজনে সে যেনতেন  পরীক্ষা দেবে।

জিয়া বলে ওকি নুপুরের  এর প্রতি দুর্বল ? বুঝিনি তো কখনো !  আচ্ছা নুপুর  কি ওকে তেমন পছন্দ করে ? ওদের মাঝে কি কোন আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে? না আছে?

তুহিন বলল থাকলে  বুঝি নুপুর এভাবে চলে যেতো?ওকে বলেওত গেল না । সব না জেনে একতরফা ভালবাসলে জাহিদ চরম কষ্ট পাবে ।এত  ইমোশনাল হওয়াটা  খুব  বোকামি  ।  আমার মনে হচ্ছে সেই অভিমানেই জাহিদ হলে চলে গেছে কাওকে কিছু না বলে। হল থেকে দুজন একসাথেই বের হোল অথচ নুপুর ওকে কোন কিছু বল্লই না এটা খুব অন্যায় হয়েছে , জাকগে যার যা খুশি করুক মন্তব্য করল জিয়া ।

নুপুর  খুব ফর্সা নয় , রুপকথা  ওকে মেরুন রঙের জমিনে সবুজ পাড় শাড়ি  পড়িয়ে সাজিয়ে দিল  কানে শুধু হিরের দুল, গলায় ঝুলানো চেইন হীরের লকেট তাতেই খুব সুন্দর  লাগছিল ওকে কপালের সবুজ  টিপটা দারুন মানিয়েছে ওকে , মা ডেকে নিয়ে বললেন এই চুলের ভেতর একটু খানি কাজলের ফোঁটা দে নয়ত কারো চোখ পড়বে । নুপুর ভাবছে রিফাতের সাথে  কতদিন পর আজ দেখা হবে এই সাজে দেখলে নিশ্চয় ও মুগ্ধ হয়ে যাবে সে , সন্ধ্যের মুখে সব বন্ধুরা  এসে উপস্থিত হল শুধু   জাহিদ আসেনি তুহিন আর জিয়া অনেক করে বলেছিল।  ও বলেছে আমার ছাত্রের কাল অঙ্ক পরীক্ষা তোরা যা , যাবার সময় এই গোলাপ গুলো আর এই প্যাকেটটা নিয়ে ওকে দিস ।

এটা শুধু  নুপুরের  বন্ধুদের নিয়ে অনুষ্ঠান তাই বড়রা কেউ আমন্ত্রিত নয় ,শুধু কেক কাটার সময় নুপুর  এর মা বাবা এসেছিলেন । চলছে খুব সুন্দর আর পরিপাটি ভাবে,  তবুও জাহিদের না আসাটা মেনে নিতেখুব কষ্ট হল সবার । জিয়া ভাবছিল নুপুর কি একটা ফোন করতে পারতোনা ওকে ? নুপুরের ফোন পেলে জাহিদ নিশ্চয় আসতো ! কিন্তু নুপুর কি ভাবছে সে কথা ? তবুও  একবার রুপকথা জাহিদকে ফোন দিয়েছিল জাহিদ বলেছে ও খুব ব্যাস্ত । 

আজ রিফাত বার বার দেখছিল নুপুরকে  খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে পরী বলে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছে যেন ! ও খেয়াল করলো যে নুপুর  এবং ওর বাবা মা ওর দিকে বেশ মনোযোগী। বিশেষ যত্ন করছেন যেন।

খাওয়া দাওয়ার পাট চুকে যেতেই শুরু হল গল্প । সবাই গল্প করছে মাঝে গান হচ্ছে এর মাঝে রিফাত ঘরের এক কোনে চুপ চাপ বসে একুরিয়ামের মাছ দেখছে একমনে , কোন দিকেই ওর খেয়াল নেই যেন। নুপুর এগিয়ে এসে জানতে চাইলো কি হয়েছে ? রিফাত বলল  ,আমার খুব মন খারাপ লাগছে  আমাকে  আজ একটু একা থাকতে দাও । নুপুর বলল না আপনি বলুন আমাকে কি হয়েছে ? রুপকথাও এসে পড়েছে সেখানে রিফাত ক্ষমা চেয়েও পার পেলনা অগত্যা  বলতে শুরু করল -

'' সেদিনও এরকম কি একটা  অনুষ্ঠান ছিল আমাদের বাড়িতে মা বাবা সবাই ব্যাস্ত  , অনেক দেশি বিদেশী অতিথি এসেছেন ,এসছে আমার এক বিশেষ  কলিগ সে ওখানকারই মেয়ে  নাম মার্থা ।  আমরা একসাথে অনেকদিন ধরে কাজ করছি , কতদিন কাজ শেষে আমি ওকে কখনো ও আমাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়েছে , কাজ করতে করতে কখন যে আমরা দুজন দুজনের পরিপুরক হয়ে উঠেছিলাম বলতেই পারবনা । গত দু বছরে আমার জন্মদিনে আমি কাওকে ডাকি  না আমরা দুজনে  একসঙ্গে কাটাই সারাদিন সাথে ওর ছেলেও থাকে। আমাদের কালচার সম্পর্কে তার অসীম আগ্রহ সে সেদিন  ঘুরে ঘুরে  প্রশ্ন করে করে অনেক কিছু জেনে নিচ্ছিল, সে এটা খুব ভালো করে বুঝেছিল যে আমাদের দেশে একটা অবিবাহিত ছেলের সাথে বিবাহিত মেয়ের বিয়ে কেউ সহজ ভাবে নেয় না তার ওপর ওর একটা ছেলে আছে , সে সিঙ্গেল মাদার । 

অনুষ্ঠান  যখন শেষ সবাই বিদায় নিচ্ছে কেউ কেউ চলেও গেছেন তখন  মার্থা এসে বসলো আমার পাশে ওর দু বছরের বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে আমার খাটেই , ও আমাকে বলল রিফাত  সত্যি আমি তোমাকে তোমাদের কালচারকে খুব ভালবেসে ফেলেছি । কিন্তু আমি জানি আমার তোমার দেশ , ধর্ম ,সংস্কৃতি সবই আলাদা তাই তুমি আমাকে গ্রহন করতে পারবে না , বলেই ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল ও , তখন আমার যে কি হয়ে গেল আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না ওর হাত ধরে বললাম আমিও তোমাকে ভালোবাসি মার্থা । মা বাবাকে বলতেই ওনারা  এটা মেনে নিলেন না তাই আমিও ওদের ছেড়ে মার্থার কাছে চলে এসেছি আমরা বিয়ে করেছি খুব ভাল আছি আমরা ।

আজ  এত আনন্দের মাঝেও  আমি ওকে খুব খুব মিস করছি রে রুপকথা ! আমি দুই একদিনের মধ্যেই চলে যাব মার্থার কাছে আমার এখানের কাজ সব শেষ , ওর শেষ  কথাগুলো রুপকথা কিংবা নুপুরের  কানে গেল না । নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মাল আর মা -বাবার প্রতি রাগ কেন এভাবে ওর মনের অতল থেকে স্বপ্ন টেনে বের করল  ওঁরা ?

বিস্ময়ে অপমানে বিমুঢ় হয়ে বারান্দায় চলে গেল নুপুর। তাকালো আকাশের দিকে, আকাশের বুক একটা ভালবাসার  অদৃশ্য দৃষ্টি  যেন ওকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল সান্ত্বনা হয়ে  ।
ফারহানা খানম ফারহানা খানম Reviewed by Pd on নভেম্বর ২১, ২০১৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.