শ্রীচরণেষু বাবা,
আজও মহালয়া।সেই ভোররাত থেকেই নীচের ঝুপড়িগুলো থেকে মহিষমর্দিনীর সুর ভেসে আসছিল।আর সেই গানের সুর আর ভাষ্যপাঠের যুগলবন্দী আমার মনের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছিল। একটা কান্নার স্রোত আমার বুকের ঠিক মাঝখান থেকে উঠে আসছিল। সেই স্রোতে ভেসে ফিরে আসছিল অতীতের কত স্মৃতি,সত্ত্বার কতো স্বর্ণকণা। বাবা,আজ বড়ই তোমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।আজ চোখের জলেই তোমার স্মৃতিচারণ করবো আমি।জান বাবা আমার এখনকার ফ্লাটটা শোভাবাজারে। আমার দক্ষিণ দিকের জানলাটা থেকে গঙ্গা দেখা যায়। কাছেই ঘাট। তবুও বাবা আজ গঙ্গায় গিয়ে আরও শত মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে পূর্বপুরুষের স্মৃতি-তর্পণ করতে পারবোনা আমি। কারণ অন্যদিনের মতো আজও সকাল ঠিক সাতটা কুড়িতে আমাকে অফিস বাসে উঠতে হবে। একটা ছুটিও আমি এখন নিতে পারবোনা; কারণ আমার নামী কোম্পানি আমাকে এক সপ্তাহ আগেই জানিয়ে দিয়েছে তারা নাকি আমার কাজে সন্তুষ্ট নয়। এখন আমার হাতে পিঙ্ক স্লিপ। এখন আমি বেঞ্চে বসি।
জীবনে কোনদিন কোন কাজে ফাঁকি দিতে শেখাওনি তুমি। প্রতিটি কাজ নিষ্ঠা যত্ন নিয়ে করতে শিখিয়েছিলে।সে পড়া হোক বা খেলা।আমাদের গাঁয়ের সব্বাই তোমাকে একডাকে চিনত। একে হেডমাস্টারমশাই তার ওপর এমন দিল-দরদী,পরোপকারী মানুষ সে তল্লাটে আর একজনও ছিলনা। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের বড় আপনার জন ছিলে তুমি।মা বলতেন তুমি নাকি অজাতশত্রু। কী শান্ত,নির্বিরোধী অথচ কর্মঠ মানুষ ছিলে তুমি,দেখলে মনে হতো বেঁচে থাকার আনন্দটাই তোমার জীবনের একমাত্র অভিপ্রায় ও উদ্দেশ্য। তোমার তপ্তকাঞ্চন বর্ণ,ঋ্জু দেহ আর অনাবিল উদাত্ত কণ্ঠ সকলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। কতো দেশ বিদেশের গল্প ,ইতিহাস জানতে তুমি।বেদ-পুরাণ,রামায়ণ-মহাভারত থেকে শুরু করে ইংরাজি সাহিত্য সবেতেই ছিল তোমার অগাধ পাণ্ডিত্য।তোমার মুখ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস,ফরাসী বিপ্লবের কাহিনী,ভাষা আন্দোলনের শত শহিদের রক্ত ঝরানোর ইতিবৃত্ত,আঙ্কেল টমের গল্প শুনতে শুনতে আমার গায়ে কাঁটা দিত। তুমি বলতে জীবনের প্রতিটি অঙ্গীকারের সঙ্গে সত্যকে জড়িয়ে রাখতে।সেটাই তো করে এসেছি বাবা তবু কেন আজ মিথ্যাবাদী,চাটুকাররা তাদের বিপুল আধিপত্য,ক্ষমতা ও কৌশলকে সঙ্গী করে এগিয়ে যাচ্ছে?
বাবা তোমার মনে আছে ঠাকুমা যে বছর চলে গেলেন আমার তখন ক্লাস ফোর।সেদিন জীতাষ্টমী।সেই শরতের ভোরে হঠাৎ মায়ের কান্নায় ঘুম ভেঙে উঠে দেখি ঠাকুমার নিথর দেহটা আমাদের শিউলিতলায় নামানো।সেই প্রথমবার তোমাকে কাঁদতে দেখেছিলাম বাবা।অস্পষ্টস্বরে বলেছিলে-"মাকে ওখান থেকে সরিয়ে দাও নীভা।মায়ের গায়ে শুয়ো পড়বে।ওখানে বড্ড শুঁয়োপোকা।"তারপর যখন ম্যাটাডোর এলো ঠাকুমার দেহটা নবদ্বীপ নিয়ে যাবার জন্য তখন তুমি বললে-"তোমরা দুভাই তৈরি হয়ে নাও।চলো ঠাকুমাকে নবদ্বীপে রেখে আসি।"বিলু তখন খুব ছোট।ও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।তারপর নবদ্বীপের ঘাটে ঠাকুমার মুখাগ্নি করে তুমি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলে।আমরা দুভাই তোমার দুপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থেকেছি শুধু।
তারপর থেকে প্রত্যেক মহালয়ার দিন আমাকে সঙ্গে করে তুমি নবদ্বীপ যেতে তর্পণ করতে।আগের দিন মনে করিয়ে দিতে যাবার কথা। তারপর ভোররাতে মহিষমর্দিনী শুরু হবার খানিক পর কাঁধের ঝোলাটা আর টর্চ নিয়ে মাঠের আলে আলে বন-বেগুন,মাঠ-কলমি আর কচুর বন পেরিয়ে একেবারে খড়ি নদীর ঘাটে। পলাশদা আগে থেকেই নৌকো নিয়ে প্রস্তুত থাকতো। তারপর সেই আধো অন্ধকারে নৌকো বেয়ে শুরু হতো আমাদের যাত্রা।ফিরতে ফিরতে দুপুর বারোটা বেজে যেতো। বিলুর ওদিন খুব আনন্দ ছিল।তোমার সাইকেলটা হাফ প্যাডেল করে সারা গাঁ ঘুরতো।আর ঘাটে আমরা নেমেছি জানলেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে লক্ষী ছেলে হয়ে যেত।মা একটা পিতলের জগে সরবত করে রাখতেন। কাগজী লেবুর গন্ধটা পেতাম নাচ-দুয়ার থেকেই।আমাদের গ্লাসে সরবত ঢেলে দিতে দিতে মা বলতো-"বাইরে খুব রোদ না গো? " আমরা দুভাই শরবত খেতাম দাওয়ায় বসে।তুমি মাকে বলতে-"তুমি শরবত খাবেনা?"মা বলতো-"আমি তো ঘরেই ছিলাম।তোমরা খাও।তেতেপুড়ে এলে সব। "তুমি বলতে-"যাও যাও আর একটা গ্লাস নিয়ে এসো।"তারপর নিজের গ্লাস থেকে অর্ধেকটা ঢেলে দিতে মায়ের গ্লাসে।এমনি ছিল তোমাদের বোঝাপড়া,ভালোবাসা।
এমনি করেই তো দিন চলে যাচ্ছিল। আমার পড়ার চাপ বাড়ছিল আর বিলুর দুষ্টুমি। হায়ার সেকেন্ডারির পর আমি যাদবপুর চলে এলাম। তুমি এসে ভর্তি করে দিয়ে গেলে আর পইপই করে বলে দিলে যেন সাবধানে থাকি। তারপর প্রতি রবিবার নিয়ম করে দেখতে আসতে আমাকে।
কিন্তু সেবার থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা চলার সময় তুমি পর পর দুটো রবিবার এলেনা।আমার অস্বস্তি হচ্ছিল খুব।চিন্তাও।তাই পরীক্ষার শেষের দিন আধ ঘণ্টা আগেই পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে রাত সাড়ে এগারোটায় বাড়ি পৌঁছালাম।সদর দরজায় কড়া নেড়ে "বিলু বিলু" করে ডেকেছি।তুমি দরজা খুলে দিলে।হ্যরিকেনের আলোয় দেখেছিলাম তোমার মুখে একবিন্দুও আলোর রেখা নেই।জীবনে সেই প্রথমবার দেখেছিলাম অপার বিষাদের প্রতিমূর্তি তোমাকে।আমাকে দেখে মা ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।তুমি বললে-"আজ নদিন বিলু নেই।খড়ির স্রোত ওকে ডেকেছিল।তোমাকে জানাইনি। তোমার পরীক্ষা চলছিল বলে।"তারপর সারারাত দুয়ারে বসে কেঁদেছি আমরা তিনজন।আমার ভাইটা দামাল দুষ্টু বিলু যার অসম্ভব প্রাণশক্তি সে যে এভাবে হারিয়ে যাবে ভাবিনি কোনদিন।আমাদের পাঁচজনের সংসারে তখন মাত্র তিনজন।পরদিন ভোরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম খড়ির ঘাটে।আমাদের শান্ত নদীটা বর্ষার জল পেয়ে তখন ভরভরন্ত,খরস্রোতা।ইচ্ছা হল চেঁচিয়ে দাকি-"বিলু কোথায় তুই?ভাই ফিরে আয়।"তারপর আবার অতলান্ত বিষাদে ডুবে যেতে যেতে ফিরে এসেছি ঘরে।
তিনদিন পর ফিরে এলাম হস্টেলে। তুমি তোমার স্কুল আর স্কুলের ছেলেদের নিয়ে আরও বেশী সময় কাটাতে লাগলে। স্কুলের জন্য,ছাত্রদের প্রয়োজনে নিজেকে উজাড় করে দিলে। আর বিলু নেই বলে মা'র আর কোন কাজ রইলোনা। সকাল আটটার মধ্যে ঘরের কাজ শেষ করে সারাদিন মা জানলা দিয়ে খড়ির দিকে তাকিয়ে কাঁদত।
আমাদের আনন্দের বাড়িটা আস্তে আস্তে কেমন যেন স্তব্ধ নিশ্চুপ হয়ে গেল। মায়ের ছুঁচ সুতোর কৌটো,উল কাঁটা অনাদরে পড়ে রইল। তারপর মাও চলে গেল দুদিনের জ্বরে। মায়ের মতো নরম মনের মানুষ এতবড় ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেনি।বাঁচার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলেছিল মা। তুমি এতকিছুর পরও আমাকে সঙ্গ দিয়ে গেছো,সাহচর্য দিয়েছ। আস্তে আস্তে আমরা একে অন্যের সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম।
মাঝে মাঝে গুন গুন করে গাইতে "তোমার মহাবিশ্বে কিছুই হারায়না তো কভু"। সত্যি করে বলতো বাবা এই মহাবিশ্বে সত্যিই কি কেউ কোথাও হারায় না? আমার এই জীবনটাতে শুধু যে সবকিছু হারিয়ে ফেলছি বাবা। যদি কেউ না-ই হারায় তবে কেন একে একে ঠাকুমা,বিলু,মা,তুমি আমাকে এভাবে একা করে দিয়ে ঐ মহাশূন্যের আলোকবর্তিকায় হারিয়ে গেলে? কেন বাবা কেন.....................
![]() |
| লেখিকা পরিচিতি |
দেবপ্রিয়া চট্টোপাধ্যায়
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২৩, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২৩, ২০১৪
Rating:


besh bhalo hoyeche
উত্তরমুছুন