শেষ যখন আমাদের আদি মামাবাড়ী মানে মা- দের গ্রামের বাড়ী এসেছিলাম তখন আমি সবে মাধ্যমিক দিয়েছি। এখনও মনে আছে সেদিনটা ছিল ৬ই জুলাই, মনিমাসীর বিয়ে ছিল। না, মনিমাসী আমার রক্তের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ কেউ নন।তবে সব সম্পর্ক কি আর রক্তের গাঢ়ত্ব দিয়ে মাপা যায় নাকি? সেভাবে দেখতে গেলে আমার বড়দাদু সর্বেশ্বর সেনের পালিতা কন্যা মনিমাসি,বড়দাদু বিয়ে থা করেননি। ওনার ছোটভাই রাজেশ্বর সেন আমার মায়ের বাবা। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি পরিবারের বয়োজেষ্ঠ হিসাবে বড়োদাদুর কথাই ছিল শেষ কথা। আমার বাবা আমার অজানা কোন এক কারনে মামাবাড়ী যেতেন না। আমরা দু’বোন মায়ের সাথে কিন্তু বছরে অন্তত একবার গরমের ছুটীতে দারুন হৈ হুল্লোড় করে আসতাম। জমাটি যৌথ পরিবার। দোতলা বাড়ীর ষোলটা ঘরের কোনঘর খালি থাকত না। একতলার টানা বারান্দার শেষে বড়দাদুর সযত্নে লালিত শৌখিন বাগান। সাদাকালো ছক কাটা সিমেন্টের মেঝেতে শীতলপাটির মত বিছিয়ে থাকতো দুপুরের রোদ। তার ওপর ঝিলিমিলি আলোছায়ার কারুকাজ। বারান্দার দক্ষিণে বিভিন্ন জাতের আমগাছে ঘেরা চৌকোণো অগভীর পুকুর। পূবে শরিকী মামলায় বেওয়ারিশ জমিতে অযত্নে বেড়ে চলা জঙ্গলপ্রায় বাগান। জানলা খুললেই ডালপালারা উঁকি মারত জানলা দিয়ে। আম জামরুল সবেদা গাছের ঘন ছায়ায় গরমের তীব্র দুপুরেও ছায়া ছায়া অন্ধকার, পূবের বারান্দার ছাঁদ ঘেষে ছিল সেজমামার পোষা পায়রাদের সাবেকি আস্তানা। পশ্চিম দালানে বিরাট রান্নাঘরের সামনে চারমুখো উনুন। সারাদিন উনুন জ্বলত, আর কিছু না কিছু চাপানো থাকত তাতে। মৈথিলী ব্রাহ্মন বনোয়ারী মহারাজ আর মায়েদের বামুনদিদি মানে দিদুনের ‘শিবুর মা’ ছাড়াও দিদুন, ছোটদিদা, তিন মামী,পাঁচ মাসী এমনকি মাও রান্নাঘরে লেগে যেত। সারাদিন বাড়ীটা হাসিতে, ধমকে, বাচ্চার কান্নায়,ঝগড়ায়, ডাকাডাকি আর সাতসতেরো আওয়াজে গমগম করতো। আজ পোড়োবাড়ীর মত হাড়গোড় বারকরা ভাঙা ইঁটের স্তুপের সামনে দাঁড়িয়ে মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল। সত্যি সময়ের সাথে কত কি যে বদলায়। আমিও তো কত বদলেছি।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের একটা আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিতে এসেছিলাম উড়িষ্যা থেকে। পড়াশুনোর পাট চুকিয়ে আজ বছর বিশেক ওখানেই আছি। স্বামী স্ত্রী দু’জনেই কলেজে পড়াই, মেয়ে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে, ঝাড়া হাত পা। আজ বিকালে সেমিনার শেষ হতে হঠাৎ কি মনে হল, গাড়ী ভাড়া করে চলে এসেছি রানীগঞ্জ কোলিয়ারী আর চিড়িমিড়ির মাঝে এই ছোটগ্রামে। যেখানে বাতাসে, নদীর জলে, রাস্তার ধুলোয় জড়িয়ে আছে আমার মেয়েবেলার অমূল্য স্মৃতি, যদিও আজ এখানে মামাবাড়ীর কেউ নেই,তবু যে কিসের টানে, কোন অজানা নেশায় ছুটে এলাম কে জানে ! কিন্তু এসে মনে হচ্ছে না এলেই ভালো হত।
আমার সাথে এসেছে স্বাতী সিংহানিয়া। কাছেই ওর বাড়ী। বাঙালী, তবে বিয়ের পর টাইটেলটা পাল্টেছে। এই গ্রামে ওর পিসি থাকে। গাড়ীতে আসার সময় বাড়ীটা দেখিয়েছে। চিনতে পারিনি। ওখানে তো ছোটদাদুর তাস খেলার সঙ্গী চানক্যদাদুর বড় বড় গাছে ঘেরা দেড়-কামরার ছোট্ট বাড়িটা ছিল, পিছনেই দোতলা মাটিরবাড়িটা ছিল তরুমাসিদের,তরুমাসি ছিল মায়ের স্কুলের বান্ধবী। চানক্যদাদুর বাড়ির পিছন দিকের একটা ইয়া বড় পেঁপেগাছ ছিল। পাকা পেঁপে কি মিষ্টিই না হত। সেখান থেকে প্রায়ই পেঁপে পেড়ে নিয়ে চলে যেত তরুমাসি। ওর ভাইয়ের পেটের রোগ ছিল কিনা। চানক্যদাদুর বাড়ীর কেউ কিছু বললে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করত তরুমাসি।কিন্তু নিজেদের বাগানে কিছুতেই পেঁপেগাছ লাগাতো না।মরসুমী সব্জী আর ফুল লাগাতো খালি। মনিমাসী বলত তরুমাসী নাকি চাণক্যদাদুর নাতি চন্দনের সাথে কথা বলার জন্য ঐরকম ঝগড়ার ছুতো খুঁজত। না সেই ঘরবাড়ী আছে, না সেই পেঁপেগাছ। এখন সেখানে স্বাতীর পিসিদের হালকা গোলাপীরঙা ইংলিশ কটেজ,তরুমাসীদের বাড়ীর বদলে মুদীর দোকান। বিলুদের সেই ভীষণ মিষ্টি মধুক্ষরা আমগাছটা কিন্তু আজও আছে দেখলাম। সাদা একতলা বাড়ীটার দেখা পেলামনা। বাড়ীটা তিনতলা হয়েছে,ইঁটরঙা বাড়ীটায় এখনও বিলুরা থাকে কিনা কে জানে? বিলু তুয়া ছিল যমজ ভাইবোন, আমরা একসাথে খেলতাম। ওদের মা ছিল না কিন্তু সুধামাসীকে কোনদিন ওদের সৎমা মনে হয়নি। এখনও মনে আছে সবুজ রঙ করা জানলার গ্রিলের ওপর ছিল লতানে লাউডগা। বারান্দার লাল শানের ওপর রোদে শুকাতো ধানের গোছা। পাশে ওদের বুড়ি ঠাকুমা এসে দুইহাতে হাঁটুদুটি বেড় দিয়ে রোদে বসে থাকত।বাড়ীর পাশের ধানের মরাইটাও আর নেই, বেশ বড় একটা মুদীর দোকান হয়েছে।বারোয়ারী চন্ডীমন্ডপটা দেখলাম পাকা হয়েছে, স্পষ্ট দেখছি পাকাচুল পাকাদাড়ি,খালি গায়ে নামাবলী জড়িয়ে পুরুতমশাই পুজোয় বসেছেন, হাতে কুশের আংটি, সামনে কোশাকুশি,ফুলমালা, চন্দন, ধূপধুনো, প্রদীপ,নৈবদ্য, অষ্টোত্তর শতনামবই,কি পবিত্র পরিবেশ, কি মায়াময় সুগন্ধ, অষ্পস্ট মন্ত্রোচ্চারন শুনতে পাচ্ছি, পাশে জংলা যে জমিটায় আমরা মাঝেমধ্যে পিকনিক করতে আসতাম,সেখানে অবৈতনিক প্রাইমারী স্কুল হয়েছে একটা। কত পাল্টে গেছে সব। অবশ্য সময় কি আর বসে থাকে? আমিও কি আর পাল্টাইনি?
ভাঙাচোরা শ্যাওলা ধরা ইঁটের স্তুপের সামনে ভাড়া করা ফিয়াটটা দাঁড়িয়ে। গাড়ীর দরজাটা খোলা। আমি সীটেই বসে আছি। স্বাতী আমাকে রেখে ওর পিসির বাড়ী গেছে খোঁজখবর নিতে। অল্পবয়সী ড্রাইভার ছেলেটি বোধহয় সিগারেট ধরাতে সরে গেছে একটু দূরে। সন্ধ্যা নামেনি তবু বড়দাদুর শৌখিন বাগান জঙ্গলপ্রায় হয়ে জায়গাটাকে মায়াবী আবছায়ার দেশে নিয়ে গেছে। দক্ষিণের চৌকোণো পুকুর আজ আকারবিহীন এঁদো ডোবা, ঢেকে গেছে কচুরিপানার বহরে। চেনাশোনা মানুষগুলোও কেউ নেই আর, রয়ে গেছে ম্লান স্মৃতি, যেন ভুলে যাওয়া গানের কলি, অজানা এক অনুভূতি, সমস্ত দূরত্ব, বাধা ভেঙে কেবলই এগিয়ে আসছে চায় কাছে, অতীত থেকে বর্তমানে। হাজার জমা কথার ভীড়ে আমি ফিরে যাই সেই ফেলে আসা সোনালীদিনে, গাল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ে জল, আঁচল তুলে মোছার হুঁশটুকুও নেই। আমি চুপ করে নিজের ভিতরের স্মৃতিমুখর নৈঃশব্দ্যকে দেখছি। টের পাচ্ছি পাকে পাকে কত মানুষ লুকিয়ে আছেন পুরোনো দিনের ভুলে যাওয়া চুপকথায়।আপনজন–পরিবার–আত্মীয়স্বজনদের গুচ্ছমূল শিকড়ে।
স্বাতীর নাম বললাম আর স্বাতী কাকিমার কথা না বলে থাকি কি করে? স্বাতীকাকিমা আমার দিদুনের বকুলফুল সই। মা বলত ‘স্বাতী কাকিমা’, শুনে শুনে আমিও।গ্রামের প্রাইমারি ইস্কুলের দিদিমণি। সহজপাঠ. কিশলয়, ঠোঁটস্থ। অবিবাহিতা। অথর্ব শয্যাশায়ী মাকে নিয়ে ভাইয়ের সংসারে থাকেন। কানাঘুষোয় শুনেছিলাম বিয়ের সাতদিনের মাথায় শ্বশুরবাড়ী ছেড়েছিলেন। আর ফেরত যাননি। রঙীন চওড়া পাড়ের সাদা খোলের শাড়ী কুঁচি দিয়ে পড়া। একপিঠ কালো চুল। ঘরে এসেই এ-কথা সে-কথার পর ঈষৎ ভাঙা কিন্তু বেশ জোরালো গলায় স্কুলের প্রেয়ার সঙ গাইবার ঢংয়ে গাইতেন ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে’, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’, ‘কি গাব আমি কি শুনাবো আজি আনন্দধামে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, আর আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে।‘ ফি বার সেই একই গান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইতে শুনতাম। মা, মাসীরা, মামীদের কেউ কেউ, কখনোবা দিদিরা মাঝেমধ্যে গলা মিলাতো। বইয়ের পোকা, অঙ্কে চৌখস ছোটমাসী মাঝে মধ্যে ভরাট মিষ্টি গলায় গাইতো গণসঙ্গীত। “ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না, নিগ্রোভাই আমার পল রোবসন”।“আমরা কালোমানুষ, আমরা গান গাই,আমাদের আফ্রিকা, ইয়াবুয়ে ইয়াবুয়ে ইয়াবুয়ে আফ্রিকা”,“পাথরে খোদাই করা ছিল এক শ্রমিক নাম ছিল তার জন হেনরী”, “আমরা করবো জয় … নিশ্চয়”… বেখাপ্পার মত সেই মহিলামহলে আমি চুপ করে বসে শুনতাম। গানের অনেকগুলোই জানা ছিল আমার। আমার কানে তখন মহম্মদ রফি, গীতা দে, লতা, আশার সুর। ভালো লাগতো না সবসময়। বরঞ্চ মেজমামীর মা-বাপ মরা ছোটবোন রেখামাসীর অদ্ভুত সুরেলা গলার গান বেশী টানত আমায়। কালো ছোটখাটো চেহারার লাজুক রেখামাসী অনেক জোরাজুরির পর মিহিগলায় শুরু করত ‘মধুবনমে রাধিকা নাচে রে’…কিন্তু গাইতে গাইতে চোখ বুজে কেমন একটা আবেশে খোলাগলায় অনায়াসে ‘এ্যয় মালিক তেরে বান্দে হম’ হয়ে একের পর এক গানে মাতিয়ে দিত সবাইকে। আমার মেজমামীরা ছোটবেলা থেকে বারানসীতে থাকত বলে অদ্ভুতটানে বাংলা বললেও হিন্দীতে স্বচ্ছন্দ ছিল বেশী। আমি ঐ রেখামাসর কাছেই হিন্দী পড়তে লিখতে শিখেছিলাম। মাসির তখন বয়স বাড়ছে।দেখতে ভালো নয় বিয়ে হচ্ছে না কিছুতেই। মেজমামী খুব চিন্তা করত এই নিয়ে। যাকেই সামনে পেত পাত্র খুঁজতে বলত। রেখামাসী সঙ্কোচে গুটিয়ে থাকত তাই। সেই বয়সেই আমার খুব মায়া হত রেখামাসিকে দেখে। রেখামাসীর সাথে একদম বনতোনা মনিমাসীর,বড়োদাদুর পালিতা এই সুন্দরী মাসীটির রান্নার হাত ছিল দারুন,কিন্তু ময়ূরীর মত গলার আওয়াজ। আমাদের আড্ডার আসরের ফাঁকেফাঁকে ঘনঘন চা আর নানান মুখরোচক টা নিয়ে আসতো মনিমাসী। কখনও ঘরে বানানো সুজির নানখটাই বিস্কুট আসত,কি ভাপা কেক। কখনও গোল গোল ফুলকাটা ডিশে করে নিয়ে আসতো পেঁয়াজি, ডালবড়া, ফুলকপির বড়া, কুমড়োফুল বা বকফুল বেসনে কড়া করে ভাজা,পকৌড়া, ঘুঘনি, আলুকাবলি। আবার কোনোদিন পেতাম জোয়ান গোলমরিচ কালোজিরে সমৃদ্ধ মাসির হাতে বানানো কুঁচো নিমকি। কোন এক অজানা কারনে রেখামাসীকে দেখতে পারতনা মনিমাসী। খুব ঘটা করে মনিমাসীর বিয়ে দিয়েছিল বড়োদাদু, সেদিন রেখামাসী কোথায় যে লুকিয়ে ছিল কে জানে। পরে মায়ের কাছে শুনেছি মনিমাসীর বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই রেখামাসির বিয়ে হয়ে গেছে।আমাদের সেই ভীতু স্বভাবের, কমকথাবলা. আনস্মার্ট রেখামাসিও যে ‘প্রেম করতে’ পারে, কেউ ভাবেইনি। সেই মাসী ঘর ছেড়েছিল একটি মাঝাবয়সী বিহারী ভদ্রলোকের হাত ধরে। মেসো তখন কুমারডুবীর রিফ্রাক্টোরিজে কাজ করত। পরে কারখনাটাই ডকে ওঠায় সে চাকরিও গেছে। মাসি তখন আসানসোলের কাছে একটা বেসরকারী স্কুলে গান শেখাত। তারপরের খবর আর জানিনা
গানের প্রসঙ্গে মনে পড়লো দীপক মাস্টারমশাইয়ে কথা। মেজদাদুর বন্ধু শীর্ণকায় মানুষটি মা মামা মাসীদের পড়িয়েছেন। সবাই খুব মেনে চলত ওনাকে। বড়মামার একমাত্র ছেলে দীপ্তদাকে তবলা শেখাত দানিদা বলে পাড়ারই একজন।একদিন সকালে যখন মা্স্টারমশাই অঙ্ক দেখাচ্ছেন ছোটমাসীকে, ছোটমাসী সে বছর অঙ্কে অনার্স নিয়ে ফাইনাল ইয়ার, দানিদা তখন তবলা বাজানো শেখাচ্ছে, হঠাৎ পড়ানো ছেড়ে মাস্টারমশাই উঠে এলেন , বললেন, ''কি শেখাচ্ছ দানি? বোলে এত ভুল কেন ?” বলেই দীপ্তদাকে সরিয়ে ব'সে পড়লেন তবলার সামনে, সাবলীল হাতের ছোঁয়ায় বেজে উঠল ডুগি আর বাঁয়া, তার বাজানো দেখে আমরা, এমনকি স্বয়ং দানিদাও থ ,পরে শুনেছি একাধিক বাদ্যযন্ত্রে দখল ছিল তাঁর। ছোটবেলায় বাজনার নেশায় নাকি ঘর থেকে পালিয়েছিলেন কোন এক যাত্রাদলের সাথে। গ্রামে ঢোকার মুখে বিশাল বটগাছের পাশেই ছিল ওনার আটচালার বাড়ী।পাশে টলটলে জলে ভরা বউমরা খাল। ওনার স্ত্রী রাধিদিদার হাতে বানানো মোয়া নাড়ু নারকেলের চিঁড়ে দেদার খেয়েছি। আজ আসার সময় সেই বটগাছও দেখিনি, সেই আটচালার জায়গায় ঝান্ডা লাগানো পার্টি অফিস দেখে এসেছি। নেহাত খালটা এখনও বুজে যায়নি,তাই জায়গাটা চিনতে পেরেছি। ছোটমাসীও আজ অনেকদিন হল দেশের পাট গুটিয়ে জার্মানীতে স্থিতু হয়েছে। দীপ্তদা আজ প্রায় বছর দশেক হল মালা ঝোলানো ফটো হয়ে রয়ে গেছে মায়ের ঘরের দেওয়ালে। অফিসের কাজে মুসৌরী গিয়ে আর ফেরত আসেনি, অথচ বড়মামা আজো অপেক্ষায় আছেন দীপ্তদার। বড়মামী মারা গেছেন। নাতি নাতনি নিয়ে বড়মামার একমাত্র মেয়ে দীপাদিও বিদেশবাসী। বড়মামা একা একা গড়িয়ার ফ্ল্যাটে বসে যত পুরানো ঘটনার ময়নাতদন্ত করেন আপন মনে। প্রতিবারই সাংসারিক অপঘাতের জন্য নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করেন। তবুও ঘনঘন ফোন করে সবার সাথে যোগাযোগটা উনিই রাখেন। আরেকটা মামাতো ভাই ছিল আমার, শাক্য, মেজমামার ছেলে। সহজ সরল ভাইটা আমার কবিতা লিখত। সেই কবিতা পড়েই প্রেমে পড়েছিল ওর সহপাঠিনী অনিন্দিতা। তুমুল প্রেম। আমরা সবাই জানতাম। কিন্তু বাস্তব যে কত নির্মম, সেটাইতো জানতো না আমার ভাইটা, একদিন অনিন্দিতা ওকে ফোনে জানায়,''জানিস তো,আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । ছেলে আমেরিকায় থাকে, কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ার। '' বলেই অনিন্দিতা ফোন কেটে দেয় । প্রেমে ব্যর্থ তো কত লোক হয়। সামলেও নেয়, কি ভুলে যায়। কিন্তু শাক্য তার কোনটাই পারেনি। আমার পড়াশুনোয় ভালো, বোকাসোকা, মেডিকেল স্টুডেন্ট ভাইটা প্রচুর ঘুমের ওষুধ নিয়ে হারিয়ে গেছে ঘুমের দেশে। কতবছর যে তাই ভাইফোঁটা দিই নি।
আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে আসছে শেষ বিকালের রোদ্দুর, কিছুটা দূরে, ঝুপড়ো গাছগুলোর আড়াল আবডালে জমে উঠছে ছায়ার ঘোর। গোধূলীর আকাশে পাখিরা ফিরে যাচ্ছে। নীড়গামী পাখিতে ভরে উঠছে বড়ো বড়ো গাছগুলোর ঝুপসি ডালপালা। অথচ আমার হারিয়ে যাওয়া সোনালীদিনের গল্প আর ফুরোচ্ছে না কিছুতেই। তাল কাটলো চেনাগলার ডাকে।
- ম্যাডাম, কি ভাবছেন এত? কখন থেকে ডাকছি আপনাকে।
স্বাতী ফেরত এসেছে, সাথে দুজন ভদ্রমহিলা, একজন ভদ্রলোক। স্বাতীই পরিচয় করিয়ে দিল,ওর পিসি, পিসির জা আর দেওর। ওনারা এসেছেন আমার হারিয়ে ফেলা সম্পর্কের ছেঁড়াসুতো জোড়া দিয়ে আমায় সাহায্য করতে। আমি সেনবাড়ীর মেয়ে, বাড়ীতে কেউ নেই তো কি হয়েছে, সেনদের পাড়াপ্রতিবেশীরা আছে না? আমি তো এখন গ্রামের অতিথি। ফিরে গেলেই হত। কিন্তু আমারও যেন কেমন ঘোর লেগে গেছে। এতদূর এলাম যখন এতদিন পর, শেষটা দেখেই যাই। স্বাতীর পিসির বাড়ীতে মালপত্র রেখে এক রাতের অতিথি হলাম। চা পর্ব মেটার পর স্বাতীর পিসি নিয়ে চললো অন্য কার বাড়ী। অন্ধকারে চিনতে পারলাম না। একতলা ছড়ানো বাড়ী, বসার ঘর পেরিয়ে পাশের ঘর। খাটে এক বয়স্কা মহিলা বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। স্বাতীর পিসি অবন্তিকা মহিলার গায়ে হাত দিয়ে বলল,
- মাসীমা, নিয়ে এসেছি..
- এনেছিস? মধুর মেয়ে এসেছে? আমার মুনিয়া? দেখি দেখি… কত বড়টা হয়েছে আমার মুনিয়া? চোখে যে ছাই ভালো দেখতেও পাইনা..আয় মুনিয়া এদিকে আয় মা।
মুনিয়া?.. মুন্নি মুনাই মানা…কতদূর থেকে ডাক শুনতে পাচ্ছি, তরুমাসী??? আমার জন্য গাছের কদবেল মেখে রাখত তরুমাসী সর্ষের তেল, লঙ্কা, নুন, অল্প চিনি,ধনেপাতা দিয়ে। গরমের সময় চালতা মাখা, তেঁতুলমাখা। আর রাখত কালো ঝাল লজেন্স, টক মিষ্টি হজমি গুলি, ঘরেবানানো তেঁতুল, কুলের আচার। মা আর তরুমাসী যখন এটাসেটা গল্প করত তখন আমি, বিনিদিদি, আমার বোন তিন্নি আর খুদে শাক্য ব্যস্ত থাকতাম ঐসব নিয়েই। এখন তরুমাসী অসুস্থ, দুই ছেলে, ছেলে বউ, নাতি নাতনী নিয়ে ভরা সংসার। শুনলাম তরুমাসির বিয়ে হয়েছিল গ্রামের স্কুলের নিবারণমাষ্টারমশাইয়ের সাথে। মাষ্টারমশাই পাশের গ্রামে থাকতেন।তরুমাসীরা আগের বাড়ী ছেড়ে উঠে এসেছে এখানে। তরুমাসীর বাড়ীতেই জমে উঠলো জমাট আড্ডা। অনেক জানা অজানা চেনা অচেনা লোকেদের আনাগোনায় সম্পর্কের বিনিসুতোর গিঁট খুলে গেল।
চানক্যদাদু,বাণীদিদুন, মাস্টারমশাই, রাধি দিদা, স্বপনমামা, কচিদিদা, অন্নপুর্না মামী, কাজল দিদি, সুমি মাসী কত লোক আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। জমিজমা বেচে চাণক্যদাদুর একমাত্র ছেলে অনেকদিন আগে গ্রাম ছেড়েছে। দাদুর নাতি চন্দন কোলকাতায় একটা শপিংমলের নামকরা শাড়ীর দোকানে সেলস্ম্যানের কাজ করে, বিয়ে করেছে এই গ্রামেই। গাট্টাগোট্টা চেহারার স্বাতীকাকিমা মা মারা যাবার পর ভাইবৌয়ের সংসারে আর টিঁকতে পারেনি। দুবরাজপুরে এক বৃদ্ধাশ্রমে থাকত। দাদুর বাড়ীতে রান্নার কাজ করত যে শিবুর মা তার মেয়ে ঝুমামাসি ওখানেই একটা আধা-সরকারী হসপিটালে আয়ার কাজ করে, শেষ খবরটা সেই এনে দিয়েছিল।দানিদাও এসেছিলেন। উনি কাছেই একটা লেদ মেশিনের কারখানা চালান। দানিদার কারখানাতেই কাজ করেন ছোটমামার কবিবন্ধু অলকমামা। ছোটবেলায় শৌখিন মানুষটার ফিন্ফিনে শাদা কাগজের ভেতর তামাক পুরে সিগারেট পাকিয়ে খাওয়া অবাক চোখে দেখতাম। কবিতার নেশায় পড়াশুনো বিশেষ হয়নি, শেষমেশ লেদ কারখানায় সুপারভাইজার। রেখামাসীরও খবর পেলম। মাসির নাকি থ্রোটক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ, কথাও বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ দেখা করতে গেলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন আর চোখ থেকে অবিরাম জল ঝরে। মেসো খুব যত্ন করেন, নীচুগলায় একাই গল্প করেন মাসীর সাথে। সারাদিন মাসীর সঙ্গেই থাকেন। মাসী আর গাইতে পারে না তাই হয়ত হারমোনিয়ামটা মাথার কাছে নিয়ে শুয়ে থাকে।
আমি শুনি আর ভাবি, কেন এলাম ? কিসের খোঁজে? শুধু নেই আর হারিয়ে যাওয়ার খবর নিতে? ভাবতে ভাবতেই সমস্ত আকাশ অলীক আলোর মায়ায় মাখিয়ে, মেঘে মেঘে পা রেখে শেষ হয়ে গেল একটা দিন। আমি চেয়ে থাকি। খোলা চুলের অন্ধকার নেশার মত রাত জড়িয়ে নেয় আমায়।রাতের পরশ,খোলা হাওয়ার পরশ, চাঁদের আখরে উন্মুক্ত আকাশছোঁয়া দুখজাগানিয়া আলোর পরশ কি আশ্চর্য গভীর, অথই। আমি ডুবে যেতে থাকি। আমার গায়ে ঠেকে তরুমাসীর কাঁপা হাতের পরশ, শিবুর মায়ের দু হাতের গন্ডীতে বাঁধা বুকের পরশ, ছোটদাদুর বন্ধু মুরারীদাদুর কড়া পড়া আঙ্গুলে চুলে বিলি কাটা পরশ,আমার ছোটবেলার বন্ধু তুয়ার দু হাতের মুঠিতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা হাতের পরশ, কমলা দিদির চোখ থেকে ঝরে পড়া অঝোর ধারার পরশ, ছানিপড়ি চোখে অন্ধপ্রায় মিনিবৌদির গাল ছুঁয়ে যাওয়া আঙ্গুলের আলতো পরশ, কাজরী মামীর দুহাতে আমার মুখটা তুলে ধরে কপালে আদরের চুমুর পরশ, পা ছুঁয়ে প্রণামের পর রমনীমামার মায়ের আমার থুতনি ছুয়ে আদরের পরশ.. কত বলবো আর! …শুনেছি পরশপাথরের ছোঁওয়ায় লোহা নাকি সোনা হত। আজ সেই রকমই এক অলীক পরশপাথরের ছোঁওয়ায় কানায় কানায় ভরে উঠেছে আমার মনের মনিকোঠায় জমানো স্মৃতির রত্নভান্ডার। আমি পরশপাথরের খোঁজ পেয়েছি।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের একটা আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিতে এসেছিলাম উড়িষ্যা থেকে। পড়াশুনোর পাট চুকিয়ে আজ বছর বিশেক ওখানেই আছি। স্বামী স্ত্রী দু’জনেই কলেজে পড়াই, মেয়ে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে, ঝাড়া হাত পা। আজ বিকালে সেমিনার শেষ হতে হঠাৎ কি মনে হল, গাড়ী ভাড়া করে চলে এসেছি রানীগঞ্জ কোলিয়ারী আর চিড়িমিড়ির মাঝে এই ছোটগ্রামে। যেখানে বাতাসে, নদীর জলে, রাস্তার ধুলোয় জড়িয়ে আছে আমার মেয়েবেলার অমূল্য স্মৃতি, যদিও আজ এখানে মামাবাড়ীর কেউ নেই,তবু যে কিসের টানে, কোন অজানা নেশায় ছুটে এলাম কে জানে ! কিন্তু এসে মনে হচ্ছে না এলেই ভালো হত।
আমার সাথে এসেছে স্বাতী সিংহানিয়া। কাছেই ওর বাড়ী। বাঙালী, তবে বিয়ের পর টাইটেলটা পাল্টেছে। এই গ্রামে ওর পিসি থাকে। গাড়ীতে আসার সময় বাড়ীটা দেখিয়েছে। চিনতে পারিনি। ওখানে তো ছোটদাদুর তাস খেলার সঙ্গী চানক্যদাদুর বড় বড় গাছে ঘেরা দেড়-কামরার ছোট্ট বাড়িটা ছিল, পিছনেই দোতলা মাটিরবাড়িটা ছিল তরুমাসিদের,তরুমাসি ছিল মায়ের স্কুলের বান্ধবী। চানক্যদাদুর বাড়ির পিছন দিকের একটা ইয়া বড় পেঁপেগাছ ছিল। পাকা পেঁপে কি মিষ্টিই না হত। সেখান থেকে প্রায়ই পেঁপে পেড়ে নিয়ে চলে যেত তরুমাসি। ওর ভাইয়ের পেটের রোগ ছিল কিনা। চানক্যদাদুর বাড়ীর কেউ কিছু বললে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করত তরুমাসি।কিন্তু নিজেদের বাগানে কিছুতেই পেঁপেগাছ লাগাতো না।মরসুমী সব্জী আর ফুল লাগাতো খালি। মনিমাসী বলত তরুমাসী নাকি চাণক্যদাদুর নাতি চন্দনের সাথে কথা বলার জন্য ঐরকম ঝগড়ার ছুতো খুঁজত। না সেই ঘরবাড়ী আছে, না সেই পেঁপেগাছ। এখন সেখানে স্বাতীর পিসিদের হালকা গোলাপীরঙা ইংলিশ কটেজ,তরুমাসীদের বাড়ীর বদলে মুদীর দোকান। বিলুদের সেই ভীষণ মিষ্টি মধুক্ষরা আমগাছটা কিন্তু আজও আছে দেখলাম। সাদা একতলা বাড়ীটার দেখা পেলামনা। বাড়ীটা তিনতলা হয়েছে,ইঁটরঙা বাড়ীটায় এখনও বিলুরা থাকে কিনা কে জানে? বিলু তুয়া ছিল যমজ ভাইবোন, আমরা একসাথে খেলতাম। ওদের মা ছিল না কিন্তু সুধামাসীকে কোনদিন ওদের সৎমা মনে হয়নি। এখনও মনে আছে সবুজ রঙ করা জানলার গ্রিলের ওপর ছিল লতানে লাউডগা। বারান্দার লাল শানের ওপর রোদে শুকাতো ধানের গোছা। পাশে ওদের বুড়ি ঠাকুমা এসে দুইহাতে হাঁটুদুটি বেড় দিয়ে রোদে বসে থাকত।বাড়ীর পাশের ধানের মরাইটাও আর নেই, বেশ বড় একটা মুদীর দোকান হয়েছে।বারোয়ারী চন্ডীমন্ডপটা দেখলাম পাকা হয়েছে, স্পষ্ট দেখছি পাকাচুল পাকাদাড়ি,খালি গায়ে নামাবলী জড়িয়ে পুরুতমশাই পুজোয় বসেছেন, হাতে কুশের আংটি, সামনে কোশাকুশি,ফুলমালা, চন্দন, ধূপধুনো, প্রদীপ,নৈবদ্য, অষ্টোত্তর শতনামবই,কি পবিত্র পরিবেশ, কি মায়াময় সুগন্ধ, অষ্পস্ট মন্ত্রোচ্চারন শুনতে পাচ্ছি, পাশে জংলা যে জমিটায় আমরা মাঝেমধ্যে পিকনিক করতে আসতাম,সেখানে অবৈতনিক প্রাইমারী স্কুল হয়েছে একটা। কত পাল্টে গেছে সব। অবশ্য সময় কি আর বসে থাকে? আমিও কি আর পাল্টাইনি?
ভাঙাচোরা শ্যাওলা ধরা ইঁটের স্তুপের সামনে ভাড়া করা ফিয়াটটা দাঁড়িয়ে। গাড়ীর দরজাটা খোলা। আমি সীটেই বসে আছি। স্বাতী আমাকে রেখে ওর পিসির বাড়ী গেছে খোঁজখবর নিতে। অল্পবয়সী ড্রাইভার ছেলেটি বোধহয় সিগারেট ধরাতে সরে গেছে একটু দূরে। সন্ধ্যা নামেনি তবু বড়দাদুর শৌখিন বাগান জঙ্গলপ্রায় হয়ে জায়গাটাকে মায়াবী আবছায়ার দেশে নিয়ে গেছে। দক্ষিণের চৌকোণো পুকুর আজ আকারবিহীন এঁদো ডোবা, ঢেকে গেছে কচুরিপানার বহরে। চেনাশোনা মানুষগুলোও কেউ নেই আর, রয়ে গেছে ম্লান স্মৃতি, যেন ভুলে যাওয়া গানের কলি, অজানা এক অনুভূতি, সমস্ত দূরত্ব, বাধা ভেঙে কেবলই এগিয়ে আসছে চায় কাছে, অতীত থেকে বর্তমানে। হাজার জমা কথার ভীড়ে আমি ফিরে যাই সেই ফেলে আসা সোনালীদিনে, গাল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ে জল, আঁচল তুলে মোছার হুঁশটুকুও নেই। আমি চুপ করে নিজের ভিতরের স্মৃতিমুখর নৈঃশব্দ্যকে দেখছি। টের পাচ্ছি পাকে পাকে কত মানুষ লুকিয়ে আছেন পুরোনো দিনের ভুলে যাওয়া চুপকথায়।আপনজন–পরিবার–আত্মীয়স্বজনদের গুচ্ছমূল শিকড়ে।
স্বাতীর নাম বললাম আর স্বাতী কাকিমার কথা না বলে থাকি কি করে? স্বাতীকাকিমা আমার দিদুনের বকুলফুল সই। মা বলত ‘স্বাতী কাকিমা’, শুনে শুনে আমিও।গ্রামের প্রাইমারি ইস্কুলের দিদিমণি। সহজপাঠ. কিশলয়, ঠোঁটস্থ। অবিবাহিতা। অথর্ব শয্যাশায়ী মাকে নিয়ে ভাইয়ের সংসারে থাকেন। কানাঘুষোয় শুনেছিলাম বিয়ের সাতদিনের মাথায় শ্বশুরবাড়ী ছেড়েছিলেন। আর ফেরত যাননি। রঙীন চওড়া পাড়ের সাদা খোলের শাড়ী কুঁচি দিয়ে পড়া। একপিঠ কালো চুল। ঘরে এসেই এ-কথা সে-কথার পর ঈষৎ ভাঙা কিন্তু বেশ জোরালো গলায় স্কুলের প্রেয়ার সঙ গাইবার ঢংয়ে গাইতেন ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে’, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’, ‘কি গাব আমি কি শুনাবো আজি আনন্দধামে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, আর আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে।‘ ফি বার সেই একই গান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইতে শুনতাম। মা, মাসীরা, মামীদের কেউ কেউ, কখনোবা দিদিরা মাঝেমধ্যে গলা মিলাতো। বইয়ের পোকা, অঙ্কে চৌখস ছোটমাসী মাঝে মধ্যে ভরাট মিষ্টি গলায় গাইতো গণসঙ্গীত। “ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না, নিগ্রোভাই আমার পল রোবসন”।“আমরা কালোমানুষ, আমরা গান গাই,আমাদের আফ্রিকা, ইয়াবুয়ে ইয়াবুয়ে ইয়াবুয়ে আফ্রিকা”,“পাথরে খোদাই করা ছিল এক শ্রমিক নাম ছিল তার জন হেনরী”, “আমরা করবো জয় … নিশ্চয়”… বেখাপ্পার মত সেই মহিলামহলে আমি চুপ করে বসে শুনতাম। গানের অনেকগুলোই জানা ছিল আমার। আমার কানে তখন মহম্মদ রফি, গীতা দে, লতা, আশার সুর। ভালো লাগতো না সবসময়। বরঞ্চ মেজমামীর মা-বাপ মরা ছোটবোন রেখামাসীর অদ্ভুত সুরেলা গলার গান বেশী টানত আমায়। কালো ছোটখাটো চেহারার লাজুক রেখামাসী অনেক জোরাজুরির পর মিহিগলায় শুরু করত ‘মধুবনমে রাধিকা নাচে রে’…কিন্তু গাইতে গাইতে চোখ বুজে কেমন একটা আবেশে খোলাগলায় অনায়াসে ‘এ্যয় মালিক তেরে বান্দে হম’ হয়ে একের পর এক গানে মাতিয়ে দিত সবাইকে। আমার মেজমামীরা ছোটবেলা থেকে বারানসীতে থাকত বলে অদ্ভুতটানে বাংলা বললেও হিন্দীতে স্বচ্ছন্দ ছিল বেশী। আমি ঐ রেখামাসর কাছেই হিন্দী পড়তে লিখতে শিখেছিলাম। মাসির তখন বয়স বাড়ছে।দেখতে ভালো নয় বিয়ে হচ্ছে না কিছুতেই। মেজমামী খুব চিন্তা করত এই নিয়ে। যাকেই সামনে পেত পাত্র খুঁজতে বলত। রেখামাসী সঙ্কোচে গুটিয়ে থাকত তাই। সেই বয়সেই আমার খুব মায়া হত রেখামাসিকে দেখে। রেখামাসীর সাথে একদম বনতোনা মনিমাসীর,বড়োদাদুর পালিতা এই সুন্দরী মাসীটির রান্নার হাত ছিল দারুন,কিন্তু ময়ূরীর মত গলার আওয়াজ। আমাদের আড্ডার আসরের ফাঁকেফাঁকে ঘনঘন চা আর নানান মুখরোচক টা নিয়ে আসতো মনিমাসী। কখনও ঘরে বানানো সুজির নানখটাই বিস্কুট আসত,কি ভাপা কেক। কখনও গোল গোল ফুলকাটা ডিশে করে নিয়ে আসতো পেঁয়াজি, ডালবড়া, ফুলকপির বড়া, কুমড়োফুল বা বকফুল বেসনে কড়া করে ভাজা,পকৌড়া, ঘুঘনি, আলুকাবলি। আবার কোনোদিন পেতাম জোয়ান গোলমরিচ কালোজিরে সমৃদ্ধ মাসির হাতে বানানো কুঁচো নিমকি। কোন এক অজানা কারনে রেখামাসীকে দেখতে পারতনা মনিমাসী। খুব ঘটা করে মনিমাসীর বিয়ে দিয়েছিল বড়োদাদু, সেদিন রেখামাসী কোথায় যে লুকিয়ে ছিল কে জানে। পরে মায়ের কাছে শুনেছি মনিমাসীর বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই রেখামাসির বিয়ে হয়ে গেছে।আমাদের সেই ভীতু স্বভাবের, কমকথাবলা. আনস্মার্ট রেখামাসিও যে ‘প্রেম করতে’ পারে, কেউ ভাবেইনি। সেই মাসী ঘর ছেড়েছিল একটি মাঝাবয়সী বিহারী ভদ্রলোকের হাত ধরে। মেসো তখন কুমারডুবীর রিফ্রাক্টোরিজে কাজ করত। পরে কারখনাটাই ডকে ওঠায় সে চাকরিও গেছে। মাসি তখন আসানসোলের কাছে একটা বেসরকারী স্কুলে গান শেখাত। তারপরের খবর আর জানিনা
গানের প্রসঙ্গে মনে পড়লো দীপক মাস্টারমশাইয়ে কথা। মেজদাদুর বন্ধু শীর্ণকায় মানুষটি মা মামা মাসীদের পড়িয়েছেন। সবাই খুব মেনে চলত ওনাকে। বড়মামার একমাত্র ছেলে দীপ্তদাকে তবলা শেখাত দানিদা বলে পাড়ারই একজন।একদিন সকালে যখন মা্স্টারমশাই অঙ্ক দেখাচ্ছেন ছোটমাসীকে, ছোটমাসী সে বছর অঙ্কে অনার্স নিয়ে ফাইনাল ইয়ার, দানিদা তখন তবলা বাজানো শেখাচ্ছে, হঠাৎ পড়ানো ছেড়ে মাস্টারমশাই উঠে এলেন , বললেন, ''কি শেখাচ্ছ দানি? বোলে এত ভুল কেন ?” বলেই দীপ্তদাকে সরিয়ে ব'সে পড়লেন তবলার সামনে, সাবলীল হাতের ছোঁয়ায় বেজে উঠল ডুগি আর বাঁয়া, তার বাজানো দেখে আমরা, এমনকি স্বয়ং দানিদাও থ ,পরে শুনেছি একাধিক বাদ্যযন্ত্রে দখল ছিল তাঁর। ছোটবেলায় বাজনার নেশায় নাকি ঘর থেকে পালিয়েছিলেন কোন এক যাত্রাদলের সাথে। গ্রামে ঢোকার মুখে বিশাল বটগাছের পাশেই ছিল ওনার আটচালার বাড়ী।পাশে টলটলে জলে ভরা বউমরা খাল। ওনার স্ত্রী রাধিদিদার হাতে বানানো মোয়া নাড়ু নারকেলের চিঁড়ে দেদার খেয়েছি। আজ আসার সময় সেই বটগাছও দেখিনি, সেই আটচালার জায়গায় ঝান্ডা লাগানো পার্টি অফিস দেখে এসেছি। নেহাত খালটা এখনও বুজে যায়নি,তাই জায়গাটা চিনতে পেরেছি। ছোটমাসীও আজ অনেকদিন হল দেশের পাট গুটিয়ে জার্মানীতে স্থিতু হয়েছে। দীপ্তদা আজ প্রায় বছর দশেক হল মালা ঝোলানো ফটো হয়ে রয়ে গেছে মায়ের ঘরের দেওয়ালে। অফিসের কাজে মুসৌরী গিয়ে আর ফেরত আসেনি, অথচ বড়মামা আজো অপেক্ষায় আছেন দীপ্তদার। বড়মামী মারা গেছেন। নাতি নাতনি নিয়ে বড়মামার একমাত্র মেয়ে দীপাদিও বিদেশবাসী। বড়মামা একা একা গড়িয়ার ফ্ল্যাটে বসে যত পুরানো ঘটনার ময়নাতদন্ত করেন আপন মনে। প্রতিবারই সাংসারিক অপঘাতের জন্য নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করেন। তবুও ঘনঘন ফোন করে সবার সাথে যোগাযোগটা উনিই রাখেন। আরেকটা মামাতো ভাই ছিল আমার, শাক্য, মেজমামার ছেলে। সহজ সরল ভাইটা আমার কবিতা লিখত। সেই কবিতা পড়েই প্রেমে পড়েছিল ওর সহপাঠিনী অনিন্দিতা। তুমুল প্রেম। আমরা সবাই জানতাম। কিন্তু বাস্তব যে কত নির্মম, সেটাইতো জানতো না আমার ভাইটা, একদিন অনিন্দিতা ওকে ফোনে জানায়,''জানিস তো,আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । ছেলে আমেরিকায় থাকে, কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ার। '' বলেই অনিন্দিতা ফোন কেটে দেয় । প্রেমে ব্যর্থ তো কত লোক হয়। সামলেও নেয়, কি ভুলে যায়। কিন্তু শাক্য তার কোনটাই পারেনি। আমার পড়াশুনোয় ভালো, বোকাসোকা, মেডিকেল স্টুডেন্ট ভাইটা প্রচুর ঘুমের ওষুধ নিয়ে হারিয়ে গেছে ঘুমের দেশে। কতবছর যে তাই ভাইফোঁটা দিই নি।
আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে আসছে শেষ বিকালের রোদ্দুর, কিছুটা দূরে, ঝুপড়ো গাছগুলোর আড়াল আবডালে জমে উঠছে ছায়ার ঘোর। গোধূলীর আকাশে পাখিরা ফিরে যাচ্ছে। নীড়গামী পাখিতে ভরে উঠছে বড়ো বড়ো গাছগুলোর ঝুপসি ডালপালা। অথচ আমার হারিয়ে যাওয়া সোনালীদিনের গল্প আর ফুরোচ্ছে না কিছুতেই। তাল কাটলো চেনাগলার ডাকে।
- ম্যাডাম, কি ভাবছেন এত? কখন থেকে ডাকছি আপনাকে।
স্বাতী ফেরত এসেছে, সাথে দুজন ভদ্রমহিলা, একজন ভদ্রলোক। স্বাতীই পরিচয় করিয়ে দিল,ওর পিসি, পিসির জা আর দেওর। ওনারা এসেছেন আমার হারিয়ে ফেলা সম্পর্কের ছেঁড়াসুতো জোড়া দিয়ে আমায় সাহায্য করতে। আমি সেনবাড়ীর মেয়ে, বাড়ীতে কেউ নেই তো কি হয়েছে, সেনদের পাড়াপ্রতিবেশীরা আছে না? আমি তো এখন গ্রামের অতিথি। ফিরে গেলেই হত। কিন্তু আমারও যেন কেমন ঘোর লেগে গেছে। এতদূর এলাম যখন এতদিন পর, শেষটা দেখেই যাই। স্বাতীর পিসির বাড়ীতে মালপত্র রেখে এক রাতের অতিথি হলাম। চা পর্ব মেটার পর স্বাতীর পিসি নিয়ে চললো অন্য কার বাড়ী। অন্ধকারে চিনতে পারলাম না। একতলা ছড়ানো বাড়ী, বসার ঘর পেরিয়ে পাশের ঘর। খাটে এক বয়স্কা মহিলা বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। স্বাতীর পিসি অবন্তিকা মহিলার গায়ে হাত দিয়ে বলল,
- মাসীমা, নিয়ে এসেছি..
- এনেছিস? মধুর মেয়ে এসেছে? আমার মুনিয়া? দেখি দেখি… কত বড়টা হয়েছে আমার মুনিয়া? চোখে যে ছাই ভালো দেখতেও পাইনা..আয় মুনিয়া এদিকে আয় মা।
মুনিয়া?.. মুন্নি মুনাই মানা…কতদূর থেকে ডাক শুনতে পাচ্ছি, তরুমাসী??? আমার জন্য গাছের কদবেল মেখে রাখত তরুমাসী সর্ষের তেল, লঙ্কা, নুন, অল্প চিনি,ধনেপাতা দিয়ে। গরমের সময় চালতা মাখা, তেঁতুলমাখা। আর রাখত কালো ঝাল লজেন্স, টক মিষ্টি হজমি গুলি, ঘরেবানানো তেঁতুল, কুলের আচার। মা আর তরুমাসী যখন এটাসেটা গল্প করত তখন আমি, বিনিদিদি, আমার বোন তিন্নি আর খুদে শাক্য ব্যস্ত থাকতাম ঐসব নিয়েই। এখন তরুমাসী অসুস্থ, দুই ছেলে, ছেলে বউ, নাতি নাতনী নিয়ে ভরা সংসার। শুনলাম তরুমাসির বিয়ে হয়েছিল গ্রামের স্কুলের নিবারণমাষ্টারমশাইয়ের সাথে। মাষ্টারমশাই পাশের গ্রামে থাকতেন।তরুমাসীরা আগের বাড়ী ছেড়ে উঠে এসেছে এখানে। তরুমাসীর বাড়ীতেই জমে উঠলো জমাট আড্ডা। অনেক জানা অজানা চেনা অচেনা লোকেদের আনাগোনায় সম্পর্কের বিনিসুতোর গিঁট খুলে গেল।
চানক্যদাদু,বাণীদিদুন, মাস্টারমশাই, রাধি দিদা, স্বপনমামা, কচিদিদা, অন্নপুর্না মামী, কাজল দিদি, সুমি মাসী কত লোক আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। জমিজমা বেচে চাণক্যদাদুর একমাত্র ছেলে অনেকদিন আগে গ্রাম ছেড়েছে। দাদুর নাতি চন্দন কোলকাতায় একটা শপিংমলের নামকরা শাড়ীর দোকানে সেলস্ম্যানের কাজ করে, বিয়ে করেছে এই গ্রামেই। গাট্টাগোট্টা চেহারার স্বাতীকাকিমা মা মারা যাবার পর ভাইবৌয়ের সংসারে আর টিঁকতে পারেনি। দুবরাজপুরে এক বৃদ্ধাশ্রমে থাকত। দাদুর বাড়ীতে রান্নার কাজ করত যে শিবুর মা তার মেয়ে ঝুমামাসি ওখানেই একটা আধা-সরকারী হসপিটালে আয়ার কাজ করে, শেষ খবরটা সেই এনে দিয়েছিল।দানিদাও এসেছিলেন। উনি কাছেই একটা লেদ মেশিনের কারখানা চালান। দানিদার কারখানাতেই কাজ করেন ছোটমামার কবিবন্ধু অলকমামা। ছোটবেলায় শৌখিন মানুষটার ফিন্ফিনে শাদা কাগজের ভেতর তামাক পুরে সিগারেট পাকিয়ে খাওয়া অবাক চোখে দেখতাম। কবিতার নেশায় পড়াশুনো বিশেষ হয়নি, শেষমেশ লেদ কারখানায় সুপারভাইজার। রেখামাসীরও খবর পেলম। মাসির নাকি থ্রোটক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ, কথাও বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ দেখা করতে গেলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন আর চোখ থেকে অবিরাম জল ঝরে। মেসো খুব যত্ন করেন, নীচুগলায় একাই গল্প করেন মাসীর সাথে। সারাদিন মাসীর সঙ্গেই থাকেন। মাসী আর গাইতে পারে না তাই হয়ত হারমোনিয়ামটা মাথার কাছে নিয়ে শুয়ে থাকে।
আমি শুনি আর ভাবি, কেন এলাম ? কিসের খোঁজে? শুধু নেই আর হারিয়ে যাওয়ার খবর নিতে? ভাবতে ভাবতেই সমস্ত আকাশ অলীক আলোর মায়ায় মাখিয়ে, মেঘে মেঘে পা রেখে শেষ হয়ে গেল একটা দিন। আমি চেয়ে থাকি। খোলা চুলের অন্ধকার নেশার মত রাত জড়িয়ে নেয় আমায়।রাতের পরশ,খোলা হাওয়ার পরশ, চাঁদের আখরে উন্মুক্ত আকাশছোঁয়া দুখজাগানিয়া আলোর পরশ কি আশ্চর্য গভীর, অথই। আমি ডুবে যেতে থাকি। আমার গায়ে ঠেকে তরুমাসীর কাঁপা হাতের পরশ, শিবুর মায়ের দু হাতের গন্ডীতে বাঁধা বুকের পরশ, ছোটদাদুর বন্ধু মুরারীদাদুর কড়া পড়া আঙ্গুলে চুলে বিলি কাটা পরশ,আমার ছোটবেলার বন্ধু তুয়ার দু হাতের মুঠিতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা হাতের পরশ, কমলা দিদির চোখ থেকে ঝরে পড়া অঝোর ধারার পরশ, ছানিপড়ি চোখে অন্ধপ্রায় মিনিবৌদির গাল ছুঁয়ে যাওয়া আঙ্গুলের আলতো পরশ, কাজরী মামীর দুহাতে আমার মুখটা তুলে ধরে কপালে আদরের চুমুর পরশ, পা ছুঁয়ে প্রণামের পর রমনীমামার মায়ের আমার থুতনি ছুয়ে আদরের পরশ.. কত বলবো আর! …শুনেছি পরশপাথরের ছোঁওয়ায় লোহা নাকি সোনা হত। আজ সেই রকমই এক অলীক পরশপাথরের ছোঁওয়ায় কানায় কানায় ভরে উঠেছে আমার মনের মনিকোঠায় জমানো স্মৃতির রত্নভান্ডার। আমি পরশপাথরের খোঁজ পেয়েছি।
![]() |
| পরিচিতি |
মৌ দাশগুপ্তা
Reviewed by Pd
on
নভেম্বর ২১, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
নভেম্বর ২১, ২০১৪
Rating:



কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন