(একাঙ্ক নাটক। চরিত্রঃ খেপলু, মেয়েটি, পুলিশ অফিসার, বৃদ্ধ)
( সময় সন্ধ্যা। সূর্যাস্তের শেষ কিরণ এসে পড়েছে। একদিকে একটা ছোট বোর্ডে লেখা এখানে বাস থামিবে। মঞ্চের একদিকে একটা বন্ধ চায়ের স্টল। সেখানে লেখা এখানে সাইনবোর্ড, গাড়ীর নম্বর প্লেট লেখা হয়। সিমেন্টের বেঞ্চ। অন্যদিকে একটা পাথর। যাত্রীরা সেটা বসার জায়গা হিসাবে ব্যবহার করে। একটি বছর পঁচিশের মেয়ে ঢোকে। পরনে শস্তার জামাকাপড়। হাতে বড় চটের বাঃ নাইলনের থলিতে জিনিসপত্র ভর্তি। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটি খুবই ক্লান্ত। কয়েক পা এগোয় আর একবার করে হাতের থলিটা নামিয়ে রাখে। এদিক ওদিক তাকিয়ে পাথরের ওপর বসে। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ওঠে। কান্না থামলে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে থাকে। অপরদিক থেকে বছর ত্রিশ পঁয়ত্রিশের একটি লোক ঢোকে। মেয়েটিকে লক্ষ্য করেনা। এদিক ওদিক তাকিয়ে দোকানের বেঞ্চিতে পা তুলে বসে। )
লোকটা – (পায়ে চড় মেরে মশা মারে) খা শালা – তুইও খা। সবাই তো চুষছে। তুইই বা বাদ যাস কেন? এঁকে তো শালা সারাদিনে পেটে পড়েছে মাকড়া মার্কা গোল্লা রুটি একটা আর হাবুর দোকানের এক চামচ ঘুগনী। শালা ওতেই চালাও পানসি মাঝ দরিয়ায়। মাইরি, এই ইসটেরাইক গুলো কোন মাকড়ারা ডাকে? কোথাও কিছু নেই, দু একটা বড় চাপড়। ব্যস! অমনি বাস ইসটেরাইক – বনধ। আর আমাদের কি হবে সেদিকে কোনো শালার হুঁশ নেই। সারাদিনে পেটের মধ্যে হা ডু ডু। নেহাৎ ওই ইসটেট টা ইদিকে এক খেপ উদিকে এক খেপ দিল তাই এই তিনটে আমদানী হল।(তিনটে মানিব্যাগ বার করে) নাহলে যে... শালা কি ভিড় মাইরি! বাম্পার! ইস এরকম ভিড় রোজ থাকে, তবে খেপলু ওস্তাদের তিনমাসে তিনমহলা। তবে আজ কিন্তু সেকেন টায় ঝাম্পু হতে হতে বেঁচে গেছি জোর। শালা মাল হাতিয়ে নেমেছি, আর পাবলিক চিল্লাতে শুরু করেছে- ব্যাগ কই... ব্যাগ কই? আরে শালা! টাকা কি কারুর বাপের? তোর পকেটে থাকলে তোর, আমার পকেটে থাকলে আমার। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে কাটতে পেরেছি। দেখি আজকের কামাইটা কি হল! (একটা একটা করে মানিব্যাগ গুলো খোলে) ইকিরে শালা! মাল কই? খালি গোছা গোছা কাগজ। মানিব্যাগে মানি নেই। কাগজব্যাগ। এ... এটা কি দশ টাকার নোট! মোটে একটা! ব্যাস! আর এই এক...দুই...আড়াই...তিন টাকা পঁচিশ পয়সা। ব্যাস! ই মাইরি কি পাবলিক! টাকা নেই তো অতো বারফাট্টাই এর দরকার কি বাপ? শালা মানিব্যাগ রেখেছে পকেটে। ইদিকে পকেট শালা জিটি রোড। ফোট শালা! এটা দেখি... এটা আবার কি রে বাপ? আরে গেল ওস্তাদ ভোগে। যা শালা...এটা তো মানিব্যাগই নয়। যোগের মেশিন কালকুটার। শালা ধোঁকা। ওপরটা এমন বানিয়েছে যে খেপলু ওস্তাদ কে ফাঁকি মেরে দিল। বাঃ রে গুরু বাঃ! আচ্ছা মাল বানিয়েছো বাপ! এটা এখন কি হবে? (একটু ভাবে) থাক শালা। যা পাই বিশ তিরিশ, সেকেনহ্যান দামে ঝেড়ে দিতে হবে। আজকের কপালটাই শালা খারাপ। দেখি এটায় কি কি আছে! (তৃতীয় মানিব্যাগটা খোলে) দুস শালা এতেও দেখছি কাগজ! আরে এটা কি রে...! (একগোছা টাকা বার করে) ইররররি... টাকা রে! গোছা গোছা পাত্তি। আরে শ শালা... পানশো একশো (গোনে) ...পান-এক-ডের-দুই-আড়াই-ছয়-সাত-আঠ-নয়-দশ... (টাকা মাথার তুলে হাত ঘুরিয়ে নাচতে শুরু করে। ইল্লি ইল্লি খাজা/খেপলু ওস্তাদ রাজা/মার দিয়া কেল্লা/তিনের পিঠ তিন গোল্লা। জয় বাপ পকেটমারেশ্বর কি জয়! হাঁটুতে চাপড় মারে। আজ গাবু শুঁড়ির দোকানে একটা বড় মাল লিয়ে বসতে হবে। শালা কার মুখ দেখে আজ উঠেছিলি রে খেপলু? নাহ, আর এখানে নয়। নেহাৎ আজ বাস ইসটেরাইক। তাই রোডে লোকজন নেই। এই মাল গুলোর গতি করে দিই। (রাস্তায় খালি ব্যাগগুলো ফেলে। আবার কি চিন্তা করে কুড়িয়ে নিয়ে দোকানের ভেতরে ফেলে দেয়।) নাহ, এখানে ফেলা যাবেনা। শালা ডেলাইটে কেউ দেখলে হুজ্জোত বাঁধবে। তারচে শালা এই ভেতরে ফেলি। কাল যখন দোকান খুলবে, তখন কেউ দেখলে খেতি নেই। চল ওস্তাদ, ভাগো হিয়াসে। (যেতে গিয়ে মেয়েটিকে নজরে পড়ে। সে এতক্ষণ বিস্ফারিত চোখে ওর কার্যকলাপ দেখছিল। এবার চোখাচোখি হতেই ভয়ে সিঁটিয়ে যায়) আরি আরি... এ মাল আবার কে বে? উই শালা ইসটেরাইকের দিনে এখানে ল্যাম্পপোস্টের মত দাঁড়িয়ে। লাইনের মাল নাকি বে? কি? কত রেট? আরে আজ চিন্তা নেই। কোনো ধারবাকি থাকবে না। আজ খেপলু ওস্তাদ রাজা। কত রেট বে? (কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিতে যায়। মেয়েটি তড়িৎগতিতে অন্য দিকে সরে যায়। ভয়ার্ত ভাব) ই কি বে! এত সতীপনা কিসের এই ফাঁকায়? কোথাও কুকুর বেড়ালও নজরে নেই! এখানে খালি হাম আউর তুম – দেব আউর ঝুম্পুস মেঘনা... মেরে থুম্পুনা... অমন পান্তার মত মুখ করে দাঁড়িয়ে কেন গো? আরে পাত্তি দেব- পাত্তি। এই দেখ লোট হি লোট হ্যায়, (আবার কাছে যায়। মেয়েটি আর্তস্বরে চিৎকার করে ছিটকে সরে যায়) আই বাপ! গেরস্ত মালনাকি বে? (এদিক ওদিক তাকিয়ে) গেরস্ত মাল তো এখন এখানে কি করছ রানী? আরে কেউ যখন নেই, তখন একখেপ কামিয়ে লাও। খেতি কি? কত নেবে? গেরস্ত মালের রেট বেশি আমি জানি। কত নেবে বল? এক পাত্তি? ডের? দু পাত্তি? (কাছে যায়। মেয়েটি আবার পালানোর চেষ্টা করে, পারেনা। খেপলু খপ করে ওর হাতটা ধরে) এই মাইরি ন্যাকাপনা আমার ভালো লাগেনা। চল-গুমটির পেছনে যাই।
(মেয়েটি চিৎকার করে ওঠে। বাইরে থেকে একটা হাঁক শোনা যায়।)
- কে রে ? কি করছিস ওখানে?
(খেপলু চট করে হাতটা ছেড়ে দেয়। মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে দোকানের বেঞ্চির পাশে লুকোয়। সাদা পোষাকে এক পুলিশ অফিসার ঢোকে)
পুঃঅঃ – কে রে ওখানে? অ্যাঁ? কি করছিস ওখানে? আরে খেপলু না? এখানে কি ধান্দায়? পকেটমারি ছেড়ে এখন ছিনতাই ধরেছিস নাকি? এই তো গতমাসে ছাড়া পেলি, তবু শিক্ষা হয়না তোদের? থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে এমন ক্যালাব না যে বাপের নাম খগেন হয়ে যাবে। কি করছিলি এখানে?
খেপলু – (বিগলিত স্বরে) কিছু না স্যার, কিছু না। এই এমনি এমনি...
পুঃঅঃ – এমনি এমনি? পরিস্কার দেখলাম কার সঙ্গে ঝাপটা ঝাপটি করছিস? এমনি-এমনি?
খেপলু – (সটান সাষ্টাঙ্গ শুয়ে পড়ে) কি বলছে স্যার! আপনি আমার মা বাপ! থানার মেজবাবু আপনি। আপনাকে স্যার মিথ্যে বলব? আপনাকে মিথ্যা বললে জিব যেন খসে পড়ে আমার। বিশ্বাস করুন স্যার...
পুঃঅঃ – (পাছায় এক ঠোক্কর মারে) এই ওঠ ওঠ... অনেক ন্যাকামো হয়েছে। আরেকটা কে ছিল যাকে টানাহ্যাঁচড়া করছিলি?
খেপলু – (তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠে) বিসসাস করুন স্যার কেউ ছিল না। আমি তো স্যার একা একা ঝোকিং কচ্ছিলাম।
পুঃঅঃ – কি করছিলি?
খেপলু – ঝোকিং স্যার ঝোকিং (জগিং করতে থাকে) এই যে স্যার এরকম।জেলে স্যার রোজ রোজ ঝোকিং করে ওব্যেস হয়ে গেছিল। এখন স্যার রোজ রকটু করে না করলে গা কেমন ম্যাজম্যাজ করে। হে হে হে...
পুঃঅঃ – এই থাম-থাম! এমন জগিং করিয়ে দেব যে হাঁটু আর সোজা হবে না। (ঘাড় ধরে চড় মারে) আরেকটা কে ছিল?
খেপলু – মরে গেলাম স্যার! আর কেউ ছিল না স্যার। আপনি স্যার শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন স্যার। চলুন স্যার আপনাকে পৌছে দিয়ে আসি। বাজারে ভালো গলদা আছে স্যার।
পুঃঅঃ – তাই নাকি? আমাকে গলদা চিংড়ি কিনে দিবি তুই? দেখি দেখি তোর পকেটটা।
খেপলু – আরে না রে স্যার না...
পুঃঅঃ – (জোর করে ওর পকেটে হাত ঢুকিয়ে একগোছা টাকা বার করে) আরে! এত টাকা! কার টাকা? ছিনতাই...(কথা শেষ হয়না। খেপলু ঘাড় ছাড়িয়ে নিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে পালায়। অফিসার দৌড়তে গিয়েও থেমে যায়। চিৎকার করে বলে-) পালিয়ে কোথায় যাবি? আজ রাতের মধ্যে তোকে যদি লকআপে না ঝোলাতে পেরেছি তো আমার নাম বদলে দেব রে হতভাগা!
(উলটো দিক থেকে এক বৃদ্ধ ঢোকে। মাথার সব চুল সাদা। পরনে সাদা গেঞ্জি ও লুঙ্গি। মুখে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি।)
বৃদ্ধ – কি হয়েছে? চিৎকার করছেন কেন? কি হয়েছে এখানে? আরে, মেজবাবু না? নমস্কার স্যার। কি হয়েছে?
পুঃঅঃ – উঁ, না কিছুনা। ওই শালা খেপলু কাটার এই সদ্য গতমাসে ছাড়া পেল। আবার লাইনে নেমে পড়েছে।
বৃদ্ধ – খেপলু? এখানে? কিন্তু আজ তো বাস বন্ধ?
পুঃঅঃ – হ্যাঁ, সেটাই তো ব্যাপার। বাস বন্ধ, স্টপেজ ফাকা-শুনশান। এর মধ্যে ব্যাটা কার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছিল? মনে হয় এগুলো (টাকাগুলো দেখায়) ছিনতাই করেছে।
বৃদ্ধ – ও, তা এখন আর ওগুলো কি করবেন স্যার?
পুঃঅঃ – কোনগুলো? টাকাগুলো?
বৃদ্ধ – হ্যাঁ স্যার।
পুঃঅঃ – কি করব মানে? কি বলতে চাইছ? তোমার কি ধারনা এগুলো আমি আমার পকেটে পুরে নেব? কি ভাবো-অ্যাঁ? কি ভাবো তোমরা পুলিশকে?
বৃদ্ধ – (জিভ কামড়ায়) না স্যার, আমি তা বলছি না। আপনার সম্বন্ধে এখানে বাচ্চারা শুদ্ধু বলে দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। এখানে গরীবদের ডিসপেন্সারি, বাচ্চাদের খেলার মাঠ, আপনি না থাকলে হত? সবাই তো নিজের স্বার্থ নিয়েই আছে আজকাল। আমি তা বলিনি। বলছিলাম যে ওগুলো কার টাকা এবার জানবেন কি করে?
পুঃঅঃ – সে ঠিক বের করে নেব। পুলিশ ইচ্ছে করলে কি না পারে। কিন্তু ভাবলাম বাজারে যাব। শালা এসেছে, একটু ভাল মাছ টাছ কিছু নিয়ে ঢুকতে হবে। তা না, আবার এখন থানায় যেতে হবে। (যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়) নাহ, বাজারটা করেই নিই। তারপর থানায় গিয়ে এই টাকাগুলো জমা দিলেই হবে। (যেতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ায়। দোকানের দিকে তাকিয়ে বলে-) ওখানে কে? কে ওখানে? বেরিয়ে এস, বেরিয়ে এস বলছি।বেরিয়ে আয় হতভাগা, নইলে এমন প্যাদাবো যে বাপের নাম... (থমকে যায়) এ কি মেয়েছেলে! (আড়াল থেকে মেয়েটি খুব ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে আসে)
বৃদ্ধ – ওই এ কি! তুমি-আপনি...ওখানে কি করছিলেন? আমার দোকানে?
পুঃঅঃ – কি ব্যাপার? কি হচ্ছিল ওখানে? চুরির মতলব নাকি? অ্যাঁ?
বৃদ্ধ – কিছু পাবেন না-হাহাহা-কিছু নেই। কটা টিন, বয়াম,ব্রাশ আর রঙের কৌটো, কটা বিস্কুট আর চায়ের জিনিসপত্তর। হা হা হাভাতের ঘরে চুরি! বারে বাঃ!
পুঃঅঃ – এই থাম তো! কি ব্যাপার কোনো উত্তর নেই কেন? কি মতলবে ঢুকেছিলে ওখানে? বলো শিগগির? (মেয়েটি চুপ করে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে) বোবামি ছাড়িয়ে দেব থান্স্য নিয়ে গিয়ে। ওসব বোবা সাজার চালাকি করার চেষ্টা কোরোনা। কি ব্যাপার সাফ সাফ বলো! বলবে কি না? (একটু এগিয়ে যায়)
মেয়েটি – (কান্নাভেজা গলায়) আমাকে ঐ লোকটা-ঐ লোকটা...
পুঃঅঃ – অ্যাঁ! কোন লোকটা? কি ব্যাপার?
মেয়েটি – (আঙুল দিয়ে বাইরের দিকে দেখায়) ঐ লোকটা আমাকে... (কেঁদে ফেলে)
বৃদ্ধ – আরে কাঁদছেন কেন? ঠিক আছে-ঠিক আছে-কি হয়েছে-
পুঃঅঃ – আঃ! তুমি থামো। হ্যাঁ, ওই লোকটা-মানে যে এক্ষুনি দৌড়ে পালিয়ে গেল এখান থেকে? কি করেছে ও?
মেয়েটি – (ফুঁপিয়ে) ও আমাকে...
পুঃঅঃ – বুঝেছি। জোর করে টাকাপয়সা কেড়ে নিয়েছে? এই টাকাগুলো আপনার? (মেয়েটি মাথা নাড়ে) অ্যাঁ! আপনার টাকা নয়? আরে ভয়ের কিছু নেই। আপনার টাকা হলে ফেরৎ পাবেন। শুধু একবার ওর নামে রিপোর্ট লেখাতে হবে।
মেয়েটি – না ও টাকা আমার নয়।
পুঃঅঃ – আশ্চর্য! টাকাটা আপনার নয়? অথচ খেপলু... (হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে) বটে! তাহলে এই ব্যাপার! ঐ জন্যেই লিকিয়েছিলেন ওইখানে? (মেয়েটি মাথা নাড়ে) খেপলুর এতবড় সাহস! এই সন্ধেবেলায়... দাঁড়াও, আজ ওর চামড়া না তুলেছি তো...
বৃদ্ধ – কি ব্যাপার! কি ব্যাপার! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!
পুঃঅঃ – তোমার না বুঝলেও চলবে। দাঁড়াও আমি যাচ্ছি থানায়। আজ ওরই একদিন কি আমারই একদিন।
বৃদ্ধ – স্যার! বাজার! শালা...!
পুঃঅঃ –অ্যাঁ! ও হ্যাঁ, বাজারটা করতেই হবে। নাহলে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। প্রায় দেড় বছর পরে শালা এসেছে। মহা মুস্কিল! ঠিক আছে, আমি এই মাছের বাজারে যাচ্ছি। কোনো চিন্তা নেই। খেপলু আর কিছু করতে সাহস পাবেনা। আর সেরকম কিছু হলে আমাকে গলা তুলে ডাকবে। আমি দৌড়ে চলে আসব। (যেতে গিয়ে আবার ফিরে মেয়েটির কাছে আসে) আমি খুব খুশি হয়েছি তোমার সততায়। অন্য কেউ হলে বলে দিত এই টাকাগুলো তার। তুমি অন্যদের মত নও। খুব খুশি হয়েছি। কোনো চিন্তা নেই। (চলে যায়)
বৃদ্ধ – কি গেরো! ভাবলাম সরু তুলিটা নেব আর যাব। আর মাঝখানে এই- । যান মা যান, আজ তো বাস বন্ধ। কোথাও যেতে পারবেন না। ছিল একটা স্টেটবাস, তা সেটাও তো চলে গেছে। যান বাড়ি ফিরে যান।
মেয়েটি – আজ বাস বন্ধ?
বৃদ্ধ – হ্যাঁ, তবে আর বলছি কি। ইছাপুরে চাঁদা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। কাল একটা গাড়ির কন্ডাকটর আর খালাসীকে বেদম মেরেছে লোকাল কিছু ছেলে। ওই নিয়েই বনধ। (হাসে) দেখছেন না বাস বন্ধ বলে লোকজন আসাও বন্ধ, আমার গুমটিও বন্ধ। আমিই কি ছাই আসতাম? এই চায়ের দোকানে বসেই ফাঁকেফাঁকে বোর্ড টোর্ড লিখি। তা কাল একটা সাইনবোর্ডের আর্জেন্ট ডেলিভারী দিতে হবে। লিখতে বসে দেখছি সরু তুলিটা নেই। তাই দেখতে এলাম। মনে হয় গুমটিতেই ফেলে গেছি। যান মা যান, আপনি যান। আমিও এই তুলিটা নিয়েই চলে যাব। (গুমটির পাশের ছোট দরজার তালা খুলে হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢোকে। সেখান থেকেই বলে) আচ্ছা দাঁড়ান, আমিও তো যাব। আপনাকে একটু এগিয়ে দিয়ে যাব। দাঁড়ান। চলে যাবেন না। (মেয়েটি হঠাৎ পাথরের ওপর বসে পড়ে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করে। বৃদ্ধ দোকানের মধ্যে থেকে বেড়িয়ে আসে। হাতে একটা ছোট তুলি।) হ্যাঁ, এই পেয়ে গেছি। ছিল দোকানেই। বলছি না যাবে কোথায়? বাড়িতে যখন নেই, তখন। কাল দোকানে বসেই একটা গাড়ির নাম্বারপ্লেট লিখেছি, ব্যাস, নিয়ে যেতে ভুলে গেছি। কই চলুন। ও হ্যাঁ, দাঁড়ান, তালাটা লাগিয়ে দিই। কিছুই তো নেই, তবুও ওই চা তৈরীর জিনিসপত্তরগুলোই অনেক। একবার গেলে তো আর কিনতে পারব না। (হঠাৎ মেয়েটির দিকে চোখ পড়ে) আরে! একি! কি ব্যাপার? কাঁদছেন নাকি? আরে কি হলো কাঁদছেন কেন? দেখ দিকি কি কান্ড! কি হলো মা? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি। (বিভ্রান্ত দেখায়। মেয়েটির কাছে যায়।) দেখুন মা, সেরকম কিছু হলে আমাকে বলতে পারেন। কান্নাকাটি করছেন কেন? আমি আবার কান্না টান্না একদম সহ্য করতে পারিনা। (ইতস্তত করে মাথায় হাত দেয়) কাঁদবেন না – কাঁদবেন না! দেখুন মা দুঃখ সমস্যা এসব তো থাকবেই। নাহলে আর মানুষের জীবন কেন? চলুন বাড়ি চলুন। আপনাকে আপনার বাড়িতে পৌছে দিয়ে তবেই আমি যাব। চলুন... (মেয়েটির কান্না বেড়ে যায়) আরে-আরে! হলোটা কি! কি মুস্কিল! এই দেখ!
(বাইরে থেকে খেপলু উঁকি মারে। মেয়েটি ভয়ে গুটিয়ে যায়)
খেপলু – (সুর করে টেনে টেনে বলে) গু...রু...
বৃদ্ধ – কে? কে মশাই? আজ আর কিছু হবে টবে না। আজ দোকান বন্ধ দেখছেন। কিছু পাবেন না।
খেপলু – পাব-পাব। পাব বলেই তো তখন থেকে হাপিত্যেশ করে বসে আছি।
বৃদ্ধ – কি বলছেন? কি চাই আপনার?
খেপলু – পেসাদ, হে হে- একটু পেসাদ চাই গুরু।
বৃদ্ধ – কি? কি বলছেন?
খেপলু – না না, চিন্তার কিছু নেই। পুরোটাতো বলছিনা। তুমি গুরু আগে খাও, চেটেপুটে খাও, তারপরে একটুখানি পেসাদ দিও। তালেই আমি খুশি।
বৃদ্ধ – (মেয়েটির দিকে ফিরে) কি বলছে কিছুই তো বুঝতে পারছি না। একি! আপনার আবার কি হলো? ভয় পাচ্ছেন কেন?
মেয়েটি – ওই যে-ওই যে-লোকটা-আমাকে-আমাকে...
বৃদ্ধ – এই লোকটা? তারমানে? এ কি কিছু করেছে নাকি? কি হে ডাকব মেজবাবুকে?
খেপলু – আহা! অত চটছ কেন ওস্তাদ? তুমি গুরু মাস্টার লোক। আমি তো ভাগ বসাব না। শুধু একটু- ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি নাহয় একটু আড়ালেই যাচ্ছি।
বৃদ্ধ – তুমি যাবে? না ডাকব মেজবাবুকে? এই পাশেই আছেন উনি।
খেপলু – আরে! এর মধ্যে আবার মেজবাবু এলো কোথা থেকে? যা ছিল সব তো ঝেটেপুটে নিয়ে গেল। শালা সারাদিনের কামাই। হলো আজ হরিমটর। এর জন্যেই বলে মেয়েছেলে যত নষ্টের গোড়া।
বৃদ্ধ – (উল্টোদিকে গিয়ে) মেজবাবু!
খেপলু – আরে এই! এই শালা মাকড়ামি করছ কেন?
বৃদ্ধ – তুমি যাবে কি না?
খেপলু – আচ্ছা-আচ্ছা, যাচ্ছি। শালা একেই বলে কপাল। যখন আসে ছপ্পর ফুঁড়ে আসে, আর যখন যায় তখন সব ছিল্ ছিল্ করে যায়।
বৃদ্ধ – মেজ...
খেপলু – যাচ্ছি-যাচ্ছি... (যেতে যেতে বলে) শালা ঢ্যামনা বুড়ো...
বৃদ্ধ – (তেড়ে যায়) তবেরে...
খেপলু – (দৌড়ে পালায়) শালা বুড়ো ভাম...
বৃদ্ধ – (উইংসের কাছে গিয়ে দেখে ফিরে আসে) চলে গেছে, আর কোনো ভয় নেই মা। ওগুলো সব পোকামাকড়। তুমি ভয় পেলেই কামড়াবে। তাড়া দিলেই পালাবে। কোনো চিন্তা নেই। চল তোমাকে বাড়ি পৌছে দিয়ে আসি। দাঁড়াও, তালাটা দিই। (তালা দেয়। হঠাৎ মানিব্যাগগুলো দেখতে পায়) এগুলো আবার কি? যাচ্চলে! এগুলো আবার কোথা থেকে এলো? এ নিশ্চয়ই ওই হতভাগাটার কাজ। কার সর্বনাশ করে এসেছে কে জানে! থাক কাল থানাতে পৌঁছে দেব। নাহ, খালি ব্যাগ থানায় দিয়ে আর কি হবে? এই রাস্তাতেই পড়ে থাক। যার দরকার হবে তুলে নিয়ে যাবে। না-না-থাক, মেজবাবুকেই দিয়ে দেব কাল। থাক এখানে। চল মা তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আবার বাড়ি গিয়ে কাজে বসতে হবে। আজ মনে হয় রাত্রি হয়ে যাবে। যাকগে, কি আর করা যাবে বল? (মেয়েটি যায় না) কি হলো? চল...
মেয়েটি – কোথায় যাব?
বৃদ্ধ – কেন তোমার বাড়ী?
মেয়েটি – বাড়ী...!
বৃদ্ধ – হ্যাঁ, চল, কোনদিকে?
মেয়েটি – জানিনা।
বৃদ্ধ – অ্যাঁ! সেকি! জানোনা মানে? তোমার বাড়ী কোথায় তুমি জানোনা?
মেয়ে – না।
বৃদ্ধ – অ্যাঁ! এ কি বলেরে! এই মেয়ে তুমি-মানে তোমার শরীর টরীর ঠিক আছে তো? মানে ইয়ে... (মেয়েটি আবার ফুঁপিয়ে ওঠে) আরে না না- স্টপ-স্টপ! আবার কান্না নয়। আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। তুই একটু ধাতস্থ হও, আমি ততক্ষণ বসছি এই বেঞ্চিটায়।তারপরে নাহয়... আজ হলো, হয়ে গেলো, বুঝতে পারছি সারারাতই জাগতে হবে।
মেয়ে – (একটু সামলে নেয়) আমার বাড়ী নেই।
বৃদ্ধ – নেই! বাড়ী নেই!
মেয়ে – না।
বৃদ্ধ – এই মরেছে! তাহলে তুমি এখন আসছ কোত্থেকে?
মেয়ে – অন্যের বাড়ী থেকে।
বৃদ্ধ – অন্যের বাড়ী! অ! তোমার মা?
মেয়ে – নেই।
বৃদ্ধ – অ্যাঁ! বা-বাবা?
মেয়ে – নেই।
বৃদ্ধ – সেরেছে! দাদা-দিদি-ভাই-বোন-মাসী-পিসি-কাকা-কাকী...
মেয়ে – নেই-কেউ নেই। (আবার ফুঁপিয়ে ওঠে)
বৃদ্ধ – এই-ঠিক আছে-ঠিক আছে- নো কান্না- একদম না। ঠিক আছে? তাহলে কোথায় যাবে এখন?
মেয়ে – জানিনা।
বৃদ্ধ – কি গেরো! জানিনা- কোথাও না এসব কোনো কাজের কথা হলো? এতদিন কোথায় ছিলে? এখনি বা যাবে কোথায়? এ তো দেখছি ধাঁধার মত ঠেকছে সব। (গান গেয়ে ওঠে) হরি পাগল পাগল করিসনে আমায়...এ ধাঁধার সাগর পার করে দে...আটানার বাতাসা দেব...যাকগে, তুমি বড় হয়েছ কোথায়? সেটা জান? নাকি তাও জানোনা? এখানকার মেয়েই? না অন্য কোথাও থেকে এসেছ?
মেয়ে – না, আমি এখানকারই মেয়ে। এখানেই বড় হয়েছি।
বৃদ্ধ – বা-বা-বা-বা-বা...তবে তো চুকেই গেল ঝামেলা। আসলে কি হয়েছে আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি রাগ করে বাড়ী থেকে পালিয়ে এসেছ। কি ঠিক কি না?
মেয়ে – বিশ্বাস করুন ওরকম কিছু নয়। আমি-আমি আপনাকে সত্যি কথা বলছি।
বৃদ্ধ – অ, হুম, ঠিক আছে। তোমার বাবার নাম টি কি বলতো? (মেয়েটি ইতস্তত করে) কি হলো, বল কি নাম তোমার বাবার?
মেয়ে – প্রবীর মন্ডল।
বৃদ্ধ – প্রবীর মন্ডল – প্রবীর মন্ডল! নামটা শোনা শোনা মনে হচ্ছে। কোন পাড়ায় থাকেন বলতো?
মেয়ে – থাকেন নয়, থাকতেন। হসপিটাল পাড়ায়।
বৃদ্ধ – হসপিটাল পাড়া? প্রবীর... দাঁড়াও-দাড়াও...আচ্ছা, তোমার বাবা কি বার্ন স্ট্যান্ডার্ড এ কাজ করতেন?
মেয়ে – হ্যাঁ, কিন্তু সে তো অনেকদিন আগে।
বৃদ্ধ – অনেকদিন আগে। হ্যাঁ, ঠিক বলেছি। হা হা হা... আরে ঠিক ধরেছি। প্রবীর-আমাদের ফার্নেসের প্রবীর... (গেয়ে ওঠে) বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও...
মেয়ে – গাইতেন, বাবা প্রায়ই গাইতেন এই গানটা।
বৃদ্ধ – হা হা হা...ঠিক গেয়েছি বল? ব্যাটা সবসময়ই গাইতো এই গানটা। ফার্নেসে কাজ করছে তখন গাইতো, মাইনে পেলে গাইতো, কাজ শেষে বাড়ী যাবার পথে জোর গলায় গাইতো।
মেয়ে – বাড়ীতেও-বাড়ীতেও তাই। সবসময়। মা বলতো তুমি কি এই একটা ছাড়া অন্য গান জানোনা?
বৃদ্ধ – জানতো-জানতো। আরো অনেক পুরনো দিনের গান জানতো রে ও। কতদিন দুপুরে খাবার ছুটির সময় শুধু গান গেয়েই মাতিয়ে দিত আমাদের। খেতে ভুলে যেতাম আমরা। (গেয়ে ওঠে) এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়...
মেয়ে – মা ওটা কথার কথা বলতো। ছুটির দিনগুলোতে বাড়ীতে থাকতে কি যে ভালো লাগতো আমার। মনে হতো বাড়ীতেই যেন পিকনিকের আসর বসে গেছে। হাসিতে গানে গল্পে বাবা একাই মাতিয়ে দিত সবাইকে। ইচ্ছে করে মায়ের পেছনে লাগতো। মা যত রেগে যেত, বাবা তত বেশি করে মজা পেত। এক একদিন...
বৃদ্ধ – আরে কারখানাতেও তো তাই। ছোট ছোট চুটকি গল্প বলতো। রসের নাগর ছিল ব্যাটা। একটা করে চুটকি শেষ হতো, আর হেসে গড়িয়ে পড়তো সবাই। জানিস ফোরম্যান শুদ্ধু ওর গল্প শোনার জন্যে ভীড়ের মধ্যে নাক গলাতো। রোজ এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করতো-‘কি রে প্রবীর। নতুন কোনো স্টক আছে নাকি?’
মেয়ে – অজস্র- অসংখ্য- বাবার গল্পের স্টক ছিল অফুরন্ত। কোনোদিন শেষ হতে দেখিনি। মজাদার মুখ করে গল্পগুলো বলতো। নিজে কিন্তু হাসত না।
বৃদ্ধ – হা হা হা… আরে শোনো-শোনো! একবার এক পাঞ্জাবীর গল্প বলছে। এক সুদখোর সর্দারজী একজনকে অনেক টাকা ধার দিয়েছে। কিন্তু টাকাটা কিছুতেই আদায় করতে পারছে না। যতবারই লোকটার বাড়ীতে যায়, দেখে দরজায় তালা বন্ধ। শেষে আরো একদিন ওরকম গিয়ে দেখছে সেদিনও দরজা তালা বন্ধ। তখন সর্দারজী খুব রেগে দরজার ওপর বাঁকাচোরা ভাবে লিখে দিল গাধা। তার কয়েকদিন পরে হঠাৎ বাজারে লোকটার সঙ্গে দেখা। সর্দারজী তো ওকে দেখেই জাপটে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো- ‘ব্যাটা তোকে পেয়েছি। এবার কোথায় পালাবি?’ লোকটা অস্থির হয়ে বলছে-‘আরে সর্দারজী ছাড়ুন ছাড়ুন লাগছে। আপনি যে আমার বাড়ীতে গেছিলেন তা আমি জানি’। সরদারজী তো খুব আশ্চর্য হয়ে ওকে ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো- ‘কি করে জানলে আমি তোমার বাড়ী গেছিলাম? আমি তো কাউকে বলে আসিনি?’ লোকটা তখন উত্তর দিল- ‘তাতে কি হয়েছে? আপনি তো আমার বাড়ীর দরজায় আপনার নামটা লিখে এসেছেন’। (দুজনে হেসে ওঠে) এদিকে বড়সাহেব যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তা তো কেউ জানেনা। গল্প শেষ। সবাই হেসে লুটোপুটি খেতে খেতে বড়সাহেব কে দেখে তো একদম ঠান্ডা। তারপর সবাই দেখে কি বড়সাহেবও হা হা করে হেসে চলেছে। হা হা হা…
মেয়ে – সত্যি! কি মজার দিনগুলো ছিল সব! প্রত্যেকটা দিনই ছিল যেন রঙিন রাংতায় মোড়া। কিন্তু হঠাৎ কি যে হল! সেই দিনগুলো – সে হাসি – সেই আড্ডা – সেই আনন্দ কোথায় যে হারিয়ে গেল…
বৃদ্ধ – (গেয়ে ওঠে) কফিহাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই…আজ আর নেই…কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই…আজ আর নেই… কারখানা বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। সবার সামনে নেমে এল একটা অন্ধকারের পর্দা। হাসিখুশি মানুষজনগুলোর মুউখ থেকে হাসিটাই কে যেন কেড়ে নিল।
মেয়ে – প্রথমে মাসদুয়েক সেরকম কিছু বোঝা যায়নি। যা ছিল টুকিটাকি খরচা হয়ে যেতেই দিনগুলোকে মনে হত যেন অসহ্য ভারী। বাবাকে বেরোতে হল ফের কাজের সন্ধানে।
বৃদ্ধ – কাজ! কে দেবে কাজ? এই অসম্ভব বেকারীর যুগে কতকগুলো আধবুড়োর জন্যে কাজ কে যুগিয়ে রেখেছে? তবুও লড়তে তো মানুষকে হবেই। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশা। ওই টুকিটাকি লেখা আর আঁকার কাজ জানতাম। তাই আর এই ঝরতি পড়তি গুমটি টা সম্বল করে নেমে পড়লাম পথে। ওতেই যা হোক বেঁচে আছি কোনোক্রমে। মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু শরীরটা যা হোক এখনো খাড়া আছে।
মেয়ে – বাবার কিন্তু কপাল এত ভালো ছিল না। মাসদুয়েক পর অভাব যখন পেছনে তাড়া করতে শুরু করলো, বাবা কিছু টাকা নিয়ে হাটে সবজী বিক্রী করা শুরু করলেন। তারপর প্রচন্ড লোকসানের ধাক্কায় সবজী বিক্রীর ব্যবসা গুটিয়ে গেল। তখন শুরু হল পঞ্চায়েতের গাছ লাগানো। অর্ধেক গাছ মরে গেল বাকী অর্ধেক গরু ছাগলে খেয়ে গেল। শুরু করলেন চায়ের দোকান। বহু লোক ধার শোধই করল না। অমন হাসিখুশি মানুষটা ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যেতে শুরু করল। বাইরে থেকে দেখে কেউ বুঝতে পারত না একটা বিশাল আগ্নেয়গিরির গলন্ত লাভা বাবার ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে রাতদিন। পড়ে যাচ্ছে বাবার সমস্ত কামনা বাসনা আশা আকাংখ্যা। বাঁচার আর বাঁচানোর ইচ্ছা সব-সব।
বৃদ্ধ – আর তোর মা?
মেয়ে – (করুন হাসে) মা! মা ছিল জোড়াতালি দেওয়া কাঁথা সেলাই করার সুতো। সংসারে যখন যেখানে ফুটো হত, মা চেষ্টা করত সেখানে তাপ্পি দেওয়ার। আস্তে আস্তে আমরা একবেলা খেতে শুরু করলাম। ডাল দিয়ে ভাত খাওয়া তো ভুলেই গেছি কবে শেষ খেয়েছি। কোনোদিন দুটো শাকপাতা জুটতো, কোনোদিন তাও নয়। শুধু নুন আর ভাত। সবাই ধার দেওয়া বন্ধ করতে লাগল। তাও জানো এরই মধ্যে কতদিন মাকে দেখেছি, মার কিম্বা আমার ছেঁড়া শাড়ী সেলাই করতে বসেছে কিন্তু গুনগুন করে গান গাইছে। আমার খুব আশ্চর্য লাগত এত আনন্দের স্রোত মার মনে কোত্থেকে আসে! মা মুখে অবশ্য বলত, তোমাদের সংসারে দাসীবৃত্তি করতে এসেছি আমি। কিন্তু মুখে যাই বলুক না কেন আমি জানতাম এই অবস্থার জন্যে মা অন্তর থেকে কাউকে দায়ী করত না। এত অভাবের মধ্যেও বাবাকে কোনোদিন গঞ্জনা করেনি মা। মা ছিল আমাদের পরিবারের মেরুদন্ড। ক পেতাই বা লেখাপড়া শিখেছিল। কিন্তু অন্য অনেকের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিতা ছিল আমার মা। সেই মা ও…
বৃদ্ধ – এত অভাব! কিন্তু তুই কি করতিস? তুই কেন চেষ্টা করতিস না যাহোক ভদ্রভাবে কিছু করে বাবা-মার হাতে দুটো পয়সা দিতে?
মেয়ে – আমাকে করতে দিলে তো? বিএ ফার্স্ট ইয়ার পড়ছিলাম।
বৃদ্ধ – তাইনাকি! বা বা বাহ… পড়াশোনা করতিস? খুব ভালো-খুব ভালো। পড় পড় মন দিয়ে পড়। চাকরী পাওয়ার জন্যে নয়। মনটাকে বড় করার জন্যে পড়। হ্যাঁ রে, পড়া ছেড়ে দিসনি তো?
মেয়ে – নাহ, এত অভাবের মধ্যেও না মা না বাবা কেউই আমাকে পড়া ছাড়তে দেয়নি। চেয়েচিন্তে বই জোগাড় করতাম। পাড়ার লোকেরা ভালবেসে ওদের ব্যবহার করা খাতার সাদা পাতা, পেন, পেনসিল দিত। কলেজের স্যারের টিউশ্যন ফিজ ফ্রী করে দিয়েছিলেন। এভাবেই চলছিল। শেষ পর্যন্ত তো পড়া ছাড়িনি। এখনো কলেজের খাতায় নাম আছে। যদিও আমি কতবার চেয়েছি পড়া ছেড়ে দুটো টিউশ্যনি করে সংসারে দুটো টাকা দিই। কিন্তু মা-বাবাই দিতনা। আমি-আমি কিছুতেই মা-বাবার মনের তল খুঁজে পেতাম না। আমি যখন পড়তাম তখন দুজনে খালি পেটে থেকেও আমার দিকে এক আশ্চর্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত। কি ছিল? সেই দৃষ্টিতে? কি আশা? কি ভাবনা? আমি-আমি জানিনা। আমি বুঝতে পারিনি কখনো। (বৃদ্ধ গেয়ে ওঠে- ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই…প্রহর হল শেষ…’ মেয়ের সংলাপের শেষ অংশে গান চলবে।) শুধু এটুকু বুঝতাম আমার ওপরে প্রচন্ড ভরসা দুজনের। আমাকে পড়তে হবে-পড়তেই হবে। আমাকে থেমে গেলে চলবে না। চারপাশের হাজার লোভী চোখ, হিংস্র শ্বাদন্ত, তীক্ষ্ণ নখ উপেক্ষা করে আমাকে পড়তে হবে-পড়তেই হবে। মাথা তুলে ফের একদিন দাঁড়াব আমরা। মাথা তুলে… (কান্নায় ভেঙে পড়ে। বৃদ্ধ তাঁকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়)।
বৃদ্ধ – কাঁদিস না রে মেয়ে- কাঁদিস না! কেঁদে কি হবে বল? আসলে কি জানিস আমাদের মত জীব, ওপরতলার মানুষেরা যাদের মানুষ বলেই ভাবেনা, তাদের জীবনগুলোই এরকম। সেই যেদিন থেকে জন্মালাম শুধু লড়াই লড়াই আর লড়াই। বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিটি সেকেন্ড তীব্র যুদ্ধ করতে হয় আমাদের।
মেয়ে – না, যুদ্ধ সবার একরকম নয়। আমাদের মধ্যে পরিস্কার একটা ভাগ, একটা দাগ টানা আছে। আপনার-আমার। ছেলেদের আর মেয়েদের যুদ্ধ সম্পূর্ণ আলাদা।
বৃদ্ধ – সে কি রে! তোর এরকম ধারনা কি করে হল? আমরা সবাই এক। সবাই গরীব মানুষ। আমাদের সবার একই লড়াই। বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা।
মেয়ে – ওটা তো প্রাথমিক ব্যাপার। তারপর? তারপরের রাস্তা ছেলেদের আর মেয়েদের সম্পূর্ণ আলাদা। মেয়েদের শুধু বেঁচে থাকলেই হয়না। তারসঙ্গে আরো অনেক অনেককিছু বাঁচাতে হয়।
বৃদ্ধ – কি? মামসম্ভ্রম? ছেলেদের ওগুলো বাঁচাতে হয়না? মান হারিয়ে যে পুরুষ বাঁচে সে ত্তো মানুষই নয় অমানুষ।
মেয়ে – ওহ! আপনি বুঝতে চাইছেন না! আপনারা পুরুষ মানুষেরা মেয়েদের সমস্যাগুলো হয় বুঝতে পারেন না, নয়তো বুঝেও না বোঝার ভান করেন।
বৃদ্ধ – কি বললি? ভান? আমি ভান করছি? আমি বুঝিনা? তুই বুঝিস? তোদের বয়সীরা বেশি বোঝে? আমার এই একমাথা সাদা চুল সেকি জন্মেই সঙ্গেসঙ্গে হয়ে গেছে?
মেয়ে – আহ! চুল সাদা কালোর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
বৃদ্ধ – আছে-আছে অনেক সম্পর্ক আছে। তোর তিনগুন বয়স আমার। পৃথিবীটাকে তোর চেয়ে অনেক বেশি দেখেছি আমি। তুই জানিস, বেশিরভাগ অপরাধ হয় অভাবের জন্যে?
মেয়ে – হ্যাঁ, বেশিরভাগ। কিন্তু পুরোটাই নয়। অনেক অপরাধই স্বভাবের জন্যে হয়।
বৃদ্ধ – হ্যাঁ, এখানেই আসল ব্যাপার। অপরাধটা অপরাধই। পৃথিবীর সব মানুষই অপরাধ করেনা।
মেয়ে – কি করে বুঝব? কি করে বুঝব আমি? প্রত্যেক সভ্য মানুষের মনের মধ্যে একটা পশু লুকিয়ে থাকে। সময় আর সুযোগ পেলেই সেটা বেড়িয়ে আসে। নাহলে শ্বশুর কখনো ছেলের বউকে ধর্ষণ করতে পারে? কাগজে এরকম খবর হামেশাই বেরোচ্ছে আজকাল।
বৃদ্ধ – ওঃ! তাতে কি প্রত্যেক পুরুষমানুষই ধর্ষক হয়ে যায়? আর এই সমস্যাটা অন্য ধরনের সামাজিক সমস্যা। বিকৃত মানসিকতার সমস্যা। যাদের পেট ভর্তি তাদেরই মাথায় এসব বদবুদ্ধি আসে।তোর এসব বুঝতে এখনো অনেকদিন লাগবে।
মেয়ে – না, একটা মেয়ে বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই এসব বুঝতে পারে। কাকুরা পড়াশোনার খবর জানতে চেয়ে গায়ে পিঠে হাত বুলায়। দাদা গোছের জীবেরা ছোক ছোক করে। লোভী চোখে বয়স্ক মানুষেরা...
বৃদ্ধ – আহ্ ! চুপ কর-চুপ কর! এসব শোনাও পাপ। আমি-আমি তোর বাপের মত। তোর মত আমার মেয়ে... (হঠাৎ চুপ অরে যায়। বিস্ফারিত চোখে, মুখে হাত চাপা দেয়)
মেয়ে – (প্রথমে বৃদ্ধকে লক্ষ্য করেনা) হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করেছেন কোনোদিন মেয়েকে কি তার সমস্যা? মুখ ফুটে আপনার মেয়ে আপনাকে কোনোদিন বলেছে, কারা তাকে বিরক্ত করে? বলুন এগুলো কি বাবার কর্তব্য নয়? কি হল, বলুন? উত্তর দিন? (তাকায়) আমি জানি, কোনো উত্তর নেই আপনার কাছে। এর উত্তর পেতে হলে বাড়ীতে গিয়ে মেয়ের সঙ্গে কথা বলুন।।
বৃদ্ধ – কোথায় পাব তাকে?
মেয়ে – কাকে?
বৃদ্ধ – ওই যে একমাথা কালো কালো চুল, গোলাপী ঠোঁট, পুকুরের গভীর জলের মত টলটলে চোখ। কাজের শেষে বাড়ীতে ফিরে এলে দৌড়ে এসে সেই কালিঝুলিমাখা আমার শরীরটা ধরে ঝুলে পড়ত। বলত-‘বাবা, আজ কিন্তু বেড়াতে যাবই যাব’। আমি বলতাম – ‘আরে, ছাড় ছাড়, লক্ষ্মী মেয়ে আমার! আমার গোটা গায়ে কালিঝুলি ভর্তি। তোর গায়ে নোংরা লেগে যাবে যে!’ ওঃ বলতো...
মেয়ে – কেন? আপনার মেয়ে কি আপনার কাছে থাকেনা এখন? (বৃদ্ধ মাথা নাড়ে) ওঃ, তাহলে কোথায় থাকে? (বৃদ্ধ ওপরে আঙুল দেখায়) ওহ্ ইয়ে, দেখুন কিছু মনে করবেন না। আমি-আমি না জেনে আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম। মানে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।
বৃদ্ধ – না রে না। দুঃখ কষ্ট তো সারাজীবনই পেয়ে আসছি। ওতে আর নতুন কিছু হবেনা।
মেয়ে – কি হয়েছিল আপনার মেয়ের?
বৃদ্ধ – একটা নতুন ধরনের জ্বর। ডাক্তার বললো হেপাটাইটিস। সেইসময় ফ্যাক্টরীটাও বন্ধ হয়ে গেল।টাকাপয়সার জোগাড় করে একটাও ভালো ওষুধপত্র কিনতে পারলাম না। মাত্র দুদিনের জ্বরে ছোট পুতুলটা...
মেয়ে – আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি কিছু না বুঝেই...
বৃদ্ধ – না-না, আমি কিছু মনে করিনি। আসলে কি জানিস, মানুষের জীবনটাই তো এরকম। ওঠা আর পড়া। ওঃ একদিন এসেছিল আমাদের কুঁড়েঘর টাকে আলোয় ভাসিয়ে দিয়ে।আবার একদিন চলেও গেল সব অন্ধকার করে।
মেয়ে – ঠিক আমার জীবনটার মতই না? আলো আর অন্ধকার। এখন তো সবই অন্ধকার। সব কিছু কালো।
বৃদ্ধ – ওহ্ হ্যাঁ, দেখেছিস, বুড়ো হলে কি হয়! কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছি। তোর বাবা-মা কি এখন এখানে নেই? তখন যেন বলছিলি যে এখানে তোর কেউ থাকেনা এখন?
মেয়ে – না।
বৃদ্ধ – ওঃ! তা তুই এখানে কোথায় থাকতিস? প্রবীররাই বা কোথায় গেছে তোকে ছেড়ে দিয়ে?
মেয়ে – আপনার মেয়ের কাছে।
বৃদ্ধ – (বুঝতে একটু সময় লাগে) অ্যাঁ! সেকি! প্রবীর আর ওর বউ দুজনেই? কবে? কিভাবে? কি হয়েছিল?
মেয়ে – বোধহয় জীবনযুদ্ধে শেষপর্যন্ত হেরে গেছিল বাবা-মা।
বৃদ্ধ – হেরে গেল? এত সহজে হাল ছেড়ে দিল ব্যাটা? কি হয়েছিল?
মেয়ে – প্রচুর ধার হয়ে গেছিল। অনেক টাকা। আমাদের তিনজনকে বিক্রী করলেও এত টাকা জোগাড় করা যেত না। তাও বাবা অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু... (মাথা নাড়ে) শেষে একদিন কোত্থেকে একটু দুধ জোগাড় করলো মা। সন্ধেবেলায় ঘরের দরজা বন্ধ করে আমাকে বললো-‘এটুকু খেয়ে নে তো মা, বহু কষ্টে জোগাড় করেছি’। আমি দুধ দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমি তো কিছু বুঝতেই পারিনি মা-বাবা কি ভেবে কি করতে চলেছে। ভীষণ অবাক হয়ে মা কে বললাম, -‘এ কি মা, ভাতের জোগাড় হচ্ছেনা, এদিকে দুধ?’ মা বললো – ‘খেয়ে নে মা। লক্ষ্মী সোনা, না করিস না। তোর শরীরটা কত খারাপ হয়ে গেছে দেখছিস না? খেয়ে নে লক্ষ্মীটি। দেখিস কাল থেকে আর আমাদের এত কষ্ট থাকবে না’। বলতে বলতে মা’র গলা বুজে এল। মুখে আঁচল চাপা দিল মা।
বৃদ্ধ – আর প্রবীর? ও কি করছিল তখন?
মেয়ে – বাবা একটাও কথা বলেনি। এককোনে চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসেছিল। তখন কে জানতো যে... (গলা বুজে আসে। সামলে নেয়।) মা কে আর কষ্ট দেবনা বলে দুধটা খেয়ে ফেললাম। কিছুক্ষণ পরেই মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। তারপর সব অন্ধকার।
বৃদ্ধ – সে কি!
মেয়ে – হ্যাঁ, চোখ মেললাম হাসপাতালে। চারপাশে সন অচেনা রুগী। দুদিন পর কাল ডাক্তারবাবুও ছুটি দিলেন। কিন্তু কেউ বলছিল না যে আমার কি হয়েছে। ছুটির পরেই থানার ছোটবাবু আমাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। যতটা জানি বললাম। ওনার কাছেই শুনলাম যে মা আর বাবা দুজনেই আর নেই। ওই রাতেই একইসঙ্গে বিষ খেয়ে... শুধু বেঁচে গেলাম আমি।
বৃদ্ধ – বাড়ী তো আর যাসনি?
মেয়ে – হ্যাঁ, গেছিলাম। তো আর কোথায় যাব? হাসপাতাল থেকে বাড়ীতেই গেলাম। গিয়ে দেখি দরজা খোলা। ছিটকিনি টা ভাঙা। ঘরে জিনিসপত্র আর কিইবা ছিল। যা ছিল সব তেমনি আছে। দুধের বাটিটা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সবই ঠিক সেই সন্ধেতে যেমন ছিল তেমনি আছে। শুধু একটা বিশাল শূন্যতা সিলিং থেকে মেঝে পর্যন্ত গোটা ঘরটাকে গ্রাস করে ফেলেছে। আমিও আসতে আসতে ঐ বিরাট শূন্যর পেটের মধ্যে ঢুউকে পড়লাম।
বৃদ্ধ – পাড়ার লোকেরা কেউ আসেনি?
মেয়ে – বাড়ীওলা ঘোষালকাকা এসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেল। আর এসেছিল পদ্মাপিসি। একবার দুপুরে, আর একবার রাত্রে। খাবার নিয়ে এসেছি। না, আর কেউ আসেনি। সাধ করে কে আর পুলিশের ঝামেলায় পড়তে চায়?
বৃদ্ধ – তাহলে তুই যে বললি, তোর থাকার বা যাবার কোনো জায়গা নেই?
মেয়ে – আজ দুপুরে আবার এসেছিল ঘোষালকাকা। ঠিক কালকের মতই গায়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললো, পাঁচ মাসের ঘরভাড়া বাকী আছে। আমি কি করব?
বৃদ্ধ – তুই কি বললি?
মেয়ে – আমার মাথাতে কিছুই ঢুকছিল না তখন। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। ঘোষালকাকা বললো যে আমি যদি ওর কথা শুনি, তবে ঘরের ভাড়া দিতে হবেনা। খাওয়া পরারও অভাব থাকবে না, আমাকে শুধু... বলতে বলতে কাকার মধ্যে থেকে জন্তুটা বেরিয়ে এসে আমাকে অশ্লীলভাবে জড়িয়ে ধরল। আমি হাঁসফাঁস করতে করতে বললাম,- ‘আঃ ছাড়ুন কি করছেন? ছাড়ুন আমাকে!’ একধাক্কায় জন্তুটাকে ছিটকে ফেলে দিয়ে দৌড়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালাম।
বৃদ্ধ – তারপর?
মেয়ে – বিকটভাবে চিৎকার করতে করতে জন্তুটা বাইরে বেরিয়ে এল। কপালের একটা দিক ফেটে গেছে। গালাগাল করতে করতে কয়েকটা জামাকাপড় আর আমার এই থলিটা বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে দরজার বাইরে থেকে একটা তালা লাগিয়ে দিল। ওখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে এখানে। এখন কোথায় যাব, কি করব কিছুই জানিনা। শুধু এইটুকু জানি, ওখানে আর ফিরব না আমি।
বৃদ্ধ – না-না, ওই নরকে আর ফিরতে হবেনা তোকে।
মেয়ে – এমনিতেও ওখানে থাকতে পারতাম না আমি। যেখানে বাবা নেই, মা নেই, সেখানে আমি কিছুতেই... কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলও যেন কখন শেষ হয়ে গেছিল। আচ্ছা, এত লোভ কেন মানুষের? মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে অসহায় অবস্থায় দেখেও কেন লোভ?
বৃদ্ধ – ওই বাড়ীওলা ঘোষালের পেটটা ভর্তি ছিল রে। টাকা কিছু উদ্বৃত্ত হয়ে গেছিল তাই এই অবস্থা।
মেয়ে – পকেটমারটার কিন্তু পেট ভর্তি ছিল না। আসলে কি জানেন, আমি ছেলে হলে অবস্থাটা অন্যরকম হত। শুধু মেয়ে বলে, শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে আজ আমাকে এভাবে রাস্তায় নেমে আসতে হল। কেন বলতে পারেন? কি দোষ করেছি আমি? (কাঁদে)
বৃদ্ধ – এই পোড়া দেশে মেয়ে হয়ে জন্মেছিস। আসলে কি জানিস, তোর যদি অনেক অনেক টাকা থাকত তবে ওই ঘোষাল কুকুরের মত লেজ নাড়িয়ে তোর পায়ের কাছে কুঁইকুঁই করত। ও
জানে তোর টাকা নেই, তাই তুই দুর্বল, ওর টাকা আছে তাই ও সবল। দুর্বলের ওপর সবলের জোর।
মেয়ে – ব্যস ! শুধু এটুকুই? টাকা থাকলেই মেয়েদের দিকে কেউ লোভী চোখে তাকাবে না?
বৃদ্ধ – তাকাবে-তাকাবে। লোভী চরিত্রের অমানুষেরা লোভী চোখেই তাকাবে। কিন্তু যদি দেখে একটা মেয়ে একটা পুরুষের চেয়ে বেশি যোগ্যতা নিয়ে নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, তবে তাকে আটকাতেও পারবে না কেউ। আর ঘাঁটাতেও সাহস পাবে না।
( সেই আগের দেখা পুলিশ অফিসার ঢোকে)
পুঃঅঃ – একি! আপনারা এখনো এখানেই আছেন? (মেয়েটিকে) আপনি বাড়ী যাননি এখনো? আপনাকে তো বললাম আজ বাস বন্ধ। কোথাও যেতে পারবেন না। যান যান বাড়ী চলে যান।
মেয়ে – বাড়ী... মানে...
পুঃঅঃ – হ্যাঁ, বাড়ী। যান চলে যান। রাত্রি হয়ে গেছে, এখানে আর থাকবেন না। আমিও এই বাজারটা পৌঁছে দিয়ে থানায় যাব। তারপর ওই খেপলুটাকে দেখছি আমি।
মেয়ে – আমার বাড়ী নেই।
পুঃঅঃ – অ্যাঁ! কি বললেন?
মেয়ে – বললাম আমার যাবার কোনো জায়গা নেই।
পুঃঅঃ – সে আবার কি? যাবার জায়গা নেই মানে? তাহলে এলেন কোত্থেকে?
বৃদ্ধ – আমি বলছি-আমি বলছি ব্যাপারটা। কয়েকদিন আগে একইসাথে দুটো সুইসাইড হয়েছিল। স্বামী-স্ত্রী।
পুঃঅঃ – স্বামী-স্ত্রী! সুইসাইড! হ্যাঁ হ্যাঁ হসপিটাল পাড়ায়। ছোটবাবু দেখছে কেসটা। কেন?
বৃদ্ধ – ওদেরই মেয়ে ও।
পুঃঅঃ – ও-ইয়ে-তাইনাকি! আচ্ছা-আচ্ছা। সরি-সরি, ভেরি স্যাড। কেন? অভাবের জ্বালায় সুইসাইড করেছিল বোধহয়। তাহলে এখন কি করবেন আপনি? কোথায় যাবেন ঠিক করেছেন?
মেয়ে – আমি... মানে...
পুঃঅঃ – কোনো আশ্রম টাশ্রমে যাবেন তো বলুন। আমি ব্যাবস্থা করে দেব।
বৃদ্ধ – না-না, আশ্রমে যাবে কেন? একটা বাড়ী হারিয়েছে তাতে কি হয়েছে? আরেকটা বাড়ী হয়ে যাবে।
পুঃঅঃ – কি সব হেঁয়ালি করছেন বলুন তো আপনারা? আমার হাতে বেশি সময় নেই। যা বলার খোলসা করে বলুন।
বৃদ্ধ – হ্যাঁ হ্যাঁ, খুলেই বলছি। ঠিক করলাম ওকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব।
পুঃঅঃ – আপনার সঙ্গে! কেন ওনাকে চেনেন আপনি?
বৃদ্ধ – (হাসে) চিনতাম না, এখন চিনে নিলাম। খাঁটি সোনা। আর আমাদের জাতটাও তো এক। গরীব জাত
পুঃঅঃ – যাত্রা টাত্রা করা অভ্যেস আছে নাকি?
বৃদ্ধ- না না, গরীবের ওসব ঘোড়ারোগ নেই। আসলে ওর বাবা ছিল আমার সহকর্মী বন্ধু।
পুঃঅঃ – ও তাইনাকি! তবে তো কোনো কথাই নেই। যান যান ওনার সঙ্গেই চলে যান। পৃথিবীতে এরকম লোকের সংখ্যা বেশি হলে আমাদের কোনো দরকারই থাকত না। যান, তবে কোনো অসুবিধা হলে সোজা আমার কাছে চলে আসবেন। নাহ, আর দাঁড়াব না। অনেক দেরী হয়ে গেছে। (চলে যায়)
বৃদ্ধ – চল মা, আমাদেরও অনেক দেরী হয়ে গেছে।
মেয়ে – আপনি-সত্যি...!
বৃদ্ধ – তবে কি আমি মিথ্যে বললাম নাকি?
মেয়ে – কিন্তু আপনার বাড়ীর লোকেরা আপত্তি করবে না?
বৃদ্ধ – বাড়ীতে আমরা বুড়ো-বুড়ী। মেয়েটা মারা যাবার পর থেকে বাড়ীতে কেউ গেলে বুড়ী তাকে ছাড়তেই চায়না। চল দেখবি, বুড়ী তোকে কেমন বুকের মধ্যে আগলে রাখবে।
মেয়ে – কিন্তু...
বৃদ্ধ – কিন্তু ওই একটাই, বুঝলি! আমাদের বাড়ীতে কেউ কাউকে আপনি বলেনা। আর আমাকে যা খুশি বল, বুড়ীটাকে মা বলে ডাকতে পারবি না? হ্যাঁ রে... (গলা ধরে আসে। মেয়েটি কেঁদে ফেলে। বৃদ্ধ ওর মাথায় হাত দিয়ে থলিটা হাতে নেয়। চল বাড়ী চল।)
মেয়ে – বাবা...
বৃদ্ধ – “যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে/সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া/তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর/এখনি অন্ধ বন্ধ কোরনা পাখা”। প্রবীরটা বোকার মত বাঁচার আশা হারিয়ে ফেলেছিল। তাই বলে তুই যেন আশা ছাড়িস না। ওর আশা আর কল্পনা হারিয়ে ফেললে তো মানুষ আর মানুষই থাকবে না। চল, তোর বাড়ী চল। দেখেছিস মা, তোর নামটাই জানা হয়নি। কি যেন নামটা তোর...
(দুজনে কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকে। আবহ উচ্চকিত হয়। আলো মৃদু হয়ে আসে। পর্দা।)
![]() |
| ~ লেখক পরিচিতি ~ |
( কপিরাইট আইন অনুযায়ী সর্বসত্ব নাট্যকার কর্তৃক সংরক্ষিত। অভিনয়ের জন্য অনুমতি আবশ্যক।)
সৌমিত্র চক্রবর্তী
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২৩, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২৩, ২০১৪
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন