সাঈদা মিমি





চতুর্থ পর্ব - 

আমার মুখে ছুঁড়লি মদ? 
তুই একটা চিমসা বদ… 
( দেলার বাপের মড়াকান্না )

সেদিন জুয়া হাঁড়িয়া আর মেয়েমানুষ তিন মিলে জম্পেস রাত জমে উঠলো, ‘শ্বশুর জামাই বন্ধু ভাই, একপাত্রে মজমা জমাই ।‘ এদিকে রাত ঢলছে, দেমাগ টলছে, এমন সময় ইয়ার খু ফু দানদানের কথা মনে পড়লো দেলার বাপের, আরে সর্বনাশ, আজ তো ওস্তাদেরে ভোগ দেয়া হয়নি! এসবের মধ্যেই পশ্চিম কোনার মাদুরে চোখ গেলো তার, খু ফু বসে আছে, চিন্তিত মুখ, আজ মাথায় পাগড়ি নেই, দাঁড়ি চুলে মাখামাখি উদভ্রান্ত চাহনি, কি হয়েছে ওস্তাদের? ভাবতে ভাবতে দেলার বাপ এগিয়ে যায় তার দিকে। অতিরিক্ত পান হেতু দেলার বাপের মগজ যথেষ্ট অস্থির এবং কিছু আগে আহ্লাদ করে আসা পুরুষ্টু নারীটির ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, এসবের মধ্যে খু ফু পীরের আলুথালু চেহারা! নুরাণী ভাবের ঠমক কই? তাহলে কি হুজুর আজ পান করেছে শরাবনে তহুরা! একই পথের পথিক হতে পেরে আনন্দের আবেশ তাকে বিবশ করে দিতে থাকে, এই অবস্থায় হাতের গেলাসটা নিয়েই খু ফুর পাশে বসে দেলার বাপ, -কি হইছে হুজুর? আমনেরে পেরেশান দেখতেয়াছি! -আমারে ফান্দে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে, বোতলে আটকাইবে? বোতল… বোতল…. দেলার বাপ বুঝলো আরেক গল্প, হুজুরে আইজ বোতল চায়! বাজারের ব্যাগে লুকিয়ে রাখা ব্ল্যাক লেবেলের বোতলটা নিয়ে এলো সে, ওস্তাদের ভাণ্ডার থেকে সরিয়েছে, আজ এটা দিয়েই ‘মহামহিম জ্বিনমানব, পীরে ইলাহি খু ফু দানদান কে সম্মানিত করবে সে । 

ঠিকমতই এগোচ্ছিলো, আঙুরের তরল ঢালা হয়েছিলো গেলাসে, মেশানো হয়েছিলো রঙহীন জল, সামনে ছিলো চানাচুরের বাটি, কেবল খু ফুর দিকে গেলাসটা বাড়িয়ে দিতেই উষ্ঠা খেলো সে, শরাব ছিটকে পড়লো দানদানের মুখে, ক্রোধে কেঁপে উঠলো খু ফু,আমার মুখে ছুড়লি মদ? তুই একটা চিমসা বদ, গোষ্ঠের কাননে ছিলি বুঝবি এবার, ক্ষয়রোগে খাবে তোরে উটকা আবাল ।‘ চমকে ওঠে দেলার বাপ, এ কোন অশুদ্ধ বচন হুজুরের মুখে! 

দেলার বাপ বাড়িমুখো, আজ জামাই বাবাজি সঙ্গে নেই । গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে চারটে ঘন্টা পড়তেই চমকে ওঠে দেলার বাপ, সর্বনাশ, এতো সুবহে সাদিকের আগ মূহুর্ত! ঠিক আধাঘন্টা স্থায়ী হবে সময়টা, একে বলে কালিরাত, এই সময় প্রেতদলের বৈঠক বসে! কি করবে সে এখন? প্রেতলোকের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে, এদের সামনে কোন মানুষ পড়া মানেই, ইহজনমের জন্য আত্মা বিক্রী করা নচেৎ মরণ । দেলার বাপের পরকাল সম্পর্কে বিশেষ ধারণা নেই, সে ধর্মকর্ম করলে হয়তো ওয়াজ মাহফিল মারফৎ কিছু জানতে পারতো, আজ অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তাহেতু লুঙ্গিও খোলা হয়নি, নয়তো পেশাবের চক্রব্যুহ তৈরি করতে পারতো, অতিরিক্ত পান ও ভোগ এবং খু ফুর কথাবার্তা তাকে আউলা করে দিয়েছে তাকে। অবশেষে লুঙ্গিই হলো কাল, সেটাতে প্যাঁচ লেগে খানবাড়ির নালায় পড়লো সে, তারপর আচানক উল্টে ভাঙ্গাচোরা স্পিডব্রেকারের ওপর । তাকে দেখতে পেলো ভোরের নামাজিরা, খবর গেলো দেলার মায়ের কাছে । ধরাধরি করে ঘরে আনা হলো দেলার বাপ কে, অজ্ঞান মুখ দিয়ে ফেনার গ্যাজলা ।

দেলার বাপের জ্বর একশ চার, নামছে না, হাকিম বদ্যি চলছে, এরধ্যেই একদিন পুলিশ এসে হাজির, জহের মিয়ার সন্ধানে । জহের গায়েব দুর্ঘটনার রাত থেকেই, কি করেছে সে? চাঁদাবাজি? সে তো সবাই জানে, যেটা জানতো না কেউ সেটাও জানলো, খুন করেছে জহের মিয়া, উকিল বাদশা খোনকারকে । পুলিশ দেলার বাপের বাসায় তাকে পেলো না বটে কিন্তু সে ধরা পড়লো নরসিংদীতে। সবকিছু ভেঙে পড়ছে, হাহাকার আর মাতম শুরু হয়েছে দেলাদের ঘরে, দেলার মা তিনটে বাসায় কাজ নিয়েছে আর দেলা রাতের সজ্জায় অলিগলির ধান্ধায়।

কা মুই হুজুরেরে অপমান করলাম? হের মুখে মদ ফেকলাম কোন দুক্কে? ওরে মোর তকদির, এহন মোর কি হইবে রে…. দেলার বাপের কান্নায় আসমান জমিন ফাটে না, মানুষের মনও গলে না, দুই কামরার বস্তিঘরের ভাড়া টানবে কে? আবার ফাঁটাফুটো একরুমের ঝুপড়িতে উঠে আসে তারা । দেলার বাপ কাজে যেতে পারে না, সে ভয়াবহ অসুস্থ, তার জ্বর কমছে না, পানাসক্ত দেহ মদের অভাবে মুচড়ে ওঠে, শুরু হয় খিচুনি, পেট ফুলে ঢোল, রক্তবমি, কঠিন আমাশা, কে টানবে একে? দরিদ্র পরিবারটা ভুলে যায়, তাদের সুদিন এসেছিলো, তারা জেনে যায়, দেলার বাপ খু ফু কে রুষ্ট করেছে । ক্রমশ দেলার বাপের রক্তবমি বাড়তে থাকে, সাথে ঘুসঘুসে কাশি, বস্তিবাসী শংকিত হয়ে পড়ে, এতো ক্ষয়রোগ! শেষতক সবাই একজোট হয়ে তাকে রেখে আসে সরকারী যক্ষা হাসপাতালে।


চুবানি খাইয়া ঢোল হইলো জমিলা, 
জটা চুল কেটেছিলো কার্তিক দুপুরে! 
(পাগলি জমিলার গল্প) 


জমিলা মোটেই পাগল ছিলো না, এমনকি হাজারটা চতুর বুদ্ধির যন্ত্রণায় তার ঘুমও ভালো হতো না, রাতভর সে প্ল্যান সাজাতো, সকালে উঠে মা কে কি কি কানপড়া দেয়া যায় যাতে, সে ছেলের বৌ দের দৌঁড়ের ওপর রাখতে পারেন । এইরকম নানাবিধ অত্যাচারে বৌ-কুল যখন জর্জরিত, তখন ওপরওয়ালা সদয় হলেন, জমিলার বিয়ে ঠিক হলো গোলাবাড়ি গ্রামের মাতবরের ছেলের সাথে, এমনকি পানচিনিও হয়ে গেলো, সরা-কাবিন পড়ানো হলো কসাইবাড়ি মসজিদে এবং তাৎক্ষণিক তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হলো না, আয়োজনের একটা ব্যাপার আছে । এভাবে আরো ছয় মাস জামাই বাবাজি নিয়মিত যাতায়াত করেন শ্বশুরালয়ে, মাছ-মুরগি, ঘি-ভাত খান, জমিলা পোয়াতি হলো ।

সমস্যার কথা, শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার আগেই পোয়াতি! আর দেরী করা যায় না, কন্যাকে আয়োজন করে শ্বশুরালয়ে পাঠাতে হবে, বাদ্যি বাজলো, পালকি সাজলো, খানাপিনার আয়োজন হলো, দান দহেজের লেনদেনও… এখানে লেন নেই, দেন আছে,  জমিলা শ্বশুরবাড়ি গেলো । কিন্তু পৌনে সাতমাইল পথ পাড়ি দিতে দিতে বেহারার দল বুলাদিয়া তালাবের (পুকুর) সামনেই থামলো কেন বিশ্রামের জন্য? থামবি থাম ঠিক আছে, জমিলার তখনই কেন তেতুল খাওয়ার সাধ জাগলো! নতুন বৌ পালকি থেকে নামে? সোয়ামির উৎসাহে সে নামলো, গেলো পুকুর পাড়ের তেতুলতলায়, গাছে উঠলো তার সোয়ামী আর সে তেতুল কুঁড়ালো, সেই গাছের চিপাডালেই ছিলো খু ফু দানদান,  কর্পূর আর জাফরান মেশানো হুক্কা খাচ্ছিলো, নজর পড়লো জমিলার দিকে ।

শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর তিনটে ঘটনা ঘটলো, সে জানলো, তার একজন সতিন আছে এবং সে বাঁজা, জমিলা ফিট পড়লো এবং তার মুখ দিয়ে আসুরিক গোঁ গোঁ শব্দ বেরুতে থাকলো, ঠিক একসপ্তাহ পর তার ঝরঝরে কোকড়া চুলের ফাঁকে একধরনের জট পাকানো চুলের গোছা দেখা যেতে শুরু করলো, এতো অশুভ লক্ষণ! শুভ লক্ষণও হতে পারে, কেননা, হঠাৎ চুলে জটা ধরতে শুরু করলে গ্রামের মানুষ ধরে নেয়, কোন মহাশক্তির আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে, অর্থবিত্ত সম্মান বাড়বে, তবে কু- নজরে পড়লেই বিপদ ।

জমিলার শ্বাশুরি আর তার সোয়ামির কথোপকথন চলছে: 
-বৌয়ের এই অবস্তা অইলে কেম্মে? 
-মুই কি জানি? হউর বাড়িতে থাকতে তো ভালোই দেখছি… 
-গণি কইল্হে তরা বুলাদিয়া তালাবের কাছে জিরাইছো? গাছে উইড্ডা তেতুল পাড়ছো? বৌ হেইয়া টোকাইছে আর কচকচ হইররা খাইছে? 
-হয় কতা সত্য, হেতে অসুবিদা হইল্হে কি? 
-তুই জানো না, ওই তালাব খারাপ? তাও ভরা দুপুর, আক্কল আছে মাতায়? 
-মুই বুঝি নাই, জমিলা তেতুল খাইতে চাইলে… 
-এইবার বুঝবিয়ানে, তর বাপে কইছে, অইহানে খু ফু দেউয়ের আস্তানা আছে, মোর তো বিশ্বাস, খু ফু অর দিকে নজর দেছে! 
-এহন উপায়?
 -জমিলার ধারে ঘেঁসবি না, পোলাডা জন্মাইতে, দে চুলের জট আরও বাড়ুক, অরে মুই ভরে বওয়ামু, দেহিস অর মুরিদ হইবে অনেক, মোগোও টেকা রোজগার হইবে, খালি অর কাছে যাবি না, খু ফু তরে মাইরা হালাইবে ।

ছেলেটা জন্মালো মৃত, স্বামীর অবহেলা এবং ক্রমবর্ধমান চাপে জমিলা তখন প্রায় উম্মাদ, তার চুলে সাপের ফণার মত জট, না ঘুমানো লাল চোখ, পরিমিতর চাইতে কম খাবারে দূর্বল শরীর, তার ভরে বসা হলো না কারণ সে মানুষ দেখলেই তেড়ে আসে, কামড় দেয়, থুতু ছিটায়, গালিগালাজ করে, তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় । খবর পেয়ে জমিলার বাপ এলো, দুই বেয়াইয়ে ঝগড়া শুরু, 
-মেয়া, পাগল মাইয়া গছাইছেন…
- মোর মাইয়ারে আমনেরা পাগল হরছেন… 
-ঢঙের কতা কইবেন না… 
-মোরা হুনছি, আমার মাইয়ারে আমনেরা ঠিকমত খাইতে দেন না, বাইন্দা রাহেন, পোলার আরেক বিয়ার কতা গোফন হরছেন, মোর মাইয়া সোয়ামিরে পায় না ।
-আমনে মেয়া ফাউল, জাইন্না শুইন্না পাগল মাইয়া পার হরছেন, চাইরডা বিয়া না হরলে ব্যাডারা মরদ অয় নাকি?
- হালায়, আমনে কয়ডা হাঙ্গা হরছেন? 
-অই মেয়া মুখ সামলাইয়া কতা কন… 
-আমনে জবান সামলান আর যৌতুকের টাকা ফেরত দ্যান.. 
-দিমু না, হরবি কি? 
-কি হরমু? দেখবিয়ানে…. একজাতিয় ইতর শ্রেণির মারামারি শুরু হয়, জমিলাকে নিয়ে তার বাবা বাড়িতে ফিরে আসে ।
জমিলার স্বামীর লাশ ভাসছিলো জমিলাদের পুকুরে, জমিলাও ছিলো ওখানে, অজ্ঞান, কাঁধ পর্যন্ত পানিতে, মাথাটা কাত হয়ে আছে ঘাটলার শেষ সিঁড়িতে । লোকজনের ভীড়, পুলিশ, জমিলার বাপের কোমড়ে দড়ি, 
-মুই মারিনাই হুজুর, বিশ্বাস হরেন, মুই তো জানিই না এই ব্যাডায় আইছে… 
-ওই হালায় মারছে হুজুর, মুই হুনছি, মোর পোলারে ও মোডর সাইকেলের লোভ দেহাইয়া ডাইক্কা আনছে.. 
-মিছা কতা হুজুর, এইয়া হরলে মোর গতরে য্যান ঠাডা পড়ে, মুই মাইয়ারে লইয়া আওয়ার পর অগো গ্যারামেই যাই নাই! মোর মাইয়াডারে খু ফু জ্বিনে ধরছে, এই মাইয়ারে মোরা বাইন্ধা রাখি, হে বাইরাইলে ক্যামনে! এর মধ্যেই জমিলার জ্ঞান ফিরে আসে, সবাই ঘটনা জানতে উদগ্রীব, 
-মুই জানি না কেমনে বাইরাইছি, জমিলা বলে, কে জানি মোরে ডাক দেলে, মুই আউগ্গাই আর ডাকটা মোরে পুহুইরঘাডে টানে, পুহুইরে আইয়া দেহি হ্যায় ভাসতেয়াছে, চিল্লান দেতে গেলে কেডা য্যান মোর গলা ঠাইস্যা ধইরা পানিতে পাক্কা মারে……… শুনেছি জমিলার বাপ জেলে, কেসটার সুরাহা হচ্ছে না ।

ক্রমশ। 


~ কবি পরিচিতি ~ 



সাঈদা মিমি সাঈদা মিমি Reviewed by Pd on সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.