বাংলার পাশাপাশি ইংরেজী লিখে বিশ্বের দুয়ারে পৌঁছে যাওয়া খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়। তবে কতখানি তাৎপর্য বহণ করছে সেটা চিন্তার বিষয়ও বটে। সমকালীন সময়ের কবিগণ রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি আর বাংলা গীতাঞ্জলির রচনা শৈলীর মধ্যে বিস্তর পার্থক্যকে উল্লেখ করে পূর্বেই বিবৃতি দিয়ে গেছেন। ১৯১২ খৃষ্টাব্দে ইংরেজি গীতাঞ্জলি প্রকাশের ফলেই রবীন্দ্রনাথ নোবেলে ভূষিত হন। রবীন্দ্রনাথ একেবারে নিজস্ব আলোকে তাঁর মূল কবিতাগুলোকে ইংরেজীর গদ্যে তুলে ধরেছিলেন যার অন্তর্নিহিত ভাব একটুও ক্ষুণ্ণ না করে। কবিতা হিসাবে ছন্দোস্পন্দনের আর ভাবগত বৈশিষ্টের কারণে কবিতাসমূহ বিশ্বমানব কূলে অধিকভাবে সমাদৃত হতে পেরেছিল সে ব্যাপারে প্রশ্নের অবকাশ নাই। বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ও কমোনিয়তাকে ইংরেজিতে অনুবাদ কেবল কষ্টসাধ্যের নয়, কিছুটা অসম্ভবও বটে। কিন্তু রবীন্দ্র প্রতিভা অনুবাদের ভাবভাষা সহ চিত্রকল্প পাশ্চাত্য জগৎকে আলোড়িত করতে পেরেছিল। গীতাঞ্জলিতে মোট কবিতার সংখ্যা ১৫৭টি, কিন্তু ইংরেজি গীতাঞ্জলি বা সং অফারিংসে ১০৩টি কবিতা রয়েছে, যার মধ্যে একটি কবিতা দুইটির মিলিত অনুবাদ। ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকা লিখেছিলেন ইয়েটস। এজরা পাউণ্ড গীতাঞ্জলির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন শুধুমাত্র তার সংক্ষিপ্ত পরিসরে ব্যাপক জীবন বোধকে উপোলব্ধি করেই। যদিও কবিতায় এজরা পাউণ্ড সংহতি, সংক্ষিপ্ততা মেদ বাহুল্য বর্জন করার ব্যাপারে সদা তৎপর ছিলেন কিন্তু গীতাঞ্জলির নিজস্ব জীবন দর্শনকে ধারণ করতে পেরে তিনি চমৎকৃত হয়েছিলেন। একই সূত্র ধরেই আদ্রে জিদ রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ ক্ষমতা দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। রবি ঠাকুরের গীতাঞ্জলির মাধ্যমে গুটা পৃথিবীর জীবনকে হাতের মুঠোয় নেবার অভিনব কায়দা আর কারও পক্ষে এ যাবৎ সম্ভব হয়নি। যে কোন ব্যাক্তিমানুষের জীবন কবির চিন্তা বা দর্শনের ফলকে স্বার্থকতা লাভ করবে যদি যথার্থভাবে সেই আলোকে নিজেদেরকে পরিচালিত করা যায়।
এবার মূল কথায় ফিরে আসি। ইংরেজি গীতাঞ্জলীতে অতুলনীয়ভাবে অনেক কিছুই আছে। কিন্তু বাংলা গীতাঞ্জলির কবিতাগুলো গানের সুরের ও বাণীর মহান মিলনে আমাদের চিত্তকে বারে বারে আহ্বান করে যায় নির্মল আনন্দঘটার ঘণ্টা বাজিয়ে, কখনও বা বিরহের আবছায়ায় কাঁদিয়ে যায় নরম মানের মনুষ্যকূলকে। মানুষের জীবনও গানের দুয়ারে বাউল হয়ে ঘুরে সদা সত্যকে আবিষ্কার করতে। কিন্তু তারপরও ইংরেজি ভাষায় গীতাঞ্জলির সৃষ্টি পাশ্চাত্যকে প্রাণ চাঞ্চলোকর করে ব্যাঞ্জনা দিয়েছিল। খুব সহজ আর সংক্ষিপ্তাসারের ভাষায় এমন গভীর তত্বকথা এক কথায় নিরাময় দিতে পেরেছিল জটিল পৃথিবীর জট ছাড়াতে। কবির কবিতার ভাবনাগুলো জীবন বোধের উপর গভীর আবিরের রঙ ছড়িয়ে দেবার মতন পরিবেশ বা উদ্দীপনা ঘটিয়েছিল। বিদেশে তৎকালীন পত্র-পত্রিকা এবং বিখ্যাত সাহিত্যিকদের লেখার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের কতখানি সম্মোহিত করেছিলেন তা কিছুটা আঁচ করা যায়। রবীন্দ্রনাথের ব্যাক্তিত্বও ছিল ঋজু ভঙ্গিমায় সহজ আর স্বচ্ছ-সুন্দরের প্রতীকে বিচ্ছুরিত যা রবীন্দ্র প্রতিভা বিকাশে একটি বিরাট অবদান রাখতে পেরেছিল। সে অর্থে রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণ বা সম্মোহনী করার ক্ষমতা ছিল তীব্রতায় ছাওয়া, লেখার আলোকে আলোকে শ্রদ্ধার আসনে তিনি রয়ে গেছেন প্রতিটি মানস সরোবরের কাছে। পাশ্চাত্য জগত রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করতে পেরে গৌরবান্বিত মনে করেছিল।
আমাদের প্রাচ্য ভূখণ্ডে – ভারতবর্ষ, বিশেষত, বাংলাদেশে (তৎকালীন পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গ মিলিত ভাবে) তাঁর নোবেল প্রাপ্তির পর যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হয় তাতে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন এবং একথা বলেওছিলেন যে, পাশ্চাত্যের অনুমোদনের পরেই তাঁর নিজের দেশের লোকেরা আত্যন্তিক আতিশয্য প্রদর্শন করেছেন। আবার অনেকে বিদ্রুপ করতেও ছাড়েননি। অথচ এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ কেবল ভারতবর্ষ নয়, প্রকৃত পক্ষে বাংলার সংস্কৃতি ও তার পরিশীলিত চৈতন্যকে বিশ্বের কাছে সপ্রশংস পরিচিতি দিয়েছিলেন। আমাদের কাছে নোবেল প্রাপ্তির বিষয়টি এ-কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপুর্ণ।
গীতাঞ্জলির মৌলিক আবেদন বাংলা লেখার মধ্য দিয়ে প্রস্ফূটিত অধিকভাবে যদিও তর্জমা করে নোবেল পুরস্কার পান রবীন্দ্রনাথ আর সেটা তার নিজস্ব সৃষ্টির দক্ষতার গুণে সম্ভব হয়েছে। বাংলা গীতাঞ্জলির প্রকাশকাল ৩১ শ্রাবণ ১৩১৭ সন। সেখানে সূচনায় ‘বিজ্ঞাপন’ শিরোনামে তিনি বলেন, ‘এই গ্রন্থের প্রথম কয়েকটি গান পূর্বে অন্য দুই-একটি পুস্তকে প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যাবধানে যে সমস্ত গান পরে পরে রচিত হইয়াছে তাহাদের পরস্পরের মধ্যে একটি ভাবের ঐক্য থাকা সম্ভবপর মনে করিয়া সকল গুলিই এই পুস্তকে একত্রে বাহির করা হইল।’ মোট একত্রিত গানের ১৫৭টি এবং এর সবই প্রায় বাংলা ১৩১৭ সনে লেখা। কেবল শুরুর কয়েকটি গান বাংলা ১৩১৩ থেকে ১৩১৬ সনের মধ্যে লেখা হয়েছিল। ইংরেজি গীতাঞ্জলীর কথাও ধারাবাহিকভাবে বলা হয়েছে কোন কাব্য গ্রন্থ থেকে কিভাবে কবিতার সমন্বয় হয়েছে। ইংরেজি কবিতার ভেতরের সজীবতাকে পাশ্চাত্য চোখে স্পষ্ট আলোকে ধরা দিয়েছে। কবিতার ঢেউয়ে ঢেউয়ের উন্মোচনে আধ্যাত্মিকতা, দর্শন ও আত্মার অধিবিদ্যামূলক অমূল্য রত্ন ভান্ডার দেখে তারা বিমোহিত ও চমকিত হয়েছিলেন। যদিও ইংরেজি গীতাঞ্জলী বা সং অফারিংসের কবিতাগুলো বাংলা কবিতার ভাবধারার সাথে সাদৃশ্য রেখে অনুবাদ করা হয় তবু দেখা যায় সেই সকল মৌলিক রচনাগুলোই ইংরেজিতে ভিন্ন স্বাদের নুতন মাত্রা দিয়েছে। এই ইংরেজি কবিতাগুলোই নোবেল প্রাইজ প্রাপ্ত হইয়াছে। পশ্চিমা জগত যদি আমাদের মত রবীন্দ্রসঙ্গীতকে চিত্তে ধারণ করার প্রয়াসী হতেন তবে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত মূল্যায়ন হত। শান্তি দেব ঘোষের ভাষায় “এক একটি করে লেখা যখন বাড়তে লাগল, তখন নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম এই গানের বহু বৈচিত্র ও বৈশিষ্ট দেখে। কারণ এ সংগীতের গতি বহু দিকে, এই সব বিভিন্ন পথের পরিচয় না জানা থাকলে গুরুদেবের গান সঙ্গিতজ্ঞদের মত জানা হবে না।”
প্রকৃতভাবে বিশ্লেষণ করলে বা রবীন্দ্র গবেষণাবিদদের মতে রবীন্দ্রনাথের তুলনায় নোবেল প্রাপ্ত ইংরেজি গীতাঞ্জলি এমন কিছু বড় নয়। এক কথায় রবীন্দ্রনাথ তার সামগ্রিকতায় ওই ইংরেজি গীতাঞ্জলির অনেক ঊর্ধ্বে অথচ ওই ছোট কয়েকটা সৃষ্টি দিয়েই রবীন্দ্রনাথ সেদিন বিশ্ব জয় করেছিলেন।
নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির অব্যবহিত পর রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথের ব্যাক্তি জীবন তথা তার সাহিত্য কর্মকান্ডকে ব্যাবহার করেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষেরা রাজনৈতিক অনাচার চালিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ তাতে দারুণভাবে আহত হয়েছিলেন। কিন্তু সাহিত্যকর্মী ও কবি কর্মীর কাছে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির তথাকথিত অনুবাদকর্ম ও তার যে প্রক্রিয়া সেটিও কম আকর্ষণের বিষয় নয়। এই কবিতা অনুবাদের বিষয়ে অজিত চক্রবর্তীকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে সচেতনভাবে কবিতাগুলো ভাষান্তর করেননি বরং মূল লেখাগুলোর ভাব এবং গঠন ধারণায় রেখে প্রায় এক ধরনের ভাবের মধ্যে ভেসে যাওয়া এবং সেটা তাঁকে যেখানে নিয়ে গিয়ে উপনীত হয় সেটা অনেকটা তার অজ্ঞাতসারেই প্রায় অবচেতনায়। এমন একটা অবস্থার মধ্যেই ইংরেজি অনুবাদ বিভিন্ন সময়ে সাধিত হয়েছে।একজন মহৎ কবি নিজের পদ্য রচনার অন্য ভাষায় অনুবাদের যে মানস প্রক্রিয়া গীতাঞ্জলির ক্ষেত্রে সেটাও পাঠক ও সমালোচকের জন্যে একটি গভীর তাৎপর্যপুর্ন পর্যবেক্ষণের বিষয়।
ইংরেজি কবিতাগুলো বাংলা কবিতা থেকে অনুবাদ করামাত্রই তার অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায়নি বরং নতুন করে কবিতাগুলোর জন্ম হয়েছে সজীবতার ডালপালাতে করেই। তাই বাংলা কবিতাগুলো আর ইংরেজি কবিতাগুলোকে পাশাপাশি রেখে অবলোকন করলে দেখতে পাব ভাবগত দিক থেকে ভাষার দুই আঙিনায় তারা দুটি সুরের ধারায় গতি পাচ্ছে। হায়াৎ সাইফ বাংলা ও ইংরেজি কবিতার মূল পার্থক্যকে যথার্থভাবে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন কবিতার ভাব সম্পদের ভার উত্তোলণ করেই। আমি তার করা ব্যাখ্যার একটি কবিতার উল্লেখ করছি।
যেমন ‘আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে’ ইংরেজিতে -
‘I know not from what distance time thou art ever coming nearer to meet me.’ বাংলা কবিতাটি যদি আলাদা করে পড়া যায় তাহলে দেখা যাবে যে, প্রায় একইভাবে শুরু হলেও মাঝখানে গিয়ে এবং শেষে ইংরেজি অংশটি একেবারে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বাংলা কবিতাটি শুরু হয়েছে ‘আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে’ এই দিয়ে। এখানে ‘আমি’ এবং ‘তুমি’ এই দুই সত্তার মধ্যে মিলনের যে উদগ্রীবতা এবং নিশ্চয়তা আবার কিছুটা এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার সংশয় --- এর সঙ্গে সঙ্গে যদি সুরারোপিত গানটি শোনা যায়, যা বাগেশ্রী রাগাশ্রিত, তাহলে ইংরেজি প্রথম বাক্যটি ‘I know not from what distant time thou art ever coming nearer to meet me.’ এই বাক্যের মধ্যে আমি এবং তুমি যে-সত্তা এবং ভগবৎ চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে এর যে গভীর প্রেমাপ্লুত মানবিক আবেদন তার পুরাটাই একেবারে উবে গেছে। এখানে কিন্তু প্রবল হয়ে হয়ে উঠেছে একটি ঐশ্বরিক প্রতিরূপ। এই তুমিটি নিঃসন্দেহে ভগবৎচিন্তায় পর্যবসিত হয়েছে, যা উপনিষদ-ভারাক্রান্ত এবং আমির মধ্যে যে মানবিক প্রেমিকার জন্যে প্রতীক্ষা এবং প্রেমিকাকে পাওয়ার যে প্রবল আর্তি তা এই ইংরেজি চরণটি থেকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রান্ত হয়েছে ।কাজেই আমাদের কাছে ইংরেজি গীতাঞ্জলীর আবেদন কখনই তেমন গভীর হবে না।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন ইংরেজি অনুবাদের সময় পশ্চিমা পাঠকের কাছে তা অধিক অর্থবহ ও সহজগম্য করার লক্ষ্যে তিনি মূলের ‘হীরে-জহরত’ খুলে নিয়েছেন। লক্ষ্য করা যাক নিম্নের গানটিকে নিয়ে যা কিনা অনুবাদের সাথে গানটির অঙ্গহানি ঘটে।
“আমি কেন বার বার তার দৃষ্টি হারাই, যার নিঃশ্বাস আমার নিদ্রাকে ছুঁয়ে যায়?”
Ah, why do I
ever miss his sight whose breath touches my sleep?
একই কথা মাথায় রেখেও বলা যায় বাংলা গানটি ও তাঁর ইংরেজি রূপান্তর একে অপর থেকে নাটকীয়ভাবে ভিন্ন। শুধু ভাষার সংকোচন নয়, বাণীর বিচ্যুতিও রূপান্তরিত কবিতার চরিত্র বদলে দিয়েছে।
অমিয় চক্রবর্তী ঠিকই বলেছেন, ‘গীতাঞ্জলিতে যা আছে, তার প্রত্যেকটিই হচ্ছে গান। গান মাত্রই সুরের অপেক্ষা রাখে, তা না হলে তার অন্তরতম ভাবরূপের পুর্ণ বিকাশ নেই। গানের মধ্যে কবি ইচ্ছে করেই সুরের জন্যে খানিকটা করে ফাঁক রেখে যান, সঙ্গীত সেই ফাঁকগুলি ভরে দেয়।’(অমিয় চক্র বর্তী, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ। মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৮) আর একটি উদাহরণ্ গুরুদেবেরই ভাষায় “ য়ুরোপীয় সঙ্গীতেইয় যে-হার্মনি অর্থাৎ স্বরসংগতি আছে আমাদের সঙ্গীতে তা চলবে কি না । প্রথম থাক্কাতেই মনে হয়, ‘না, ওটা আমাদের গানে চলবে না, ওটা য়ুরোপীয়’ কিন্তু যে-হেতু এটা সত্যবস্তু, এর সম্বন্ধে দেশ কালের নিষেধ নেই। তবে কিনা এও নিশ্চিন্ত যে, আমাদের গানে হার্মনি ব্যবহার করতে হলে তার ছাঁদ স্বতন্ত্র হতে হবে। অন্তত মূল সুরকে সে যদি ঠেলে চলতে চায় তবে সেটা তার পক্ষে স্পর্ধা হবে। কাজেই দেশ কাল হিসেবে মৌলিক একটা ব্যাপার থেকেই যায়।
অনেক পর্যালোচনার পরে রবীন্দ্রনাথ নিজেও শেষ জীবনে এসে উপলব্ধি করেন, অনুবাদ-অসাধ্য এই গানগুলি নির্বাচন করে এবং তার এমন একরৈখিক ভাষান্তরের মাধ্যমে তিনি নিজের কাব্যের প্রতি সুবিচার তো করেনইনি, বাংলা কবিতার প্রতিও অবহেলা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে নীরদ সি চৌধুরীর কথাও বলা যেতে পারে। গীতাঞ্জলির ইংরেজি কবিতাসমূহ, যা মূলের ছন্দোবদ্ধ কবিতার স্থলে গদ্য-কাবিতা হিসেবে প্রকাশিত হয়, নীরদ চৌধুরীর বিবেচনায় তারা আঙ্গিক বা কাব্যিক সৌন্দর্যে মোটেই তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না।
পাশ্চ্যাতেও রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি নিয়েও অনেক সমালোচনা হয়েছিল। ইংরেজি ভাষার একজন অসামান্য কবি রবার্ট ব্রিজেস চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার পরিবর্তিত রূপ দিতে। তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলেও গীতাঞ্জলির কোন রূপ পরিবর্তনের আগ্রহকে অগ্রাহ্য করেছেন এই মর্মে যা একবার পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়ে গেছে তাতে হাত দেবার কোন আবশ্যকতা নাই। বিনয়ী রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেন যেহেতু ইংরেজি ভাষা তার নিজের নয় সেখানে স্বভাব সিদ্ধ বড় ধরণের ভাষার দখল তাঁর না থাকাই স্বাভাবিক। কাজেই রবীন্দ্রনাথের রুচিতে সাঁয় দেয় নাই কবিতার কোন পরিবর্তনের। মূল যে কবিতাটি নিয়ে ব্রিজেসের এত আপত্তি সেটি ইংরেজি গীতাঞ্জলির ৬৭ –নং কবিতা। মূল ইংরেজি কবিতাটি এই রকমঃ
Thou art the sky and thou art the nest as well.
O thou beautiful, there in the nest
It is thy love that encloses the soul
with colours and sounds and odours.
There comes the morning
with the golden basket in her right hand
bearing the wreath of beauty,
silently to crown the earth.
And there comes the evening
over the lonely meadows
desertes by herds, through trackless paths,
carrying cool draughts of peace
in her golden pitcher
from the western ocean of rest.
but there, where spreads the infinite sky
for the soul to take her flight in.
reigns the stainless white radiance.
There is no day nor night,
nor form nor colour,
and never, never a word.
কবিতাটি নৈবেদ্য থেকে নেওয়া হয়েছিল যা বাংলায় এরকমঃ
একাধারে তুমিই আকাশ, তুমি নীড়।
হে সুন্দর, নীড়ে তব প্রেম সুনিবিড়
প্রতি ক্ষণে নানা বর্ণে নানা গন্ধে গীতে
মুগ্ধ প্রাণ বেষ্টন করেছে চারি ভিতে।
সেথা ঊষা ডান হাতে ধরি স্বর্ণথালা
নিয়ে আসে একখানি মাধুর্যের মালা
নীরবে পরায়ে দিতে ধরার ললাটে;
সন্ধ্যা আসে নম্রমুখে ধেনশূন্য মাঠে
চিহ্নহীন পথ দিয়ে লয়ে স্বর্ণঝারি
পশ্চিম সমুদ্র হতে ভরি শান্তিবারি।
তুমি যেথা আমাদের আত্মার আকাশ,
ওপার সঞ্চারক্ষেত্র – সেথা শুভ্র ভাস-
দিন নাই রাত্রি নাই নাই জনপ্রাণী,
বর্ণ নাই, গন্ধ নাই, নাই নাই বাণী।
_
ব্রিজেস যেভাবে রবীন্দ্র নাথের মূল ইংরেজি পরিবর্তন করেন তা এই রকমঃ
THOU art the sky and Thou art also the nest.
O Thou Beautiful! How is the love embrace the soul
with sweet sounds and colour and fragrant odours!
Morning cometh there, bearing in her golden basket the wreath of
Beauty, silently to crown the earth.
And there cometh Evening, o’er lonely meadows
Deserted of the
Herds, by trackless ways, carrying in her golden
Pitcher cool
Draughts of peace from the ocean-calms of the west.
But where thine infinite sky spreadeth for the soul to
Take her
Flight, a stainless white radiance reigneth; wherein is
Neither day
Nor night, nor form nor colour, nor ever any word.
এখন মূল বাংলা কবিতাটির পাশাপাশি ইংরেজি অনুবাদ দুটিকে বিচার করলে ব্রিজেসের কবিতা নিঃসন্দেহে উচ্চমানের। রদেন স্টাইন এবং ইয়েটস পছন্দ করেছিলেন বিধায় রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেনঃ ‘He(Bridges)tells me now that Macmillan has showed him a letter from you refusing, lest I should be offered to allow him to make those changes….I should be sorry to prevent Robert Bridges from making the slight changes he wishes.’ কিন্তু রবিঠাকুর তাতে রাজী হন নাই অকাট্য যুক্তির নিরিখেই। অবশ্য অনেক দিন পরে রবিঠাকুরের অনুমতি ক্রমেই ব্রিজেস সেই কবিতাটি তাঁর সংকলনে ছাপাতে সক্ষম হন। রবীন্দ্রনাথ যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন এবং তাঁর চরিত্র ছিল ইস্পাতকঠিন। ইয়েটস এবং রদেন স্টাইনের সঙ্গে তিনি যে অবস্থান নিয়েছিলেন তাঁর পেছনেও যথেষ্ট যুক্তি ছিল আর তাতে তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তাই প্রকাশিত হয়েছে। আবার তিনি ব্রিজেসের ব্যাপারটিকেও হৃদয় দিয়ে অনুধাবনও করে ছিলেন। গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হবার পর ভারতে নানাধরনের গুজবও ছড়িয়ে পরে এই বলে রবীন্দ্রনাথ নিজে না লিখে কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন। রদেন স্টাইন সে ভুল ভাঙিয়ে দিয়ে স্মৃতি কথায় তা লিখে গেছেন। সুইডিশ কবি Verner von Heidenstan, যিনি ১৯১৬ –তে নোবেল প্রাপ্ত হন, দৃঢ় ভাবে বলেছিলেন যে, গেটের কয়েকটি মাত্র কবিতা পড়েই বোঝা যায় যে তাঁর বিরাটত্ব কত যদিও তাঁর সব লিখা পড়িনি। ঠিক তেমনি নিশ্চিত ভাবে গীতাঞ্জলির মাধ্যমে যুগের সেরা একজন কবিকে আবিষ্কার করি । সেখানে একটি পাল্টা যুক্তিও খাঁড়া হয়েছিল, মূল জার্মানে গ্যেটের কবিতা পড়ার পর তা বুঝে গেটেকে মহান জার্মান কবি বলে মানা এক কথা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতা শুধু তাঁর ইংরেজি অনুবাদে পড়ে বোঝা অসম্ভব যে, তিনি একজন মহান বাঙালি কবি।
পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশে বিদেশে গীতাঞ্জলির অনুবাদ লিখিত হয় সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবার ফরাসি কবি আদ্রে জিদের কথা বিশেষ করে উল্লেখ করে আবার পুনরাবৃত্তি করি। রবীন্দ্রনাথ স্বল্প পরিসরে বিশাল জীবন বোধকে একত্রে করে কবিতার ভেতর দিয়ে অত্যন্ত সংহতভাবে প্রকাশ করেছেন যা কিনা ভারতীয় ভগবৎ তত্ব বা ভারতীয় জীবন বোধের নির্জাস বলেই খ্যাত হয়েছে। কাজেই তিনি বলেই ফেলেছেন ‘মহা ভারতের ২১৪, ৭৭৮টি শ্লোক এবং রামায়ণে ৪৮,০০০টি শ্লোকের পর “গীতাঞ্জলি” –আঃ কি আরাম! হায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌলতে ভারতবর্ষ অবশেষে স্বল্পতাদোষে দুষ্ট হইতে হইল—সে জন্য আমি তাঁহার নিকট কত না কৃতজ্ঞ! এই যে দৈর্ঘের বদলে মহার্ঘতা, ভারের বদলে সার—এ পরিবর্তনে আমাদের কত না লাভ; কারণ গীতাঞ্জলির ১০৩টি ক্ষুদ্র কবিতার প্রায় সবকটি যথেষ্ট সারগর্ভ।’ আদ্রে জিদের আরও একটি বক্তব্যে গীতাঞ্জলির সার্থক প্রশংসা অর্জিত হয়েছে ‘জীবনের তাৎপর্য সম্পর্কে ঠাকুর মশাইয়ের কি মতামত সে তথ্য উদঘাটিত করবার যোগ্যতা আমার নাই এবং থাকিলেও আমি চেষ্টা করিতাম না—সংক্ষেপেও নহে। তাঁহার একটি বিশেষ কারণ এই যে, তিনি উপনিষদের ধর্মতত্ত্বের কোন প্রকার বদল করিতে বা তাহাতে কোন প্রকার অভিনত্ব আরোপ করিতে সম্পুর্ণ নারাজ। এবং সে ধর্মত্ব আর যাহাই হোক নূতন একেবারেই নহে। সুতরাং এ স্থলে আমি সে-তত্বের প্রতি ভক্তি প্রকাশ করিতে বসি নাই। কিন্তু ঠাকুর মহাশয় যে আবেগ দ্বারা তাহা সঞ্জীবিত করিয়াছেন ও নিখুঁত নৈপণ্যের সহিত তাহা প্রকাশ করিয়াছেন, তাহাতেই আমি মুগ্ধ।’ কবি ও শিল্পী রবীন্দ্রনাথ এইভাবে তাঁর কাছে বিরাটত্বের মহিমায় উপস্থিত হয়েছেন।
এজরা পাউন্ডের মতো কট্টর সমালোচকও উচ্ছ্বাসিতভাবে বলেছেন ‘এ কবিতার ছন্দসৌকর্যের শিল্পকর্ম ও তাঁর সংগীতই প্রধান বলে প্রতিভাত হয়েছিল। ‘এ কবিতা পড়তে হবে আস্তে আস্তে, নিস্তব্ধ শান্তিতে, চেঁচিয়ে। কারণ এর ইংরেজি অনুবাদ লিখেছেন একজন বিরাট সঙ্গীতকার, একজন ওস্তাদ শিল্পী যার কারবার আমাদের চেয়ে অনেক সূক্ষ্ম সংগীত নিয়ে।’ তিনি বাংলাদেশের কথা নিয়েই কিন্তু শুরু করেছেন, ‘কোথায় আরম্ভ করব ভাবছি। বাংলাদেশে পাঁচ কোটি লোক। বাইরে থেকে মনে হয় রেল গাড়িতে আর গ্রামোফোনে এরা বুঝি ডুবেছে। কিন্তু এর তলায় আছে একটা সংস্কৃতি, যার সঙ্গে তুলনীয় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রভোজ (Provence)।’ এমন কি গীতাঞ্জলি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বাংলাভাষা সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণও দিয়েছেন। তিনি বলেন বাংলা ভাষা সংস্কৃত হলেও এর আওয়াজ শুদ্ধ গ্রীক ভাষার কাছাকাছি প্রায়। বাংলাভাষা বিভক্তি মূলক, তাই এতে মিল সহজ। গ্রীক ও জার্মানের মত বাংলাতে সমাস বা সন্ধি চলে । আমাদের বাংলা ভাষাকে নিয়ে তিনি যে মূল্যবান বক্তব্য তুলে ধরেছেন সে কথাগুলোকে তাঁর আলোকে বললে আমাদের বাংলা ভাষা যে কতখানি সমৃদ্ধ তা বুঝতে সক্ষম হব। তিনি বলেন,‘এসব দিয়ে দেখাতে চাই যে বাংলা ভাষার কবিতার সহায়, এর তারল্য এবং ব্যাকরণের নমনীয়তায় শব্দের সার্থক তীক্ষ্ণতা আনা যায়। এ ভাষায় কথার পারম্পর্য এদিক ওদিক করা যায়, ইংরেজির মত অর্থের গোলমাল না করে।’ রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির অনূদিত কবিতাগুলোর মধ্যেই এজরা পাউন্ড অত্যন্ত উৎকৃষ্ট গদ্য ছন্দের ব্যবহার দেখেছিলেন এবং তাঁর ভেতর দিয়ে বাংলা সংস্কৃতি তাঁর কাছে যেমন মনে হয়েছে তাই বলেছেন, ‘কিন্তু এর ভেতরে আরও ঘিরে আছে একটা বিচিত্র শান্ত স্থিরতা। হঠাৎ আমরা খুঁজে পেলাম আমাদের নতুন গ্রীস।’
ইয়েটস গীতাঞ্জলির ভুমিকার মাধ্যমে বাঙালি জীবনকে আশীর্বাদ করে গেছেন । তিনি বলেছেন, If the civilization of Bengal remains unbroken, if that common mind which –as one divines –runs through all, is not, as with us, broken into a dozen minds that know nothing of each other, something even of what is most subtle in these verses will have come, in a few generations, to the beggar on the roads.
গীতাঞ্জলির মাধ্যমে নোবেল পুরস্কার শুধুমাত্র চমৎকৃত ঘটনা নয়, বিশ্বের দরবারে কবিতাগুলির মাধ্যমে বাঙালির পুরো স্বত্বা একটা সার্বিক পরিচিতি পেয়েছে বিশেষত বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির বৈশিষ্টকে ধরেই। অতি সাধারণ বা সহজ করে উন্নত জীবন বোধকে মানব সাগরের তীরে তুলে ধরার শক্তি রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। এ যেন একটি ঝর্ণা ধারার ভূবন যা তিনি তাঁর মরমিয়া বাণীর মধ্যে দিয়ে অবলীলায় বোধগম্য করে তুলেছেন। এখনও আমরা রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই বিশ্বের অনেকখানি অবলোকন করি। আমাদের জীবনবোধের মধ্যে আমরা রবীন্দ্রনাথকেই সদা প্রত্যক্ষ করি সমগ্র বাঙালি জাতির আসন্ন কল্যাণকে প্রার্থনা করে।
![]() |
| পরিচিতি |
ঝিলিমিলি
Reviewed by Pd
on
নভেম্বর ২১, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
নভেম্বর ২১, ২০১৪
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন