আলো হও, আলোকিত করো চারপাশ। আলোয় মুছে যাক সকল আঁধার, আলোয় খুলে যাক শেকল অন্ধকারের । আলো হোক মুক্তির একমাত্র পথ । প্রশ্ন জাগতে পারে আমরা কি মুক্ত নই ? আমরা কি আলোয় বাস করছি না ? যদি জাগে এমন প্রশ্ন মনে তাহলে বলব- অবশ্যই মুক্ত এবং আমরা আলোতেও বাস করছি আর তা যদি না হতো তাহলে কেমন করে ঘটছে উন্নয়ন মানুষের, সমাজ ও সভ্যতার ? তবে একথা বলতে পারি মুক্ত নই আমরা পুরোপুরি । বাস করছিনা পুরো আলোয় আমরা । আমাদের চারপাশে আজো রয়ে গেছে অন্ধকার । আমরা আজো মুক্ত নই অনেক কিছু থেকে । মুক্তির সবটা স্বাদ আজো পাইনি আমরা । এই অন্ধকারে আলোর দৃষ্টি ফেলতে হবে আমাদের, নিতে হবে মুক্তির স্বাদ, দিতে হবে মুক্তি মানুষকেও । সাম্য, সম্প্রীতি আর উদারনীতির চর্চা দিতে পারে আমাদের মুক্তি; তাই মুক্তির পথে আলোর দেখা পাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন ।
পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই মানুষ যুদ্ধ করে চলেছে আঁধারের সাথে । আজো করছি আমরা । এই যুদ্ধের কোন সমাপ্তি নেই অন্ধকারের সাথে আলোর যুদ্ধ চলবে ততোদিন, যতদিন পৃথিবী ধ্বংস না হয় । অন্ধকার ও মুক্তির প্রয়াস পাশাপাশি হেঁটেছে অতি প্রাচীনকাল থেকেই । অন্ধকার চেয়েছে বন্দিত্ব আর বন্দিত্ব চেয়েছে আলো । বিভেদ হয়েছে, রক্তপাত ঘটেছে আলো অন্ধকারের সংঘর্ষে । আজো কি হচ্ছে না ? মুক্তির মিছিল হয়েছে তবে নিঃশব্দে । মিছিল বেশি দূর অগ্রসর হয়নি থেমে গেছে । অত্যাচার আর জীবননাশের ভয়ে প্রগতিশীলতার প্রচার ও প্রসার তেমন ঘটেনি আগে । প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নীচে বসবাস করেছে মানুষ । সে ছায়া তলে আজো বাস করছি আমরা এই আধুনিক সময়টিতেও ! তবে সময়ের সাথে সাথে, যুগের পালাবদলে বদলে গেছে অন্ধকারের পদ্ধতিগত রূপটি, কাঠামোটি । আলো ফেলে আলোকিত হয়ে মুক্তির দরোজা খোলার রূপটি নতুন । মোটামুটি বলা যায় তার শুরু আঠারো শতকের প্রথমার্ধ থেকে । বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য তখন থেকেই দেখতে শুরু করেছে প্রকৃত আলো মুখ । সেই আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে মানুষের মনে আঁধার কাটতে শুরু করে ধীরে ধীরে ।
কোন সময়, কাল, শতাব্দী গুরুত্বহীন নয় । তবে কেন জানি মনে হয় আঠারো শতক থেকে শুরু করে উনিশ শতকের শেষার্ধের সময়টুকু অতি গুরুত্বপূর্ণ পুরো পৃথিবী বদলে যাবার পেছনে । আধুনিক পৃথিবী নির্মাণে । মানুষের পরিবর্তনের পেছন, মুক্তির পেছনে । বলতে পারি মুক্তির মিছিলের পদযাত্রার শুরু সেই থেকেই । যদিও যুদ্ধ থেমে নেই দেশে, দেশে জাতিতে, জাতিতে । অস্থিরতা কাটেনি মানবজাতির । মানবতার বিপর্যয় ঘটেছে- আজো ঘটছে । তবুও এসবের ভেতর দিয়েই এই দু’শতকের যাবতীয় দেনা পাওনা ।
যাঁদের হাত দিয়ে শুরু মুক্তির পথ চলা তাঁরা প্রায় সবাই সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান । তাঁদের কর্ম ও সৃষ্টি বদলে দিয়েছে পৃথিবীর রূপ রেখা । তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দেখিয়েছেন মুক্তির পথ । বলে দিয়েছেন মুক্তি কি ও কেমন করে পেতে হয় । মুক্তির দরোজা খুলবে মানুষ তাঁর চিন্তা চেতনা দিয়ে । মন ও মননশীলতা প্রসারে।
মুক্তির পথে সবচায়তে বেশি যেটা জরুরী তা হল মানুষের মানবিক হওয়া, সত্যকে ধারণ করা । মানবিক না হলে মুক্তির পথ রুদ্ধ । পৃথিবীতে এমন সময়ও গেছে যে সময়টাতে ছিল কেবলই আঁধার, আলো ছিলোনা মানুষের মনে, সমাজে, রাষ্ট্রে । মুক্ত ছিলনা মানুষ। সামন্তবাদ গ্রাস করেছিল মানবতা, মানুষের অধিকার । ফলশ্রুতিতে দেখা দিয়েছিল সংকট । তবে চোখ খুলে গিয়েছিল মানুষের; তাঁরা চোখের পর্দা সরিয়ে দেখতে পেয়েছিল আলোর পথ । মুক্তির মিছিলে যোগ দিতে তাঁরা পেছনে ফেলে এসেছিল অন্ধকার । তাই পৃথিবীতে অনেক মতবাদ আর টেকেনি । কোন মতবাদ যদি মানবতার জয়গান না করে, যদি আলোর পথ না দেখায়, যদি মুক্তির কথা না বলে তবে সে মতবাদ হারিয়ে যায় ।
মানুষ মুক্তির পথ খুঁজে পায়নি বহুকাল, অন্ধকার ছিল তাঁদের নিয়তি ! মুক্তির বন্ধ দরোজা খুলতে থাকে ধীরে ধীরে- কারণ, মানুষের পক্ষে একনাগাড়ে অন্ধকারে বসবাস সম্ভব নয় । তাই সে চেয়েছিল মুক্তি । কিসে আমাদের মুক্তি ? অবশ্যই আলোতে । আলোটা কোথায় ? অবশ্যই শিক্ষায় এবং সত্যে । আত্মার মুক্তিতে সত্যের উপলব্ধি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাটি এখানে প্রণিধানযোগ্য আলোচনার প্রয়োজনে । তিনি ‘’শিক্ষার মিলন’’ প্রবন্ধে সত্য সম্পর্কে যা বলছেন- ‘’ সত্যকে চাই অন্তরে উপলব্ধি করতে এবং সত্যকে চাই বাহিরে প্রকাশ করতে,কোনো সুবিধার জন্যে নয়,সম্মানের জন্যে নয়,মানুষের আত্মাকে তার প্রচ্ছন্নতা থেকে মুক্তি দেবার জন্য। মানুষের সেই প্রকাশতত্ত্বটি আমাদের শিক্ষার মধ্যে প্রচার করতে হবে,কর্মের মধ্যে প্রচলিত করতে হবে'’’ । অত্যন্ত খাঁটি ও অমূল্য কথা । একজন কবি হিসেবেতো বটেই একজন সমাজ চিন্তাবিদ হিসেবেও তিনি আমাদের পথ দেখাচ্ছেন মুক্তির ।
এ কথাও সত্যি যে সকল মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেও আলো ছড়াতে পারেনা অন্য মানুষের মনে, সমাজে রাষ্ট্রে । আবার স্বশিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত মানুষও ছড়িয়ে দিতে পারে আলো । বিষয়টি নির্ভর করে সচেতনতার উপরই বেশি তার পর আছে উপলব্ধি, অনুভব, অনুভূতির বিষয় গুলোও । অন্ধকার থেকে আলোয় আসবার পথে অর্থাৎ মুক্তির প্রধান উপায় শিক্ষা । আমাদের বুঝতে হবে জানতে হবে শিক্ষাই আলো আর সেই আলোতে মুক্তি । ঝেড়ে ফেলতে হবে মন থেকে সঙ্কীর্ণতা । মুক্তবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে জাগিয়ে তুলতে হবে তরুণ প্রজন্মকে । সচেতন হতে হবে নিজেকে; করে তুলতে হবে তাঁদেরকেও । এই দায়িত্ব অগ্রজদের ।
শিক্ষায়, কর্মে, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে দিতে হবে শিশু ও নারীকে অধিকার । যে বিশ্বাস আলো দেবে, মুক্তির পথ দেখাবে তাকে কর্মের সাথে মিশিয়ে নিলেই অনেকটা পথ পেরোনো যায় । সে থেকে উপকার হয় পরিবারের, সমাজের এমন কি রাষ্ট্রেরও । প্রথাগত সীমাবদ্ধতায় মানুষের মুক্তি নেই । প্রথা মুক্তি ও উন্নয়নে বাঁধা । সামাজিক বেশির ভাগ প্রথা-ই যা মেনে চলছি আমরা মেনেছি বহুকাল তা সামনে এগোতে দেয় না মানুষকে।
