একুশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বাংলার বেশীরভাগ অঞ্চলই পাল রাজাদের হাত থেকে দাক্ষিণাত্য থেকে আসা সেন ও বর্মণ রাজাদের অধিকারে চলে যায়। পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মের উপাসক হলেও তাঁরা ছিলেন পরম ধর্ম সহিষ্ণু।তাঁদের শাসন কালে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য থাকলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পৌরাণিক দেবদেবীর মন্দির স্থাপন ও মূর্তি নির্মাণে তাঁদের কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। নয়পাল ও বিগ্রহ পাল বরং হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠায় সহায়তাই করেছেন।
কিন্তু সেন ও বর্মণ রাজারা ছিলেন বেদ ব্রাহ্মণ, বর্ণাশ্রম-আশ্রয়ী হিন্দুধর্মের উদ্যমী উপাসক। ওই সময় বাংলার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষেরা চরম নিগৃহীত হয়েছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই সময়ে পাল যুগের পুঁথি এবং চিত্র প্রবাহের ক্ষেত্রটি ক্ষীয়মান হয়ে পরে, তবে সেই ধারা কিন্তু একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় নি। তার প্রমান পাই লক্ষণ সেন এবং হরিবর্মণ দেবের রাজ্যাঙ্কে লিখিত ও চিত্রিত বৌদ্ধপুঁথি গুলিতে।ইসলামী তুর্কি অধিনায়ক বখতিয়ার উদ্দিন খিলজি ত্রয়োদশের গোড়ার দিকে যখন সহসা নবদ্বীপ অধিকার করে পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গের শাসক হন তখন বাংলার স্বাধীন সংস্কৃতিতে বেশ বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা যায়।
তুর্কীরা ছিলেন ধর্মবিশ্বাসে ও সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারার মানুষ। তাদের সময়ে মন্দির ও মঠ একই ভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হল। আর সেই মঠ ও মন্দিরের ইট দিয়ে তৈরি হল মসজিদ। সুতরাং তার আমলে হিন্দু এবং বৌদ্ধ উভয় ধর্মের মানুষদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে।
এই সময়ে দক্ষিন বিহার ও বাংলার বৌদ্ধ বিহারগুলি ধ্বংস হওয়ার ফলে নিরাশ্রয় পূর্ব ভারতের বৌদ্ধ ভিক্ষুকরা নেপালে ও তিব্বতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। তাঁদের হাত ধরেই পূর্ব ভারতের শিল্প আশ্রয় নিল ওই দুই বৌদ্ধধর্মের উপাসক দেশে। এইভাবেই বাংলার রূপকলার ভিত্তিতে গড়ে উঠল নেপাল ও তিব্বতের ভাস্কর্য ও চিত্রকলা। তিব্বত এরই মধ্যেই বিখ্যাত শিক্ষক ও ধর্মগুরু অতীশ দীপঙ্করের শিক্ষায় মহাযান ও হীনযান ধর্মমত গ্রহন করেছিল। এইভাবেই সংঘাত ও বিরোধের পরে চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগে বাংলার সুলতানি শাসনের নতুন যুগের সূচনা হল।
ইলিয়াস শাহর সময় থেকেই বাংলার স্বাধীন সুলতানরা দেশ শাসনের ব্যাপারে হিন্দু জমিদার ও প্রশাসকের সাথে এক বোঝাপড়ার মাধ্যমে দেশে সুশাসনের ধারা নিয়ে আসেন। বাংলার সুলতানেরা ইসলামের উপাসক হয়েও বাংলার দেশজ সংস্কৃতির প্রতি যে যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন তা জানা যায় রামায়ন, মহাভারত ইত্যাদি মহান সংস্কৃত গ্রন্থগুলির বাংলা অনুবাদে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা থেকে। তবে এই ধারা ইলিয়াস শাহর শাসন কালের থেকে হুসেন শাহর শাসন কালে আরও ব্যাপ্তি লাভ করে।
হুসেন শাহ স্বয়ং ছিলেন চৈতন্যদেবের গুণগ্রাহী। আর চৈতন্যদেবও তাঁকে সুশাসক হিসেবে সম্মান করতেন। বাংলার স্বাধীন সুলতানদের আমলে বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতি এমন স্তরে পৌঁছেছিল যে যার তুলনা চলে একমাত্র পালশাসনকালের সঙ্গেই।সেই সময়ে সুলতানরা যতই বাংলার সৃজনশীলতার প্রতি যত্নবান হয়ে থাকুন না কেন তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন মুসলিম দুনিয়ার সংস্কৃতির প্রতি সমর্পিতপ্রান। তাই দেখা যায় ইলিয়াস শাহ, সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের সাথে পত্র বিনিময় করেন তাঁর অসম্পূর্ণ গজল সম্পূর্ণ করে দিতে। তাছাড়া চীনা বানিজ্য প্রতিনিধি মাহুয়ানের বর্ণনা থেকে জানা যায় সেই সময় বাংলার ব্যবহৃত ভাষা ছিল বাংলা ও ফার্সি। এই একই ধারায় হুসেন শাহের পুত্র নুসরৎ শাহ তার দরবারের আনুকূল্য করছেন পারস্যের বিশিষ্ট চিত্ররীতিতে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে এই সময় উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাংলার সংস্কৃতি ও চিত্রকলার অনুশীলন বিলুপ্ত হয়।
তবুও কিছু কিছু চিত্রশিল্পের অবশেষ গ্রামীন লোকচিত্রের স্তরে সাধারণ মানুষের দ্বারা রক্ষিত হয়েছিল। তার প্রমান পাই ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকের পরবর্তী সময়ে বাংলার পটচিত্রে প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের চিত্রকলার রেশ আমরা দেখতে পাই। ওই সময়ে যে বাংলার সব শিল্পীরা কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন তা কিন্তু নয়, কারন নতুন শাসকবর্গ তাদের নিজস্ব উদ্দ্যমে নতুন এক রীতির সুত্রপাত করেন। গৌড়ের মসজিদ ও সমাধিসৌধ গুলিতে আজও তার পরিচয় পাওয়া যায়।
পোড়ামাটির টালি ও ইঁট দিয়ে তৈরি স্থাপত্যকর্ম গুলি নির্মিত হয়েছিল এ দেশেরই শিল্পীদের দ্বারা। টালি ও ইটের নকশায় নানা রকমের যে জ্যামিতিক ও লতা- ফুলের নকশা দেখতে পাওয়া যায় সেগুলি পশ্চিম এশিয়ার আরবীয় ও ভারতীয় নকশার সংমিশ্রণের ফলে তৈরি। কেননা রক্ষণশীল ইসলামী মতবাদ অনুসারে শিল্পের ক্ষেত্রে মানুষ ও পশুপাখির চিত্র নিষিদ্ধ। তাই এই সময়ের চিত্রশিল্পীর ভাবনাটুকু পাওয়া যায় গৌড়-পাণ্ডুয়ার সুলতানি স্থাপত্যকর্মের নানান নকশায়।
রিয়া রিয়া
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২৩, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২৩, ২০১৪
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন