শুক্লাসান্যাল





লাল ইটিয়স কারটা সুধীর সাহার বাড়ির সামনে এসে যখন দাঁড়ালো তখন বাড়ির সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিবেশীরা। নয়নতারা গ্রামের সাহাদের বাড়ি সচরাচর প্রতিবেশীরাকেউ যায় না। কারন তাদের বিন্দুমাত্র সুনাম নেই।যেমন দুর্বিনীত তেমন অহংকারীআর কটূভাষী।পড়ার লোক ওদের এড়িয়ে চলে।কিন্তু আজ না এসে পারেনি।ওদের জন্য নয়।ওদের বাড়ির কচি বউটার জন্য। বছর আঠারোর বউটা আজকেই বিধবা হয়েছে।গঙ্গার ঘাটে এয়োতির চিহ্ন সব মুছে দিয়ে কোন এক বিধবা আত্মীয়ার সঙ্গে সে ঘরে ফিরল।সাদা থান পরাভেজা এলোচুল। কপালে একটা গঙামৃত্তিকার ফোঁটা।শান্ত ভাবলেশহীন দুটি আয়ত চোখ। যেন মূর্ত্তিমতী তপস্বিনী।দীর্ঘ তপশ্চর্যায় শীর্ণ ক্লান্ত। প্রতিবেশীরা সমবেদনা জানালো নীরবে।বাড়ির ভয়ে কেউ টুঁ শব্দটিও করলো না।

পাশের বাড়ির দোতলার ভাড়াটে বিপিন গ্রামের হাইস্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক সেও জানলায় এসে দাঁড়িয়েছে।একবছর ধরে এই মেয়েটির যন্ত্রনার নীরব দর্শক সে। প্রতিদিনই মেয়েটি কাপড় শুকোতে দিতে ছাদে আসত। মুখে তো কথা নেই শুধু করুণ দুটি চোখ দিয়ে শুনিয়ে যেত তার লাঞ্ছনার দিনলিপি।তার গুণধর স্বামীটি যার আজই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হয়েছে সে তো ছিল একটা পাষণ্ড। পাঁড় মাতাল হেন গুণ নেই যা তার ছিল না।বউ পিটিয়ে পৌরুষ দেখানো ছিল তার বড় কাজ।এছাড়া রণচন্ডী শাশুড়ী ওষন্ডামার্কাদেওরটির অত্যাচার। গায়ে গরমজল ঢেলে দেওয়া,আঙুলে সূঁচ ফুটিয়ে দেওয়াঅত্যাচারের নিত্যনতুন কৌশল শাশুড়ির জানা ছিল।স্বামী দেবতাটি শুধু মেরেই ক্ষান্ত হতো না,ওই অবস্থাতেই তার শারীরিক চাহিদা মেটাতে হবে। নীরবে সহ্য করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

এসব কথা বিপিন শুনেছে বাড়িওয়ালি মাসীমার কাছে।মাসীমার কাছেই শোনা মেয়েটির নাম আলো।একদিন বিপিন নিজেই বলেছিল- মাসীমা আমরা তো মেয়েটির জন্য কিছু করতে পারি? থানা পুলিশ কিংবা নিজেরা গিয়েও তো প্রতিবাদ করতে পারি? এ অন্যায় তো সহ্য করা যায় না।মাসীমা কঠিণসুরে বলেছিলেন দ্যাখো বাপু! সুখে খেতেভূতে কিলোচ্ছে কি তোমাকে?তোমাকে একটা সাফ কথা বলি শোনঐ থানা পুলিশ আইন আদালত সবই ওদের ট্যাঁকে,নইলে কি পাড়ার লোক চুপ করে থাকে? পয়সা পয়সা বুঝেছ? ভদ্র লোকের ছেলে ভদ্রভাবে থাকো ওসব ছোটলোকমিতে যেও না।আর নেহাৎই যদি কিছু করতে চও তো আমার বাড়ি ছাড়তে হবে।ওরাপারে না এমন কাজ নেই। মাসীমা আরও জানায় দাস পাড়ার একটি ছেলে জোর প্রতিবাদ করেছিল কি ফল হল তাতে বেচারা ছেলেটা সেইযে নিখোঁজ হল আর এল না। কে জানে বেঁচে আছে কিনা। মাসীমার কথায়তখনকার মতো চুপ করে গেলেও তার পৌরুষ আহত হয়েছে। বারবার ভেবেছে কি করে বাঁচানো যায় মেয়েটিকে।

আচ্ছা মাসীমা মেয়েটিকে মানে আলোকে কোনক্রমে বাপের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া যায় না? বিপিন জিঞ্জাসা করে।হা আমার পোড়া কপাল মাসীমা মাথায় হাত দিয়ে বলেন, ওর যে তিনকূলে কেউ নেই।সৎমা টাকার লোভেএই পাষন্ডদের বাড়িতে বিয়ে দিয়েছে। বিয়ের পর একবেলার জন্যও নিয়ে যায়নি। এক অন্ধকার থেকেআরেক অন্ধকার। মেয়েটির নামেই আলো  আলোর মুখ সে দেখলে কোথায়? বিপিনের বুকটা মুচড়ে ওঠে।

মোচড়ানোরই কথা।আলোর  যা রূপতাতে তার নাম সার্থক কিন্তু জীবন অন্ধকার। কোনো আলো নেই।একটু একটু করে আলোর যন্ত্রনাগুলো কখন যে বিপিন নিজের করে নিয়েছিল সে নিজেই জানে না।তাতেইতো বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। একটি কথাও দুজনের মাঝে হয়নি ওই নীরব চাহনিটুকু ছাড়া তাতেই যে কখন আলোর সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বিপিন নিজেও জানে না। তার বারবার মনে হয় নিজের সবটুকু সুখ দিয়ে যদি আলোর সব দুঃখগুলো শুষে নিতেপারত।আলোর নীরবচাহনি অহর্নিশতাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।আজও একবার বুঝি আলো তার ঘোমটারফাঁক দিয়ে একবার চাইল। আবার মুচড়ে উঠল বিপিনের হৃৎপিন্ড।

কই গো বউ পাথর হয়ে গেলা নাকি? চল চল। সব মজা দেখার জন্য দাঁড়িয়েআছে দ্যাখো। আলো ও প্রতিবেশীদের উদ্দেশ্য বাক্যবাণ ছুঁড়ে দেয় আত্মীয়াটি।আলো  নিঃশব্দে অনুসরণ করে আত্মীয়াটিকে। বিশাল সদরদরজা সশব্দে।

প্রায় একমাস পার হয়েছে।আলোর স্বামীর শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেছেবাইরে থেকে আত্মীয় কুটুম্বিতা এসেছিল।আলো কিন্তু এই একমাসেএকদিনও ছাদে আসে নি।বিপিনের তখন পাগল পাগল অবস্থা।

আলোর চাপা কান্নার আওয়াজ এবং শাশুড়ি দেওরের তর্জন গর্জন কানে আসে। বিপিন নিজেকে স্থির রাখতে পারেনা।ঠিক করে সরাসরি ওদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হবে।দেওয়ালীর ছুটি পড়েছে বিপিন বাড়ি যায়নি। আলোকে ছেড়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।

আজ দীপাবলি।ঘরে ঘরে আলোর উৎসব ...
গ্রামের মন্দিরে কালীপূজো। সবাই প্রায় ব্যস্ত।শুধুমাত্র বিপিন স্থির। সে জানলায় মুখ দিয়ে আলোর বাড়ির ছাদেরদিকে চেয়ে আছে।চোখফেটে জল আসছে তার।মাসীমা খেতে ডেকেছেন অনেকবার।বিপিনকে কে যেন পেরেক গেঁথে বসিয়ে রেখেছে উঠতে পারছে না সে। ইতিমধ্যেই বীভৎস আর্তনাদ।আলো আলোর কান্না।বিপিন উৎকর্ণ হয়ে শোনে।

খুলে যায় সদর দরজা।শাশুড়ি চুলেরমুঠি ধরেছেঁচড়ে বের করছে আলোকে আর দেওর সমানে লাথি কিল চড় চালাচ্ছে।
হারামজাদি! আমার ছেলেকে তুই খেয়েছিস একদিনের জ্বরে ছেলেটা আমার মরে গেল।তোর বাঁচার কোন হক নাই। মর মর সব্বনাশী। শাশুড়ির প্রবল গর্জন।দেওর লাথি মারতে বলে শালীকে মেরেই ফেলবো। আলোর পরিত্রাহি চীৎকার
আর মেরো না আমাকে তোমরা যা বলবে তাই করবো। আমি কোথায় যাবোআমার যে কেউনেই।জাহান্নামে যা। দিব্য তো গতরখান আছে তাই খাটিয়ে খা গিয়ে।

আলো দুহাতে কান চাপা দেয়। শাশড়ির বর্ষণ তখনো চলছে। বিপিন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার বাস্তব চেতনা যেন লোপ পেয়েছে।

ইতিমধ্যে দেওর একখানা জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে হাজির। বল ছেনাল! কোন নাংকে চিঠি লিখছিলি? ওই মাষ্টারকে?  তোকে বাঁচাবে? কোথায় সে শুয়োরের বাচ্চা? বিপিনের কাছে সব পরিস্কার হয়ে যায়। সে সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে। না আর নয় বিপিন নামতে থাকে গেটের তালা বন্ধ। মাসীমা তালা খোলো শিগগির আলোকে ওরা মেরে ফেলল।

বিপিন এসে দাঁড়িয়েছে এসেছে মাসীমাও। আলো তখন জ্বলছে। সদর দরজা বন্ধ। কে যে একটা কম্বল দিল বিপিন দ্যাখেনি সেটা দিয়েই আলোকে জড়িয়ে ধরেছে  আমি এসেছি আলো  তোমার কিছু হবে না। বিপিন পাগলের মতো বলতে থাকে। আমি বাঁচতে চাই মাষ্টার আমাকে বাঁচাও। সে কথাটাই তো লিখে রাখালের হাত দিয়ে পাঠাচ্ছিলাম তোমাকে। ওরা দেখে ফেলল। কোন রকমে বলল আলো। পাদুটো বেশি পুড়েছে। অসম্ভব জ্বালা। তবুও মুক্তির আনন্দে আলো যন্ত্রনা ভুলেছে। মাসীমার জিপ গাড়িতে করে সদর হাসপাতালেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আলোকে। কতক্ষণ পার হয়েছে বিপিন জানে না পরে কি হবে সেটাও তার জানা নেই। তার একটাই চিন্তা আলো বাঁচবে তো? আলোকে যে সত্যিকারের আলো দেখাতে হবে!

জল! একটু জল আলো ক্ষীনস্বরে বলে বিপিন হক্চকিয়ে ওঠে। গাড়িটা তখন বার্নওয়ার্ডের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।


 লেখিকা পরিচিতি
শুক্লাসান্যাল   শুক্লাসান্যাল Reviewed by Pd on অক্টোবর ২৩, ২০১৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.