প্রথা ভেঙে ফেলার চায়তে অনেক বেশি কঠিন প্রথাকে অমান্য করা।এই কাজটি যত সহজ পশ্চিমে ঠিক ততোটাই কঠিন পুবে । বলছিনা যে প্রথা ভাঙায় কিংবা প্রথা অমান্যতায় মুক্তির পথ নিহিত । তবে আলোকিত হওয়ারও কিছু নেই প্রথাতে। মুক্তিতো আসলে মনে ও প্রাণে সত্য ও সুন্দরে। তাদের সঠিক চর্চা ও প্রয়োগে এনে দিতে পারে মানব মুক্তি । আমরা এখন যে সময়-কালে বাস করছি, কোন সন্দেহ নেই তা আধুনিক । শিক্ষায়, দীক্ষায়, প্রযুক্তির আধুনিকায়নে পৃথিবী বদলে যাচ্ছে, বদলে যাবে আরও । পরিবর্তনেই বিবর্তনের ধারা বদলে দেয় । সে ধারায় চলতে গিয়ে মানুষ বদলে ফেলে তাঁর চিন্তা চেতনার জগৎটি । বদলে ফেলতে বাধ্য হয় । একই ধারায় চলাও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় । আমরাও ধারা বদলের সাথে সাথে এগিয়ে যাচ্ছি; কিন্তু প্রশ্ন হলো কতোটা এগিয়েছি আমরা ? যখন দেখি এই সমাজে আজো শিশুরা বঞ্চিত, নারীরা অবহেলিত । আমাদের মুক্তির মিছিলে শিশু ও নারী মুক্তি অগ্রগণ্য । আমরা হয়তো ব্যক্তিগত ভাবে অথবা মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ মিলে নারী ও শিশুকে অধিকার দিতে সচেতন থাকি- এবং দিচ্ছিও; তাঁদের অধিকার রক্ষায়ও হয়তো সচেষ্ট কিন্তু সম্মিলিত সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্রচেষ্টা চোখে পড়েনা এ ক্ষেত্রে । আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো শক্ত নয়, উন্নত নয়, আধুনিক নয় । এখনো অধিকাংশ রীতিনীতি, বর্বর মধ্যযুগীয় ! ভাবা যায় ?
বিস্ময়কর ঠেকে যখন দেখি আজো কোন কোন সমাজে আলো নেই, মুক্তির পথ রুদ্ধ করে রেখেছে সমাজপতিরা তথাকথিত সামাজিক রীতিনীতির কথা বলে । কোন কোন রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে পালন করছে নীরব ভূমিকা ! তাহলে আমাদের মুক্তি কোথায় ? ঘুরে ফিরে মুক্তি সেই শিক্ষায়, মন ও মানসিকতায় । বিভেদে মুক্তি নেই, বিভেদহীনতায় মুক্তি । বন্ধনহীনতায় মুক্তি নেই, মুক্তি বন্ধনে । মুক্তি সচেতনতায়, অধিক মানবতাবোধে ।
এই বিশাল পৃথিবীতে এতোটুকু সূর্যের আলোয় আলোকিত সকল মানুষ বাহ্যিক ভাবে ! কিন্তু ভেতরের আলো কোথায় ? আমাদের দেহের ভেতর মন আছে কিন্তু অজস্র মনে আজো আলো নেই । মনে আলো জ্বালাতে একজন মানুষ অন্য আরেকজন মানুষকে সাহায্য করতে পারে নানান ভাবেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আলো নিবতে না দেয়া নিজেরই কাজ । আলো জ্বাললে মুক্তি, নিভে গেলে অন্ধকার । যদি জ্বালতে পারি আলো মন ও মননে সমাজ ও রাষ্ট্রে তাহলে মুক্তি মানবতার । আলোর সম্মিলিত প্রজ্বলনে পুড়ে যাবে সমাজের নষ্ট রীতিনীতি, প্রথা ব্যবস্থা; মুক্ত হবে আঁধার সমাজের । যার ফলশ্রুতিতে মুক্তি মানুষের ।
আজ যে মানুষে মানুষে বিরোধ- আজ যে সমাজে, সমাজে বিরোধ। রাষ্ট্রে, রাষ্ট্রে বিরোধ তা মোটেও কল্যাণকর নয় আমাদের জীবনে । শুরুতেই বলেছি উদারনীতির কথা; আর তার সঠিক চর্চায় সব কিছুইর অবসান ঘটবে । সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে মানবিক আচরণের উপর । আমাদের মনোভাবে, আমাদের চিন্তা ভাবনায় যদি ফেলতে পারি আলো সঠিক ভাবে; যদি মন থেকে দূর করতে পারি হিংসা বিদ্বেষ স্বার্থপরতা, তাহলে আমি নিশ্চিত আমাদের মুক্তির মিছিলে আজ যদি একজন মানুষও পাশে থাকে তাহলে একদিন সে মিছিলে যোগ দেবে লক্ষ মানুষ- লক্ষ থেকে কোটি মানুষ । একদিন হয়তো সমস্ত পৃথিবীর মানুষই । আলো কেন্দ্রিক নয়, সামগ্রিক । সামগ্রিক মুক্তিতে আলোর এই সামগ্রিকতা খুব দরকার আমাদের জীবনে । মুক্তির মিছিলেও তাই ।
ইফতেখারুল হক
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২৩, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২৩, ২০১৪
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন