এই অকাল শীত আর রায়মঙ্গলের লোনা হাওয়া এমনিতেই যেন জল এনে দেয় চোখে, নন্দিনী এখনো নদীর পাড় ঘেঁষে হেঁটে যায় রোজ যেমন আগে যেত। রায়মঙ্গলের দুধারেই জীবন চলে ধুঁকিয়ে, বাঁচবার তুমুল লড়াই এখানে এক করে দিয়েছে সকলের জীবন, দুধারের বাসিন্দারাই নির্ভর করে একে অন্যের ওপর যদিও তাতে শত্রুতার কমতি হয় না এক তিল। এবারে শীত মনে হয় খেয়ে ফেলল হেমন্তকে, আসলে এই ঋতুটা যেন নেই হয়ে আছে, ফি-বছরই কারো না কারো সাথে মিলে যায়, ঋতুর এত খবর জানে না নন্দিনী শুধু বোঝে ঘা শুকিয়ে আসছে মানেই হাওয়ায় শীতের টান, আর নদীতে কাঁকড়ার আমদানি। বরষার ভরাডুবির পরে ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূলগুলোও মাথা উচিয়ে থাকবে আরও বেশী আর তা রেয়াত করে না মধুখোর মানুষ বা কাঁকড়াখোর বাঘ কারোকেও।
টাঙির মত মাথা তোলা শিকড়গুলো অজান্তে খোঁচা দেয় নন্দিনীর হৃদয়ে, আজ এক বছর প্রায় সুন্দর নেই, নেই মানে নন্দিনীর কাছে নেই, সরকারী বাবুরা যখন রক্তাক্ত সুন্দরকে নৌকায় তুলছিল তখনো অচৈতন্য চোখ যেন বলে যাচ্ছিল ফিরে আসবার কথা। ফিরে সে আসবেই, এ বিশ্বাস রাখে নন্দিনী, তাই তো দিনে একবারও তার আসা চাই নদীর পাড়ে।
নদীর মাঝ বরাবর চর পড়ে আছে, কোন কোন দিন ইচ্ছা হয় সেই চর অবধি এগিয়ে দেখে আসে, ওপারেই তৈরি হচ্ছে সরকারী হাসপাতাল, পুরোপুরি তৈরি হয় নি হয়ে গেলে আর এপারের কারুকে চিকিৎসার জন্য শহরে যেতে হবে না হয়ত। এই হাসপাতালের জন্যই মানুষের আনাগোনা খুব বেড়ে গেছে রায়মঙ্গলের পাড়ে, তাদের কেউ কেউ বেশী উৎসাহী হয়ে এপারেও চলে আসে যদিও নন্দিনীদের বিরক্ত করা ছাড়া আর উদ্দেশ্য কিছু নেই তাদের। খুব ভয়ে ভয়ে বাচ্চা দুটি নিয়ে থাকে সে, পারতপক্ষে সামনে আসে না ওদের। দিন গোনে কবে আসবে সুন্দর সেদিন সে বুক ভরে শ্বাস নেবে।
দেখতে দেখতে বাচ্চা দুটিও বড় হয়ে এল, সুন্দরের যাবার কালে ওরা নিশ্চিন্তে ছিল মাতৃগর্ভে, কোন বিপদ নেই সেখানে, মনের গোপন ইচ্ছা ফুল হয়ে ফোটার দেরি ছিল না। মনে মনে স্বপ্ন দেখত নন্দিনী, তাদের বাচ্চারা জন্ম নেবে কোন শান্তির পৃথিবীতে, যেখানে দুই গ্রাস খাবারের জন্য নেই এত সংগ্রাম। এই জঙ্গলে কেটে গেছে তাদের কত প্রজন্ম,এখন আর আগের মত দিন নেই, খাবারের বড় অমিল, বিপদের হার বেড়ে গেছে শতগুন।যদিও নানা রকম সরকারী প্রকল্প শুরু হয়েছে তবে তা যেন সরকারের বাড়তি বোঝা। তাদের কথা বিশেষ ভাবে না কেউই আর ভাববেই বা কেন তারা তো আর ভোটার নয়। সুন্দরকে এসব কথা বললেই অসহায় দৃষ্টিতে চাইত আর তারপরই চেটে দিত নাক, কান, গলা......। এটা ওর পুরনো অভ্যাস, কথার জবাব না থাকলেই এমন করবে আর ওই পরশে নন্দিনীর সব প্রশ্ন ঝড়ের মুখে কোথায় উড়ে যাবে। আজ বড্ড কষ্ট হচ্ছে সুন্দরের জন্য, এতগুলো দিন পার হয়ে গেল এখনো ফিরল না... ও বেঁচে আছে তো? কথাটা মনে আসতেই নিজেকেই নিজে ধিক্কার দেয়—এসব কি ভাবছে সে? সুন্দর ফিরবেই ।
ওদেরই এলাকার বাজ-বাহাদুর, সেও গেছিল শহরে, কালই ফিরেছে, ওই বলল সুন্দরকে আলিপুর বলে কোন একটা জায়গায় রেখেছে, ভাল আছে সে। প্রতিদিন প্রচুর লোক আসে তাকে দেখতে, খুব নাম হয়েছে তার ,আর হয়ত এই জল-জঙ্গলের দেশে ফিরবে না, যদিও মুখোমুখি তার সাথে কথা হয় নি তবু দূর থেকে তার খুশী খুশী মুখ দেখেছে বাজ। নন্দিনীর বুকের হাহাকার অশ্রু হয়ে নেমে আসে, তাই দেখে বাজ বলে—কাঁদিস কেন? সুন্দর নেই তো কি হয়েছে আমি তো আছি। তোর বাচ্চা দুটো তো বড়ই হয়ে গেছে, এবার ওরা নিজেরাই বাঁচতে পারবে, আয় আমরা আবার নতুন করে শুরু করি। আগুন চোখে বাজের দিকে তাকায় নন্দিনী সে চোখে বাজের প্রতি ঘৃণার চেয়েও অনেক বেশী অভিমান ছিল সুন্দরের জন্য, আজ সে নেই বলেই বাজের মত ধূর্ত লোকের এত সাহস। যদি সুন্দর নাও আসে তবু নন্দিনী একাই একশ ,কারুকে চাই না তার।
রাত কত ঠাহর হয় না, ঘুমের মধ্যেই যেন সুন্দরের গর্জন কানে এল, স্বপ্ন ভেবে চোখ বুজতেই আবার সেই ডাক, তার নাম ধরে সুন্দর ডাকছে, পরিষ্কার শুনেছে সে, ভুল নয়। ছেলেদুটোর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে –- নড়িস না বাছারা, যতক্ষণ না আমি ফিরে আসি। তীরের বেগে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ায় সন্ধ্যেবেলাতেও নিয়ম মত ঘুরে গেছে সে, এখন ওপারের হাসপাতালের বড় আলো জ্বলছে, কিছু একটা ঘটছে ওখানে, আবার সুন্দরের ডাক--—ন......ন্দি......নী। আর পারে না সে, ডাক ফিরিয়ে দেয় ---সু......ন্দ.........র।
উত্তেজনায় গায়ের প্রত্যেকটা রোম খাড়া হয়ে ওঠে, সে ঠিক করে ওপারে যাবে সে, যা থাকে কপালে। বাচ্চাদের মুখগুলো মনে আসতেই বুকটা চাপ ধরে আসে, মনে মনে ভাবে-- ওরা বড় হয়ে গেছে।
পরের দিন হুলুস্থুল বনদপ্তরের লোকেরা, খবরের কাগজের লোক, টি ভি চ্যানেলের লোকে ছয়লাপ। চরের বালির ওপর মিলেছে টাটকা পায়ের ছাপ, পরিণত বয়স্কা বাঘিনীর। গতকাল আলিপুর চিড়িয়াখানা থেকে যে বাঘটিকে চিকিৎসার পর ফেরত আনা হয়েছিল তারই গর্জনে হয়ত আকৃষ্ট হয়ে থাকবে মাদী বাঘটি। প্রসঙ্গত বাঘটি এই জঙ্গলেরই ভূমিপুত্র, গুরুতর আহত অবস্থায় এটিকে বনদপ্তরের কর্মীরা উদ্ধার করেন ও দীর্ঘ চিকিৎসার পরে সুস্থ অবস্থায় আবার ফেরত দিতে আসেন কিন্তু সন্দেহ ছিল আবার সে এই জঙ্গলে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা, সে সন্দেহের অবসান করে লম্বা লাফ দিয়ে আজই সফল ভাবে বাঘটি রায়মঙ্গল পেরিয়ে নিজের এলাকায় ফিরে যায়। কেউ কেউ দেখেছে অপর পাড়ে একটি বাঘিনী দুটি শিশু বাঘের সাথে অপেক্ষমানা ছিল।
![]() |
| ~কবি পরিচিতি ~ |
দোলনচাঁপা ধর
Reviewed by Pd
on
নভেম্বর ২১, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
নভেম্বর ২১, ২০১৪
Rating:



কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন